কৈশোর

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২২/০৬/২০১০ - ৮:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জহিরুল ইসলাম নাদিম

গোলাপের পাঁপড়ির মত চোখের পাতা দুটিকে বিযুক্ত করে যেই তুমি চোখ মেলেছ, ঘুম ভেঙ্গেছে তোমার-সেই থেকে তুমি ভীষণ অবাক হয়ে আছো! তোমার সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে এক অজানা আশংকায়, এক অদ্ভুত খুশীর শিহরণে। সূর্যও প্রতিদিনকার মতো তার স্বর্ণাভ অলৌকিক হাত বুলিয়ে তোমাকে জাগাতে গিয়ে আজ কেমন যেন থমকে গিয়েছিল। তখন তুমি ঘুমিয়ে ছিলে। ক্লান্তি আর তৃপ্তির যোগফল যদি স্নিগ্ধতা হয় তাহলে স্নিগ্ধতাই ছিল তোমার পুরো চেহারায় লেপ্টালেপ্টি করে। সূর্য দেখছিল তোমার হরিণীর মতো সুন্দর যে চোখ, তার চেয়েও সুন্দর যে চোখের পাতা, যে পাতা কিনা মাসকারা না মেখেও হয়ে উঠতে পারে কিংবদন্তীতূল্য, তার অসামান্য পরিস্ফুটন। ওকেও বলতে শুনেছি ‘আজ হলো কী এর!’ সূর্যের অভিব্যক্তিতে তখন আনন্দ আর বিস্ময়ের মিশেল ছিল। তুমি অবশ্য সূর্যকে তার প্রতিদান ঠিকই দিয়েছ। কমলার কোয়ার মতো সূর্যকণা দেখে তুমি যেন আনন্দে ফেটে পড়তে চাইলে। সবটুকু বিস্ময় কন্ঠে ঢেলে যখন উচ্চারণ করলে ‘বাহ’ তখন সূর্য কী যে খুশী হলো। খুশী না হয়ে পারে? এটাতো তোমার কাছ থেকে তার প্রথম পাওয়া। এই মাত্র গতকালও সূর্য তোমার কাছে ছিল নেহাৎ সূর্য। সাত সকালে তোমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিত বলে তুমি তাকে পছন্দই করতে না। আজ করলে। করছ। কালকের তুমি আর আজকের তুমি যেন এক নও কিছুতেই। বিস্তর ফারাক দুজনের মধ্যে। হঠাৎ তোমার কী এমন হয়ে গেল যে তুমি অপূর্বভবে পাল্টে গেলে?

আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা ছেড়ে তুমি এখন স্যান্ডেল পায়ে গলালে। তার মানে তুমি বাগানে যাবে। এই তোমার এক অভ্যেস। প্রতিদিন ভোর বেলা একবার ওখানে ঢুঁ মারো। দেখো কোনো ফুল ফুটেছে কি না। তারপর সেটিকে ছিঁড়ে এনে রাখো ফুলদানীতে। এই নিয়ে ছোট বোনদের সাথে একটা প্রতিযোগিতার ব্যাপারও আছে তোমার। কার আগে কে রাখতে পারে। তুমি বাগানে এসে খুশী হয়ে গেলে। বেশ কটি ফুল ফুটে আছে। কিন্তু টিনা যে তোমার আগেই এসে পড়েছে এখানে। সে হাতও বাড়িয়েছে ফুল ছিঁড়বে বলে। অন্যদিন হলে কী করতে তুমি? লাফিয়ে টিনার পেছনে চলে যেতে। তারপর পেছন থেকে টুপ করে টিনার আগেই ছিঁড়ে ফেলতে ফুলটা। যদি পারতে- টিনা রেগে মেগে কাঁদতে শুরু করতো। হাত পা ছুঁড়তো। আর তুমি হাসতে। দুষ্টুমির হাসি তোমার সারা মুখ দখল করে নিত। আজও তুমি টিনাকে ফুল ছিঁড়তে দিলে না। কিন্তু নিজেও ছিঁড়লে না। সদ্য ফোটা গোলাপ দেখে তোমার মনে যে আবেগ সঞ্চারিত হলো তা তোমার পক্ষে নতুন, অন্যদের কাছে অকল্পনীয়। তুমি ভাবলে, ‘ইস এত সুন্দর ফুলকে কি ছিঁড়ে ফেলতে আছে? থাক না বেচারা ওখানেই দশদিক আলো করে!’ কী অদ্ভুত সুন্দর তোমার এই অনুভব। এরপর তুমি যা করলে তা আরো অবিশ্বাস্য। টিনাকে ডেকে বললে,
‘টিনা তোকে না একটা জিনিস দেব...’
‘কী জিনিস আপু?’
‘এখন বলব না। আগে চল আমার সাথে। তবে তার পরিবর্তে তোকে একটা কথা রাখতে হবে।’
‘কী কথা?’
‘আমাকে না বলে ফুল ছিঁড়তে পারবি না!’
টিনা এই শর্তে রাজী হলো কি না বোঝা গেল না। আসলে সে কল্পনাই করতে পারেনি তুমি তাকে কী দিতে পার। তোমার উপহারের গুরুত্ব সম্পর্কে টিনার মনে হয়তো সন্দেহ ছিল। আর যাই দাও ওকে তো তোমার কাপড়ের পুতুলগুলো দেবে না! পৃথিবীর যেকোনো কিছুর বিনিময়ে টিনা সেগুলো পেতে রাজি ছিল। কিন্তু তুমি ছিলে ওর চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে। তুমি কোনোকিছুর বিনিময়েই সেগুলো হাতছাড়া করতে চাইতে না। এই নিয়ে দুজনে ঝগড়া কি কম করেছ? টিনা আব্দার করে করে ক্লান্ত হয়ে শেষে কান্নাকাটি শুরু করতো। সবার ছোট বলে আম্মা অনিবার্যভাবে টিনার পক্ষ নিতেন। তোমাকে শুনতে হোত নানা কথা। গালমন্দ শুনে শুনে তোমার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসতো কান্নায় কিন্তু তুমি আপোষ করতে না। যেন পুতুলগুলোই তোমার প্রাণ ছিল। আর এই জন্য তোমাকে কম অপমান হজম করতে হয়নি। তোমার সমবয়সী সবার কাছে তুমি পরিচিতি পেয়েছিলে ‘দুধের শিশু’ হিসেবে! এই বয়সে মেতে থাকবার অনেক বিষয় থাকলেও তুমি পছন্দ করতে পুতুল খেলা। কারো সাথে তোমার তেমন মিলও হতো না। তুমি একাকী হয়ে ছিলে। সবার ঠাট্টা আর অবহেলার মাঝখানে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মতো। তুমি কারো সাতে থাকতে না, পাঁচে থাকতে না। কিন্তু তোমার সহপাঠীরা তোমাকে ঠিকই ফাঁসাতে চাইতো। একবার ক্লাশ টিচার তোমাকে কী একটা পড়া ধরেছেন-তুমি পারছিলে না। তখন একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ও পারবে কী ম্যাম-পুতুল খেলেই তো সময় পায় না! পুঁচকে পুঁচকে মেয়েদের সাথে সারাদিন পুতুল খেললে কি পড়াশোনা হয়?’ তখন ম্যাম তোমাকে লজ্জার সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ এই মেয়ে এসব সত্যি নাকি হু? ওরা কী বলে এসব?’ তুমি লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে চাইলে। কিন্তু তোমার বন্ধুদের হাতে আরো তাস বাকি ছিল। তোমার একটা লাল টুকটুক পুতুল ছিল যেটা তুমি হাতছাড়া করার কথা ভাবতেই পারতে না। সব সময় কাছে কাছে রাখতে। এমনকি ব্যাগে পুরে নিয়ে যেতে স্কুলেও! অবশ্য সবার অজান্তে। কোনো অসর্তক মুহূর্তে হয়তো তোমার পুতুরের খবর জেনে ফেলে ওরা। তোমার বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে সেই গোপন কথা ওরা ফাঁসও করে দেয় টিচারকে। টিচারের চোখ যেন কপালে উঠে গেল। তিনি তোমার সামনে এসে কেমন কড়া ভাবে তাকালেন। ‘তুমি নাকি স্কুলে পুতুল নিয়ে আসো?’ তুমি তখন কী বলবে? মাথা নিচু করে ছিলে। টিচার ধমকে উঠলে তুমি জবাব দিয়েছিলে ‘জ্বী’ আর সঙ্গে সঙ্গে পুরো ক্লাসে যেন হাসির ফোয়ারা ছুটে গেল। আর তোমার চোখে কান্না
‘এখন আছে সেটা?’
‘জ্বী’
‘বের করো’
তুমি বের করলে। তোমার কাঁপা কাঁপা হাত থেকে সেটা নিয়ে নিলেন টিচার। তারপর এক চড় কষালেন তোমার গালে। লজ্জা, অভিমানে সেদিন তোমার কান্নাও আটকে যাচ্ছিল কন্ঠে। সবার মুখে তখন বিদ্রুপের হাসি। পর পর তিনদিন তুমি স্কুলে গেলে না এরপর। কিন্তু তুমি পুতুল-প্রীতিটা রেখেই দিলে। আম্মু এই নিয়ে মাঝে মধ্যে আক্ষেপ করতেন, ‘এই মেয়েকে নিয়ে আমি কী করি!’
টিনার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
‘সত্যি সত্যি আমাকে দিয়ে দিচ্ছ!’
‘সত্যি নাকি মিথ্যে..’
‘স-ও-ব?’
‘সব।’
আনন্দে যেন চোখে পানি এসে গেল টিনার। সে তার ছোট্ট লতার মতো বাহু দিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরল। তুমি তোমার সব পুতুল এমনকি সেই বিশিষ্ট লাল পুতুলটিকেও টিনাকে দিয়ে দিয়েছ নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কেচে! কী করে পারলে? মাত্র গতকালও সাত রাজার ধনের চেয়েও ওগুলো দামি ছিল তোমার কাছে। আজ হঠাৎ করে এত উদার? এতো মহৎ? তোমার চোখে কিসের যেন ঝিলিক দেখলাম। কিছু যেন বললে? ওহো বুঝতে পেরেছি। আমারই ভুল। তুমি তো আর আগের মেয়েটি নও। আজ সকাল থেকেই তুমি অন্যরকম, অন্য কিছু। মানুষ তখনই তার প্রিয় জিনিসটিকে বিনা দ্বিধায় দিয়ে দিতে রাজি হয় যখন তার চেয়েও ভাল জিনিস সে পেয়ে যায়। এজন্যই তুমি পুতুলগুলোকে দিয়ে দিলে। ওসবে এখন আর তোমার প্রয়োজন নেই। বরং ওগুলো খসিয়ে ফেলতে পারলেই ভাল। সাপ যেমন খোলস পাল্টে নতুন হয়ে ওঠে তেমনি তুমি আজ নতুন হয়ে গেছ। পুতুলগুলো তোমার শৈশবের খোলস ছিল। আজ সেগুলো তুমি ছেড়ে দিলে। তোমার সামনে তো এখন অপেক্ষা করে আছে রহস্যময় এক ভুবন। সুন্দর আর অদ্ভুত। যার নাম কৈশোর। আজই প্রথম তুমি তার কাতারে প্রবেশ করলে। হয়ে উঠলে কিশোরী। আর তুমি ‘দুধের বাচ্চা’ নও। আজ থেকে তুমি কিশোরী। কৈশোর নামক এক অনিন্দ্যসুন্দর জগতের গর্বিত সদস্য। অভিনন্দন তোমাকে!


মন্তব্য

সাইফ তাহসিন এর ছবি

চলুক

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

অতিথি লেখক এর ছবি

ব্যাপারটা তখন মাথায় আসেনি। যখন বুঝলাম তখন সম্পাদনা করার অধিকার নেই। ধন্যবাদ সুপরামর্শ দেয়ার জন্য। মেইল করছি।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে কষ্ট করে পড়া ও মন্তব্য করার জন্য!

সাফি এর ছবি

হুমম

অতিথি লেখক এর ছবি

হুমম!
গল্প পড়ে পাচ্ছে ঘুম?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।