(নিচের গল্পটি নেহায়েত-ই একটি স্বপ্নে প্রাপ্ত রূপকথা, এর সাথে সাম্প্রতিক অভ্র বনাম বিজয় কপিরাইট বিতর্কের কোন সম্পর্ক নেই)
আফ্রিকার গহীন অরণ্যের মাঝে নিঝুম একটি গ্রাম- সেলুকাসাংগো। এই গ্রামটা ‘বোবা মানুষের গ্রাম’ হিসেবেই আশে-পাশের গ্রামে পরিচিত। কারণ সেলুকাসাংগোতে জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশু সাপের জিভের মত মাঝখানে চেরা জিভ নিয়ে জন্মায়। কেন এমন হল সেটা বিস্তারিত জানা যায় না, তবে ঐ গ্রামের আশে-পাশের গ্রামের লোকজন বলাবলি করে সর্পদেবতার অভিশাপেই নাকি ওদের এই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। জিভের মাঝখানটা চেরা হওয়াতে সেই গ্রামের কেউই কথা বলতে পারতো না। আকার-ইংগিতে ভাব বিনিময়েই তারা কোনমতে দিন পার করত।
তারপরেও গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের প্রয়োজনেই সেই গ্রামে গড়ে ওঠে একটা শাসন ব্যবস্থা। পুরো গ্রামটা কয়েকটা পাড়ায় বিভক্ত ছিল, প্রত্যেক পাড়ায় একজন করে মোড়ল দায়িত্ব পালন করত। আর সব পাড়ার মোড়লদের মধ্যে যিনি বয়সে সবচেয়ে বড়, তিনিই হতেন পুরো গ্রামের প্রধান। পাড়ার ভেতরকার টুক-টাক ঝগড়া-বিবাদ পাড়ার মোড়লরাই সমাধান করে দিতেন কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় কোন গোলমাল হলে সেটা বিচারের ভার পড়ত গ্রাম-প্রধানের ওপরে। সবার কাছে সম্মানিত একদল প্রবীণ মানুষ গ্রাম-প্রধানকে এই কাজে সাহায্য করতেন।
বোবা মানুষের রাজ্যে সব সময় বিরাজ করে এক নিঃস্তব্ধ নীরবতা। আশে-পাশের গ্রামের মানুষের ভাষা তারা বুঝতে পারত বটে কিন্তু নিজেরা কথা বলতে না পারায় প্রতিবেশীদের সাথে ওদের তেমন কোন যোগাযোগ গড়ে ওঠে নি। ওদের এই সমস্যার সমাধান কখনোই হবে না ভেবে ভাষাহীন জীবনযাপনেই ওরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু একদিন এমন একটা ঘটনা ঘটল যার ফলে এই দুঃখী গ্রাম নতুন করে বাঁচার উপায় খুঁজে পেল। মোজুকাংগুলালা নামে এক যুবক এক অবিশ্বাস্য ঘটনার জন্ম দিল। মোজুকাংগুলালা ছিল পেশায় কাঠুরে। স্ত্রী আর এক মাত্র ছেলে বিজুকাংগুলালাকে নিয়ে গ্রামের এক কোণে, বাঁশবনের ধারে ছোট্ট একটা বাড়িতে মোজুকাংগুলালা বাস করত। তিন জনের একটা দল নিয়ে বনে কাঠ কাটতে যেত সে। একবার কাঠ কাটতে গিয়ে বেশ কয়েক দিন পর সে গ্রামে ফিরে এল একা, এবং তার চেয়েও বিস্ময়কর; সে কথা বলতে লাগল! সবাই বিস্ময়ে হতবাক! সে সবাইকে বোঝাল, সে দেবতার বরে এমন এক বটিকার সন্ধান লাভ করেছে যেটা খেলে যে কেউ কথা বলতে পারবে। এটা শুনে সবাই সেই বটিকার জন্য গ্রমবাসীরা হুড়োহুড়ি শুরু করে দিল। সবার-ই চাই সেই আশ্চর্য বটিকা।
