গোটা সিবিল-পরিবারই যেন দিশা হারিয়ে ফেলেছে। সবাই একসঙ্গে আকুল হয়ে উঠেছে পাণিপ্রার্থীটিকে দেখতে। সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছেন সিবিলের মা। তাঁর স্বপ্ন ছিল সিবিল একদিন বড় অভিনেত্রী হবে। তিনি মেয়ের জন্য অন্য আর সবকিছুর পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। শুধু বিয়েটা ছাড়া।
‘মা, আমি এত্ত খুশি!’ ক্লান্ত, ম্লান চেহারার মায়ের কোলে মুখ গুঁজে দিয়ে সিবিল ফিসফিস করে বলল। মলিন একটা ঘর। সিলিং থেকে ঝোলা বাতিটি কর্কশ আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। সিবিলের মা বাতির দিকে পেছন ফিরে একটি চেয়ারে বসে আছেন।
মিসেস ভেন তাঁর চিকন চিকন সাদা দুটি হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন মেয়ের মাথায়। ‘খুশি!’ যেন সিবিলের কথাটাই ফিরিয়ে দিলেন। ‘সিবিল, শুধু তুই অভিনয় করলেই আমি খুশি। তোর আর অন্য কিছু ভাবার দরকার নাই। মি. আইজ্যাক বড়ই দয়ালু। আর তিনি আমাদের কাছ থেকে টাকাও পাওনা আছেন অনেক।’
‘টাকা, মা?’ ঘেন্নায় ঠোঁট ওলটাল মেয়েটি। ‘টাকায় কী আসে-যায়, মা? টাকার চেয়ে প্রেমের দাম অনেক বেশি!’
‘কী জানিস তুই ওই ছেলেটা সম্পর্কে? ঠিক করে তার নামটা পর্যন্ত বলতে পারিস না! সে যা হোক, আমি যেমনটা আগেও বলেছি, সে যদি সত্যিই ধনী হয়ে থাকে...’ মিসেস ভেন তাঁর প্রস্তাবটি যেন শূন্যে ভাসিয়ে দিলেন।
‘মা, তুমি কেন যে এত টাকার কথা ভাব? আমি শুধু ভালোবাসার কথাই ভাবতে পারি,’ সিবিল বলল। ঝকঝকে চোখ দুটো তুলে তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে।
হ্যাঁ, সিবিল যদি সত্যিই তেমন পাত্র বেছে নিয়ে থাকে, তাহলে আরেকটু বেশি ভদ্রলোক হয়ে ওঠা যাবে—মনে মনে ভাবছিলেন মিসেস ভেন। প্রেমে পড়া মেয়ের প্রতি এখন তাঁর একটাই প্রশ্ন বাকি আছে। যুবকটি কি ধনী? সিবিল তার মাকে আশ্বস্ত করল যে তার বাগদত্ত প্রিন্স চার্মিং একজন চমৎকার তরুণ ভদ্রলোক। সে একই সাথে ধনী আর অসাধারণ।
ঠিক তক্ষুনি দরজাটা খুলে গেল। কর্কশ, বাদামি চুলের একটা ছেলে ঘরের ভেতর এসে ঢুকল। ছেলেটার নাম জেমস ভেন, সিবিলের ভাই। গাট্টাগোট্টা আর বেঁটে ধরনের। চলাফেরায় অপটু, হাত-পা বড় বড়। সে একটুও তার বোনের মতো নয়।
সে তার লোভী মায়ের মতোও নয়, যাকে সহজে পটানো যায়। তবে সে সিবিলের খুব ভক্ত। তার মনে একটাই ভয় সিবিলের বাগদত্ত কোনো বখে যাওয়া টাকার কুমিরই হবে। হয়তো ওই লোকটা তার বোনের দুর্বলতা থেকে ফায়দা ওঠাতে চায়। এতই যখন ধনী তাহলে সে কেন বিয়ে করবে তার চেয়ে অনেক নীচু শ্রেণীর একটি মেয়েকে? অনায়াসেই তো সে অভিজাত পরিবারের কোনো মেয়েকে সঙ্গীনী হিসেবে পেতে পারে!
