এখন সময় যেমন

সজল এর ছবি
লিখেছেন সজল (তারিখ: বুধ, ২১/০৭/২০১০ - ৩:০৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বুয়েটে ফোর্থ ইয়ারের কথা। একমাস হল এক স্যারের ক্লাসে যাইনা। স্যার একদিন ডেকে পাঠালেন, তার জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, আমি তার ক্লাসে যাইনা কেন? নিরীহ মুখ করে বললাম, “স্যার, আপনি তো আটটার পরে ক্লাসে আসলে ঢুকতে দেননা”। আসলেই ঘুম থেকে ৮.১৫ তে উঠে, দাঁত ব্রাশ না করেই তো আর ক্লাসে চলে যেতে পারিনা। এর চেয়ে পরের একঘন্টার ব্রেক সহ ৯ টা পর্যন্ত ঘুমানোই ভাল। সেই আমি, এখন অনেক তোড়জোর করেও সাতটা পর্যন্ত ঘুমাতে পারিনা। আমার কি দোষ, এখন তো আর এমন কোন চাপ নেই, যে তার হাত থেকে পালানোর জন্য আমাকে ঘুমের আশ্রয় নিতে হবে।

অফিসের জন্য বের হই সাড়ে দশটায়। মাঝের সময়টা কাটানো একটু মুশকিলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় । আমি অবশ্য ম্যানেজ করে নেই। দশ বারোটা ডাউনলোড করা গান আছে, সেইগুলাই রিপিট দিয়ে শুনতে থাকি। তারপর অনলাইনে পেপার পড়ে কিছুটা সময় যায়, অবশ্য অনেক হিসাব করে পড়তে হয়, কারণ পুরোটা পড়া হয়ে গেলে অফিসে বসে কি করব! স্বীকার করলে ভাবটা একটু কমে যায়, তাও বলে দেই, মূল সময়টা কাটে আসলে ফেসবুকে। উফ, ওই সাইটে ঢুকার পর আমার আর নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকেনা। যার যেই স্ট্যাটাস দেখি, তাতে গিয়ে একটু পঁচিয়ে না আসতে পারলে, আমার কেমন জানি লাগতে থাকে। কেউ হয়ত অনেক ভাব সঞ্ছয় করে, তাতে বিস্তর আবেগের সস ঢেলে স্ট্যাটাস আকারে পরিবেশন করে, আর আমি তাতে আমার সুচিন্তিত মন্তব্য যোগ করে পুরো প্রেক্ষাপটই পালটে দেই। আমি আগের জন্মে নিঃসন্দেহে ঈস্ট ছিলাম ।

অফিসে আসি, ফোন করে চায়ের অর্ডার দিয়ে, প্রায় ইজিচেয়ার হয়ে যাওয়া আমার ভাঙ্গা চেয়ারে বসে জিমেইল, ফেসবুক, বিডিনিউজ24, সচল, প্রথম আলো ফায়ারফক্সের ট্যাবে ট্যাবে টানিয়ে দেই। এরপর জুনিয়রদের উপর ছড়ি ঘুরানোর চেষ্টা করি কিছুক্ষন। সুবিধা করতে পারিনা তেমন। এক সিনিয়র ভাইয়া আমার অত্যাচারে বলত, “তুমি মারা যাওয়ার পর ও তোমার মুখ চলতেই থাকবে”। আজ বুঝি কর্মফল বলে একটা জিনিস সত্যিই আছে, বিবর্তনের ধারায় জুনিয়র গুলা ও দিনকে দিন ফাজিল থেকে ফাজিলতর হয়ে নাজিল হচ্ছে।

এই করে লাঞ্ছ পর্যন্ত যায়, টুকটাক কাজ করি। মাঝে মাঝে জুনিয়র গুলা এটা সেটা বুঝতে চায়। সব কি আর আমি জানি আর বুঝি! আবার বুঝিনা বলে দেয়ার মত বেকুব ও আমি না, তাই মনের মাধুরী মিশিয়ে একটা কিছু বলে দেই। সেই কলেজ লাইফ থেকে এই অভ্যাস। পাশের বন্ধু পরীক্ষায় জৈব রসায়নের একটা বিক্রিয়া জিজ্ঞেস করল একবার, আমি মোটামুটি মিলিয়ে একটা কিছু বলে দিলাম। বইয়ে হয়ত পানি তৈরী হয়, আমার কল্পনায় সেটা হয়ে যায় অ্যালকোহল। তাতে কি? অ্যালকোহল তো আর পানির চেয়ে কম দামী না। আর খাতায় অ্যালকোহল লিখলে ই তো আর দোজখ বরাদ্দ হয়ে যায়না।