আসলে কি ঘটেছিল মোজুকাংগুলালার ভাগ্যে? আসলেই কি দেবতার আশীর্বাদ পেয়েছিল? ওই রকম গল্প সে বাজারে রটিয়ে দিলেও আসলে তা মোটেও সত্যি নয়। গভীর জঙ্গলে পথ হারিয়ে তিন কাঠুরের এক এক জন চলে যায় একেক দিকে। মোজুকাংগুলালা হাঁটতে হাঁটতে বহুদূরে এক নদীর ধারে চলে যায়। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তার প্রাণ যখন যায় যায়, তখন নদীর বুকে এক অদ্ভুত নৌকা দেখতে পায় সে। সে নৌকা ছিল ইন্ডুমামা উপজাতির মানুষের। তাদের বৈদ্য অনেক রকম তুক-তাক জানত। সেই তুকতাকের জোরেই সে যাত্রা সে প্রাণ ফিরে পায়। বৈদ্য মোজুকাংগুলালার জিভের অবস্থা দেখে তাকে এক আশ্চর্য বটিকা খাইয়ে দেয় আর মোজুকাংগুলালাকে সেই বটিকা তৈরির উপায় শিখিয়ে দেয়। কয়েকদিন পর পুরোপুরি সুস্থ হলে সে গ্রামে ফিরে আসে আর দেবতার আশীর্বাদের গল্পটি প্রচার করে। মোজুকাংগুলালা এই বড়ির নামকরণ করে বিজু-বটিকা।
ব্যবসায়িক বুদ্ধির মানুষ মোজুকাংগুলালা। সে প্রথমেই ঠিক করে নেয় সমাজসেবার জন্য সে বিজু-বটিকা বিতরণ করবে না। তাই সে সবাইকে বোঝায় যে এই বটিকা পেতে হলে প্রথমে পাড়া-প্রধানের অনুমতি লাগবে। অনুমতি পেলেই শেষ না, এরপর বিজু-বটিকা প্রদানকারী দেবতাকে তুষ্ট করার পালা। দেবতা তুষ্ট করার নাম করে মোজুকাংগুলালা লোক দেখানো যজ্ঞের আয়োজন করত এবং সেই যজ্ঞের খরচাপাতি হিসেবে বিজু-বটিকা প্রার্থীকে মোজুকাংগুলালার গোলায় এক বছরের ধান জমা দিতে হত। শুধু তাই না, প্রতিদিন সকালে উঠে খালি পেটে একশবার ‘বিজু-বটিকার জয় হোক-মোজুকাংগুলালা দীর্ঘজীবী হোক’ বলে জয়গান করতে হত। এসব না করলে বিজু-বটিকা কার্যকারিতা হারাবে বলে মোজুকাংগুলালা সবাইকে ভয় দেখিয়েছিল।
মোজু-কাংগুলালা নিজে বৈদ্য না হওয়ায় সে নিজে বিজু-বটিকা বানাতে পারত না। তার জানা ছিল কেবল সেটা বানানোর উপায়খানি। ফলে অন্য গ্রাম থেকে কিছু তরুণ বৈদ্যকে সে এনে এই কাজে লাগাতো। কিন্তু এরা যেন বিজু-বটিকার ব্যবসা না করতে পারে সেজন্য সে আগেই নিজেকে দেবতার আশীর্বাদধন্য বলে প্রচার করেছিল। দেবতার অভিশাপের ভয় দেখিয়ে এদেরকে সে কাজ করিয়ে নিত এমনকি ওদের পরিশ্রমের মূল্য দিত না ঠিকমত।
