খোলা চিঠি - ১ :: সৃষ্টি ও ছন্দাকে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০৯/০৮/২০১০ - ৭:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সৃষ্টি,তুই আমার জীবনের প্রথম সত্যিকারের বন্ধু, হৃদপিণ্ডের খুব কাছাকাছি কী করে একটা মানুষকে জায়গা করে দিতে হয়, তোর কাছেই প্রথম শেখা । আমাদের দুজনের ভীষণ গাঢ় বন্ধুত্বে কবে কী করে আরেকটা নাম যোগ হয়ে গেল - তুই, আমি, ছন্দা - আমরা কেউ জানি না ।

মনে পড়ে শৈশবের উচ্ছাস ভরা দিনগুলো, কী ভয়ানক দুষ্টু হয়ে উঠছিলাম আমরা! পাল্লা দিয়ে পড়াশোনা, খেলাধুলা, গোয়েন্দাগিরি আর আজগুবি সব স্বপ্নবোনা । তিনজন তিনজনকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারতাম না ! এই, তোদের মনে আছে রে, সেবার বৃত্তি কোচিংয়ে কী সব মজার মজার কাণ্ড ঘটলো! হাফিজ স্যারকে ভুলতে পারিস নি, জানি । কী ভীষণ আদরটাই না করতেন স্যার আমাদের তিনজনকেই ।এই সেদিন জানিস, হঠাত্‍ রাস্তায় দেখা হয়ে গেল স্যারের সাথে । কিভাবে কিভাবে যেন চিনে ফেললেন আমাকে ! ওহ, তোরা তো জানিস না আমি চুল কেটে ফেলেছি যে । দেখলে হয়তো তোরাও চিনতে পারবি না এখন !
এইই, মনে আছে, আমরা তিনজনে যে একবার রক্তশপথ করেছিলাম - সেফটিপিন দিয়ে আঙুল ফুটো করে । কী ছেলেমানুষই না ছিলাম !

আরেকবার ক্লাস ফোরে থাকতে আমি খুব অসুস্থ হয়ে গেছিলাম, ছন্দা তুই আনাড়ী হাতে ছুটির দরখাস্ত লিখে অসহায়ের মত দৌড়াদৌড়ি করেছিলি স্যার ম্যাডামদের কাছে - এতো ভালবাসতি আমাকে !

আমাদের তিনজনের বন্ধুত্বটা ক্লাসের সবাই উপভোগ করতো - আসলে আমাদের খ শাখার প্রত্যেকটা মেয়েই তো ছিল আমাদের বন্ধু । ইতু, মোটা মুন্নী, মিতুল, নিশি, তামান্না, মনিকা, নিটোল, প্রিংয়াকা - কয়জনের কথা বলবো ! মনে আছে, একবার নিঘাত শবনম ম্যাডাম ক্লাসে জিজ্ঞেস করেছিলেন বড় হয়ে কে কী হবে, কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার , আমরা তিনজন একবাক্যে বলে দিলাম, গোয়েন্দা হব । এখন খুব হাসি পায় সেসব মনে পড়লে ।

সিফাতও আমাদের তিনজনের খুব ভাল বন্ধু ছিল, বিশেষ করে আমার । কিন্তু হঠাত্‍ একদিন কী হল, একদিন হুট করে মেয়েটা আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিল ।
তোদের সাথে আগের মতই ছিল । যত রাগ সব আমার সাথে । বন্ধুবিচ্ছেদের কষ্টটা সেই প্রথম টের পেলাম । বহু বহু বছর পরে, ক্লাস টেনের বিদায়দিনে আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিল ও, সব অভিমান ভুলে ক্ষমা চেয়েছিল আমার কাছে ।

