কিছুদিন হলো প্রতি সোমবার সন্ধ্যায় সুইডিশ ভাষা-শিক্ষা ক্লাস করছি। বাচ্চাদের মত হোম-ওয়ার্ক করতে দেয়। যেমন: সারাদিন কি করলাম তা লিখে আনা, নিজের পরিবার সম্পর্কে লিখে আনা, সামারের ছুটিতে কে কী করবে তার পরিকল্পনা লিখে টিচার কে জমা দেয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি।
কাকতালীয় ভাবে আজ সবাই কে যার যার দেশ প্রেজেন্ট করতে হবে এবং প্রেজেন্টেশনের পর প্রশ্ন উত্তর পর্ব। অবশ্যই সব কিছু সুইডিশ ভাষায়। তবে একেবারে অপারগ হলে একটু একটু ইংলিশ বলা যাবে, কারণ আমরা মাত্র লেভেল ১ এ পড়ি।
স্বাভাবিক ভাবেই আমি প্রেজেন্টেশনে আমাদের ১লা বৈশাখ এর ব্যাপারটা ঢুকিয়ে দিয়েছি এবং প্রেজেন্টেশন শেষ করার ঠিক আগ মুহূর্তে হাত ঘড়িটার দিকে নাটকীয় ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সবাই কে শুভ নববর্ষ জানিয়ে শেষ করেছি। কারণ তখন সুইডেনে সন্ধ্যা ৮টা বাজলেও বাংলাদেশে রাত ১২ টা!
আগেই আন্দাজ করেছিলাম, আমাদের নিজেদের একটা আলাদা ক্যালেন্ডার আছে জানার পর ক্লাসের সবাই ব্যাপারটাতে অবাক হবে এবং আমাকে হাজার রকমের প্রশ্ন করবে। তাই আগেরদিনই ভালোমত প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। আমার ল্যাব এবং ক্লাসে ফেইস করা গত দুই দিনের বাছাই করা প্রশ্ন-উত্তর গুলো নিচে দেয়া হলো।
ওসা (ক্লাস টিচার): আজ তোমাদের নিউ ইয়ার!?
আমিঃ হু। আজই আমাদের নিউ ইয়ার। আজ থেকে ১৪১৭ সাল শুরু হলো।
এক সাথে প্রায় ক্লাসের সবাই: ১৪১৭! ১৪১৭ কেন? এটা কি আরবি ক্যালেন্ডার?
সাদিয়া(ইরান থেকে আসা): আরবি ক্যাল্যন্ডার অনুযায়ী হলে তো ১৪৩১ হতো। (ভাগ্যিস উত্তরটা দিয়ে দিয়েছে! কারণ আরবি কত সাল চলে সেটা আমার জানা ছিল না।)
ইউক্রেন এর একটা মেয়ে নাম ভুলে গেছি, জিজ্ঞেস করলো: কিন্তু তোমাদের এই সালটা ১৪১৭ হলো কিভাবে?
আমি: আগের সালটা ১৪১৬ ছিল তাই এই সালটা ১৪১৭ হয়েছে!
ক্লাসের সবার হাসির রোল পড়লো।
প্রশ্ন: মানে তোমাদের সালটা কে চালু করলো?
উত্তর: সম্রাট আকবর নামের এক লোক। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সে শূন্য থেকে এই সালটা শুরু করেনি। ব্যাপারটা আন-অফিসিয়ালি শশাঙ্ক নামের এক রাজার আমল থেকেই চলছিল, সম্রাট আকবর জাস্ট ক্যালেন্ডারটা কে অফিসিয়াল করছে।এ জন্য অবশ্য তাকে বেশ খাটাখাটি করতে হয়েছে।
মেলিন্ডা: তোমরা কি তাহলে অফিসিয়ালি বাংলা ক্যালেন্ডার ফলো করো?
আমি: না। আমরা অফিসিয়ালি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ফলো করি।
আন্: তাহলে তোমরা এই ক্যালেন্ডার দিয়ে কি করো?