এভাবে দিন চলে যায়, এমনকি বছরও ঘুরে আসে কয়েকবার। উচ্চমূল্যের কারণে বিজু-বটিকার ব্যবহার কেবল ধনী আর নেতৃস্থানীয়দের মধ্যেই চালু হয়। এই সুযোগে মোজুকাংগুলালা সমাজের একজন কেষ্টু-বিষ্টুতে পরিণত হয়। একসময় বিজু-বটিকার পরশ পাওয়া সৌভাগ্যবান বাচ্চাদের জন্য পাঠশালা খোলা হয়। একজন কাঠুরিয়া হয়েও সেই পাঠশালার বাচ্চাদের পড়ানোর দায়িত্ব বাগিয়ে নেয় মোজুকাংগুলালা। সে যুক্তি দেয়, তার কারণেই সবাই কথা বলতে পারছে, তার জ্ঞান-গম্যি কম হলেও এই একটা কারণেই সে এই বাচ্চাদের পড়ানোর যোগ্য! বাধ্য হয়ে গ্রামবাসীরা তার আবদার মেনে নেয়।
এভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল। হয়তো আজীবন এভাবেই যেত কিন্তু মোজুকাংগুলালার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় এক তরুণ যুবক- নাম তার মোহক। মোহকের গরীব বাবা-মা মোহকের জন্য বিজু-বটিকার ব্যবস্থা করতে পারেন নি। এজন্য মোহক দমে যায় নি, কৃষিকাজের পাশাপাশি অবসর সময়ে নানা গ্রামে ঘুরে বেড়াতো সে। অবসর সময়টাতে আশে-পাশের গ্রামের বৈদ্যদের কাছে সে তন্ত্র শিক্ষা নিল। কিন্তু কোন তন্ত্রেই জিভ-চেরা রোগের সমাধান না পেয়ে পাঁচ বছর সাধনার পর সমস্ত তন্রের নির্যাস একত্র করে মোহক এক নতুন বটিকা আবিষ্কার করল। মোহক এর নামকরণ করল অভয়-বটিকা। এই বটিকার গুণে সে নিজে কথা বলার ক্ষমতা লাভ করল। সে নিজে গরীব হওয়ার অভিশাপে বিজু-বটিকার আশীর্বাদ পায় নি। তাই সে ঠিক করল গ্রামের সবাইকে সে ভাষাহীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দেবে। তাই ভাষাকে উন্মুক্ত করার জন্যেই সবার মাঝে বিনামূল্যে অভয়-বটিকা বিতরণ শুরু করল। অভয়-বটিকার ব্যবহারকারীরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল তারা বিজু-বটিকা সেবনকারীদের চেয়েও ভাল ভাবে কথা বলতে পারছে! অভয়-বটিকার সাফল্যে চারদিকে হৈ-চৈ পড়ে গেল। ধীরে ধীরে বিজু-বটিকার বাজার কমে গেল। একমাত্র মোড়লরাই তার পক্ষে ছিল, কারণ কানা-ঘুষো শোনা যেত যে বিজু-বটিকার লাভের গুড় কিছুটা তারাও পেয়ে থাকে। এক সময় একজন সাহসী মোড়ল মোহকের সাহায্য নিয়ে তার পাড়ার সবাইকে অভয়-বটিকা বিলিয়ে দিল । এসব দেখে মোজুকাংগুলালা ভীষণ রেগে যায়। সে প্রচার করে যে মোহক ডাকিনীবিদ্যা চর্চা করে অপদেবতাকে তুষ্ট করেছে আর সেই শক্তির জোরে সে আমার বিজু-বটিকার প্রস্তুতপ্রনালী চুরি করে অভয়-বটিকা বানিয়ে মানুষকে বোকা বানাচ্ছে। সে আরো ভয় দেখায় মোহকের কর্মকান্ডে দেবতাদের অমর্যাদা হয়েছে। এই ঘটনায় দেবতা ক্রুদ্ধ হয়েছেন ভীষণ। মোহককে শাস্তি না দিলে কয়েকদিন পরই দেবতার অভিশাপে এই গ্রামে এক ভীষণ ঝড় হবে আর সেই ঝড়ে সবাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে!
