এইমাত্র একটা কেঁচো আমার খসে পড়া পেটের চামড়ার উপর দিয়ে হেঁটে চলে গেল। ডান চোখের কোটরটাতেও অনেক অনেক কিলবিলে পায়ের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। বেঁচে থাকতে এই সব পোকামাকড় আর কেঁচো ছিল আমার দু'চোখের বিষ। ভীষন ভয় পেতাম আমি এসব। আর এখন! শরীরের কত জায়গায় যে পোকারা ডিম পেড়ে মহানন্দে বাচ্চা ফুটিয়ে চলেছে। যে সুন্দর, কমনীয় শরীর নিয়ে আমার অসম্ভব গর্ব ছিল, তা আজ পোকাদের খাদ্য, হায়রে!
চারদিন হল ওরা আমাকে এই মাটির নিচে অন্ধকারে রেখে গেছে। অক্ষত শরীরে নয় অবশ্য। আমার শরীরের বিভিন্ন অংশই আমার সাথে নেই। হৃদপিন্ড, কলিজার কিছু অংশ, দুই বৃক্কের অর্ধাংশ, পাকস্থলী ও খাদ্যনালীর কিছু অংশ ইত্যাদি। ওগুলো এখন আছে মহাখালীতে। পচন নিবারক দ্রবনে চুবিয়ে জারে ভরে রাখা হয়েছে। কেমিকেল টেস্ট এর জন্য। আমার শরীরের গলা থেকে বুক হয়ে পেট পর্যন্ত সেলাই দেয়া। খুলে গেছে এখন অবশ্য। আমার মোহনীয় শরীরের এই করুন অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। ঘুমের অষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করাটাই বোকামি হয়েছে। আত্মহত্যা করার এত হাপ্যা কে জানতো। কারনটাও খুব সামান্য। আমার স্বামী আমাকে বাদ দিয়ে অন্য নারীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।তাকে আমি এতটাই বিশ্বাস করতাম যে, আঘাতটা ছিল আমার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত। আঘাতটা অবশ্য ঠিক কোথায় লেগেছিল আমি নিশ্চিত না। আমার ভালবাসায়, না বিশ্বাসে, না কি আমার ২৬ বছর বয়সী অতুলনীয় রুপ-যৌবনে! অন্য যে কার চেয়ে আমিই শ্রেষ্ঠ এই অহংকারে! যেটাই হোক, হঠাত মাথা গরম হয়ে যাওয়ায় সিদ্ধান্ত নিলাম বেঁচে থেকে লাভ নেই। বরং মরে গিয়ে ওকে একটা শিক্ষা দেব। বলাই বাহূল্য, সিদ্ধান্তটা খুবই ভুল ছিল। পরম ভালবাসার মানুষটাও যখন পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়, সে স্থানটাও পূর্ণ হয়ে যায়, আর যাকে চাচ্ছিই না তার ক্ষেত্রে?
সুতরাং, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে দু দিন পড়ে থাকার পর চারদিন আগে আমি আমার এই স্থায়ী আবাসনে এসেছি। তীব্র অন্ধকারে হাঁপিয়ে উঠি।নিজের মাংস পচার গন্ধে নিজেরই প্রচন্ড বিবমিষা হয়। পোকামাকড় কিলবিল করে। মনে পড়ে আলো ঝলমল পৃথিবীর কথা, নিশুতি রাতে ভরা জোতস্নায় নৌকার পাটাতনে শুয়ে থাকার কথা, মনে পড়ে রিমঝিম বৃষ্টির একটানা শব্দ, কচুরিপানার ফুলে ভরা পুকুর, হাস্নাহেনা আর কামিনীর মাতাল করা গন্ধ। মনে পড়ে আমার মৃতদেহ দেখে মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ, বাবার শোকে পাথর হওয়া মুখটা। আর আমার কলিজার টুকরা দু'বছরের মেয়েটার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা। হায়, মৃত্যুর আগে একবারও যদি বুঝতাম জীবন কত মধুর!
নীলা
মন্তব্য
লাশেরাও দেখি আজকাল সুন্দর গল্প লিখছে!
আমার একটা ব্যাখ্যা জানবার কৌতুহল হচ্ছে। গল্পের এক জায়গায় আছে "ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে দু দিন পড়ে থাকার পর চারদিন আগে আমি আমার এই স্থায়ী আবাসনে এসেছি। " আবার অন্যত্র "হৃদপিন্ড, কলিজার কিছু অংশ, দুই বৃক্কের অর্ধাংশ, পাকস্থলী ও খাদ্যনালীর কিছু অংশ ইত্যাদি। ওগুলো এখন আছে মহাখালীতে। পচন নিবারক দ্রবনে চুবিয়ে জারে ভরে রাখা হয়েছে। কেমিকেল টেস্ট এর জন্য।"- পোস্ট-মর্টেম যদি ঢাকা মেডিকেলে হয়ে থাকে তবে মহাখালীতে কী রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে?
--চিরায়ত পাঠক
মেডিকেল কলেজে পোস্ট মর্টেম করার সময় লাশ কেটে খালি চোখে পরীক্ষা করা হয়। পড়ে প্রয়োজন বোধে অন্যান্য পরীক্ষার জন্য শরীরের অংশবিশেষ (এগুলিকে ভিসেরা বলা হয়) পাঠানো হয়। সমস্ত দেশ থেকেই কেমিকেল টেস্ট এর জন্য ভিসেরা মহাখালি আসে। দরকার হলে প্যাথলজি বা হিস্টপ্যাথলজির জন্য বা অন্য কোন পরীক্ষার জন্য পাঠান যেতে পারে। ধন্যবাদ।
ফ্যান্টাসি আছে। অসংলগ্নতাও আছে। আরেকটু ভেবে লিখলে হয়ত আরো ভালো একটা স্টোরি পাওয়া যেত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ভাবতে গেলে না আবার ন্যাচারাল বিষয়টা নষ্ট হয়ে যায়। লেখককেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কতটা স্বতঃস্ফূর্ত আর কতটাই বা সতর্ক থাকতে হবে।
লেখা খারাপ লাগল না।
__________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
নতুন মন্তব্য করুন