আমার দেখা প্রথম ধারাবাহিক নাটক "কোথাও কেউ নেই"। যতটুকু মনে পড়ে হুমায়ুন আহমেদ-এর নাটক "কোথাও কেউ নেই" দেখার পর জীবনে প্রথম নাটকের মোহে পড়েছিলাম; সে অনেক অনেক আগের কথা। সে দিক বিচারে আমি "কোথাও কেউ নেই", "আজ রবিবার", "বহুব্রীহি" নাটকগুলো আজও বারংবার দেখতে সম্মতি জানাই। এই সম্মতিতে আমি যতটুকু আগ্রহী ঠিক ততটুকু উদাসীন ইদানিংকার দেখা নিয়ে। আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, শেষ ধারাবাহিক নাটক দেখেছি যতদিন আগে, ততদিনে কয়েক হাজার ধারাবাহিক এসেছে ছোট পর্দায় নানান সময়ে!
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নিবেদিত, কচি খন্দকার পরিচালিত আমার দেখা একটি সার্থক নাটকের নাম "খসরু+ময়না"। বাংলাদেশীয় একটি টিভি চ্যানেলে "ছবিয়াল উৎসব" নামে এক-ঘন্টার নাটক প্রচারের ধারাবাহিকতা নিয়ে শুরু হওয়া এই নাট্য-উৎসবে এই নাটকটিও অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তা নিয়েই আজকের আয়োজন।
নড়াইলে নাটকের শুটিং চলাকালে কচি খন্দকার কি একবারের জন্যেও ভেবেছিলেন তিনি কী উপহার দিতে যাচ্ছেন? চারপাশের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ ও আড্ডার ছলে বন্ধুমুখর প্রতিদিনের ছবি দেখতে পাই এই নাটকে। নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শক চাহনি কৌতুহলে পরিপূর্ণ হয়ে থাকবে; সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। একের পর এক বাস্তব জীবনের খুটিঁনাটি ঘটনার আবেশ, পাড়ার ছেলেদের দস্যিপনা আর নিকটবর্তী নারীর প্রতি প্রেম, সব মিলিয়ে নাটকের প্রতি দর্শক আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে।
চতুর্থবার ম্যাট্রিকে ফেল করা খসরু রোজকার মত বেলা করে ঘুম থেকে উঠেই অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে স্কুলের দিকে রওনা হয়। এদিকে মা রেডিওতে খবর শুনতে পায় ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এ খবর খসরু'র খুব ভাল করে জানা, তা স্বত্তেও সে এমন ভান করে যেন রেজাল্ট প্রসঙ্গটা তেমন কোন ব্যাপারই না আর তাছাড়া মফস্বলে রেজাল্ট কয়েকদিন পর আসে। মাকে কোনরকম বুঝিয়ে চলে আসতে পারলেও এলাকার মুরুব্বিদের চোখ ফাঁকি দিতে পারে না সে। স্কুল বিল্ডিংয়ের দোতলায় দেয়ালের ফোঁকর দিয়ে উল্লাসিত ছাত্রদের ঢল দেখে ভেতরটা নৈরাশ্যের হাহাকারে জেগে উঠে তার, আর এদিকে মনে মনে মহান আল্লাহর কাছে মোনাজাত করে জানায়, জীবনের ক্ষুদ্র ভুল-ত্রুটির জন্য সে বিশেষভাবে ক্ষমাপ্রার্থী এবং উদাসীন জীবনে কতিপয় মাদকতার উর্ধ্বে থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে ইবাদতের মাধ্যমে জীবন পরিচালনার একরকম প্রতিজ্ঞা করবে সে, যদি সৃষ্টিকর্তা তাকে পরীক্ষায় পাশ করার মর্জাদা দান করে। কিন্তু বিধাতার নিকট সে বার্তা বর্তায় না; যশোর বোর্ডের অকৃতকার্য ছাত্রদের তালিকায় নিজেকে পুনোর্বহাল রেখে ফেল করার এক অসামান্য কৃতিত্বের ভাগিদার হয় "খসরু" অর্থাৎ নাটকের নাম চরিত্রের প্রেমিক পুরুষ।
অতঃপর খসরু'র ফেল করার ঘটনা মুহূর্তের মধ্যেই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। আবার দেখি পাচঁবার ফেল করা উপলক্ষে এলাকায় রীতিমত হৈচৈ পড়ে যায়। পলাতক দেহ নিয়ে খসরু হাজির হয় এলাকার ভাই-ব্রাদার ও সহপাঠী বাচ্চুর কাছে। খসরুকে সাথে নিয়ে বাচ্চু, ভট্ট এই তিনজন গ্রাম ছেড়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে টাউনের পথে চলে আসে। তিনজনই ঐ বছর অকৃতকার্য হয় এবং পরবর্তীতে গ্রাম ছেড়ে চলে আসার ঘোষণা দেয়, চলেও আসে। কষ্ট বিসর্জন দিতে মাদকতার স্বাদে সুখলাভের আশায় রাতের আধাঁরে জহুরুলের বাড়ির ভাঙ্গা প্রাচীরের পাশে বোতলভর্তি মোজমাস্তির নিকটবর্তী হতে দেখি বিদ্যাবৈরাগী কতিপয় তিন যুবককে।
অতঃপর একটি বছর হয়তো এভাবেই কেটে যায়...
