- অনন্ত আত্মা
আমাদের বাঙালীদের জীবনে ধার এর গুরুত্ব অপরিসীম। ধানমন্ডি থেকে সুদূর ধ্যাধধ্যারে গোবিন্দপুর, যেখানেই যান ধারের ধার থেকে আপনি নিরাপদ নন।
আমাদের মহল্লার সফেন ভাই ছিল একজন বিশিষ্ট ধাররাজ। আড়ালে আমরা তাকে ধার সসপেন বলতাম। আমার বন্ধু কমল কোন এক কুক্ষণে তাকে তিন’শ টাকা ধার দিয়েছিল। টাকা নেয়ার সময় সফেন ভাই বলেছিল –
- কমল চিন্তা করো না, সামনের সপ্তাহেই দিয়ে দেবো।
তারপর কমলের সামনে দিয়ে অনেকগুলো সপ্তাহ চলে গিয়েছিল, কিন্তু কমল সেই টাকা তো দূরের কথা সফেন ভাইকেও কখনও সামনের উপর পায় নাই। প্রায় মাস তিনেক পরে, কমল এলাকার এক চিপার মুখে হাস্যমুখে সফেন ভাইকে কোন এক মক্কেলের সাথে কথা বলতে দেখে, এক দৌড়ে সেখানে হাযির হল। এরপর কমল কোন ভূমিকার ধার না ধেরে তার ধার ফেরতের দাবী সংক্রান্ত বিলটা উত্থাপন করার জন্য মাত্র হা করেছে, কিন্তু তার আগেই সফেন ভাই বলছে –
- কমল তুমি তো আমার কাছে তিন’শ টাকা পাও; কমল তুমি বরং এক কাজ কর, তুমি এখন আমাকে দুই’শ টাকা দাও, আমি এই ঘুরে এসেই তোমাকে একসাথে পাঁচ’শ টাকা দিয়ে দিচ্ছি।
কমলের মুখের হা বন্ধ না হয়ে আরো বড় হয়ে মোটামুটি রাজহাঁসের হাফ-বয়েল ডিমের যাতায়াতের রাস্তা হয়ে গেল। কোনমতে হা বন্ধ করে বলল – ভাই আপনে যান, আর ঐ তিন’শ টাকাও আপনার আর দেয়ার দরকার নাই।
আসলে ধার এর ব্যাপারটাই এমন যে অনেক সময় ঘাড় ধরেও ধারের টাকা ফেরত পাওয়া যায় না, আবার অনেক সময় বিনা আয়াসেই পকেটের ছেলে পকেটে ফিরে আসে।
আমার এক কলিগ একবার আমার কাছে সপ্তাহখানেকের জনা শ’পাঁচেক টাকা ধার করল, সপ্তাহ শেষ হবার আগেই ভদ্রলোক সেই টাকা শোধ করে দিল। পরের মাসে আবার উনি টাকা নিলেন এবং সময় মত শোধ করে দিলেন। তৃতীয় বারের বার আবার যখন টাকা চাইল, আগের দু’বারের ‘হালায় দিব তো’ মনের ভাবের বদলে ‘আরে দিয়া দিব’ মনের ভাবে টাকা দিয়ে দিলাম। এবার অবশ্য দুই মাস পার হয়ে গেলেও আমার কলিগ ভদ্রলোকের টাকা দেবার আর কোন খবর নাই, ইতোমধ্যে আমি অবশ্য ধারের ব্যপারটা ভুলেও গিয়েছিলাম।
একদিন করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, আমার কলিগ তখন ক্লাস নিচ্ছিল মানে কোন একটা ক্লাস ওয়র্ক দিয়ে ক্লাসরুমের দরজায় দাড়িয়েছিল। আমি প্রায়শই এই রকম ক্রশিয়াল মুহূর্তে কলিগদের উল্টাপাল্টা ঝাড়ি দেই কারণ ক্লাস নেয়ার সময় কেউ তো আর ঝাড়ির উত্তরে কিছু বলতে পারবে না। এইসব সময়ে ঝাড়ি দেয়াটা তাই সবচেয়ে নিরাপদ। যথারীতি তাই ওকে দেখে ঝাড়ি দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না –
- কিরে তুই এখনও দুই পায়ের উপর খাড়ায়া আছোস? এক লাত্থি দিয়া চাইর তালার থে নিচে ফালায়া দিমু।
ঝাড়ি শেষ করেই ওর ফ্যালফ্যালে মুখের সামনে দিয়ে আমি চ্যালচ্যালায়া চলে আসলাম। সেই দিন রাতে আমার মোবাইলে একটা ম্যাসেজ আসলো –
Don’t panic, I’ll refund your money on next week.
