আধোঘুম ঘোরে রাত ঠিক-ই পার হয়ে গেল।
ভোর। কুয়াশার চাদরটা সবে সাদা হতে শুরু করেছে। জানালার ওপাশে তাকিয়ে দেখলাম পাহাড়ের হাল্কা গোলাপী ওড়না টা নীল আকাশের গায়ে লেপ্টে আছে। আমিও বেহায়ার মতো তাকিয়েই আছি, চোখ তো সরাতে পারছি না; সরালেই মনে পড়ে যাচ্ছে অপাশে কম করে হলেও শ'খানেক ফুট নিচে, খাদের কথা। যার জন্য অনেক খন ধরেই মনের এক কোনে প্রার্থনা চলছে- চালক আকাবাকা এই "সাপ" টার বুক থেকে ভুল করে নেমে না যায়!
অবশেষে নেমে গেলাম "চার চাকার বাক্স" থেকে। দ্বিতীয় বারের মতো পদার্পণ অথবা দ্বিতীয় বারের মতো পায়ে ধুলো নেয়া।
বান্দরবান.........
ঘোর কাটেনি তখনও। চার পাশ বেশ শান্ত। ওদেরও ঘোর লেগে আছে।
বিশাল বড় এক পাহাড়ের মধ্যে বুলডোজার চালিয়ে তৈরি হয়ে গেছে চার চাকার বাক্স গুলো রাখার জায়গা। চার পাশে পাহাড় কাটা মাটিতে ভরে আছে। কয়েক জন মানুষ আছে, বেশির ভাগ-ই রিক্সা পাইলট। পরের গন্তব্য তিন চাকায় উঠে রামুর বাস স্ট্যান্ড। বাস গুলো রামুর ছিলো? কি জানি!
প্রচন্ড শীত। এতোক্ষণ টের পায়নি। রিক্সায় খোলা বাতাসে বসেই টের পেলাম। গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সময় তার সাথে চাকা গুলো। চোখে পড়লো হিলবার্ড হোটেলের তিন তলার বারান্দাটা; যেখানে বসে আগের বার-ই পণ করেছিলাম আমি আবার আসবোই। চোখে পড়লো আশেপাশের ছোট ছোট চূড়াগূলো; যে গুলোতে উঠেই মনে হয়েছিল কি যেন করে ফেলেছি। শিমুল গাছটা এখনো দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। মাথাটা চূড়োর উপরে আর গোড়া টা পাহাড়ের নীচে। লাল লাল ফুল গুলো অবশ্য চোখে পড়লো না। কাঠের সেতু, দুইপাশে কতগুলো ঘর পার হয়ে গেলাম। চূড়ার মাথায় মাথায় কুড়ে ঘর।
কুয়াশা ততোক্ষনে ঘুমাতে চলে গেছে। আর সুর্যের ঘুম ভাংগেনি। বাতাস নিরলস বয়েই যাচ্ছে।
যেখানে নামিয়ে দিলো সেখানে বাস খুজে পেলাম না একটাও। কতোগুলো জীপ দাঁড়িয়ে আছে। চান্দের গাড়ী। চালক নিশ্চই "ফেরেশতা!" কিছুক্ষনের মধ্যে এক ফেরেশতা চলে এলো। উঠে গেলাম একটায়, চাদে নয়, আপাততো রামুর ঘাট যেতে হবে।
আবার সাপের বুকে, আবার বুক ধুকধুক!! ভরশা যে এবার ফেরেশতা আছে সাথে। আবার সারি সারি পাহাড়, সবুজ জামা পড়া পাহাড়, কোনটা ধুসর। আগুন লেগে ছিল এই গুলোতে। নতুন প্রজন্ম জায়গা করে নিয়েছে আবার।
চার চক্রের এই যানটি নিয়েই ব্যাপক দ্বিধা দ্বন্দ কাজ করে চলেছে মনে। গায়ের যা হাল !! আর ইঞ্জিন যে পরিমাণ অদ্ভুত শব্দ করছে তাতে ভরসা পাচ্ছি না। এই নিয়েই হঠাৎ খাড়া ২০-২৫ ফুট উপরে উঠে যাচ্ছে আবার সাথে সাথেই তার চেয়ে বেশি নিচে নেমে যাচ্ছে। অতঃপর উপায়ান্তর না দেখে আবারও প্রকৃতিতে ফিরে গেলাম হাত দুটো শক্ত করে গ্রিলের সাথে আটকে।
উপরে খোলা আকাশ, সাদা মেঘ- নতুন কিছু নয়। নিচের দিকে যেন পুরাতন কিছুই নেই। কয়েকশ’ ফুট নিচে থেকে শুরু হয়ে পাহাড়ের গা গেষে জুম চাষ দেখলাম। একি সাথে অনেক ধরণের শস্য। পুরো পাহাড় টা যেন সিড়ি! তবে এতটাই খাড়া সিড়ি যে তাতে কি করে মানুষ ওঠে বা উপর থেকে নিচে নামে আমার দিব্য চোখে তা আমি দেখতে পেলাম না।
ধপাসসস......!!