জেমস ভেন তার বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে তন্ন তন্ন করে কিছু খোঁজে। ‘তোকে নিয়ে একটু হাঁটতে যাব, সিবিল। আজই আমি অস্ট্রেলিয়া রওনা হবো। আশা করি এই জঘন্য লন্ডন শহরটা আর দেখতে হবে না!’
‘দাঁড়াও, কাপড় ছেড়ে আসি। এক্ষুনি ফিরব।’ সিবিল সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে বলল।
‘আহ্, জেমস,’ মায়ের কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি। ‘আমি চাই না তুই বিদেশে যা। এর চেয়ে কেরানির কাজ করাও অনেক ভালো। উকিল হওয়াটাও খারাপ না, অন্তত ভদ্রলোক বলে পরিচয় দেয়া যায়। আমার ভাবতে খারাপ লাগে যে তুই শুধু অস্ট্রেলিয়া যেতে চাস। কী আছে ওখানে? কলোনি দিয়ে ভরা একটা দেশ। আমার তো মনে হয় না সেখানে সমাজ বলতে কিছু আছে!’
‘অফিস আর কেরানি। কেরানি আর অফিস। ঘৃণা করি এগুলোকে,’ জেমস উত্তরে জানাল। ‘আমি আমার নিজের জীবন ঠিক করে নিয়েছি। আমি শুধু বলতে চাই তুমি সিবিলকে দেখে রাখবে, মা। তার কোনো ক্ষতি যেন না হয়। মা, তুমি তাকে অবশ্যই রক্ষা করবে।’
‘জেমস, তোর কথাবার্তা কী অদ্ভুত! অবশ্যই আমি আমাদের সিবিলকে দেখে রাখব।’
‘শুনেছি, কে এক ভদ্রলোক সিবিলের পেছনে ঘুরঘুর করছে! প্রতিদিনই থিয়েটারে যায়। মঞ্চের পেছনে গিয়ে বসে থাকে সিবিলের সাথে কথা বলার জন্যে। তার ব্যাপারটা কী?’
মিসেস ভেন তাড়াতাড়ি ব্যাখ্যা করলেন যে যুবকটি সত্যিকারের একজন ভদ্রলোক। এবং এ ব্যাপারে তাঁর মনে কোনো সন্দেহই নেই। ‘সে যথেষ্ট নম্র,’ তিনি বললেন, ‘সে একই সাথে ধনী এবং সংস্কৃতিমনা।’
‘তোমরা তার নামটা পর্যন্ত জানো না।’ জেমসের মুখ তিক্ত হয়ে উঠল কথা বলতে গিয়ে।
‘না,’ মুখে শান্তভাব ধরে রেখে মিসেস ভেন সায় দিলেন ছেলের কথায়, ‘সে এখনও তার আসল নাম প্রকাশ করেনি। তবে বোঝা যায় অভিজাত সমাজের কেউ হবে। আর সে যদি সত্যিই ধনী হয়, তাহলে,’ ধূর্ত ইঙ্গিত ফুটে উঠল তাঁর কণ্ঠে, ‘কেন সিবিল তাকে বিয়ে করবে না।’
জেমস ভেন ঠোঁট কামড়ে ধরল। ‘সিবিলকে দেখে রাখবে মা,’ সে আবার বলল, ‘দয়া করে তাকে দেখে রাখবে।’
‘বেটা, তোর এ ধরনের কথায় আমি কষ্ট পাই। সিবিলকে তো আমি সব সময়ই যত্নে রাখি। সত্যিই যদি ওই পাণিপ্রার্থী যুবকটি ধনী আর ভদ্রঘরের হয়, তো মেয়েকে তার কাছে তুলে দিতে আপত্তি কোথায়? আমাকে বলতেই হচ্ছে, এটা একটা চমৎকার বিয়ে হবে। দুটোকে যা মানাবে না! সবাই ব্যাপারটা লক্ষ করেছে। ছেলেটার সুন্দর চেহারা সত্যিই মনে রাখার মতো।’
জেমস বিড়বিড় করে কী যেন বকল। হাত দিয়ে জানালায় ঘুষি মেরে ঘুরে দাঁড়াল শক্ত কিছু বলার জন্য। কিন্তু সিবিল চলে এসেছে।
‘তোমরা দু জনেই এত গম্ভীর!’ সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী হয়েছে?’
‘কিছু না,’ জেমস গজগজ করে উত্তর দিল, ‘এমন কিছু কিছু সময় আসে যখন গম্ভীর থাকাই ভালো। আসি মা, বিকেল পাঁচটার মধ্যে ফিরে এসে ডিনার করব। সব গোছগাছ করা আছে।’
‘আয়, সিবিল,’ তার ভাই যোগ করল, ‘আমাদের হণ্টন পর্ব শুরু করি।’
***
বাইরে রৌদ্র-ছায়ার লুকোচুরি, বাতাস বইছে একটানা। বিষণ্ন ইউস্টন রোড ধরে দু ভাই-বোন ধীরে-সুস্থে হেঁটে চলেছে। পথচারীরা যেতে যেতে ঘুরে তাকায় এই ব্যতিক্রমী জুটিটির দিকে—একটি গোমড়ামুখো নীরস যুবক, অন্যটি লাবণ্যময়ী, মার্জিত তরুণী। মনে হয় যেন বাগানের একটি গোলাপ ফুল তার মালীর সাথে হাঁটছে।
সিবিল কিন্তু তার ভাইয়ের ভাবান্তর লক্ষ করেনি। সে হাসছিল, ভাবছিল প্রিন্স চার্মিং-এর কথা, কখন আবার তাকে দেখতে পাবে। তার ভাই জেমসও বোনের পাণিপ্রার্থীটি সম্পর্কে ভাবছিল।
‘শুনলাম একটা নতুন বন্ধু জুটিয়েছিস। কে সে? তার কথা আমাকে কেন বলিসনি? নিশ্চয়ই তার মনে কোনো কুমতলব আছে,’ দাঁত খিঁচিয়ে বলল জেমস।
‘ব্যস, জিম!’ যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল সিবিল। ‘তার নামে কিচ্ছু বলবি না। আমি তাকে ভালোবাসি।’
‘কেন? তার নামটা পর্যন্ত জানিস না তুই!’ তার ভাই উত্তর দিল। ‘কে সে? আমার সেটা জানার অধিকার আছে!’
‘আমি তাকে ডাকি প্রিন্স চার্মিং নামে। তোর পছন্দ নয় নামটা? তুই যদি শুধু তাকে দেখতি,’ সিবিল বলল, ‘দুনিয়ার সবচেয়ে অসাধারণ ব্যক্তি মনে করতি তাকে। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এসে তার সাথে দেখা করবি। আজই যদি থিয়েটারে আসতে পারতি! সে ওখানে আসবে।’
‘আমি চাই সাবধান থাকবি তার কাছ থেকে,’ হুঁশিয়ার করল জেমস। বোনের খুশির জন্য তার মরিয়া ভাব প্রকাশ পেল। ‘যদি তোর প্রিন্স চার্মিং কখনও আঘাত করে তোকে,’ গর্জন করল সে, ‘শপথ করে বলছি তাকে খুন করব আমি!’
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
ছবি-কৃতজ্ঞতা : www.crisortega.com
কুটুমবাড়ি
মন্তব্য
এ পর্বটা চমৎকার লাগলো।
ধন্যবাদ।
কুটুমবাড়ি
চমৎকার অনুবাদ আর গল্পটাও
কিন্তু পর্বে পর্বে ভাগ করা গল্প পড়া বেশ মুশকিল
পারলে সবগুলো একসাথে দিয়ে দেন না
ধন্যবাদ, লীলেনদা।
আরও পনেরো পর্ব বাকি। কী করা যায় ভাবছি!
কুটুমবাড়ি
বাহ।
ধৈর্য্য নিয়ে গোটা একটা ক্লাসিক অনুবাদ- দারুন।
অনুবাদ প্রায় সময়ই থ্যাংকসলেস জব। তবু কাউকে না কাউকে তো করতেই হয়।
আপনি আপনার মতো পুরোটা শেষ করুন। তারপর একটা ই-বুক করে ফেলেন।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
ধন্যবাদ, মোরশেদ ভাই। সাহস প্লাম।
কুটুমবাড়ি
দারুণ কাজ।
চালিয়ে যান।
শুভেচ্ছা রইল।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ধন্যবাদ, তুলিরেখা।
কুটুমবাড়ি
নতুন মন্তব্য করুন