১.
রাতের যন্ত্রণাময় গভীর অংশটা শেষ হতে চললো। উদভ্রান্ত-যন্ত্রণাময় একটা সময় পার করে প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থায় লিখতে বসেছি। কি যে লিখতে বসেছি ঠিক জানিনা। আমি শুধু জানি যে আমি যন্ত্রণাটাকে বলতে চাই- 'আর পারি না'। হয়ত 'আর পারি না'-টাকেই কাগজটাকে অথবা কলমটাকে বোঝাতে বসেছি; হয়তবা ট্র্যাশ-পেপার বাস্কেট টাকে- যে প্রতিরাতে আমার যন্ত্রণাকাতর সময়ের সাক্ষী দোমড়ানো কাগজগুলোকে বুকে ধরে,স্পন্দনটাকে অনুভব করে বোঝে যে আমি আর সত্যিই পারি না।
২.
এ অস্থিরতা, এ যন্ত্রণা- আর পারছি না, সত্যিই আর পারি না। দুই-দুইটা দিন ধরে যন্ত্রণায় প্রায় নেশাগ্রস্থ হয়ে আছি। ইচ্ছে করছে কিছু ছিঁড়ি, ভাঙ্গি, পেটাই। জানি এ যন্ত্রণা তাতেও মেটার নয়। কারণ যন্ত্রণাটা আদৌ ধ্বংস-উম্মাদনাজাত নয়। বরং...আশ্চর্য! বলার মত নয়। কে বিশ্বাস করবে যে এটা ভালবাসার! শুনেছি ভালবাসার অনুভূতিগুলো নাকি সব যুগে, সব দেশে, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সবার একই। এও শুনেছি যে প্রত্যেকেরই তবু মনে হয় যেন এ শুধু সে-ই বুঝতে পারছে, এভাবে কেবল সে-ই অনুভব করছে। জানি না- হয়ত তা-ই। কিন্তু এই মূহুর্তে কেউ এসে আমার সামনে এই কথা বললে হয়ত আমি রক্তারক্তি-ই বাধিয়ে বসব। কারণ আমি এমন এক অবস্থায় আছি যে 'জানা' টাকে 'হৃদয়' নিতে পারছে না, পারছে না নিতে 'হৃদয়' টাকে 'কলম'। অদ্ভুত সমন্বয়হীনতা। আর তাই পড়েছি প্রেমে, চাই পেটাতে, ভাঙ্গতে, ধ্বংস করতে। আবার থেকে থেকে অনেকের ছবি মনে ভেসে উঠছে, তাদেরকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে- 'আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।' ঠিক যেমন মৃত্যুর কথা খুব ভাবলে অনেককে বলতে ইচ্ছে করে। তাই মনে হচ্ছে যেন আসলে আমার যন্ত্রণাটা মৃত্যুযন্ত্রণার ধরণের। আসলেই আমি মারছি, ভাঙ্গছি, ধ্বংস করছি কোন একটা 'আমি' কে'; জানি না কিভাবে, কেন, কোন দোষে।
আমি কাঁপছি- সত্যি কাঁপন,রূপক নয়। আমার হৃদয়টা রক্তে ভেসে যাচ্ছে- এ রূপক, তবে অনুভূতিটা এতই ঐরকম যে বলছি আসলেই তাই। হৃদয়টা যদি আসলেই একটা নির্দিষ্ট সাকার অঙ্গ হত তাহলে হয়ত তা হত-ও, কি ওটা যে ছড়িয়ে সমস্ত শরীরটাতে! আর তাই আমার হাত কাঁপছে, থেকে থেকে বুকের মধ্যে কি-টাকে যেন কে চেপে ধরছে, গলা দিয়ে আত্মা-পাখি বেরিয়ে যাচ্ছে ধরণের অনুভূতি। জানি- প্রেমের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে কিছু লিখতে বসেছি শুনে তথাকথিত রোমান্টিক ধরণের বা আমি বলব কিছু কিছু