এরপর নতুন ভার্সিটির নানা বিষয়ে একটু খোঁজখবর নেই। ভার্সিটির হাউজিং পেয়েছি। গুগল ম্যাপের স্ট্রীট ভীউ খুবই কাজের একটা জিনিস। আমি প্রায়ই আমার রূমের দরজা পর্যন্ত গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে আসি। তারপর রূমে ঢুকতে না পেরে ডিপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। রূমমেট চাইনীজ শুনে খুশী আর ধরেনা।এখন থেকে চাইনীজ খাবার খেতে আমাকে আর রেস্টুরেন্টে যেতে হবেনা। ডিপার্টমেন্টের ছেলে-পুলে খুবই ভালো। এরা প্রায়ই বিয়ার আর চিকেন গ্রীল সহকারে পার্টি আয়োজন করে, আর মেইল করে দাওয়াত দেয়। চিকেন গ্রীল শোভিত স্বর্গে যাওয়ার জন্য পেট আনচান করে। আহা, মানুষ এত ভালো কেন?

এইসব নানা বিষয়ে গবেষণা করতে করতে ক্লান্তি এসে ভীড় করে। সুতরাং এবার বাসায় ফিরতে হবে।রিকশায় চড়া মাত্রই দোজখ নাজিল হয়। গার্মেন্টস থেকে বের হওয়া তীব্র গরম বাতাসে ঝলসাতে ঝলসাতে আমার মাথায় ব্যবসার বুদ্ধি খেলে যায়। মুরগী-খাসি-গরু মশলা মাখিয়ে ওইখানে ধরে রাখলেই হল, তারপর আর কাস্টমার গুণে শেষ করে কে! রিকশা আরেকটু আগায়। বিস্কিটের গন্ধ নাকে লাগার আগে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ওষুধের গা গুলানো গন্ধ। তারপর মোড় পেরোলে, বেগুনবাড়ী ট্রাক স্ট্যান্ড। বাতাসে ধুলা এখান এত বেশি যে, বইয়ে পড়া বায়ুর অন্যান্য উপাদান এখানে আছে কিনা সন্দেহ জাগে। কয়দিন আগের ট্রাক-চালক সমিতির নির্বাচনের আমেজ এখনো যায়নি। একপাশে শেষ বিকালের রোদ পোহায় জাহাজ। উপরের দড়িতে সারবাঁধা বালতিতে বৃষ্টির পানি জমতেই থাকে। দুপাশের দৃশ্য ক্লান্তিকর হয়ে গেলে চোখ যায়, ছোকড়া রিকশাওয়ালার পিঠে। ঘামে জবজব শার্টের পিঠে লাল সুতায় লিখা স্টাইল মার্ট। কি জানি একটা অসংগতি মনে আসি আসি করে থেমে যায়। মধ্যবিত্তের ক্ষণিক সমাজসচেতনতায় কি আসে যায়। এর চেয়ে রোমান্টিকতা ভাল। আকাশের মেঘ দেখি। মেঘেরা নকশা করে, আর আমি কত কিযে খুঁজে পাই। তারপর যখন একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, বিবেক বেচারা চোখ রাংগায়, “কবি-সাহিত্যিক হয়ে যাচ্ছ?” বলে। আমি আর কি করি। বাস্তবের জমিনে চোখ মেলে রেললাইনের দুইপাশে মুখোমুখি অপেক্ষারত রিকশার ভীড় দেখি। সিগনাল ছেড়ে দিলে ইতস্তত ভ্রমণরত গ্যাস কণিকার মত ধাক্কাধাক্কি করে রিকশা গুলা কিভাবে গন্তব্যে পৌঁছে যায় সেটা ভেবে এখন আর অবাক হইনা।

বাসায় ফিরে কেনাকাটা করতে বের হই। যে পরিমাণ জিনিস কিনছি কয়দিন ধরে, তাতে আমার মত দুই-চারটা ছেলের বিয়ের কাজ চলে যায়। কেনাকাটা শেষে আবারো বাসায় ফিরি। তারপর দুনিয়ার যত বিরহ-জাগানিয়া গান আছে, শুনতে বসি। যে গান শুনি সেটাই আমার জন্য গাওয়া বলে মনে হয়। তারপর বেশি ভাব জেগে উঠলে ফেসবুক স্ট্যাটাসে দু’একটা লাইন তুলে দেই।

