বিখ্যাত গাড়ী ব্যবসায়ী আমাদের ওয়ার্মউড সাহেব
মাটিল্ডারা যে বাড়িটাতে থাকতো সেটা ওর বাবা-মায়ের নিজস্ব বাড়ি। দো’তলাতে তিনটা শোবার ঘর, আর নীচতলাতে বসার ঘর, খাবার ঘর, রান্নাঘর মিলিয়ে বেশ সুন্দর একটা বাড়িই ছিলো সেটা। ওর বাবা ছিলেন ব্যবহৃত মানে আমরা যেগুলোকে সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি বলি আর কি, সেগুলোর একজন বিক্রেতা। আর তাকে দেখে বোঝাই যেতো যে তার ব্যবসা বেশ ভালো চলে।
“কাঠের গুড়া, বুঝলা, আমার এই সফল ব্যবসার পিছনে সবচেয়ে বড় রহস্য হলো কাঠের গুড়া। আর এই জিনিসটার জন্য আমাকে কোন পয়সাই খরচ করতে হয় না। স’মিল থেকে আমি একদম বিনা পয়সায় নিয়া আসি।“ ওয়ার্মউড সাহেব খুব গর্ব করে বলতেন।
একদিন মাটিল্ডা জিজ্ঞেস করেই বসলো, “তুমি কাঠের গুড়া দিয়ে কি করো?”
“হেহ্! তোমারে আমি বললে তো!” তার বাবা দিলেন এক ধমক।
“সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি বিক্রি করতে গেলে কাঠের গুড়া কি কাজে লাগে বুঝতে পারছি না তো, বলো না?”
“তুমি বুঝতে পারছো না তার কারণ তুমি একটা অশিক্ষিত বেকুব!” বাবা আবারো ধমক দিলেন।
মাটিল্ডার সংগে তিনি কখনো নরম স্বরে কথা বলেননি আর তাই মাটিল্ডাও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো এরকম কথা শুনতে শুনতে। ও এটাও জানতো যে ওর বাবা অহংকার করতে খুব পছন্দ করতেন। আর তাই ও নিজেও বেহায়ার মতো বাবাকে তেল দিতেই থাকতো।
“বাবা, তোমার মাথায় নিশ্চই অনেক বুদ্ধি, তাই না! এইরকম বিনা পয়সার একটা জিনিসকে কেমন তোমার কাজে লাগিয়ে ফেলেছো। ইশশ্, আমিও যদি করতে পারতাম এমন কিছু।“
“তুমি করতে পারবাই না। কারণ তুমি একটা বেকুবের হদ্দ। কিন্তু মাইকের সংগে আমার গোপন বুদ্ধিটা নিয়া আলাপ করাই যায়। একদিন আমার পুরা ব্যবসাটা ও-ই তো সামলাবে!” মাটিল্ডাকে পাত্তাই না দিয়ে তিনি তার ছেলের দিকে ঘুরে বসলেন আর তাকেই বলতে থাকলেন তার ব্যবসার গুপ্ত রহস্যের কথা, “কিছু কিছু গাধা টাইপ মালিক আছে যারা গাড়িগুলার গিয়ার এতো শক্তি দিয়া চালায় যে ওগুলা একদম নড়বড়ে হয়ে যায়। সমানে এদিক ওদিক ঘোরে গিয়ারগুলা। এইরকম গাড়ি আমি সবসময় কিন্তু খুশি মনে কিনে ফেলি। কারণ দামে সস্তা পাই। তারপর করি কি জানো? ওই কাঠের গুড়ার সংগে তেল মিশায়ে গিয়ার বক্সে দিয়া দেই। আর কি তামশা! গাড়ি পুরা পঙ্খিরাজের মতো চলা শুরু করে!”
মাটিল্ডা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে, “গাড়িটার গিয়ার আবার নড়বড় করে না? কতোক্ষণ পর্যন্ত ভালো থাকে?”
“মোটামুটি অতোখানি দূর নিয়া যায় যেখান থেকে আমার কাছে আবার ফেরত আসা কাস্টোমারের সম্ভব হয় না। একশ’ মাইলের মতো নিয়া যায়।“ বিরাট এক হাসি ওর বাবার মুখে।
“কিন্তু বাবা, এটাতো ঠিক না। তুমি লোকজনকে ঠকাও বাবা!”
“আরে ভাগ্! লোক না ঠকায়ে বড়লোক হওয়া যায় নাকি আবার! কাস্টোমাররা আছেই তো ফাঁকি খাওয়ার জন্য।“ বাবা বুঝিয়ে দিলেন মাটিল্ডাকে।
মাটিল্ডা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলো বাবার দিকে। ওয়ার্মউড সাহেব মানুষটা ছোটখাটো। ছুঁচোর মতো মুখে চিকন রেখার মতো গোঁফের জন্য ইঁদুর ভাব আরো প্রবল। সেই গোঁফের নিচে সামনের কয়েকটা দাঁত বেরিয়ে থাকতো সবসময়। চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল সব রঙের চেক কাটা কোট ছিলো তার পছন্দ আর সেই সংগে হলুদ কিংবা ফ্যাকাশে সবুজ টাই। তিনি মাটিল্ডার চাহনিকে মোটেও পাত্তা না দিয়ে আবার বলে চললেন, “এখন মাইলেজের কথাই তুমি ধরো, মাইক। সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনার সময় কাস্টোমার প্রথম যেটা জানতে চায়, সেটা হলো গাড়িটা কতো মাইল চালানো হইছে, তাইতো?”
