জাকির জাহামজেদ
ক্রিকইনফোর যে ভদ্রলোক ম্যাচ রিপোর্ট লিখেছেন, তার নাম লেখা নেই, রিপোর্টের উপরে লেখা ক্রিকইনফো স্টাফ, আর একেবারে নিচে গ্লাসগো। হয়তো তিনি তার নাম লেখেননি লজ্জায়, আমরা এটাই ধরে নিতে পারি। হয়তো ভদ্রলোক নিছক ম্যাচ কাভার করতে না, গ্লাসগো ঘুরে আসতেও গেছিলেন, অবকাশ যাপনের একটা সুপ্ত ইচ্ছেও হয়তো মনের ভিতরে ছিলো। কিন্তু তিনিও কি ঘুণাক্ষরে ভেবেছিলেন, এমন লজ্ঝা তাকে দেখতে হবে মাঠে বসে !
আমাদের উৎপল শুভ্র, যিনি প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক, খেলার খবর রাখেন আর নিয়মিত খেলার পাতার সংবাদে যারা চোখ বুলান, এমন একটি মানুষও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা উৎপল শুভ্রকে চিনেন না। এখানে উৎপল শুভ্রের কথা আসছে কেন আপনাদের মনে এই প্রশ্নটা আসতেই পারে। কারণ আছে ভাই। কারণটাও পরিস্কার করে বলি, আমার যে এখন বড় জানতে ইচ্ছে করছে উৎপল শুভ্র এখন কোথায় আছেন ? যদি দেশে থাকেন, তাহলে বেঁচে গেছেন। আর যদি গ্লাসগোতে থাকেন তাহলে তো ক্রিকইনফোর এই রিপোর্টটা তারই করা। হয়তো লজ্জায় আর অপমানে তিনি রিপোর্টের উপরে তার নামই দেননি !
এখন আসি মূল প্রসঙ্গে। ফুটবলে যেমন একটা কথা প্রচলিত, ফুটবল ৯০ মিনিটের খেলা, ফলাফল জার্মানি জয়ী। তেমনি ক্রিকেটেও এখন ইদানিং অষ্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের সাবেকরা খোঁচা মারতে গিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রায়ই একটা কথা হয়তো কিছুদিন পর বলতে শুরু করবেন। কথাটা হবে ফুটবলের কথাটার মতোই, ক্রিকেট ম্যাচটা সারাদিনের, ফলাফল বাংলাদেশ পরাজিত !
টেস্ট খেলুড়ে কোনো দেশের সাথে আন্তজার্তিক ক্রিকেটে প্রথম জয় পেলো হল্যান্ড। ফেসবুকে আমার এক পরিচিত বন্ধু, তার নামটা এখানে দিচ্ছি, নোমান হোসেন, তিনি তার স্ট্যাটাসে লিখছেন- বাংলাদেশ হল্যান্ডের কাছে হেরে গেল। আমি অবাক হয়ে তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে একটা কমেন্ট করি, বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ফুটবলের রানার্সআপ দলের সাথে ফুটবল খেললো কবে ? অথচ তখন আমার মনেই ছিলো না, হল্যান্ড ক্রিকেটও খেলে !!! এই সেই হল্যান্ড, যাদের হারিয়ে আকরাম খান এমন দৌড় দিয়েছিলেন, তার সাথে তখন যেন দৌড়েছিল পুরো দেশটাই। সেটা ১৯৯৭ সালের কথা। মনে পড়ে, কৈশোরে দাঁড়িয়ে থাকা আমরা তখন চাঁদা তুলে মাইক ভাড়া করে আইসিসি ট্রফির কমেন্ট্রি শুনতাম এবং আম জনতাকে শুনাতাম।
আইসিসি ট্রফি জেতা, বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলা, ওয়ানডে স্ট্যাটাস প্রাপ্তি, টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তি- সবই এখন রূপকথার গল্প। কিন্তু বাংলাদেশ ম্যাচ হারে এটা কেন এখনো রূপকথার গল্প হতে পারলো না ?
