খুব ঠান্ডা। গান বাজছে।
“হাওয়া মে উড়তা যায়ে,
মেরা লাল দোপাট্টা...মল মল কা হো জি...হো জি।”
গাড়ির কাঁচ সবকটা উঠানো। কালো কাঁচ। বাইরের কোন চ্যাঁ-ভ্যাঁ ভেতরে আসছেনা। পেছনের সিটে বেশ আয়েশ করে হেলান দিয়ে আছে নীলা। চোখ বন্ধ। চোখ খুলতে ইচ্ছা করছেনা।
“হাওয়া মে উড়তা যায়ে,
মেরা লাল দোপাট্টা...মল মল কা হো জি...হো জি।”
গানটা এবার যেন কানের ভেতরে হচ্ছে। চোখ খুলতে ইচ্ছা হচ্ছেনা। বাজুক গান। চোখ বোধহয় খোলা দরকার। গানের শব্দ বেড়ে গেছে। এতো শব্দে ঘুমানো যায়না।
চোখ খুললো নীলা। গাড়ির স্বপ্নদৃশ্য উধাও। সে শুয়ে আছে তার নিজের পরিচিত বিছানায়। কভারে গাঢ় নীলের মাঝে হাতে আঁকা মেঘ। বালিশের কভারেও তাই। তার উপরে সে নিজেও শুয়ে নীল রঙের নাইটগাউন পড়ে। মোবাইলের রিং বেজেই চলেছে।
“হাওয়া মে উড়তা যায়ে,
মেরা লাল দোপাট্টা...মল মল কা হো জি...হো জি।”
“হ্যালো...” ঘুম জড়ানো গলায় সাড়া দিলো নীলা।
“ঘুমাও নাকি?”
“হুমম...”
“উঠে পড়, কাজ আছে। আমি আসছি।”
“হুমম...”
ফোন রেখে আবারো চোখ বুজলো নীলা। ঘুম তার বড় পছন্দের, বিলাসের। ইচ্ছা না করলেও উঠে পড়লো নীলা। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে চোখ বোলালো সে। বাইরে মন কেমন করা আলো। গোধূলি। দিনের আলোর বিদায়। রাতের আলো আসি আসি করছে।
হাত-মুখ ধুয়ে সোজা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গেলো নীলা। গফুর ভাই আসছেন। তার গাড়ী আছে। কালো টয়োটা। ভেতরটা খুব ঠান্ডা। চাইলে গান বাজানো যাবে।
“হাওয়া মে উড়তা যায়ে,
মেরা লাল দোপাট্টা...মল মল কা হো জি...হো জি।”
ঘুম থেকে উঠার কষ্ট স্বপ্নদৃশ্য বাস্তব হয়ে যেতে পারার ক্ষীন সম্ভাবনায় উবে গেলো।
নীলার সামনে বিশাল আয়না। আয়নার সামনে দাঁড়াতে, বসতে নীলার খুব ভালো লাগে।
সোজা আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলো নীলা। তার চোখের রঙ কালো। কুচকুচে কালো। কালো মনির বাইরে সাদা। ঝকঝকে সাদা। চোখের নীচে হালকা কালি। অসুবিধা নেই। হালকা কালিতে তাকে ভালোই লাগে। চোখের উপর ভ্রু। চিকন করে নিকিয়ে নেয়া। চোখ ছেড়ে এবার গোটা মুখটায় তাকালো নীলা। লম্বাটে আর গোল, দুটোর মাঝামাঝি চেহারা। ভরাট, ভারী ঠোঁট। একটু লম্বা নাক। এই নাকের কারনে স্কুলে তার নাম ছিলো নীল বাঁশি। নাকের মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। আলো পড়ে চিকচিক করছে।
ড্রেসিং টেবিল থেকে উঠে শাড়ি পড়লো নীলা।
আকাশী নীল শিফন। নীলের মাঝে কদম আর কদমের কচিপাতার ছড়াছড়ি। মনে হচ্ছে বর্ষার আকাশের ছবি তোলা হয়েছে। এবং ছবিটা তোলা হয়েছে সদ্য কদমফুল ফুটেছে এমন গাছের নীচ থেকে। রঙতুলির কাজ। যে করেছে সে জানতো যে সে কি করছে। পাড়ের দিকটায় এলোমেলো সাদা। মেঘ মেঘ ভাব আছে। আঁচলের দিকটায় সাদার মাঝেই কেমন যেন ফাটাফুটি। বেশ শিকড় শিকড় অনুভুতি। সাদা শিকড়।