অ্যাক্সিডেন্টাল সত্য বাদ দিয়ে পুরোটাই বানানো,চাপানো ধরণের যে প্রেমে অস্থির দৃশ্যগুলো আপনাদের মনে ঢোকানো হয়েছে তার সাথে আমার নিজের অবস্থার বেশিরভাগটাই হয়ত যাচ্ছে না। অনেকটা ওইসব গানের মত আপনাদের এসব ঢোকানো চিন্তা-ভাবনা- কথাগুলো সুন্দর, কিন্তু যেটা আসলেই ছাপ রেখে যায় চিরতরে সেই সুরটাই ঠিক কথাগুলোকে ধরে না। কিন্তু কথার আমি নিকুচি করি। কথা দিয়ে সব বোঝানো গেলে আমার এই 'যন্ত্রণা'প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণা দিয়ে আমাকে আরও মারত না। এ প্রকাশ করা সম্ভব কেবল সুরে, কারণ ও-ও ঠিক পুরোপুরি ব্যক্ত নয়, বরং অব্যক্ত- ঠিক যেমন আমার এই যন্ত্রণা। আর তাই কথার বিচারে ঠিক না গেলেও আমার এই মূহুর্তের গান হল 'lonely nights'। মেয়েটার নাম সেঁজুতি- আসল নয়, কিছু একটা বলে খুব ডাকতে ইচ্ছে করছিলো- তাই। কিন্তু ও ফুল নয়, ও-ই গন্ধ। আসলে আমি বলতে চাই ও পিস্তল নয়, ও-ই বুলেট।
৩.
আহসানউল্লাহ হল, বুয়েট; রাত দুইটা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। ঝড় হচ্ছে। কালবৈশাখী না হয়েই যায় না- মাত্র পরশুই তো সবাই নববর্ষ উদযাপন করল। বারান্দায় পানির ছাঁট আসছে, আর আসছে হৃদয় এ ফোঁড়-ওফোঁড় করা বাতাস। ঝড়ো বাতাস হৃদয়ে আঘাত দিতে পারেনা এমন মানুষ বোধহয় নেই। আর আমার হৃদয়ে শুধু আঘাত নয়, রক্তাক্ত করে ছাড়ছে। বারান্দার রেইলিং-এ হাতের ভর দিয়ে এই প্রবল ঝড়ের মধ্যে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে ভিজতে দেখে হয়ত কারও কারও কাছে আমাকে অতৃপ্ত আত্মার মত কিছু মনে হতে পারে। মনে হওয়ার কিছু নেই;আমার সমগ্র অস্তিত্ব এখন আসলেই তাই। যৌবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যের একটা বোধহয় দুঃখবিলাস- কষ্ট কষ্ট সুখ। কিন্তু শপথ করে বলছি- এ সে নয়। আমি আর পারি না, সত্যিই পারি না। অসহ্য এ কষ্ট। চোয়াল শক্ত করে চোখ ফেটে আসতে চাওয়া কান্না রোধ করতে আমি আর পারি না।
দুর্ভাগ্যের শুরুর সেই রাতটার আগে তো সব ঠিকই ছিল। হল থেকে বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরতে দেরি হওয়ায় ফিরলাম সোজা বকশিবাজার, রাতের খাওয়াটা সেরে নেব বলে। ওহ্! কেন আরও দশটা মিনিট বেশি খেলাম না? খাওয়া শেষে কাউন্টারে ফিরে যাকে দেখলাম সে শুধু আমার দুনিয়াটা নয়, আমার মহাবিশ্বটাকে পর্যন্ত এক চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানি দেখাল। সৌন্দর্যে বজ্রাহত হওয়া যায়? যায় বোধহয়; আসলে বোধহয় নয়, নিশ্চয়ই যায়- নইলে আমার অবস্থাটা