খেলায় হারজিত থাকে। ম্যাচ হারলেও তাই আমাদের দুঃখ থাকার কথা না। কিন্তু যে দল মাত্র পনের দিনের ব্যবধানে একটি টেস্ট খেলুড়ে দেশকে হারিয়ে তারপর টেস্ট খেলে না এমন দুটি দেশের কাছে হেরে যায় তখন আমরা লজ্জিত না হয়ে পারি না। আমাদের মতো ক্রিকইনফোর রিপোট্র্ারও হয়তো লজ্জিত হন, এই জন্য তিনি হয়তো রিপোর্টে তার নাম দিয়ে এমন লজ্জার সাক্ষী হতে চান না।
এখন আসি মূল খবরে, বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম আজ একটা একদিনের আন্তর্জাতিক খেলায় হল্যান্ডের কাছে ৬ উইকেটে হেরেছে। বিশ্বাস হচ্ছে না ? সত্য কি জানেন ভাই, কথাটা শোনার পর আমারও প্রথম বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু কথাটা সত্যি। আমাদের প্রিয় ক্রিকেট টিম আয়ারল্যান্ডের কাছে হারার ক্ষত আমাদের হৃদয় থেকে শুকিয়ে যাবার কোনো সুযোগ না দিয়েই ক্ষতটাকে আরো বড় করে ফেললেন !!!
বাংলাদেশ তো নিয়মিত হারে, ব্যাপারটা এখন সূর্য পূর্ব দিকে উঠে কথাটার মতোই সত্য। এখন দেখি, কেন বাংলাদেশ হারের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না ?
( এটা একান্ত আমার ব্যক্তিগত মতামত )
1. নতুন ক্রিকেটার উঠে আসছে না। তাই আশরাফুলদের মতো বস্তা পঁচা খেলোয়ারকে এখনো টিমের সাথে দেখা যায়।
2. খেলোয়ারদের দেশের প্রতি হয়তো কমিটমেন্টের অভাব।
3. বয়সভিত্তিক পর্যায়ে খুব একটা মনোযোগ দিচ্ছে না বোর্ড।
4. স্কুল ক্রিকেট অনিয়মিত। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে অনেক জেলাতেই স্কুল পর্যায়ের ক্রিকেটের চর্চা নেই বললেই চলে।
5. ঘরোয়া ক্রিকেটের মান এখনো অনুন্নত।
6. জাতীয় লীগ থেকে বোর্ড বেশি মনোযোগী টাকাওয়ালা ( যেসব জায়গায় কর্পোরেট কোম্পানীগুলো স্পন্সর করে ) লীগ- যেমন, প্রিমিয়ার লীগ, এনসিএল, পিসিএল ইত্যাদি আয়োজনে। অথচ একটা দেশের ক্রিকেটের মেরুদন্ড সেই দেশের জাতীয় লীগ। ভারতে যতই আইপিএল হোক না কেন, রঞ্জি ট্রফিতে খেলেই মূলত একজন খেলোয়ারকে দলে আসতে হয়।
7. নির্বাচকরা অযোগ্য। খেলোয়ার বাছাইয়ে তারা স্বজনপ্রীতি ও ব্যক্তিগত সম্পর্ককে গুরুত্ব দেন বেশি। যে কারণে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দেশের একমাত্র টি টোয়েন্টি স্পেশিয়ালিস্ট অলক কাপালির সুযোগ হয় না।
8. আমরা হোসে মরিনহো অথবা ফার্গুসনের মতো ফুটবল কোচকে খেলোয়াড়ের সন্ধানে সারা বিশ্বে চষে বেড়াতে দেখি, অথচ সারা বিশ্বে টেস্ট খেলে মাত্র দশটা দল, সেই দলের কোচ জেমি সিডন্স তরুণ সম্ভাবনাময় খেলোয়ারের খোঁজে রাজশাহী অথবা সিলেটে গেছেন এমন কথা এখনো শুনি নাই।
9. বিসিবি কর্তারা দেশের টাকা ক্রিকেটে খরচ না করে বিদেশ বিভূঁইয়ে-ই বেশি ব্যস্ত থাকেন। অথচ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা ক্রিকেটে পেছনে টাকা খরচ করতে চান না। ছেলেরা যাতে ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহী হয়ে ক্রিকেট খেলতে আসে এই ব্যাপারে কোনো ক্যাম্পেইন করেন না।