আমি: আমরা এই ক্যালেন্ডার দিয়ে মূলত নববর্ষ পালন করি! (আবার হাসির শব্দ!)। অবশ্য গ্রাম গুলোতে এখনো লোকজন কৃষিকাজের জন্য এই ক্যালেন্ডারই অনুসরণ করে।
ম্যল্কম: তাহলে তো মনে হয় নতুন প্রজন্ম বৈশাখী উৎসবে তেমন একটা অংশগ্রহণ করে না? এটা তোমাদের একটা প্রাচীন অনুষ্ঠান, ঠিক বলেছি না?
আমি: কি বলো আন্দাজে! এটা আমাদের দেশে সব চেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসব। এই দিন তরুণ-তরুণীরাই সবচেয়ে বেশি আনন্দ করে।
পরের দিন ল্যাবে:
করিডরের সবাই কে বাংলায় শুভ নববর্ষ বললাম এবং ওদের কে শিখিয়ে দিলাম কি করে শুভ নববর্ষ উচ্চারণ করতে হয়। তারপর আবার একেক জনের একেক রকম প্রশ্ন শুরু হলো। (নিচে কিছু বাছাই কৃত প্রশ্ন)
ক্রিস্টিনা: (চোখে মুখে খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো) ইন্টারনেট এ কি দেখা যাবে বাংলাদেশে এখন কি হচ্ছে?
আমি: বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পেপার গুলো খুঁজেও তেমন ভাল কোন ছবি পেলাম না! লাইভ ভিডিও পাওয়া যাবে না বলে ইউটিউবে এ কার যেন আপলোড করা গত বছরে একটা ভিডিও দেখালাম। ভিডিওর ব্যাক গ্রাউন্ডে রবীন্দ্র সংগীত বাজছিল। সুযোগ মত জানিয়ে দিলাম, যে গানটি শুনছো সেটা যে লিখেছে তাকে তোমরা সম্মান জানানোর জন্যে অনেকদিন আগে নোবেল প্রাইজ দিয়েছো।
আমার পেছন থেকে কম্পিউটারের দিকে ঝুঁকেপড়া আমাদের পুরো রিসার্চ গ্রুপ। এদের মাঝ থেকে ক্যারোলিনা অবাক হয়ে বলে উঠলো- 'বলো কী! আমাদের Ace of base, Abba এমন কি সারা দুনিয়া কাঁপানো মাইকেল জ্যাকসনও তো নোবেল প্রাইজ পেলো না! আর উনি এই গান লিখে নোবেল প্রাইজ পেয়ে গেছে!'
আমি বুঝিয়ে বললাম যে আসলে গানের জন্যে নোবেল প্রাইজ পায়নি। একটা কবিতার বই এর জন্যে পেয়েছিলেন। কিন্তু আসলে সেই কবিতা গুলো ছিল এক একটা গানের লিরিক! উনার গান বাংলাদেশের মানুষ ১৫০ বছর ধরে শুনছে।এবং এখনো জনপ্রিয়তা একফোঁটাও কমেনি। একেবারে সাসটেইন রিলিজ ড্রাগ এর মত স্টেডি-স্টেট লেবেলে আছে।
সুইডেনে আমার পরিচিত মানুষজন আর যেসব জিনিস যেনে খুব অবাক হয়েছে সেগুলো হল:
আমাদের প্রতিটা মাসের নাম নক্ষত্রের নামে, বার গুলি গ্রহের নামে। অবশ্য সূর্য আর চাঁদ এর দেবতার নামেও দুইটা দিন আছে।(আমার ধারনা ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটো বাদ পরছে কারণ এগুলার কোন বাংলা নাম নেই অথবা এগুলো দিনের নাম নামকরণের সময় আবিষ্কারই হয়নি!!) ইন্ডিয়ার কলকাতায়ও পহেলা বৈশাখী উৎসব হয় কিন্তু সেটা আমাদের চেয়ে একদিন পরে, কারণ ওদের লিপ ইয়ার নেই! আমাদের ক্যালেন্ডারে লিপ ইয়ার যোগ করা আছে। আমার বলার আগ্রহ দেখেই বোধহয় ওরা মজা পাচ্ছিল আর সারাদিন পুরো করিডোরে কারো সাথে দেখা হলেই প্রতিবার `শুভ নববর্ষ´ বলে শুভেচ্ছা জানাবার চেষ্টা করে যে কত রকম অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করছিল তা আর এখানে উল্লেখ না করি।
মন্তব্য
আবার লিখে ফেললাম! বুনোহাঁসের আক্রমনের কথা ভেবেই গলা শুকিয়ে আসছে!