বোঝানোর সাধ্য যে অন্য কোন উপমার নেই! মন আমার যা-ই বিশ্বাস করতে চাক না কেন, আসল কথাটা হল এই যে আমি জানিনা ও-ও কেন আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকল। কেন তাকালে? শুধু যদি জানতাম যে ঐ চোখ ঝলসানো আলোর পরই আসবে অশেষ অন্ধকার, তাহলে আমি বরং দেখতামই না সেই আলো। মনের ভাবনাগুলো কেউ দেখতে বা জানতে পায় না বলে যে অসীম স্বস্তি সেই স্বস্তির সাথেই আবার মানুষের আজীবনের আক্ষেপও এই-ই। বেরিয়ে এসেই পুড়তে থাকলাম সেই আক্ষেপে- শুধু যদি জানতে পারতাম কি ছিল ঐ দৃষ্টির কারণ! সেটা তো আর সম্ভব নয়, তাই আক্ষেপ বুকে নিয়েই ফেরত আসতে হল। কেমন যেন নেশাগ্রস্থ,উদভ্রান্ত। ভদ্রতার নিকুচি না করে কিছু করার যো ছিল না- অন্তঃত আমাদের বাঙ্গালিয়ানার বিচারে। করাও হলনা। রাত গভীর হতে থাকল, আমার নেশাও বাড়তে থাকল। সব নেশারই যেমন ঘোর কাটে এটারও তেমনি যখন ঘোরটা একটু একটু করে কাটতে বসেছে- হঠাৎই একটা কথা মাথায় এল- এত রাতে বকশিবাজারে একটা মেয়ে-ওর মত একটা মেয়ে এল কোত্থেকে! সাথে অবশ্য আরও দু'জন ছিল। আচ্ছা ঠিক আছে- তিনটা মেয়েই বা এল কোত্থেকে? যাই হোক, ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিনও মাথায় ব্যাপারটা ঘুরছে। ঘুরছে যে সেটাও অবশ্য টের পেতে সময় লেগেছে। জানা আর বোঝার মধ্যে যে পার্থক্য- এও অনেকটা সেরকম। রাতে আবারও খেতে যাওয়া হল সেই বকশিবাজারেই। খেয়ে বের হতে না হতেই আবারও চোখ ঝলসানো আলো, আমি বজ্রাহত, ওর সেই দৃষ্টি, আমার সেই আক্ষেপ, সেই নেশা এবং সাথে সাথে এটাও আবিস্কার করা যে আমার মাথায় ওর চিন্তা ঠিকই ঘুরপাক খাচ্ছিল। হয়ত অবচেতন মনের সেই চিন্তাই আমাকে টেনে এনেছে আবারও এখানেই,এই সময়েই। মনোঃবিশ্লেষণ বাদ, উপস্থিত সমস্যা হল এই যে আমি বুঝতে পারছি না আমার কি হল! ভয়ের কারণ থেকে পালাতে চাইলে ভয় আরও আঁকড়ে ধরে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেল- ভদ্রতাবোধটুকু আজকের জন্য অন্য কাউকে ধার দিয়ে দিলাম। কথা বলবই। ফিরে তাকালাম আবার- আবারও আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট। হাজার ভোল্টের শক খেয়ে যেন মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে গেল। কিন্তু আমি মরিয়া। কি বলে কথা শুরু করব ভাবতে গিয়ে যখন এই লাইনের সবচেয়ে চোখা-চোখা,স্মার্ট কথাগুলো মনে এল,সাথে সাথেই পড়াশোনা শেষ করে চাকুরীজীবনে ঢোকা বাঙ্গালি ছাত্রদের মত বুঝতে পারলাম যে থিওরি আর প্র্যাক্টিক্যাল ফিল্ড পুরোপুরি দুই আলাদা জগৎ। কিন্তু চাকরীর চেয়েও এই ক্ষেত্রটা