সামনেই বাড়ি যাচ্ছি। নতুন কাফেলা শুরু করার আগে যাযাবর জীবনে একটু বিরতি নেয়া এখন সময়ের দাবি।

সজল
২১/০৭/২০১০


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ভাল্লাগছে।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

লেখার ফরম্যাটিং দুয়েক জায়গা বাদে একদম ঠিক ঠিক। সে জন্যই ৪ তারা দিচ্ছি। আরো লিখুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

গুগল ডকস এ লিখে কপি পেস্ট হাসি । ধন্যবাদ পড়ার জন্য।

সজল

Razib [অতিথি] এর ছবি

Hi,

Your writing is very fluent and the standard of sense of humour is quite high. Keep on writing bro.

razib

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ রাজীব উৎসাহের জন্য হাসি

সজল

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

তরতর করে পড়লাম। ভালো লাগলো।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য হাসি

সজল

তিথীডোর এর ছবি

বেশ লাগলো পড়তে।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ তিথীডোর হাসি

সজল

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি আগের জন্মে নিঃসন্দেহে ঈস্ট ছিলাম ।

হা হা! পচানোর মাস্টারসাব, লেখা ভালু প্লাম। হাসি

কুটুমবাড়ি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ কুটুমবাড়ি। লেখা ভালু পাওয়াতে ভালু পাইলাম। পরের জন্মে আমি কেমিকেল ফার্মেন্টেশন এজেন্ট হয়ে জন্মাব। দেঁতো হাসি

সজল

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। আপনার নাম লিখেন নি হাসি

সজল

বাউলিয়ানা এর ছবি

ভালৈসে ব্লগরব্লগর চলুক

লেখালেখি জারি রাইখেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

থ্যাঙ্কু। পড়াও জারি রাইখেন হাসি

সজল

রিদওয়ান [অতিথি] এর ছবি

লেখাটি বেশ সরল আর প্রাঞ্জল | পড়তে ভাল লাগল | লিখতে থাকুন | দেঁতো হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ রিদওয়ান হাসি

হাসিব জামান এর ছবি

ভাল লাগসে সজল ভাই, লেখার উপর থেকে পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল এটা আপনার লেখা। হাসি
দেশের বাকী কয়েকটা দিন এঞ্জয় করতে থাকেন।
-----------------------------------------
এই গল্প ভরা রাতে, কিছু স্বপ্ন মাখা নীল নীল হাতে
বেপরোয়া কিছু উচ্ছাস নিয়ে, তোমার অপেক্ষায় ...

অতিথি লেখক এর ছবি

বল কি! পড়ছ বলে ধন্যবাদ হাসি

সজল

আরিফ জেবতিক এর ছবি

সহজিয়া মনকাড়ানিয়া লেখা।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ হাসি

সজল

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- যান বস, মুরগা পোড়া খান গিয়া।
আর আশে পাশের ঈমানের ক্যুইজ নেয়া বালিকাদের নিয়েও ল্যাইখেন আমাদের মতো পাপিষ্ঠের জন্য। বহোত ফায়দা হবে ভাই।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

অতিথি লেখক এর ছবি

দোয়া কইরেন বস, দুই-একবার যেন ঈমানের ক্যুইজে ফেল করে, সেই করুণ কাহিনী আপনাদেরকে বলতে পারি। খাইছে

সজল

সুমী এর ছবি

মজা মজা!! বিজ্ঞানের ছাত্র তার রসবোধের জন্য উপাদান পদা,রসা থেকেও আনতে পারে।
আগের জন্মে ছত্রাক আর পরের গাঁজনের সহায়ক হতে চাওয়ার জন্য সাহস লাগে। এজন্য ধন্যবাদ। হড়বড় করে পুরোটা পড়ে ফেললুম!!!!!!

"পরের জন্মে দশ দিগন্তের অন্ধার হব আমি।"

অতিথি লেখক এর ছবি

মাঝে মাঝে কম্পু'র জার্গন দিয়া জোক করার চেষ্টা করি। তখন দেখা যায়, নন-কম্পু শ্রোতা আমার রসবোধ নিয়া সিরিয়াস প্রশ্ন তুলে দেয়। অনুবাদ করতে গিয়া দেখি জোকটাতে আমিই কোন মজা পাচ্ছিনা।

রিএজেন্ট হওয়ার খায়েশ আসলে কম চেষ্টায় অনেক বেশি পঁচানোর জন্য। আর অন্ধকার না হইলে হয়না? দেশ এমনিতেই ভয়াবহ বিদ্যূৎ সঙ্কটে আছে।

সজল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।