খসরু পরের বছর ঘটনাক্রমে পাশ করে যায়। প্রতি বছর গণিতে ফেল করা খসরু নিজের পাশ করা উপলক্ষ্যে এক নৈশ্য-পানের আয়োজন করে। চারপাশের সবাইকে জানান দিতে এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করে। প্রতিবেশী এক মামাকে সে তার পাশ করার সু-সংবাদ দিয়ে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়। সব মিলিয়ে নিজেকে নতুনভাবে প্রকাশ করার সুযোগ আসে খসরু'র। এলাকায় "খসরু ও তার দল" নামে পরিচিতি পাওয়া বিচ্ছুবাহিনী হঠাৎ কেমন যেন বদলে যেতে থাকে। নিকটবর্তী নারীর প্রতি প্রেমের সাক্ষাত পাই এর পর থেকেই। ময়নার প্রতি খসরুর প্রত্যাশিত প্রেমে বাধাঁ হয়ে দাড়াঁয় বয়স, বাধাঁ হয় শিক্ষাগত যোগ্যতা। "ময়না" নামের মেয়েটি যেন কোনভাবেই খসরুকে সহ্য করতে পারে না, তা খসরু যতভাবেই তার সামনে এসে উপস্থিত হয়, ময়না শুধু তার ঘৃণাটুকুই প্রকাশ করে। তা স্বত্তেও খসরু চেষ্টার ত্রুটি করে না এবং নতুন, অভিনব সব পদ্ধতির সাহায্য নেয়।
এলাকার ভাই ব্রাদার বাচ্চুর পরামর্শ অনুযায়ী ময়নাকে প্রেম নিবেদনের জন্য খসরু কী না করতে বাকি রাখে! কিছুতেই যেন আর কাজ হয় না। ময়নার এক বান্ধবীকে খসরু অনুরোধ করে যেন সে ময়নাকে জানায় "খসরু তাকে ভালবাসে"। এই প্রস্তাবের পর ময়না জানায়, "খসরুর সাথে তার প্রেমের সম্ভাবনা নেই” এবং এদিকে দেখি এলায়ায় "রাঙ্গা" নামের এক প্রতিবেশীর আগমন ময়নাকে প্রভাবিত করে।
দীর্ঘ বিরতির পর প্রায় দেড়যুগ পর নড়াইলের কুড়িগ্রাম এলাকায় খসরুজ্জামান ওরফে খসরু’র রচনা ও পরিচালনায় নাটকের আয়োজন করা হয় আর এর মূল উদ্দেশ্য ময়না নামের মেয়েটিকে হাতে পাওয়া। সমস্ত পরিকল্পনা, সব আয়োজনের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্বকে জানান দিতে খসরুর মাঝে অন্য এক খসরুর দেখা পাই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, বিশ্ব বরেণ্য এস.এম. সুলতান সবাই যখন নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে মানুষের মনে-মনে,দেহে-অন্তরে দাগ কেটেছে; খসরুজ্জামানও চেয়েছিল কিছু একটা করে দেখাতে। কিন্তু সবার সব চাওয়া কি পূরণ হয়? এই নাটকে অন্তঃত তার দেখা মেলে না।
পরিশেষে দেখতে পাই ‘দুটি মন, দুটি আশা” নাটকটি আর মঞ্চস্থ করা হয় না। যাকে নিয়ে এতো কিছু করা, এতো আয়োজন, সেই ময়না অবশেষে রাঙ্গা নামের ছেলেটির লোক দেখানো ভালবাসায় সায় দেয়। খসরুকে মেনে নিতে যার এতো আপত্তি, সে খুব সহজেই ভুল প্রেমের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয় অকাতরে।
খসরু চরিত্রের সাথে আমাদের চারপাশের অন্য অনেকের ব্যর্থ প্রেমের মিল খুজেঁ পাই। সাধারনত নাটক যে পর্যায়ে গেলে তা সার্থক হয়ে ওঠে সে বিবেচনায় কোন অংশেই কমতি নেই এই নাটকে। ভালবাসার অপূর্ণতায় কোনো কমতি ছিল না, তা স্বত্তেও কি শুধু বিদ্যাবৈরাগী, দূরন্তপনাসুলভ আচরনের কারণে ময়না খসরুকে পরিত্যাগ করে? কিন্তু যে রাঙ্গার জন্য ময়নার প্রেমের দুয়ার সর্বদা উন্মুক্ত ছিল নাটকের শেষে দেখি সে রাঙ্গা ময়নাকে বলে দুশ্চরিত্র!