আরও ভয়াবহ- ওরা চায় চোখা কথাবার্তা, কিন্তু চাকরীর মত এখানে পূর্ব-অভিজ্ঞতা কোন এক্সট্রা কোয়ালিফিকেশন হিসেবে কাউন্ট করা হয় না, বরং ডিসকোয়ালিফাই-ই করে। যদিও আমার ক্ষেত্রে সমস্যা ঠিক সেটা নয়। যাই হোক সমস্ত ইচ্ছাশক্তিকে একত্র করে শেষপর্যন্ত যে সময়টুকু ধরে কথা হল সেটা যেন কেটে গেল একটা লাজুক বাচ্চার জীবনে প্রথমবার মঞ্চে উঠে পুরস্কার নেয়ার সময়ের মত- আমি জানি আমাকে খেয়াল করা হচ্ছে, সবাই দেখছে আমাকে, আমিও উঠতে চাওয়ার কারণেই কাজটা করেছিলাম- কিন্তু মূহুর্তে আড়ষ্ট হয়ে সমস্ত অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছি। শুধু এটাই জানতাম না যে আমি পুরস্কার নিতে উঠিনি, উঠেছি সর্বগ্রাসী হাহাকার বয়ে নিয়ে যেতে।
যতটুকু কথা হয়েছে তাতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই, নেই কিছু আশারও। অত্যন্ত সাদাসিধে কথা-বার্তা, নাম জানা-জানানো এসবই। সারপ্রাইজিং ছিল একটা ব্যাপারই- জানা যে ও ভারতীয়। কিন্তু এ-ও কিছুই নয়। আমি যেন অবশ হয়ে চলে এলাম। শুধু যেন মনে হতে থাকল- এর সবটাই অসাধারণ। আসল নাম ছাড়া আর হচ্ছে না। ও খুশবু, ও পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে, ও ভারতীয়, ও আমার সাথে কথা বলল- অসাধারণত্বে কোনটা যেন কারও চেয়ে কম নয়। এদেশের নয় জানাটা হল আগে, নামটা জিজ্ঞেস করা হল পরে। নাম জিজ্ঞেস করতে যখন পরিস্কার বাংলায় বলে উঠল- 'আমি খুশবু', খুবই অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম- 'আপনি বাংলা বলতে পারেন?' সে প্রশ্নের উত্তরে না-বোধক মাথা ঝাকানোটা ছিল অনেকটা লজ্জার সাথে অপরাধ স্বীকার করার মত। এবং আমার স্মৃতিতে ঐ ফ্রেমটা আটকা পড়ে গেল আজীবনের জন্য। যে অস্থিরতায় সারাটা পথ, সারাটা রাত কেটেছে সেটা প্রকাশ করতে চাওয়ার মত বোকামি বোধহয় আর কিছু হয় না। যারা সেটা কখনও অনুভব করেছে তাদের সেটা ভোলার নয়- প্রতিটা মূহুর্তে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ দিয়ে দিয়ে সেটা তাকে আজীবনের জ্ঞান দিয়ে যায়, আর যারা সেটা কখনও অনুভব করেনি তাদেরকে বোঝাতে যাওয়া আমাকে এই মূহুর্তে খুশবু-কে ভুলতে বলার মত। আমি জানি কতটাই সে বৃথা। দিন-রাতের দৈর্ঘ্যের সমস্ত জানা হিসেব ভুল করে দিয়ে যখন আবার পরের রাতটা এল আমি যেন অনেকটা খবরবাহী পায়রার মত করে বকশিবাজারে পৌঁছানোটাকেই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বানিয়ে ছুটে গেলাম।