আমি ইংলিশ মিডিয়ামে চলে আসার পর একটু একটু করে দূরত্ব বাড়ে আমাদের তিনজনের, সিলিয়া, মৃদুলা, শুভ, কতজনই তো চলে আসলো আমাদের মাঝখানে । মুনীরা আর নুসরাতও হয়তো তোদের থেকে দূরে যাওয়ার একটা কারন । কী করবো বল, ওদের দুটোকে ছাড়াও তো থাকতে পারতাম না ! দূরে ছিলাম, কিন্তু জানতাম সবসময়, তিনজন আমরা একসুতোতেই বাঁধা আছি । তারপর একদিন অবাক হয়ে শুনি, সৃষ্টি-ছন্দার নাকি মুখ দেখাদেখি বন্ধ !
একটু একটু করে অনেকের মুখে অনেক কিছু শুনি । দুজনের সাথেই দেখা হয়, কারুকেই দোষ দিতে পারি না আমি । ছন্দার সেই আজীবন জেদ আর সৃষ্টির একদম একা হয়ে যাওয়ার কষ্টে ধীরে ধীরে কুঁকড়ে যেতে থাকা । দুটোর কোনটাই সহ্য করতে পারি না ।

সৃষ্টিরা তখন শাজাহানপুর থেকে বনশ্রীতে চলে এসেছে, ওকে সঙ্গ দিতে রোজ রোজ ছুটতাম ওদের বাসায় । কত কত দিন, কত কত গান, হাসি, আড্ডা । সৃষ্টি রে, তোর কষ্টগুলো কি একটু হলেও কম করতে পেরেছিলাম ?

ছন্দা, নাইনে আমি আবার বনশ্রীতে ফিরে আসার পর তুই ক্লাসে একদিন চিত্‍কার করে কেঁদেছিলি লিভারের ব্যথায়, মনে পড়ে? আমার 'বেষ্টফ্রেণ্ড' তখন অন্য কেউ, তোরও । আমি দেখি মৃদুলা তোকে জড়িয়ে ধরে আছে, তোর কষ্টে কাঁদছে সেও । আমি কাঁদতে পারি নি, শুধু সেই ছোট্টবেলায় তুই যেমনটা করেছিলি - ছোটাছুটি করে আন্টির কাছে নিয়ে গেছিলাম তোকে । বিশ্বাস কর ছন্দা, বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল রে সেদিন নিজেকে সামলাতে ।

একটা সময় কী অদ্ভুতভাবে তিনজন তিনদিকে ছিটকে গেলাম! আমার না, এখনও বিশ্বাস হয় না জানিস ! কী থেকে কী হয়ে গেল বল তো ! এমনভাবেই ছিঁড়ল সব, কোনও আঠাতে আর জোড়া লাগবে না । আমরা তিনজন আর আগের মত করে এক হতে পারবো না কোনওদিনও, জানি, কিন্তু একদিন তোরা আমারই ছিলি । আমি খুব করে বিশ্বাস করি রে, তোদের ভেতরে এখনও একটা আমি আছি ।

সেই আমিটা চুপিচুপি খুব কাঁদে রে । বড্ড দেখতে ইচ্ছে হয় তোদের দুটোকে । একসাথে । সেই আগের মতন । ছন্দা রে, কতদিন তোর ভুবনভোলানো হাসিটা দেখি না ! সৃষ্টি, জানিস, তোর হাতের সেই লেবু চায়ের সুবাস এখনও নাকে লাগে । একটা দিন, সত্যি করে না হোক, মনে মনে, চল না আবার স্কুলের পুরোন মাঠটায় গিয়ে বসি, আমাদের সেই মাঠ, ঘাসকার্পেটে শুয়ে আকাশ দেখি চল, খুনসুটি করি, কারন ছাড়াই হেসে কুটিকুটি হই চল । একটা কোনও স্বপ্ন আবারও তিনজনে মিলে দেখি চল । ঠিক আগের মতন ।

অনন্যা ফারজানা,
২৬ জুন, ২০১০ ।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

বলতে পারিস
তুই একদিন বলতে পারিস
তুই প্রতিদিনই বলতে পারিস
আর খুবলে খাবি জোছনা
বেশ তো

অন্য কারো খন্ড খন্ড অশ্রু
ভীষণ ভয়ংকর চুলের প্রতিফলন
একবাক্যে বলে দেব
ঘটে গেছে
হয়ে গেছি

কাকলী এর ছবি

হায়রে ভালবাসা..........

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।