রাত ৯ টা। গ্রামীণ রাস্তা, দু'ধারে বাঁশঝাড়। ঝকমকে আলোর ঝলকানি আর বিকট ভো ভো শব্দে একটি মোটরবাইকের সাড়া পেয়ে চিক চিক শব্দ করে দ্রুত রাস্তা পাড় হলো একটি ছুঁচো। রাস্তা পাড়ি দে'য়া ছুঁচোর নিত্য দিনের ব্যাপার। ইদানিং তাকে পড়তে হচ্ছে নানা ঝুট ঝামেলায়।
জানে বেঁচে গিয়ে ধাতস্ত হলো।তার অভিজ্ঞতায় নাই এমন যন্ত্রচালিত জন্তু।
আবহমান কাল থেকে চলে আসা জিনেটিক কোড, পুরাণ, স্মৃতি বা শ্রুতিতে পাওয়া যায় না এর কথা। আলো ঝলমলে স্বশব্দে গতিশীল-সামনে পড়লে তালগোল পাকিয়ে যাওয়ার দশা। বাপ-দাদাদের কাছে শুনেছি সাপ থেকে বা অন্যান্য ভয়ংকর প্রাণি থেকে সাবধান থাকার কথা, শুনেছি বর্ষাকালে কীভাবে সংগ্রাম করে সকল স্থলচর প্রাণিদের জন্য সংকুচিত হয়ে আশা জায়াগায় কৌশলে গা বাঁচিয়ে চলার কথা। কই এমন সমস্যার কথাতো শুনিনি! তাই ভাবছিলাম নিজের অভিজ্ঞতার কথা।
এই সে দিনকার কথা মানুষের বসতবাড়ীর আশেপাশে রাতের বেলা পড়ে থাকতো আমাদের খাবার। বেগ পেতে হতো না মোটেও। কুকুর বিড়ালের তাড়া খেয়েছি তা আর এমন কী! আমাদের উপস্থিতিই নাকি সইতে পারে না মনুষ্যজাতি। কী বোলে দুর্গন্ধ আমাদের গায়ে। ভাগ্যিস সুগন্ধ না। শুনেছি এরা নাকি বাসনার জন্য আফ্রিকার গহীন জঙ্গলের বিড়াল জাতীয় কোন প্রাণির ঘাড়ের লোমের নিঃস্বরণ বা হাজার হাজার পুরুষ হরিণের ভিতর হঠাৎ হওয়া মৃগনাভী কস্তুরীর জন্য অস্ত্র হাতে হন্যে হয়ে ছুটে। সে সব থাক্গে। আমাদের নিয়ে নানা কথাবার্তাও চালু তাদের মুখে মুখে।যেমন 'ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ' বিষয়টা এমন যে নিজে মারতে আসাও যুতসই মনে করে না। বিধায় কুকুর বা বিড়ালের এই মহান দ্বায়িত্ব হয়তো ছিল বা আছে।
আমি যেখানে থাকি তা গ্রামের মোটামুটি একটি সচ্ছল পরিবারের বাড়ী। তাদের সবাইকে আমি চিনি।বাড়ীর আশপাশ আনাচে-কানাচের কখন কোনদিকে পলায়ন সম্ভব তা আমার নখদর্পনে।পাশেই ছিলো ছোট খাট নালা ডোবা। হরেক রকমের মাছ থাকতো।মাছের কাটাই মূলত জুটত আমার কপালে। পানকৌড়ে , মাছরাঙ্গা, বক, ডাহুক সারাদিন এসে জুটত এই ডোবায়।থাকতো গুইসাপ,ইঁদুর ধোরা সাপ সহ নানা প্রাণি। গেল কয়েকদিন আগে ডোবাটি হয়ে উঠলো একটি পুকুর। ছাড়া হয়েছে কার্প মাছ। বাড়ীর সকল ঝুটা ও অতিরিক্ত খাবার গিয়ে পড়ছে পুকুরে। ক্বচিৎ দু'একটা টাকি বা মাগুর মাছ দেখলে বাড়ীর লোকজন সে কী ক্ষ্যাপা! নাম দিয়েছে রাক্ষুসে মাছ।পুকুরের ধারে বসতে দেয়না কোন মাছ খেকো প্রাণিকে এমন কী পুচকে মাছরাঙ্গাটিকেও।ইঁদুর মারার জন্য বিড়াল পালেই ক্ষান্ত হয়নি তারা এখন ইঁদুরের খাবারে মিশানো হচ্ছে বিশ।