ভালো লাগলো আপনার লেখা, বেশ সাবলীল।
-----------------------------------------------------------------
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা ...
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা ...
ধন্যবাদ।
মাস নক্ষত্রের নামে এটা জানতাম না
১১টা মাসই নক্ষত্রের নামে। পৌরাণিক মতে, চাঁদের সাতাশ জন স্ত্রীই নক্ষত্র (দক্ষ প্রজাপতির কন্যা) এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রমতে তাঁরা মানুষের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক।
এবার কোন মাসের নাম কোন নক্ষত্রের নামে:
১) বৈশাখ=বিশাখা
২) জ্যৈষ্ঠ=জ্যৈষ্ঠা
৩) আষাঢ়=পূর্বাষাঢ়া/উত্তরাষাঢ়া
৪) শ্রাবণ=শ্রাবণী
৫) ভাদ্র=ভদ্রা
৬) আশ্বিন=আশ্বিনী
৭) কার্তিক=কৃত্তিকা
৮) অগ্রহায়ণ বাদ, কারণ এর মানে হচ্ছে 'শস্য সংগ্রহের মাস'। 'অগ্র' অর্থ তো জানেনই, আর 'হায়ন' মানে 'শস্য'। এটাই ছিলো আদি মাস। এর নাম ছিলো 'মার্গশীর্ষ'। এসেছে 'মৃগশিরা' নক্ষত্রের নাম থেকে।
৯) পৌষ=পুষ্যা।
১০) মাঘ=মাঘী (উচ্চারণে বেখেয়ালি না হওয়ার আহ্বান)
১১) ফাল্গুন=ফাল্গুনী
১২) চৈত্র=চিত্রা।
শুভেচ্ছা।
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
কষ্টকরে সবগুলো মাসের নামের উৎস লেখাটার সাথে মন্তব্য আকারে জুড়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
আমিও জানতাম না এক সময়। হুমায়ূন আহমেদ এর একটা বই পড়ে জেনেছিলাম বৈশাখ মাসটা নক্ষত্রের নামে। পরে হঠাৎ বাংলা একাডেমি থেকে বৈশাখী উৎসবের উপর প্রকাশিত একটা বই এ দেখি প্রায় সবগুলো মাসের নামই নক্ষত্রের নামে!
আমিও জানতাম না এক সময়। হুমায়ূন আহমেদ এর একটা বই পড়ে জেনেছিলাম বৈশাখ মাসটা নক্ষত্রের নামে। পরে হঠাৎ বাংলা একাডেমি থেকে বৈশাখী উৎসবের উপর প্রকাশিত একটা বই এ দেখি প্রায় সবগুলো মাসের নামই নক্ষত্রের নামে!
ভালো লাগলো৷
_______________
নীল তারা৷৷
আমারও ভালো লাগলো।
বেশ ভালো লাগলো
----------------------------
-হামিদা আখতার
ভালো লেগেছে যেনে আমারও বেশ ভালো লাগলো।
ভালো লেগেছে! সবারই এভাবেই দেশকে বিদেশে উপস্থাপন করা উচিৎ। ধন্যবাদ।
জহিরুল ইসলাম নাদিম
আপনাকেও ধন্যবাদ।
দেশের চমকপ্রদ উপস্থাপনা দেখে ভাল লাগলো ।
ধন্যবাদ আপনাকে ।
ওলি
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
লেখার ধরন খুব ভালো লাগলো,আরো নিয়মিত লিখলে আরো ভালো লাগবে।
[বিষন্ন বাউন্ডুলে]
নতুন মন্তব্য করুন