বলা বাহুল্য দিনে ঝাড়ি খাওয়া আমার কলিগ ভদ্রলোকই রাতে আমাকে ম্যাসেজটি প্রেরণ করেছিলেন।
আমার ভার্সিটি লাইফের বন্ধু দেবাশীষের ধার বিষয়ক কথাগুলো জটিল ছিল। হয়তো কারো কাছ থেকে ধার নিয়েছে কিন্তু শোধ করতে পারছে না, এই রকম সময়ে পাওনাদার বন্ধুটির সাথে পথে দেখা হয়ে গেল। ও যেটা করত সেটা হচ্ছে, দৌড়ে বন্ধুটির কাছে যেত, তারপর বলত –
- দোস্ত কি অবস্থা ক্যামন আছস ?
বন্ধু হয়তো কুশলাদির ধারে কাছে দিয়ে না গিয়ে, ধারের কথাটা ওকে মনে করিয়ে দিতে যাবে; কিন্তু দেবার সাথে পারবে কেন, দেবা তো অনেক ফাস্ট
- তুই কিন্তু আমার কাছে দুই’শ টাকা পাস, আমি কিন্তু ভুলি নাই।
দেনাদার বন্ধুর এই রকম আত্ম-উপলব্ধিমূলক কথার পরে পাওনাদার বন্ধুর আর কী বা বলার থাকে।
ধার বিষয়ক সবচেয়ে মজার জিনিস হচ্ছে সময় দেয়া। আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান হচ্ছে; যেই লোক ঠিক-ঠাক মত ধার ফেরতের সময় দেয়, বেশীরভাগ সময়ে সে ধার শোধ করে না, কিংবা বলা যায় সেই সময়ে ধার শোধ করে না। হয়ত বলল –
- সামনের শুক্রবার জুম্মার নামায কি এলাকার মসজিদে পড়বেন? তাইলে ওই সুময়ে টাকাডা দিয়া দিমুনে।
তারপর? তারপর শুক্রবার আসে, জুম্মার নামায ও শেষ হয় কিন্তু ধারের টাকা সুদূর পরাহত, অনেকটা সুনিলের কবিতার মত আক্ষেপ বেরিয়ে আসে পাওনাদারের হৃদয় চিড়ে –‘কেউ কথা রাখে না’।
মন্তব্য
আমার ধার অভিজ্ঞতা ভালো। যাকেই দেই সে আবার সময়মতো ফিরে দেয়।
ব্যাংক যেই ইন্ডিকেটরগুলো দেখে জনগনকে লোন দেয় সেই রকমভাবে দেখে-শুনে ধার দিলে ফেরতের সম্ভাবনা বেশী থাকে।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
অনন্ত আত্মা
উদ্ধৃতি
'কেউ কথা রাখে না'
কেউ কথা দিলোই না, আর রাখবে কী? কাউকে কখনো ধার দিলে তবে তো ফেরত দেয়ার প্রশ্ন...
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধার তো অনেক ধরনের হয়, আমার এই গল্পটা অর্থনৈতিক ধার সম্পর্কিত। মনে হয় সুনিলের কাব্যকথা পড়ে আপনি হৃদয়ঘটিত ধার বিষয়ক আবেগে আবেগতাড়িত হয়ে গিয়েছেন। ব্যাপার না।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
অনন্ত আত্মা
কাউকে টাকাপয়সা ধার দিই না বলে ফিরে পাওয়া নিয়ে টেনশিত হতে হয়না... সেটাই বুঝিয়েছিলাম| হালকা ধাঁচে মন্তব্যের কারণেই বোধহয় 'আবেগ' খুঁজে পেয়েছেন! ব্যাপার না.. লিখতে থাকুন|
_______________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ব্যাপার না, একটু জোক করেছিলাম।
ভাল থাকবেন।
অনন্ত আত্মা
ব্যাড ডেটের মতো হতে থাকলে ডোনেট করাই শ্রেয়। ১ টাকায় ৭০ টাকা।
রাতঃস্মরণীয়
ভাই আপনার ঠিকানাটা দিবেন, বন্ধু দেবাকে দিতাম। বেচারার তাহলে একটু উপকার হয়।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
অনন্ত আত্মা
সবই বুঝলাম। কিন্তুক সসপেনের বিষয়টা কী?
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
আসলে বিবর্তনের সূত্রে সফেনই সসপেন হয়ে গেছে। ডারউইন বিবর্তনের সূত্রে বানরকে মানুষ বানিয়ে ফেলল যেটা কিনা আবার তাবৎ দুনিয়া বিশ্বাসও করে ফেলল। আর আমি (এবং আমরা) শুধু সফেনকে সসপেন বানিয়েছি, বেশি কিছু তো পরিবর্তন করি নাই। একটু কষ্ট করে বিশ্বাস করে ফেলেন।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
অনন্ত আত্মা
ভালো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধন্যবাদ।
অনন্ত আত্মা
নতুন মন্তব্য করুন