10. বাংলাদেশ দলের আত্মবিশ্বাসের অভাব।
এই কারণগুলো ছাড়াও হয়তো বাংলাদেশ দল ম্যাচের পর ম্যাচ হারার পেছনে আরো অনেক কারণ আছে। কিন্তু প্রধান কারণ, ঘুরেফিরে দেখা যাবে এগুলোই।
সেদিন বিসিবি সভাপতি ঘোষণা দিলেন, জন্টি রোডস বাংলাদেশের ফিল্ডিং কোচ হচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের
আভন্ত্যরীণ খেলার মান যদি উন্নত না হয়, নতুন খেলোয়ার যদি উঠে না আসে, তাহলে জন্টি রোডস কেন, সারা পৃথিবীর সব সেরা কোচও যদি বাংলাদেশকে দলকে কোচিং করান তারপর দেখা যাবে বাংলাদেশ জিতবে না। কারণ, কোচরা তো আর মাঠে গিয়ে খেলবেন না, খেলতে হবে খেলোয়ারদেরকেই, আর সেই খেলোয়ারদের যদি আত্মবিশ্বাস না থাকে, দেশের প্রতি কোনো কমিটমেন্ট না থাকে, তাহলে বাংলাদেশ জয়ী হবে কিভাবে ?
এখনই সময়, বিসিবিকে এসব ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হবে। না হলে যে দেশের ক্রিকেট বঙ্গোপসাগরের অতল জলে হারিয়ে যাবে ঢাকাই মসলিনের মতো !!!
লেখাটা শেষ করি একটা কৌতুক বলে।
এক ছেলে আর্জেন্টিনার পতাকা টানাচ্ছে তার বাসার ছাদে।
আরেক ছেলে টানাচ্ছে ব্রাজিলের।
দুজনের পতাকা টানানো দেখে পাশের বাসার এক ছেলে টানালো বাংলাদেশের পতাকা।
এটা দেখে তো আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকা টানিয়েছে যে দুজন তারা তো হেসে গড়াগড়ি খায়। এই দেখে তৃতীয় ছেলে অন্য দুজনকে প্রশ্ন করলো, তোমরা হাসছো কেন ?
তারা উত্তর দিলো, তোমার পাগলামি দেখে হাসছি। ফুটবল বিশ্বকাপ চলছে আর তুমি টানাচ্ছো বাংলাদেশের পতাকা ?
তখন তৃতীয় ছেলেটা অন্য দুজনকে উত্তর দিলো, আমি তোমাদের মতো ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য অন্য দেশের পতাকা টানাচ্ছি না, আগামী বছর ক্রিকেট বিশ্বকাপের জন্য নিজের দেশের পতাকা টানাচ্ছি !!!
বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলে এই একটি মাত্র খেলায়। এখন এই খেলাটাতেই যদি আমরা একর পর এক হারতে থাকি তখন একদিন দেখা যাবে আইসিসি টেস্ট স্ট্যাটাসও কেড়ে নিয়েছে। তখন হয়তো আমরা ছোট ছেলেটার মতো কোনো খেলার একটা বিশ্বকাপে নিজের দেশের পতাকাটাও আর টানাতে পারবো না !!!
বিসিবি, প্লিজ ক্রিকেটের জন্য দয়া করে ভাবুন... আমরা আমাদের নিজের দেশের পতাকা উড়ানোর অধিকার চাই।
e-mail :
মন্তব্য
সহমত।
কুটুমবাড়ি
লেখাটা সময়োপযোগী। ভালো লাগলো। কিন্তু ঘটনা তো খারাপ, এরকম খবর শুনে কার ভালো লাগে বলুন? হল্যান্ড কিন্তু আসলে অতটা খারাপ টিম না। তবুও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক এক্সপোজারের বিচারে এদের সাথে হারাটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায়না। আমরা কি আসলেই এগুচ্ছি না পিছাচ্ছি তা বুঝতে পারি না। কবে আমরা ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলবো বা এই জীবদ্দশায় সেরকম একটা টিম হবে কি না সেটা নিয়েও মাঝে মাঝে হতাশা কাজ করে।
অ.ট.