ব্লাউজটাও নীল। ঘটি হাতা ব্লাউজ। পুরোনো সিনেমার নায়িকারা পড়তেন। নীলার এই ব্লাউজ পড়তে ভালো লাগে। নিজেকে পুরোনো দিনের নায়িকা মনে হয়, সাধারন কিন্তু অনন্য। হালের নায়িকারা আর যাই হোক জনারন্যের মানুষ না। আলাদা। আগের নায়িকারাই ভালো ছিলেন। মনে হতো কাছের মানুষ।
শাড়ি-ব্লাউজটার সাথে কাজল না হলে ঠিক মিলছেনা। চোখে কাজল দিলো নীলা। একটু টানা টানা ভাবেই চোখে কাজল জড়িয়ে গেলো। সুন্দর। চোখের দিঘীতে এখন কালো পাথরে বাঁধানো ঘাট।
চুল কেমন রাখা যায়? খোঁপা না বেনী। বাঁধনের প্রয়োজন কি আছে? ধুর, কি দরকার? শাড়ির এই বর্ষার আকাশের সাথে মেঘ না হলে কি হয়? চুলই না হয় সেই মেঘ হোক। নীলা চুল ছেড়ে দিলো। চেহারার সামনের দিকটায় দুগোছা কুন্তল। লটরপটর করছে। ওদুটো আবার কি কারনে যেন ঢেউ এর মতো বাঁকানো। বাঁকানো ঢেউ একবার চিবুক ছোঁয় তো আবার ঠোঁট। এই আবার চোখের সামনে। নীলা অবাধ্য ঢেউ দুটোকে টেনে কানের পেছনে নিয়ে গেল।
মসৃন গালে মসৃন গোলাপী আভা। শেষ বিকেলের আকাশের আবির এখন নীলার গালে।
ঠোঁটে প্রথমে লাইনার। লাল লাইনার। এরপর লিপষ্টিক। গাঢ় লাল। বধ্যভূমি। পুরুষের বধ্যভূমি। সাথে কাজলবাঁকা চোখের চাউনি কিংবা দিঘীর টলটলে জলে পা ভেজানোর আকাঙ্খা। প্রচ্ছন্ন আমন্ত্রন। আকর্ষনও হয়তো।
আয়নার উপরের দিকে সারি সারি টিপ লাগানো। লাল, নীল, কালো, খয়েরী, সবুজ, হলুদ, বেগুনি...আরো কত রঙ। আজ কোনটা যাবে? লাল যাক। নাহ, লাল না। গোটা সাজের সাথে লাল টিপ যাচ্ছেনা। গায়ে বর্ষা আর পিঠের মেঘের সাথে লালের জায়গা কোথায়? তাহলে ঠোঁটটাই বা কেন লাল? ওটাও নীল বা অন্যকিছু হোক। নাহ, লালই ভালো। ঠোঁট থেকেই সব ঠোকাঠুকি শুরু হয়। ওখানে না হয় সতর্ক হবার বার্তা হিসেবেই লাল থাকুক। হ্যাঁ, লাল। থাকুক। টিপটা কি হবে? লাল না। নীল? সারা শরীরে নীল, কপালেও কি তাই যায়? বেশী হয়ে গেলোনা? কালো কেমন হয়? কালো মেঘের প্রান্তভাগে একটু সাদা তো থাকে। জলভরা মেঘের সূচনা হোক কপাল থেকেই। কালো টিপই যাবে। টিপ কালো, তারপরেই কপালের সাদা ত্বক, এরপরেই কৃষ্ণকালো চুল কিংবা মেঘ।
কগাছা কাঁচের চুড়ি হাতে উঠাতেই হবে। নইলে পুরো ক্যানভাসটা অসম্পুর্ন থাকবে। দুহাতেই চড়ানো যায়। নাহ এক হাত ফাঁকা থাকুক। ডান হাতটাই থাকুক ফাঁকা। ওতে চেইনের ছোট্ট ডায়ালের ঘড়ি। রুপোলি ঘড়ি। বাম হাতে চুড়ি। দুই রঙের। ছটা করে। সাদা তিনটা, নীল তিনটা, আবার তিনটা সাদা, তিনটা নীল। মেঘের টুকরো হাতেও উঠুক।
“হাওয়া মে উড়তা যায়ে,
মেরা লাল দোপাট্টা...মল মল কা হো জি...হো জি।”
বিছানার দিকে তাকালো নীলা। রিং বাজছে। এসে গেছে রোকন?
“হ্যালো...”
“হয়েছে?”
“হ্যাঁ। নামবো? এসেছো?”
