ডানা ঝাপ্টানোর শব্দটা কানে আসতেই অন্যমনস্ক হয়ে যান মহসিন সাহেব। হাল্কা সবুজ ডানা, ছাই রঙের মাথা আর কালচে লেজ। শেষ কবে সবুজ ঘুঘু দেখেছেন মনে করতে পারলেন না মহসিন সাহেব।
একটা বুড়ো চাপালিশ গাছের মাঝারি ডালে স্থির হয়ে আছে পাখিটা। কেয়ারটেকার মন্টু মিয়ার বিরতিহীন বকবকও ধ্যান ভাঙাতে পারছে না সুন্দর পাখিটার। প্রথম কিছুকক্ষণ শোনার ব্যর্থ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন অবশেষে। স্মৃতিরা বড় বিশ্বাসঘাতকতা করে আজকাল। দশ বছর পেরিয়ে গেছে অথচ মনে হয় মাত্র সেইদিন এসেছেন এখানে।অপু তখন ক্লাশ সিক্সে পড়ত। বাবার সাথে জঙ্গলে আশার জন্য আগের রাত থেকেই কত জল্পনা কল্পনা। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই জামা কাপড় পরে তৈরি, হাতে এয়ারগান।
ওয়ালথার ফেলকনের ২৫ ক্যালিবারের এয়ারগান ছিল সেটা।এখনো পরে আছে স্টোর রুমের পুরনো ওয়ার্ডরোবটার ড্রয়ারে। বহুদিন যত্ন নেয়া হয় না।বনবিভাগের কর্মকর্তা হিসাবে একটা সম্মেলনে গিয়েছিলেন জার্মানিতে। সেখান থেকেই আনা।
তখন সবকিছুই বোধহয় অন্যরকম ছিল। নাকি তিনি নিজেই বদলে গিয়েছেন সময়ের সাথে।অপুর হাত ধরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক
শুনতে শুনতে বনের মধ্যে হাঁটা কি রোমাঞ্চকরই না ছিল।হঠাৎ হঠাৎ উল্লুকের ডাক শুনে অপু ভয় পেয়ে যেত। তিনি অপুকে জড়িয়ে ধরে অভয় দিতেন।
'স্যার এইবার আর শিকার করবেন না?' উৎসাহী চোখে তাকায় মন্টু মিয়া। জবাব না পেয়ে আবার নিজেই যোগ করে,
'আর করবেনই বা কিভাবে। চেয়ারম্যানএর লোকগুলা সেগুন কাঠ যেইভাবে উজাড় করছে, বনের আর কিছু বাকি নাই। বন নাই তো পাখি নাই', আর পাখি নাই তো শিকার নাই।'
'পাখি শিকার তো এখন নিষেধ মন্টু মিয়া।'
'এইগুলা মুখে মুখে স্যার। এইতো সেইদিনও এক বড় সাহেব আসলেন ঢাকা থেইকা। একটা তোতা আর সবুজ সুইচোরা শিকার কইরা নিয়া গেলেন। তবে যাই কন, কত সাহেব গেলো আসলো, আপনার নিহান নিশানা আর কারো দিখলাম না স্যার।'
মন্টু মিয়ার চোখে মুখে আলোর ঝিলিক। শিকার বিষয়ক কোন আলোচনাতে তার থেকে উৎসাহী লোক এই তল্লাটে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
'গত দুই-তিন বছরের মইধ্যে এই প্রথম স্যার কালোমাথা বুলবুল দেখছি, ধুমকলও আছে কিছু। চাইলে বলেন স্যার ব্যবস্থা করি। পুবদিকে মাইল দুয়েক গেলে একটা ছড়া আছে, পানি নাই বেশি। ওই জায়গার আশেপাশে দেখছিলাম একদিন।'
'আমি আর শিকার করি না মন্টু মিয়া।'
কথাটা বলার মধ্যে এক ধরনের বিষন্নতা ছিল। মন্টু মিয়া কিছুটা থমকে গেল।
শেষ বিকেলের আলো সেগুন আর গর্জনের পাতার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি মারছে ভিতরটায়। আলো আঁধারির অপূর্ব খেলা চারপাশে। এরকম এক বিকেলেই পাখিটাকে দেখেছিলেন তিনি। সন্ধ্যা হবে হবে তখন। সবুজ হলদে আর জলপাই হলুদে মেশানো শরীর।
ডানায় ঘাড়ের কাছে হালকা গোলাপি ছোপ।লাল পা। এখনো কেমন জানি কানে ভাসছে হরিয়ালটার ডানা ঝাপটানোর শব্দ। অপু আসেনি সেবার। মায়ের সাথে থেকে গিয়েছিল ঢাকাতেই।
শিকার ভালবাসতেন তখন মহসিন সাহেব।ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর মশার শব্দকে উপেক্ষা করে পা টিপে টিপে অপেক্ষা করতেন গাছের আড়ালে ঘন্টার পর ঘন্টা। সেদিন মন্টু মিয়া ছিল না সাথে। তিনি একাই ওয়ালথারটাকে সাথে নিয়ে বেরিয়েছিলেন শেষ বিকেলের আলোয়।
হেমন্তের আকাশে কি মেঘ ছিল? মনে করতে পারলেন না।