বিরাম চিহ্নের পরে স্পেস হয়না। এদিকটা খেয়াল রাখলে আরো ভালো হবে।
নিয়মিত লিখতে থাকুন।
হল্যান্ড ভালো দল আপনার কথাটা মানলাম। কিন্তু একটা টেস্ট খেলুড়ে দেশের কেন বারবার পঁচা শামুকে পা কাটবে ?
যারা একদিন স্বপ্ন দেখিয়েছে, তারাই যদি এখন হেরে বারবার হেরে যায়, তাহলে স্বপ্ন দেখতে আমরা কার কাছে যাবো ?
আপনাকে ধন্যবাদ।
জাকির জাহামজেদ
সেটাই তো বললাম।
নতুন প্লেয়ার বানাইতেই হবে ... ওইদিকে বিনিয়োগ না করে, এদের পিছনে খামাখা টাকা ঢাললে ফল পাওয়া যাবে না ...
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
লেখাটা ভালো লাগলো। নিয়মিত লিখবেন
আমার বিশ্লেষণ ধর্মী লেখাটা ভালো লাগল। কালকে খবরটা দেখে আমার মাথাও লজ্জায় নীচু হয়ে গিয়েছিল।
কামরুজ্জামান স্বাধীন
নিচু হলে ভাল হতো!
এছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এই দলের সর্বোচ্চ চারজন ছাড়া বাকি কেউই আন্তর্জাতিক মানের নয়। এটা তাদের পারফরমেন্সই আর খেলার ধরণেই প্রমাণ দেয়।
কথা ঠিক। নতুন খেলোয়াড় তৈরি করাটাও খুব জরুরি।
সুমিমা ইয়াসমিন
কয়েকদিন আগের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজের প্রথম ম্যাচটা দেখেছিলাম... আমার মনে হচ্ছিল ছেলেগুলোকে মাঠে নামিয়ে দেয়া হয়েছে তাই খেলছে... খেলার প্রতি কারো কোন আগ্রহ আছে বলেই মনে হচ্ছিল না...
আমার মনে হয় এই টিমের কোন টিম স্পিরিট নেই... এবং এখনকার বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমটাতে সত্যিকারের কোন সমন্বয় নেই...
প্রতি টা প্লেয়ার এর ধৈর্যের অভাব আছে | আমাদের দেশে কোনো ৫ দিনের টেস্ট খেলা নাই, আছে মাত্র চার দিনের! তাও সেই খেলা গুলি শেষ হয় মাত্র ৩ দিনে, তার মানে টোটাল খেলা ২৭০ ওভার তার মানে প্রতিটা দল প্রতি ইনিংস এ খেলতেসে ৬৭ ওভার এর মত, যেটাকে ওয়ান ডে ই বলা সমীচীন... যাদের টেস্ট এ এই অবস্থা তারা ১ দিনের খেলায় এ কি করবে টা জানা ই আছে , তারপর ও বেক্কল এর মত আশায় থাকি!
বাংলাদেশ দলের একজন মনস্তত্ত্ব বিদ দরকার, শুধু প্লেয়ার দের জন্য না নির্বাচক দের জন্য ও |
ভাই বোর্ড কর্তারা কি দোষ করলেন ? উনাদের কি আপনার চোখে লাগে নাই। টিমের সাথে বিদেশে গিয়ে হাওয়া খাইবো, আর মনস্থত্ত্ববিদের কাছে শুধু খেলোয়াররা যাবে কেন ?
উনাদের কারণেই তো এমন হচ্ছে, উনাদেরকেই তাই সবার আগে মাথাটা কিলিয়ার করা দরকার !
নতুন মন্তব্য করুন