“হ্যাঁ, তাইতো জিজ্ঞেস করে আগে।“ মাইক মাথা নাড়ে।
“তো, আমি করি কি, একটা পুরানা লক্কড় ঝক্কড় মার্কা গাড়ি কিনি যেটা অলরেডি দেড় লাখ মাইলের মতো দেখাচ্ছে মিটারে। অনেক সস্তায় পাই। কিন্তু মিটারে এইরকম সংখ্যা দেখলে কেউ সেই গাড়ি কিনবে না, নাকি? আর এখনকার গাড়িগুলাও এমন করে বানায় যে দশ বছর আগের মতো মিটারটা খুলে নিয়া আর ইচ্ছামতো মাইলেজ বাড়ানো কমানোও যায় না! আজাইরা ঘড়ির দোকানদার টাইপ কিছু না হলে ওই মিটারটাকে মোটেও নড়াচড়া করানো যায় না। তাহলে আমি কি করি? আমি আমার মাথার বুদ্ধি কাজে লাগাই, বুঝলা বাছাধন!”
মাইক মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো। তাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছিলো বাবার লোক ঠকানোর প্রবণতাটা তার মধ্যেও ভালোভাবেই আছে। সে খুব আগ্রহ নিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কিভাবে বাবা, কিভাবে?”
“আমি ঠান্ডা হয়ে বসে নিজেরেই জিজ্ঞেস করি যে কিভাবে মিটারটারে ভেঙে টুকরা টুকরা না করে দেড় লাখ মাইলেজরে মাত্র দশ হাজারে নামায়ে আনা যায়? ধরো, আমি যদি গাড়িটা পেছন দিকে চালাই যথেষ্ট টাইম নিয়া তাহলে হয়তো কাজ হতেও পারে। সংখ্যাগুলা তখন পেছন দিকে যাওয়া শুরু করবে, তাই না? কিন্তু কার মাথা এতো আউলায়ে গেছে যে মরার একটা গাড়িরে হাজার হাজার মাইল পেছন দিকে চালাবে? তুমি এইটা করতেই পারবা না!”
“সেই তো! এটা করা সম্ভবই না বাবা!” মাইক সায় দেয়।
“আমি বসে বসে মাথা খাটাতে থাকি। বুদ্ধি খুঁজি। আমার মতো এতো বুদ্ধি যদি কারো থাকে তাহলে সেইটা কাজে না লাগানো বিরাট পাপ হয়া যাবে। আর হঠাৎ আমার মাথার মধ্যে উত্তরটা লাফ দিয়া উঠে। বুঝছো, ওই যে আরেক বুদ্ধিমান লোক পেনিসিলিন আবিষ্কার করে যেমন লাফ দিয়া চিৎকার করতেছিলো, আমিও তেমন চিৎকার দিয়া উঠলাম, ‘ইউরেকা! পেয়ে গেছি আমি!’”
ছেলের চোখে বিশাল প্রশ্ন, “তারপর তুমি কি করলে?”
ওয়ার্মউড সাহেব বলে চলেন, “স্পিডোমিটারটা চলে সামনের একটা চাকার সংগে লাগানো তার দিয়া। আমি সবার আগে ওই তারটা চাকার থেকে খুলি। তারপরে তারের মাথাটারে লাগায়ে দেই ওই যে হাই-স্পিড ড্রিলগুলা আছে না, ওইগুলার একটার সংগে। এমনভাবে তারটারে লাগাই যে ড্রিলটা যখন চলবে তখন তারটা যেন পেছন দিকে ঘুরে। বুঝছো তো তুমি? আমার কথা বুঝছো তো?”
“হ্যাঁ, বাবা! তুমি বলো।“ ছেলের উত্তর।
“এইসব ড্রিলগুলা অনেক স্পিডে ঘুরে। আমি যখন ড্রিলটা চালাই তখন মিটারের সংখ্যাগুলা চোখের পলকে পিছনে যাইতে থাকে। পঞ্চাশ হাজার মাইল মুছতে লাগে মাত্র কয়েক মিনিট! আমার কাজ শেষ হতে হতে গাড়িতে মাত্র দশ হাজার মাইল বাকি থাকে আর গাড়িও তখন বিক্রির জন্য রেডি! কাস্টোমাররে আমি বলি, ‘গাড়ি তো একদম ঝকঝকে নতুন! মাত্র দশ হাজার মাইল চলেছে। আসলে এক বুড়ি ভদ্রমহিলার গাড়ি ছিলো তো, তিনি সপ্তাহে এক-দুইবার বাজারে যাওয়ার জন্য গাড়িটা নিয়ে বের হতেন শুধু!’”