“নামো, নিচেই আছি।”
“ওক্কে। ছাড়লাম।”
কট করে লাইন কেটে গেলো।
এবার একটু সুগন্ধী। হালকা গোছের কিছু। নড়াচড়ায় যেন সুবাস ছড়ায়।
সবশেষে বেরিয়ে এলো নীলা। হাতে ব্যাগ। ছোট্ট। বুক আর হাতের মাঝের জায়গায় হারিয়ে যাবো যাবো করছে।
গাড়ীর দরজা খুলে ধরলো রোকন। নীলা স্বচ্ছন্দে ভেতরে ঢুকে গেলো। গাড়িতে গান বাজছে। অঞ্জনের গান।
“তুমি না থাকলে রবীন্দ্রনাথ,
কালির দোয়াত মাথায় ঠুকে হতো কুপোকাত,
রাপা...রাপাপ্পা...রামপাম পা...”।
ভেতরে এসে বসলো রোকন। বাঁকা চোখে তাকালো নীলার দিকে। মুহুর্তে নীলার বর্ষার আকাশ, জলভারে নত মেঘ, শান বাধানো দিঘীর ঘাট, দুটো ঢেউ সব উধাও হয়ে গেলো। রঙ্গীন নীলা হয়ে গেলো সাদাকালো।
নীলার মনেই ছিলোনা যে তার সাজ শাঁষালো খদ্দেরের জন্যে।
মানিক চন্দ্র দাস
manikchandradas10(@)gmail.com
মন্তব্য
লেখার ধরন,বর্ণনা খুব সুন্দর।ভালো লাগলো।
বিষণ্ণ বাউন্ডুলে,
আমি আপনার নামের ভক্ত হয়ে গেছি। লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।--------------------------মানিক
লেখা ভালো লাগলো।
হাওয়া মে উড়তা যায়ে, মেরা লাল দোপাট্টা...মল মল ... গানটাতে মাদকতা আছে। রাতের বেলায়, বিশেষ করে মাঝ রাতে সদরঘাটের লঞ্চঘাট কিংবা মফস্বল শহরের রেল স্টেশনের চায়ের দোকান, কতদিন যে মুগ্ধ হয়ে শুনেছি।
...........................
Every Picture Tells a Story
ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই। ভালো থাকবেন।---------------মানিক
বর্ণনার ধরনটা বেশ...
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
প্রিয় তিথীডোর,
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। ভাল থাকবেন।----মানিক
- 'চোখের ওপর ভ্রু' মানে কী আবার! ভ্রু তো চোখের উপরেই থাকে, নিচে তো না।
আর আপনার নীলা এতো আইলসা কেনো! দুপুর বেলায় ঘুমায়। তাও রাতের গাউন পরে!
সাজের বর্ণনা বেশ পাকা হাতে দিয়েছেন। মনে হচ্ছিলো, নীলা বুঝি আমার সামনেই সাজুগুজু করছে। শাড়ি পরার সময় অবশ্য চোখ ঘুরিয়ে রেখেছিলাম।
আরও লিখুন। আপনি বেশ লিখেন।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
প্রিয় ধূসর গোধূলি,
আপনার রসবোধ চমৎকার। ঠিকই বলেছেন, ভ্রু তো চোখের উপরেই থাকে। নীলা বেচারী কি করবে বলেন, রাতে তো তার কাজ থাকে। তাই দুপুরে ঘুমায়। ঘুমের সময় গাউন পড়ে। এই আরকি। লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।-----------------------------মানিক
গল্পটা ভালো লাগলো। অনুগল্প ট্যাগ দিয়েছেন কেন? আমার কাছে গল্পই মনে হলো।
প্রথমে দেখলাম গফুর ভাই আসছে কালো টয়োটা নিয়ে, কিন্তু আসলো রোকন... কাহিনী কী? নাকি আমিই কোথাও বুঝতে ভুল করলাম?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নজরুল ভাই,
ভুলটা আমারই। দুই ক্ষেত্রেই রোকন হবে। ভুলটা চোখে পড়েছে লেখা জমা দেবার পর। সামনে আশা করছি এইরকম হবেনা। লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। চন্দের সমগ্র কিনেছেন? ভালো থাকবেন।
----------------------------------------------------------মানিক
শুরুতেই কেন জানি মনে হইতেসিল, মন খারাপ করা এন্ডিং হবে। সবাই মন খারাপ করা গল্প লিখে কেন?
==========================
আবার তোরা মানুষ হ!
==========================
আবার তোরা মানুষ হ!
পল্লব ভাই,
আমাদের কদম গাছ কেটে ফেলছে, এই কারনে মন মেজাজ ভাল ছিলনা। তাই হয়তো মন খারাপ করা সমাপ্তি। লেখা পড়েছেন জেনে ভালো লাগলো। আপনার বাচ্চা-কাচ্চারা কেমন আছে? ভালো থাকবেন।
---------------------------------------------------------মানিক
মানিক ভাই চরম লিখছেন!
নতুন মন্তব্য করুন