এই নিয়ে কতোবার গুণে শেষ করতে পারছি না। শুনেছি স্বর্গের রাস্তা উপরের দিকে আর নরকের রাস্তা নিচের দিকে। এই মুহুর্তে যে স্বর্গের দিকে যাচ্ছি তার কোন কিছুই খারাপ লাগছে না, শুধু মাঝে মাঝে চান্দের গাড়ির আসন থেকে নিচের ফ্লোরে পড়ে গিয়ে দু চারটা ড্রপ খাওয়া বাদে। রাস্তার গুণগান না হয় এখন থাক।
ক্ষণিক পর পর গাড়ী থামছে, এক রাশ লোক নেমে যাচ্ছে আর এক গাদা লোক ঠাসাঠাসি করে জায়গা করে নিচ্ছে। সাথে তাদের প্রতিদিনকার প্রয়োজনীয় সবকিছু তো থাকছেই। কারো কারো সাথে কথা হলো, বেশ খানিকটা কষ্ট করলাম ভাষা বোঝার জন্য। কিছুটা বুঝলাম বাকিটা হু, হা করে কাটিয়ে নিতে হলো।
অনেক নিচে সাঙ্গু চোখে পড়লো। আকাবাকা নদীটা বান্দরবানের বেশির ভাগের উপর দিয়েই বয়ে গেছে। মিলনছড়ি পার হলাম। পার হয়ে এলাম নীলাচল। নীলাচলের মাথার ছাউনিটা বেশ অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। শৈলপ্রপাত এর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম ভাগ্য আগের বারের চেয়েও খারাপ। আগের বার প্রপাতের অস্তিত্ব হাল্কা হলেও অনুভব করেছিলাম, এবার তাও নেই।
ততোক্ষণে হাজার খানেক ফুট ওপরে!
আরও কিছুক্ষন চলার পর ওয়াই জোন-এ(এখানে রাস্তা টা দুই দিকে চলে গিয়ে Y এর আকৃতি ধারণ করেছে, তাই হয়তো এই নাম) পৌছে গেলাম। পুলিশের খাতায় নাম লেখাতে হবে। ঘুরে আবার রওনা হয়ে গেলাম।
সুয্যিমামার ঘুম টা কে ভাঙ্গালো জানতে পারি নি, তবে ঘুম টা ভেঙ্গে যাওয়ায় উনি ব্যাপক রাগ করেছেন সেটা বেশ করে বুঝতে পারছি। আমাদের কি দোষ!!!
বেশ কতোগুলো গ্রাম পার হয়ে এসেছি। একেকটা একেক আদিবাসি গোত্রের। একেকটা গ্রামের দুরত্ব অনেক। রাস্তায় এক হাড়ি পাতিল ওয়ালাকে দেখতে পেলাম। আগের গ্রাম পার হয়ে পরেরটায় যাচ্ছে। এই মুহুর্তে ভেবে দেখলাম শহরে স্বর্গ সুখেই আছে মানুষজন, অন্তত এতো দূর হেটে হেটে ওপরের দিকে উঠতে হয় না। যে উঠছে সে জানে, ব্যাপার টা আসলে কি। আরোও অবাক হচ্ছি রাস্তার মাঝে যখন দুই একজন গাড়ী থামিয়ে নেমে যাচ্ছে। আশেপাশে মাইল তিন চারেক এর মধ্যে কোনো ঘর বাড়ি তো দেখতে পাচ্ছি না!
এই উঠছি তো এই নামছি। রাস্তা গুলো এতোটাই প্রশস্ত যে বিপরীত দিক থেকে যখন আরেকটা গাড়ী আসছে তখনই তওবা পড়ে নিচ্ছি। বিধাতাকে মনে করলেই যদি নেকি পাওয়া যায় তবে আমি এই দিন টার জন্যই স্বর্গের স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিতে পারি!
মণ খানেক কিলোমিটার দুরত্ব পাড়ি দিয়ে চলে এলাম রামুর ঘাটে.........এরপর নৌকা............
মন্তব্য
ভালো হচ্ছে লেখা। সচলে স্বাগতম। অতিথির পরিচয় জানলে ভালো লাগতো।
...........................
Every Picture Tells a Story
ধন্যবাদ আপনাকে.........।
ভেবেছিলাম এই বারো সম্ভবতো প্রকাশ পাবে না......কিন্তু পেয়ে গেল।
---------------------------------------------------------
ভবের নেশায় মাতাল ভাবনা
ভালো লাগলো! পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
আর হ্যাঁ, আরো কয়েকটা ছবি দিয়েন।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
লেখা বেশ ভালো লাগলো
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম
ছবি চাই
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এমনিতেই কথা গুছায়ে বলতে পারি না, তার উপর এই ভাবে উৎসাহ দিতে থাকলেতো নিজেরে আটকায়ে রাখতে পারবো বইলা মনে হইতেছে না ......
হায়রে! সবাই বান্দরবান ঘুরে আসছে, যাচ্ছে। আমি খালি প্ল্যানই করে যাচ্ছি।
লেখা ভাল লাগল। আমার বান্দরবান যাত্রার মোটিভেশন জিইয়ে রাখল। ছবি দিন আরো।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
নতুন মন্তব্য করুন