রাত দশটা। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি ঢাকা মেডিকেল এর মেয়েদের হল থেকে বকশিবাজারে বের হওয়ার গেটটাতে। ওখানে দাঁড়িয়ে মনে হল যেন ঠিক এখানেই গতকাল আমার আত্মাটাকে ফেলে চলে গিয়েছিলাম এবং সেই টানে আমি জায়গাটার সাথে বাঁধা পড়ে গিয়েছি, আজীবনের তরে। খোদা সাক্ষী আমি প্রেমে পড়েছি। শুনতে চাই না তোমাদের বুদ্ধিমান-বোকা তত্ত্ব, জানতে চাই না ন্যায়-অন্যায়। বলে দেখ- 'অযৌক্তিক'; আমি অভিশাপ দেব- ভালবাসার যুক্তিতত্ত্ব নামের নন্-ক্রেডিট কোর্স টার পরীক্ষা তোমারও যেন আমার মতই বিনা-প্রস্তুতিতেই এমন করে দিতে হয়। একের পর এক সিগারেট, কাপের পর কাপ চা। সময়ের হিসেব নিয়ে এমন দ্বন্দে আমি আগে কখনও পড়িনি। কেন ওকে এখনও দেখতে পাচ্ছিনা ভেবে সময়টাকে মনে হচ্ছিল বড় দীর্ঘ, আবার সময়টা যতই বারোটার দিকে গড়াচ্ছে ততই ওর না বের হওয়ার সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে মনে হচ্ছিল যেন এ বড় দ্রুত ছুটছে।
চায়ের দোকানের ছেলেটার নাম আরিফ। খুব ইচ্ছে করছিল ওকে আমার সমস্ত কথাটা বলতে,ওকে মনে হচ্ছিল বড় আপন- ও যে এখানেই থাকে। আর পারছিলাম না স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে। খুব ইচ্ছে করছিল ওদের হলের সামনে চলে যেতে। হলটার সামনে দাঁড়িয়ে যখন ভাবলাম ও ঐ জানালাগুলোরই কোন একটাতে দাঁড়াতে পারে, পা দু'টোতে যেন লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া টাইপ কিছু ঢোকানো হল, মাথাটাতে মদ, বুকটাতে যে কি আমি জানিনা, তবে সেখানে ডাবল্ বেইস প্যাডেল কেউ নিশ্চয়ই বাজাচ্ছিলো। হলের বাইরে কিছু জুটি এখানে-ওখানে বসে ছিলো। ওদেরও বড় আপন মনে হচ্ছিল। আবার হিংসাও হচ্ছিল ওদের দেখে। আর হলটাকে যে কি মনে হচ্ছিল বলে বোঝাতে পারব না, তবে এটা জানি যে এখন থেকে আমি চাইব আমার বেহেশ্তের বাড়িটা যেন
দেখতে ওমনই হয়।
হঠাৎ করে মনে হল যেন ওরা সবাই জানে আমি কেন এখানে দাঁড়িয়ে, হয়ত সবাই মনে মনে হাসছে আমাকে নিয়ে, ভাবছে কত নির্বোধ আমি! আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। হাটতে হাটতে চলে গেলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেইন গেট টাতে। অস্থিরভাবে সিগারেট টানছি, তাকিয়ে আছি গেট টার উপরের নাম ফলকটার দিকে। নামটা মনে হল আশ্চর্য ছন্দময়, ফন্টের ক্যাটক্যাটে হলুদটাকে মনে হল আশ্চর্য সুন্দর। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁইছুঁই করছে। আবার ঢুকে হলটার সামনে দিয়েই এলাম- আত্মাটাকে যেন ওখানে ছিঁড়ে রেখে এলাম। তারপর থেকে একে একে সাতদিন। প্রতিদিন একই ঘটনার চক্র। এ অস্থিরতার যেন শেষ নেই। আমার আত্মাটা যেন অতৃপ্ত অশরীরী কিছুর মতই ওখানে ঘুরে বেড়ায় সারাদিন। রাতে যাই তার খোঁজ নিতে। চায়ের দোকানটাতে বসে অপেক্ষার সময়গুলো কাটে কলজে-ছেঁড়া কষ্টে, কানে বাজে একটাই সুর- 'আবেগী এমন রাতে, ভুল করে এই পথে, এসে যদি ফিরে যায়, আমায় না পেয়ে...'- টানটা যেন আমার হৃদয়ের বসন্তের আমবাগানে গ্রীষ্মের কালবৈশাখীর তান্ডব চালায়, ফুলগুলো অকালে যাচ্ছে ঝরে, ভবিষ্যতের নিকুচি করে। তবু আমার অপেক্ষা থামে না- যেন সারারাত জেগে থাকার জন্য দুঃখ কিনতে যাই, যাই যেন সেই ফ্রেমটাকে রিফ্রেশ করার আশায় যা বারবার মনে মনে দেখতে দেখতে গেছে ঝাপ্সা হয়ে, শুধু ভঙ্গিটাই গিয়েছে রয়ে, আর অস্থির অনুভূতির বোঝা। যাই হয়ত একবার শুধু ওকে জানানোর আশায় যে তুমি আমার সকালটাকে সন্ধ্যা করে দিয়েছ, লাল টাকে কালো। অথবা আমার সমস্ত কষ্ট-ব্যাকুলতা চাপা দিয়ে শুধু একটামাত্র অক্ষম কথা বলতে- 'তুমি এতদিন আসোনি কেন?'। এর কিছুই হয়না, হয় শুধু বিষ খাওয়া ইঁদুরের মত যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে নিজের ডেরায় ফিরে আমার মৃত্যুকাতর যন্ত্রণা, মরা, পঁচা।
৪.
এর পরে এবং শেষের আগেটা জুড়ে শুধু মৃত্যুদন্ডের রায়ের মত একটা বাক্যেরই অস্তিত্ব; মেডিকেল কলেজের-ই এক বন্ধুর কনফার্ম করা- ওই নামের,ওই বর্ণনার সাথে মেলে এমন কেউ ওখানে পড়ে না।
শব্দ বড় অক্ষম- পারল না হতে আমার যন্ত্রণার দূত। ওর নেই সে ক্ষমতা- আমার যন্ত্রণাগুলোকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে তোমাদের সামনে ফেলার। পারত হতে সুর। কষ্টের রঙ সুরে, খিঁচুনিটাকে ছন্দে- পারতাম যদি এভাবে বের করতে- কাঁদতে তোমরাও কাঁদতে, হুহু করে কাঁদতে। দেখতে চেয়ে কান্নার নোনাজলের পরিবর্তে কখনও যে বেরোয় রক্ত-ও। সহ্য হয় না আর এ দমকা বাতাস। বড় বেশি অনুনাদ তোলে হৃদয়ে- কাঁপুনিটা যে মিলে যায়! ইচ্ছে করে জিজ্ঞেস করি- 'পারতি না তুই এমন করে ওর হৃদয়েও ঝড় তুলতে?'। পারেনা, ও পারেনা। পারে শুধু আমাকে হুহু করে কাঁদতে দেখতে, পারে আরও উস্কে দিতে। পারেনা আমার কষ্টের খবর ওকে দিতে। পারি না, আর পারি না। উঠুক ঝড় আরও, লন্ডভন্ড হয়ে যাক সব। তোরা সব আমার হৃদয়ের ঝড়ের রূপ দেখে মর। তোদের বধ্যভূমিতে আমি পিশাচের মত হেটে বেরাব, হাসব অট্টহাসি। তোরা সব বড় বেশি সুখী- মর তোরা, সবাই মর। অথবা এনে দে আমার খুশবু-কে।
এহসান
মন্তব্য
সুন্দর। চলতে থাকুক!
জহিরুল ইসলাম নাদিম
যে পেয়েছে এই যাতনা সেই জানে , কতটা খড়ে কতটা গোয়ালের দিশা মেলে ।
নতুন মন্তব্য করুন