ময়নাকে লেখা খসরুর চিঠি* নাটকের সমাপ্তিকালে নাটকের ভাববস্তুকে দারুনভাবে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়। "খসরু+ময়না" নাটকে দেখি, ভালবাসা একজন মানুষকে দারুনভাবে প্রভাবিত করতে পারে; তা সে ভালবাসা সার্থক হোক বা না হোক!
তাহসিন গালিব
==========
মন্তব্য
নাটকের গল্প এভাবে বলে দিলে আমরা যারা এই নাটকটা দেখি নাই, তাদের মজাটা একটু মরে যায়। এই দিকটা পরেরবার একটু বিবেচনায় রাখবেন। নাটক দেখে সেটার গল্প তো আমরা জেনে যাবোই। যেটা জানতে পারবো না সেটা হল, এই নাটকের কোন দিকটি আপনাকে নাড়া দিয়েছে, কিভাবে, কেন এসব। আপনার নিজের কিছু কথাও আসুক। আপনার গল্পবলার ভঙ্গী আমার খারাপ লাগে নাই। আশা করি সচলে আপনার আরো লেখা পড়ব।
নাটকটা অনেক আগের দেখা।
গল্পটা সবই বলে দেয়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু এইটা নাটকের প্রিভিউ না। প্রিভিউ কিভাবে লেখে এখনো জানা নাই... ভবিষ্যতে সবদিক বিচার করে লিখতে বসবো আশা রাখি।
ধন্যবাদ
সাথে থাকেন!
দ্যাখেন ভাই, সিনামার রিভিউ লেখা গেলে নাটকের রিভিউ-ও লেখা যায়। কৌলিন্যের চর্চা করতে চাই না। কিন্তু একটু ভাইবেন, এই পার্টিকুলার নাটকটার রিভিউ লিখার আসলেই কি কোনো দরকার আসিলো? বিজ্ঞাপন ভাবলে তো মুশকিল। বাকি আপনার অধিকার, অভিরুচি ...
আর নাটকের এন্ডিং বলে দিলে ওই নাটক তো আর দেখতে মঞ্চায় না। আপনি কি তাই চান?
আমাদের লাইফটাও তো কম নাটক না। ওইটাও একটু লিখেন। অনুরোধ আর কি। লিখেন তো ভালো। ২ দিলাম।
__________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
সবদিক বিবেচনায় রেখে খুব শীঘ্রই নতুন কোনো গল্প লিখবো।
ভুল-ত্রুটি এইবারের মত ক্ষমা দেন।
লেখা পড়ার জন্য অশেষ মেহেরবান।
_________
তাহসিন গালিব
নাটকটা আমি দেখেছিলাম, আসলেই মজার ছিল। শেষটা বেশ সারপ্রাইজিং ছিল।
এই নাটকটা একবার দুরপাল্লার বাসে বসে দেখেছিলাম। মজাই লেগেছিলো।
...........................
Every Picture Tells a Story
টিভির সামনে বসি কালেভদ্রে, এই নাটকটা ছোট ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে দেখা হয়েছিলো... মজাই লেগেছে!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
টিভি দেখা হয় না বহুদিন। এ নাটকটাও দেখিনি। বই বা সিনেমার রিভিউ সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলি মজা নষ্ট হওয়ার ভয়ে। আপনি তো পুরোটাই বলে দিলেন। তবু লেখা ভালো লাগলো।
বানানে কিছু সমস্যা আছে।
নাটকের গল্পঃ > নাটকের গল্প: [বিসর্গের জায়গায় কোলন হবে]
ইদানিং > ইদানীং
বাংলাদেশীয় > বাংলাদেশী
কৌতুহল > কৌতূহল
খুটিঁনাটি > খুঁটিনাটি
খসরু'র > খসরুর
স্বত্তেও > সত্ত্বেও
উর্ধ্ব > ঊর্ধ্ব
পুনোর্বহাল > পুনর্বহাল
ভাগিদার > ভাগীদার
ভাঙ্গা > ভাঙা
সু-সংবাদ > সুসংবাদ
বাধাঁ > বাধা [obstacle অর্থে]
দাড়াঁয় > দাঁড়ায়
খুজেঁ > খুঁজে
সাধারনত > সাধারণত
দূরন্তপনা > দুরন্তপনা
আচরন > আচরণ
দারুন > দারুণ
এ ব্যাপারে সচেতনতা আশা করছি।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
ভয়াবহ লিস্টি!
লেখা শেষে একবার পড়ে দেখা উচিৎ ছিল, তাহলে হয়তো আপনার কষ্ট আর একটু কমতো। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
_________
তাহসিন গালিব
নাটকটা আগেই দেখা, আপনার লেখাটা পড়ে ভালোই লাগলো। তবে এখনতো বেশিরভাগ নাটকই বস্তাপঁচা, তাই দেখি না। শেষ কবে বাংলা নাটক দেখছি ভুলেই গেছি।
পাগল মন
নতুন মন্তব্য করুন