'স্যার আজগা কি আরো ভিতরে যাইবেন? নাকি ফেরত যামু বাংলোতে।' জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় মন্টু মিয়া।
'তুমি চলে যাও মন্টু মিয়া। আমি কিছুক্ষণ একা থাকব এখানে।'
একটু ইতঃস্তত করে রাজি হয়ে যায় সে।'স্যার বেশি দেরী কইরেন না কিন্তু। জানোয়ার ছাড়াও আরো ভয়ের কারণ হইছে আজকাল চোরের দল। একলা পাইলে কিন্তুক খবর হইব।'
ছোট ছোট পায়ে উলটো দিকের পথ ধরে মন্টু মিয়া।
তার পায়ের শব্দটা মিলিয়ে যেতেই নিঃস্তব্ধতাটা বড় বেশি কানে বাজে মহসিন সাহেবের।বিকেল থেকে সন্ধ্যা হবার মাঝের সময়টুকু নিমিষেই যেন মিলিয়ে যায়।
ছোটবেলায় অন্ধকারে জঙ্গলে বেরুলেই তার হাত শক্ত করে ধরে রাখত অপু। হঠাৎ হঠাৎ বুনো শিয়ালের ছায়া দেখে চমকে উঠলে তিনি অভয় দিতেন। সেই ছোট অপু কিভাবে যেন বড় হয়ে গেল হুট করে।
ঢাকা ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টের দিন ছুটে এসে যখন জড়িয়ে ধরল তাকে, তিনি উপলব্ধি করলেন ছিমছিমে লম্বা তরুনটাকে কেমন অচেনা লাগছে তার। তার ছোট্ট অপু তখন আর ছোট নেই, এই বিশাল পৃথিবীর বুকে নিজের স্বপ্ন বোনার সংগ্রামে পা বাড়িয়েছে অনেক আগেই।
উল্লুকের ডাকে অন্যমনস্কতা কেটে গেল মহসিন সাহেবের। অর্কিডের ঝোঁপটাকে খুব পরিচিত মনে হল। ওখানেই কি বসে ছিল পাখিটা? গোলাপি ছোপওয়ালা পাখা ঝাপটে ঝাপটে উঁকি দিচ্ছিল গর্জন পাতার ফাঁকে লুকোচুরি খেলতে থাকা একাদশীর চাঁদে।মৃদু জোছনায় গর্জন আর ম্যানজিয়াম গাছের কালচে সবুজ পাতা, বুনো শেয়ালের ডাক, ডালের ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ বানরের কিচমিচানি- সব কেমন জানি ফ্রেমের ছবির মতন চোখের সামনে ভেসে আসে মহসিন সাহেবের।সেদিনও তিনি একাই ছিলেন। সেগুন গাছের মোটা গুড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ করছিলেন ডানা ঝাপটানো পাখিটাকে।হাতের এয়ারগানটাকে শক্ত করে ধরে বড় বড় নিঃশ্বাসে দেখছিলেন।হঠাৎ করেই শিকারের ইচ্ছেটা জেগে উঠেছিল।অভ্যস্ত হাতে লোড করেছিলেন ওয়ালথার। যান্ত্রিক শব্দও যেন ধ্যান ভাঙায়নি পাখিটার। লক্ষ স্থির করে নিশানা টিপেছিলেন নিষ্কম্প হাতে।দৃষ্টিবিভ্রম হল মহসিন সাহেবের।
ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত পাখিটা যেন এখনো পড়ে আছে অযত্নে বেড়ে ওঠা ঘাসের আড়ালে। কাঁচা রক্তের তীব্র গন্ধে ভারী হয়ে আছে বাতাস। হঠাৎ তীক্ষ শীষের শব্দ। আরেকটা হরিয়াল ছুটে এসেছে অর্কিড ঝোঁপের অন্য পাশ থেকে। উপলব্ধি করলেন, একটা বাচ্চা হরিয়ালকে মেরেছেন।
মা হরিয়ালটা কিছুক্ষণ রক্তাক্ত দেহটার পাশে পাক খেয়ে ছুটে এল তার দিকে। ছোট মায়াবী চোখে তীব্র ঘৃনার ছায়া। পাখিটা বুঝি তাকে ঠোকর মেরে যাবে। শরীরের সমস্ত মাংসপেশীতে অসার অনুভব করলেন। কিন্তু
পাখিটা হঠাৎ করেই যেন থমকে গেল, হয়ত নিজের অসহায়ত্ব টের পেল। ডানা ঝাপটানো আর্তচিৎকার করে উড়ে গেল জোছনার আলোতে। মহসিন সাহেবের মনে হল এটা বুঝি জোছনাময় রাত না - ঢাকার মধ্যদুপুরের মগবাজার।
জোহরের নামায পড়ে ঘরে ফিরছেন। দরজার মুখে রাহেলা বেগম (তাঁর স্ত্রী) বিহবল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোন শব্দ নেই মুখে। বুকের ভিতর অজানা ভয়ে এক ধরণের শিরশিরে অনুভূতি।
'কি হয়েছে রাহেলা?' কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেছিলেন মহসিন সাহেব।