“তুমি আসলেই ড্রিল মেশিন দিয়ে গাড়ির মাইলেজ কমাতে পারো বাবা?” মাইক প্রশ্ন করে অবাক হয়ে।
“দ্যাখো, আমি তোমাকে আমার ব্যবসার গোপন সব কথা বলে দিতেছি। তুমি আবার জনে জনে এইসব বলে বেড়ায়ো না। আমারে ধরে গর্তে ভরে রাখুক এইটা নিশ্চই তুমি চাও না, নাকি?”
“আমি কাউউকে বলবো না! তুমি কতোগুলো গাড়িকে এইরকম করে দাও বাবা?”
“আমার দরজা দিয়ে যতোগুলা গাড়ি আসে সব একইরকম ওষুধ পায়। বিক্রির আগে সবগুলার মিটার ধরে দশ হাজারের নিচে মাইলেজ নামানো হয়। আর চিন্তা করে দেখো, এইরকম একটা জিনিস আমার নিজের আবিষ্কার করা!” বাবা এটুকু বলে গর্বের সংগে আবার যোগ করলেন, “আমার এই আবিষ্কারটার জন্যই আজকে আমরা এত্তো বড়লোক।“
মাটিল্ডা এতোক্ষণ খুব আগ্রহ নিয়েই তাদের কথাবার্তা শুনছিলো। বললো, “কিন্তু বাবা, কাঠের গুড়ার চেয়ে এটা তো আরো বড় ফাঁকি। একদম পচা কাজ। যে লোকগুলো তোমাকে বিশ্বাস করে আসে তুমি তাদের ঠকাও।“
“তোমার যদি এতোই খারাপ লাগে তাহলে এই বাসার খাবার তোমার খাওয়ার দরকার নাই। এই খাবার-দাবারের পয়সা আসে ব্যবসার ওই লাভ থেকেই।“ ধমক লাগায় বাবা।
“পচা পয়সা। এই পয়সা আমি ঘেন্না করি।“ মাটিল্ডা সহজ মনের সরল জবাব।
ওর বাবার গালদু’টো টমাটোর মতো লাল হয়ে গেলো যেন। তিনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন, “এইসব বড় বড় কথা বলার তুমি কে? এহ্, পোপ চলে আসছে আমার কাছে সততা নিয়া ভাষণ দিতে! তুমি হইতেছো একটা পুচঁকা অশিক্ষিত ফাজিল যার কোন ধারণাই নাই কি থেকে কি হয়!”
মা সায় দিলেন বাবার কথায়, “তুমি একদম সত্যি কথা বলছো, হ্যারি। মাটিল্ডা, তোমার সাহস তো কম না তুমি তোমার বাবার সংগে এইরকম করে কথা বলছো! এখন তুমি তোমার বাজে বকা বন্ধ করে চুপ থাকো। টিভির অনুষ্ঠানটা শান্তিতে দেখতে দাও আমাদের।!”
চলবে ...
[ভাষার ক্ষেত্রে একটু এদিক ওদিক হয়ে গেছে এবার, বিশেষত "বাবা"র কথ্য ভাষাটা মিক্স হয়ে গেছে। এ বিষয়ে কারো মতামত থাকলে জানাবেন অবশ্যই। ধন্যবাদ।]
- নৃ
--ছবি ওয়েব থেকে সংগৃহীত--
মন্তব্য
ভালো হচ্ছে অনুবাদ। তবে কথ্য ভাষাটা দুপক্ষের মধ্যেই দেয়াটা বাস্তবসম্মত হতো। এই পর্বটা কি একটু তাড়াহুড়ো করে করা হয়েছে?
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
মূল বইতে "বাবা"র ভাষা বেশ কর্কশ.. এবং পড়াশোনার প্রতি তার এ্যাটিচুড হেনতেন চিন্তা করে তার ভাষাটা কথ্য করলাম। কিন্তু মাটিল্ডার ভাষাটা মূল বইতেও খুব ভদ্র আর সংযত মনে হলো, যেজন্য ওর সংগে "বাবা"র কথার সংগে পার্থক্য দেখাতে গিয়ে এই লাইনটা টানলাম।
নাহ্, তাড়াহুড়া করে করি নাই নীড়দা.. বাট্, "বাবা"র ভাষা কি পুরোই কথ্য করে দিবো? এই ব্যাপারে কনফিউজড্ ছিলাম একটু..
দিলে বাবার পুরোটাই কথ্য করে দেন। কারন একই মানুষ দুভাবে কথা বলে না সাধারণত।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
মাটিল্ডার আকর্ষণেই এই সিরিজে ফিরে আসতে হয়।
ধন্যবাদ..
সেজন্যই বার বার এসে লিখি..
চলুক!
সিনেমাটা অনেকবারই দেখেছি কিন্তু কেম্নে কেম্নে বইটা পড়া হয় নাই।এই সু্যোগে সেইটাও হয়ে যাচ্ছে।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
ধন্যবাদ.. পড়ছেন বলে
আর নাই?
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
নতুন মন্তব্য করুন