কিন্তু সেলুকাসাংগোর তরুণ সম্প্রদায় মোজুকাংগুলালার এই ভন্ডামি বুঝতে পেরে বিদ্রোহ করে। এমন সময় বিজয়-বটিকার প্রাক্তন কারিগররাও মুখ খুলতে শুরু করে। সব গোঁমর ফাঁস হওয়ার আগেই মোজুকাংগুলালা মোহককে চোর সাজিয়ে গ্রাম-প্রধানের দরবারে বিচার দেয়।ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মোজুকাংগুলালা খুব দ্রুতই মোহকের বিচার শুরু করায়। অন্যদিকে নির্ভীক-তরুণ মোহকের পক্ষে তরুণসমাজের সবাই এসে দাঁড়ায়। বিচারসভায় তর্কাতর্কি চলতে থাকে। কয়েকদিন পর বিচারের রায় দেওয়ার দিন ধার্য করা হয়।
রায় দেওয়ার আগের দিন মোজুকাংগুলালা সারাদিন পাড়া-প্রধান আর প্রবীণ মানুষের দলের সাথে আলাপ-আলোচনা চালিয়েছে। তার ইচ্ছে মোহককে যেন ‘কালো জাদুকর’ আখ্যা দিয়ে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার রায় ঘোষণা করা হয়। এই ইচ্ছে চরিতার্থ করার জন্যেই সে সারাদিন গোপন শলাপরামর্শ করে বেড়িয়েছে। তাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
গভীর রাতে হৈ-চৈ শুনে মোজুকাংগুলালার ঘুম ভাঙ্গে। চমকে উঠে সে দেখে গ্রামের কয়েকশ তরুণ বাঁশ হাতে ঘিরে ফেলেছে তার বাসভবন। দৌড়ে পালাতে চায় মোজুকাংগুলালা। বাঁশ হাতে সবাই ধাওয়া করে পেছন পেছন। দৌড়াতে গিয়ে পা পিছলে উপুড় পড়ে যায় মোজুকাংগুলালা। সুতীক্ষ্ণ বাঁশের অস্তিত্ব সে পশ্চাদ্দেশে অনুভব করে। আর্তনাদ করে ওঠে সে...............
(ঠিক এই পর্যায়ে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। এর ফলে গল্পের পরবর্তী অংশ লেখা আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। পাঠকরাই এর সমাপ্তি টেনে নেবেন আশা করি)
মন্তব্য
আদুনিক-রূপকথা-মোজুকাংগুলালার দেশে লেখার শেষে নাম আর ই-মেইল জুড়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।এখানে দিয়ে দিলাম
পথিক রহমান
______________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ
আমি আসলেই এর সাথে অভ্র বনাম বিজয় কপিরাইট বিতর্কের কোন সম্পর্ক খুঁজে পাই নি।
____________
ত্রিমাত্রিক কবি
ই-মেইলঃ
বাঁচাইলেন ভাই। আমিতো ভাব্লাম আমার নাকে নাকি কেউ মানহানির মামলা ঠুকে দেবে। মোজুকাংগুলালা বড় ভয়ানক মানুষ!
গল্পটা মজার লাগল না। অন্য বিষয়ে আরো মজার লেখা চাই।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
এইবার স্বপ্নে পাওয়া গপ্পো! যাওকগা... আবার ঘুমায় পড়েন, স্বপ্নের সেকেন্ড পার্টও পাইয়া যাইবেন!
--- থাবা বাবা!
দশ নম্বর প্যারার প্রথম লাইনে কপিরাইট লঙ্ঘিত। মোজুকাংগুলালার অভিশাপ থেকে এখন কোন বটিকা আপনাকে বাঁচাবে ??
নতুন মন্তব্য করুন