'অপু!" শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন রাহেলা। বাকি ঘটনাগুলো দুঃস্বপ্নের মতন- কেমন আবছা আবছা লাগে মহসিন সাহেবের কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ছাত্র সংগঠনের গোলাগুলিতে ক্রসফায়ারে পরে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনা কতটাই বা নাড়া দেয় ব্যস্ত শহরের খেটে খাওয়া মানবজীবনে। কোন সাক্ষী ছিল না পু্রো ঘটনাতে। বিচার পাননি মহসিন সাহেব। শুধুই ঘুরেছেন এক উকিলের কাছ থেকে আরেক উকিলে। একসময় থেমে গেছেন।
যেভাবে বেশিরভাগ মানুষই এক সময় পরাজয় মেনে নেয়।কিংবা শুধু মানুষই না, সেই মা হরিয়ালটাও হয়ত ঠিক একইভাবেই পরাজিত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তার দিকে। এক ঝলক ঘৃণার আগুন ঝরিয়ে উড়ে গিয়েছিল সন্ধ্যার আকাশে।
ডানা ঝাপটানোর সেই বিভৎস শব্দটা পরিষ্কার যেন শুনতে পেলেন মহসিন সাহেব। পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন মাংসপিন্ডটা যেন অসহায় পাখিটার নয়, তার অপুর। তার অতি আদরের অপুর। ঘাসের মাঝে পরে থাকা নিঃসঙ্গ পালকগুলোকে জোছনার আলোতে অপার্থিব মনে হয়।
তিনি মগ্ন হয়ে দেখেন।
মন্তব্য
গল্পটা অসম্ভব ভালো লাগলো!! আপনার লেখা পড়ে মনে হলো আপনি লেখেন, মানে এটাই আপনার লেখা প্রথম গল্প না (ভুল হতেও পারি)। সচলে কি লিখেছেন আগে? নাম দেয়া নেই, তাই নিশ্চিত হতে পারলাম না।
মানুষের অসহায়তার কথাটা যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সেটা পড়ে যেমন ভালো লাগলো, সবুজ রঙের ঘুঘু'র কথা পড়েও একইরকম ভালো লাগলো। পাঠকের মন আসলেই বিচিত্র! কোন লেখার কোন অংশ যে কেন, কীভাবে নাড়া দেবে তার যদি কোন ব্যাখ্যা থাকতো!
দারুণ লিখেছেন, খুব ভালো লেগেছে।
++++++++++++++
ভাষা হোক উন্মুক্ত
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
অসাধারণ! অপূর্ব !!!
এমন আরো গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
গল্পের শেষে নাম লিখতে ভুলে গিয়েছি। লেখালেখি আগে থেকেই করি, যদিও সচলে এটা প্রথম লেখা। অনেক ধন্যবাদ ভাল লেগেছে বলে।
সাবাশ নাসাদ। চমৎকার হয়েছে লেখাটা। সচলে স্বাগতম
প্রকাশের আড়ালে তীরতীরে অনুভবের সামনে দাঁড়িয়ে হতবিহ্বল , কিছু বলার পাচ্ছি না ।
সাবলীল এই লেখাটি পড়ে ভালো লাগল।
Looking forward to read more...
খুবভালো লাগলো ভাই। আ্পনার নিকটা জানতে ইচ্ছে করছে।
আরেকটা কথা। প্যারা করে দিলে মনে হয় পড়তে একটু আরাম হতো, এই আরকি।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
চমৎকার!!!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
চমৎকার গল্প
খুব...খুব ভালো লাগলো।
ভালো গল্প। ...
ঠিক এইরকম একটা গল্প পড়েছিলাম, গল্পটার নাম যদ্দুর মনে পড়ে 'অপার্থিব'- কে লিখেছিলেন মনে নেই। সেই গল্পে এক গৃহস্ত পাখির বাচ্চা মারা যাবার পর তার উঠোনে শোরগোল করতে থাকা পাখিদের তাড়িয়ে দেন। পরে নিজের ছেলে মারা যাবার দিনে হঠাৎ ঐ ঘটনার সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পান নিজের...
_________________________________________
সেরিওজা
অসাধারণ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
বাহ... চমৎকার
_____________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ
অনেক ধন্যবাদ সবাইকে
নাড়া দিয়ে গেলো লেখাটা!আরো লিখবেন।
অসাধারন লাগল! তুমি এত ভাল লেখ জানতাম নাতো!
দূর-দ্বীপবাসিনী
নতুন মন্তব্য করুন