বক বেচারাকে দেখলাম মনের দুঃখে বসে আছে বাঁশঝাড়ে। কস্মিনকালেও সে ভাবে নি যে ডোবায় মাছ ধরা যাবে না।নতুন এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে উঠেছে এই বকের পক্ষে।বক একটু দুর্বল প্রাণি। ঝড় এলেই দু'একটা মরে আর বড় ঝড় হলে তো অনেক বক মরে। কথাই আছে 'ঝড়ে বক ম'ল ফকিরের কেরামতি বাড়ল'। এ সব দুর্যোগ মোকাবেলা করে বেঁচে থাকার পরও যদি সে বাঁধাপ্রাপ্ত হয় তার বাস্তুভিটা্য় তবে তো বেচারার অবস্থা খারাপ।
এখন দেখছি শুধু আমিই না মানুষের মহাবিস্ফোরনের ধাক্কায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রাণি বৈচিত্র।অনেকে বিলুপ্ত অনেকে বিলুপ্ত প্রায় আর আমাদের প্রাণতো ওষ্ঠাগত।কবে কোন প্রাণিকূল মহাসমাবেশে নির্ধারণ করা হয়েছে মানুষ আশরাফুল মোখলোকাত তা আমি জানি না।তবে আমরা মানি আর না মানি শৌর্যে বীর্যে ওরা তো সকল প্রাণিকে ছাপিয়ে উঠেছে।মা ধরণীকে ভাল না বেশে করায়ত্ত করার চেষ্টা করে নিজেকে মা হতে বিচ্ছিন্ন অতিপ্রাকৃতিক সত্তা ভাবার দর্শনে বুঁদ এরা।এত বড় দুনিয়া এত ক্ষমতা মানুষের তবুও নিজেদের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে এমন সব কীর্তি করে মনে হয় যেন এরা মানব নয় দানব।
Bio-diversity, Ecology, Habitat ইত্যাকার নানা শব্দ মানুষের ভাষার জগতে খুব চালু। ১৯৯০ সালে বসেছিল রিও ধরিত্রী সন্মেলন। Bio-diversity রক্ষার্থে পাস করেছে নানা আইন কানুন। কিন্তু মুনাফা ধর্মের পুঁজিবাদী সমাজে কোনকিছুই কার্যকর হচ্ছেনা।সবুজ বিপ্লবের নামে এরা ধ্বংস করেছে প্রাণিবৈচিত্র। এরকম একরৈখিক উন্নতি অতি অল্প জ্ঞানেই ধরে নে'য়া এটা ভাল এটা খারাপ বা ব্যবসার খাতিরে ঢালাওভাবে Monoculture মোটেও সুখকর নয়।
কিছু মানুষ আছে যারা এসব নিয়ে সোচ্চার দার্শনিকভাবে ও তৎপরতায়।'সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্ত' এমন বাণী দ্বারা জগৎ জোড়া আলোড়ন তুলেছেন বুদ্ধ।চলুন জন্মদাতা মা'র আশ্রয়ে থেকে মা'র ভালবাসায় জীবজন্ম সুখময় করে তুলি।
পুরাণ খাতার পাতা থেকে: ২৬ জুলাই ২০০৬।
মোমেন
মন্তব্য
সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্ত'
আমরাও নিশ্চয়ই তা চাই।
হুম
জগতের সকল প্রানী সুখী হোক।
মঙ্গল লাভ করুক।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
জীবে দয়া করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।
আপনাকে ধন্যবাদ.. এমন চিন্তাশীল একটি লেখা উপহার দেয়ার জন্য
________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ
আপনাকেও ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন