রিকসা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১২/০৭/২০১০ - ৪:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

- অনন্ত আত্মা

রিকসা নিয়ে লেখার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের, কিন্তু নানা ব্যস্ততায় লেখা হয়ে ওঠে না। আজ সেই রিকসা নিয়ে যখন লিখতে বসেছি, রিকসার শহর থেকে তখন আমি অনেক দূরে। যখন থেকে সিগারেট ধরেছি, তখন থেকেই রিকসার ব্যপারে আমার বিশেষজ্ঞ হওয়ার শুরু অর্থাৎ কিনা সিগারেট খেতে সেলিম ভাই এর দোকানমুখী হওয়া আর সেলিম ভাই এর দোকানের মূল কাস্টমার এলাকার সমস্ত রিকসাওয়ালা। ‘মাহাজন’, ‘দিন’, ‘গেরেজ’, ‘এ্যাকসেল’, ‘টাল’ – রিকসা সম্পর্কিত এসব টার্মের সাথে পরিচয়ের সাথে সাথে রিকসাওয়ালাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথেও চেনা-জানা হয়ে যায় আমার। যাই হোক আজাইরা কথা বাদ দিয়ে রিকসা নিয়ে আমার মজার কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যাক।

দুইজন রিকসাওয়ালাকে বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত নবীন (জোয়ান মরদ আর কি) রিকসাওয়ালাকে নিয়ে বাসা থেকে বাসষ্ট্যান্ডে রওনা হয়েছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বুঝতে পারলাম কি ভুল করেছি। নিতু (আমার ছোট বোন) কে বললাম –
- হইছে কাম!
নিতু বলল –
- কি হইছে?
আমি আস্তে আস্তে বললাম –
- এই পাবলিক তো রিকসা চালাতে জানে না।
- হ তোমারে বলছে, তুমি ক্যামনে জানলা?
- ক্যান দেখিস না ওর পায়ে স্যান্ডেল নাই।
- স্যান্ডেল না থাকলে রিকসা চালাতে জানে না, এই কথা কে বলছে?
- আমি বললাম দ্যাখ তাইলে –
এরপর রিকসাওয়ালাকে বললাম –
- তোমার কি আইজ নিয়া তিনদিন?
রিকসাওয়ালা পিছন ফিরা বলল -
- না, মামা; দুই দিন হইছে।

রিকসোপদেশ (রিকসা সম্পর্কিত উপদেশ): স্যান্ডেলবিহীন রিকসাচালকের রিকসায় নিজ দায়িত্বে উঠুন, কারন এরা নবাগত। তবে রিকসা ভ্রমনে আপনিও যদি নবাগত (যদিও এই সম্ভাবনা খুবই কম) হন, তাহলে তো সোনায় সোহাগা, নিশ্চিন্তে উঠে যান।

যাই হোক সেইদিন আল্লাহর রহমতে আমরা দুই ভাই-বোন ছাল-বাকল সহই রিকসা থেকে নামতে পেরেছিলাম।
আরেক দিনের ঘটনা, বাসষ্ট্যান্ড থেকে একাই ফিরছিলাম। টুকিটাকি কিছু কেনার ছিল, ভাবছিলাম সামনের মোড়ের বাজারে দুই মিনিটের জন্য রিকসা থামিয়ে কিনে নিলেই হবে। মোড় ঘুরতেই লাফ দিয়ে রিকসা থেকে নামতে নামতে রিকসাওয়ালাকে বললাম –
- সাইড কইরা দুই মিনিট খাড়াও, আমি আইতাছি।
কেনাকাটা শেষ করে বাজার থেকে রাস্তায় এসে রিকসাওয়ালাকে তো আর খুঁজে পাই না। এদিকে তাকাই, ওদিকে তাকাই, মাথায় গামছা প্যাচানো আমার রিকসাওয়ালাকে আর খুঁজে পাই না। শেষতক হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ এসে অন্য একটা রিকসায় বাসায় ফিরলাম। বেচারা রিকসাওয়ালার জন্য মনটা খারাপই লাগছিল, কিন্তু কি আর করা।

তিন-চার দিন পরের কথা, অফিস আওয়ার – রিকসা আর পাই না। হাঁটতে হাঁটতে বাসা থেকে বাজার পর্যন্ত অর্ধেকটা পথ প্রায় চলেই এসেছি। বাজারে এসে দেখি মোটামুটি মচ্ছব, প্যাসেঞ্জারের অভাব নাই কিন্তু রিকসার প্রচন্ড অভাব। অনেক দূরে একটা খালি রিকসা দেখে ওকেই টার্গেট করে আগাচ্ছিলাম, ওপস্ দুই পাবলিক দেখি ওই রিকসাওয়ালাকেই ধরেছে। এরপর দেখি ওই রিকসাওয়ালা ঐ দুজন (অথবা দূর্জনদের)কে না নিয়ে আমার দিকে আসছে, দূর থেকেই চিৎকার করলাম –
- ঐ বাসষ্ট্যান্ড যাবা?
- হ যামু।
ভাড়ার চিন্তা না করে হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লাম। রিকসায় উঠলে সচারচর আমি রিকসাওয়ালাদের সাথে কথা বলি। অনেক সময় বয়স্ক রিকসাওয়ালারা নিজ থেকেই কথা শুরু করে। যাই হোক, কিছু দূর আসার পর, রিকসাওয়ালা নিজ থেকেই কথা শুরু করল –
- ভাই ঐ দিন আপনে কই গেলেন?
আমি বললাম –
- মানে?
- ঐ দিন বাসষ্ট্যান্ড থেইকা আপনেরে লয়া আইতাছিলাম না?
হঠাৎ করে আমি বুঝতে পারলাম, এ আমার সেই হারানো মানিক, মানে হারানো রিকসাওয়ালা। এরপরের কাহিনী রিকসাওয়ালার জবানীতেই লিখছি।
‘আপনেরে লয়া তো রওনা হইলাম, কদ্দুর যাওনের পর এক ভদ্রলোক কয় – ঐ খালি যাইবা? মনে মনে কই ব্যাডায় পাগল নাকি, প্যাসেঞ্জার লয়া যাইতাছি আর আমারে কয় – ঐ খালি। আরো কদ্দুর যওনের পর আরো দুই জন লোক কইল ‘ঐ খালি যাইবা? আমি তহন পেরায় পৌছায় গেছি। হঠাৎ কইরা কি মনে কইল, পাছের দিক চাইলাম, দেহি আপনে নাই্। এত ক্ষন ধইরা খালি রিকসাডারে পঙ্খীরাজের মত উড়ায়া লয়া আইছি।’

রিকসোপদেশ (রিকসা সম্পর্কিত উপদেশ): রিকসাওয়ালার কর্ন-মস্তক যদি গামছা দিয়ে প্যাচানো দেখেন, তাহলে পথিমধ্যে ক্ষনিকের তরে নামিবার প্রয়োজন হইলে, রিকসাকে পথপার্শ্বে পরিপূর্নরূপে নিশ্চল করিয়া এরপর নামুন এবং কখনোই শ্লথ রিকসা হইতে লম্ফ দিয়া নামিবেন না, ইহাতে আপনি যেইরূপ আসাবধানতাবশতঃ অনাগত দূর্ঘটনা হইতে বাঁচিবেন, সেইরূপ রিকসাওয়ালাও যাত্রা শেষে আপনাকে রিকসাতেই সমাসীনরূপে দেখিয়া বাঁচিবে।

এ ধরনের ঘটনা আমার যে প্রথম এবং শেষবারের মত ঘটল তা না, আরো একবার মোটামুটি একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল, কিন্ত এ ঘটনার মত Happy Ending মানে ‘কিছুকাল পরে যাত্রীকে রিকসাওয়ালা পুনরায় ফিরিয়া পাইল’ ধরনের কিছু হয় নাই।
অনেক সময় স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির মুখোমুখি হতে হয়। আমাকে যখন অনুরোধ করা হয়, প্রায়শই এই ঘটনা দুটির যেকোন একটি বলতে শুরু করি, এবং উপসংহারে বলি – যেই ভদ্রলোক রিকসার প্যাসেঞ্জার ছিলেন উনি হচ্ছি আমি, রক্তদান কর্মসূচির লোকজন আমার প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। যেই লোক রিকসা থেকে নেমে গেলে রিকসাওয়ালা টের পায় না, তার কাছ থেকে রক্ত নেয়ার বিপদের কথা যে কেউই পরিস্কার বুঝতে পারে।

onnajagat@yahoo.com


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি

সেই পুরনো তোকে ফিরে পেলাম। ইচ্ছেমতো নিয়মিত লিখতে থাকিস। তবে যাচ্ছেতাই না কিন্তু চোখ টিপি

অতিথি লেখক এর ছবি

আসলে আমার ধারনা গদ্য সাহিত্য আমাকে দিয়ে হয় না, যে কারনে সাহস করি না কখনো, কেন জানি না এবার সাহস করে ফেললাম। তোর ভাল লাগল জেনে আমার আরো ভাল লাগল। আর মূলতঃ আমি তো নিজের জন্যই সব সময় লিখতাম তাই কারো ভাল বা মন্দ লিখার ধার আমি ধারতাম না, যা মনে চাইত তাই লিখতাম। হয়ত করো কারো কাছে সাহিত্য মানের ব্যপারে এসব নাখাস্তা মনে হতে পারে, সেটা একান্তই ব্যক্তি সাধারণের আভিব্যক্তি। আমি নিতান্তই নিজের জন্য লিখি, আর সারা জীবন তাই লিখতে চাই।

অনন্ত আত্মা

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

সাহিত্য লিখতে হবে না, গদ্য হলেই চলবে। নিজের জন্য লেখাগুলোই ভালো হয়। ফরমায়েশি লেখায় স্বাদ কম। সেজন্যই বলি-- জোর করে না লেখাই ভাল।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল্লাগছে!

জহিরুল ইসলাম নাদিম

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ নাদিম ভাই, আপনার লেখাও আমি অনিয়মিতভাবে পড়ি যদিও নিজের সীমিত সাহিত্য জ্ঞানের জন্য কখনোই মন্তব্য করা হয়ে ওঠে না।

অনন্ত আত্মা

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ অ আ!
এখন থেকে নিয়মিত ভাবে পড়া আর মন্তব্য করা যায় না?!?

অতিথি লেখক এর ছবি

সু-স্বাগতম (most welcome এর বাংলা করলাম)। নিয়মিতভাবে পড়ার প্রচেষ্টা থাকবে ইনশাল্লাহ্, আর মন্তব্য করার দুঃসাহস ও করব, কথা দিলাম।।

অনন্ত আত্মা

অতিথি লেখক এর ছবি

১ নম্বর উপদেশটা দারুন লাগলো

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।

বাউলিয়ানা এর ছবি

হা হা হা...দারুন দারুন চলুক

এরকম লেখা আরও চাই।

সিলেট শহরের রিক্সা নিয়ে কেউ যদি লেখা দিত তাইলে বুঝা যাইত রিক্সার কাহিনী কারে কয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।
রিকসা নিয়ে আরো ২/১ টা লেখার পরিকল্পনা আছে। দেখা যাক ..
সিলেট শহরের কথা যেটা জানি সেটা হচ্ছে - সিলেটে রিক্সাওয়ালাদের, রিক্সা-ড্রাইভার না বললে নাকি ওনারা মাইন্ড করেন। মফস্বলের রিক্সাওয়ালাদের নিয়েও আমার কিছু কাহিনী আছে, সময় পেলে (ব্রা-ঝিলের পেলে না কিন্তু, পাইলে লিখলে বেশী শুদ্ধ হত) লেখার আশা রাখি।

অনন্ত আত্মা

রফিক এর ছবি

রিকসায় চইরা ভাড়া না দিয়া পালানোর কৌশলটা তাহলে আপনার ভাল জানা আছে দেখছি।

Rafiqulislamrafiq@rocketmail.com

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই আমি তো পালাই না, রিকসাই পালায় যায়। আপনি হয়ত বলবেন আমি হারায় যাই; ভাই আমি হারাই না আমার রিকসা হারায় যায়।
মন্তব্যর জন্য ধন্যবাদ।

অনন্ত আত্মা

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

রিকশা নিয়ে আপনার অবসার্ভেশন বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো...

আপনার রক্তদান কর্মসূচীর কথাতেও মজা পেলাম...

_________________________________________

সেরিওজা

অতিথি লেখক এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ।

অনন্ত আত্মা

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

রিকশা আমার খুব পছন্দের যান। আর আপনার লেখাও চালিয়ে যান। হাসি

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাদের ভাল লাগলে নিশ্চয়ই লিখব।
ধন্যবাদ।

অনন্ত আত্মা

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- হা হা হা
বেশ মজা করে লিখেন আপনি। হাসি

কিন্ত, আপনি কি সত্যি সত্যিই রিক্সা চালকদের 'তুমি' করে বলেন! চিন্তিত
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

অতিথি লেখক এর ছবি

যখন যেমন, তখন তেমন; কখনো তুমি, কখনো আপনি, মেজাজ খারাপ হলে তুই। ব্যাপার না। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

অনন্ত আত্মা

অনুপম মল্লিক এর ছবি

সেলিম ভাই এর দোকানমুখী হওয়া আর সেলিম ভাই এর দোকানের মূল কাস্টমার এলাকার সমস্ত রিকসাওয়ালা। ‘মাহাজন’, ‘দিন’, ‘গেরেজ’, ‘এ্যাকসেল’, ‘টাল’ – রিকসা সম্পর্কিত এসব টার্মের সাথে পরিচয়ের সাথে সাথে রিকসাওয়ালাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথেও চেনা-জানা হয়ে যায় আমার।

জোশ হইছে।
গুরু আবার হবে বিনিময়, মতের, ভাবনার, আর অনেক অব্যক্ত আবেগের।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।