তালিবানের জন্মকথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো (পর্ব ৩)

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি
লিখেছেন রাতঃস্মরণীয় [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৬/০৮/২০১০ - ১:৫১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তালিবানের জন্মকথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো (পর্ব ১)
তালিবানের জন্মকথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো (পর্ব ২)

(চিন্তা করছিলাম সংক্ষেপে সেরে ফেলবো লেখাটা কিন্তু হলো না। ভূমিকাতেই কয়েকটা পর্ব চলে গেলো। ইচ্ছে করলে এই পর্বগুলো বাদ দিয়ে সরাসরি তালিবান রিজিমে চলে যেতে পারতাম কিন্তু মন সায় দিলো না। লেখা বিরক্তিকর হয়ে উঠলে ক্ষমাপ্রার্থী। আর এই লেখা তৈরী করতে গিয়ে শতাধিক ওয়েবসাইট ঘাটতে হয়েছে। তবে সবথেকে বেশি সাহায্য পেয়েছি উইকপেডিয়া থেকে। গুরুত্বপূর্ণ লিংকগুলোই শুধু এখানে দিচ্ছি। তবে এই প ...(চিন্তা করছিলাম সংক্ষেপে সেরে ফেলবো লেখাটা কিন্তু হলো না। ভূমিকাতেই কয়েকটা পর্ব চলে গেলো। ইচ্ছে করলে এই পর্বগুলো বাদ দিয়ে সরাসরি তালিবান রিজিমে চলে যেতে পারতাম কিন্তু মন সায় দিলো না। লেখা বিরক্তিকর হয়ে উঠলে ক্ষমাপ্রার্থী। আর এই লেখা তৈরী করতে গিয়ে শতাধিক ওয়েবসাইট ঘাটতে হয়েছে। তবে সবথেকে বেশি সাহায্য পেয়েছি উইকপেডিয়া থেকে। গুরুত্বপূর্ণ লিংকগুলোই শুধু এখানে দিচ্ছি। তবে এই প্রসঙ্গে গুগলে সার্চ দিলে হাজার হাজার রেফারেন্স পাওয়া যাবে। ধন্যবাদ)

১৯৭৮ সালের ১৭ই এপ্রিল পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তান (পিডিপিএ)-এর নেতা মীর আকবার খাইবারের রহস্যজনক হত্যাকান্ড ক্ষমতাসীন সরদার দাউদ খানের সরকারের পতনের সুচনা করে। যদিও দাউদ খান চেয়েছিলেন পিডিপিএকে নিশ্চিন্হ করে দিতে এবং এজন্যে তার সরকার অধিকাংশ পিডিপিএ নেতাকে বন্দী করে রেখেছিলেন। কিন্তু হাফিজুলালাহ আমিন এবং পিডিপিএর সামরিং উইং দলের শক্তিকে ধরে রেখে আরও জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষে কাজ করে যাচ্ছিলেন। মাত্র ১০ দিন পরে নূর মোহাম্মদ তারেকী, বাবরাক কারমাল এবং আমিন তহ’র নেতৃত্বে সরদার দাউদ খানকে সপরিবারে হত্যার মধ্যে দিয়ে পিডিপিএ আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। এই ঘটনার নাম দেওয়া হয় ‘সায়ুর বিপ্লব’। পারসিয়ান ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় মাস সায়ুরে এই বিপ্লব ঘটে বলেই এই নামকরণ।

ক্ষমতা গ্রহনের সাথে সাথেই পিডিপিএ উদারপন্থী সমাজতন্ত্র বাস্তবায়ন শুরু করে। মে মাসের ১ তারিখে তারেকী নিজেই প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহন করেন এবং পিডিপিএর সাধারন সম্পাদক নিযুক্ত হন। আফগানিস্তানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব আফগানিস্তান। তারা প্রচলিত এবং ধর্মীয় আইনের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ এবং মার্কসবাদী আইন প্রচলিত করে। এই সরকার শুরুতেই আরও যে কাজগুলো করে তা হলো পুরুষদের দাড়ি শেইভ বাধ্যতামূলক ও নারীদের বোরখা পরা নিষিদ্ধ করা; মসজিদের সংখ্যা সীমিত করা; দেশব্যাপী ভূমি সংষ্কার; সমূদয় কৃষি ঋণ মওকুফ এবং মহাজনী প্রথার বিলুপ্তকরণ। এই সরকার নারী অধিকার রক্ষায় সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নেয় যেমন জোরপূর্বক বিবাহ নিষিদ্ধ, নারীদের ভোটাধিকার এবং সক্রিয় রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ।

পিডিপিএ সোভিয়েত ইউনিয়নকে আমন্ত্রণ জানায় আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আধুনিকায়নে সহযোগিতার জন্যে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো প্রাকৃতিক গ্যাস এবং দূর্লভ খনিজসম্পদের অনুসন্ধান এবং উত্তোলন। সোভিয়েত ইউনিয়নও দক্ষ ঠিকাদারদেরকে আফগানিস্তানে পাঠালো রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংষ্কার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, পানিয় জলের উত্তোলনসহ বিভিন্ন প্রজেক্ট দিয়ে। একই সাথে তারা আফগান সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও সামরিক সরঞ্জান দিয়ে উন্নত করতে লাগলো। আর যেহেতু আফগানিস্তান তার নাম পরিবর্তন করে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব আফগানিস্তান রেখেছে; এই নতুন প্রজাতন্ত্রকে পুনর্গঠন করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ন্যূনতম ১.২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অনুদান ঘোষনা করলো। উল্লেখ্য যে এই অনুদানের একটা বিরাট অংশ খরচ হলো আফগানিস্তানে কর্মরত সোভিয়েত ঠিকাদারদের বিল পরিশোধে।

পিডিপিএর এইসব নীতি কাবুল এবং শহর এলাকার কিছু মানুষের সমর্থন পেলেও মফঃস্বল ও গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ এই নীতিকে মেনে নিলো না। বিশেষ করে যারা ধর্মভীরু, তারা প্রচলিত্ ইসলামিক বিধিনিষেধের বাইরে যেতে চাইলো না এরা নারীর অধিকার মেনে নিলো না। আর এক দল যারা ভূমি সংস্কারের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, এর্ও সরাসরি নতুন আফগান নীতির বিরোধিতা করলো। এর ফলে দেশে বিচ্ছিন্ন গোলযোগ এবং নাশকতামূলক কর্মকান্ডের সূচনা হলো। এরমধ্যে ১৯৭৯ সালের মার্চে ফিল্ড মার্শাল হাফিজুল্লহ আমিন আফগানিস্তানের প্রদানমন্ত্রীর পদ দখল করলেন। প্রেসিডেন্ট তারিক সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন প্রেসিডেন্ট থাকলেন নভেম্বর মাসে নিহত হওয়া পর্যন্ত।

ঠিক এমনই সময়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া-উল-হক প্রকাশ্যেই আফগানিস্তানে সোভিয়েত প্রভাবের বিরোধিতা করলেন। সিআইএর নির্দেশনামতো আইসিআই পশতুন গোরিলাদের (ডুরান্ড লাইনের উভয় পাশের) সংগঠিত করে আফগানিস্তানে অভিযানের জন্যে তৈরী করতে লাগলো এবং দফায় দফায় পাকিস্তানী মুজাহেদিনদেরকে এনডব্লিউএফপি দিয়ে আফগানিস্তানে ঢুকাতে লাগলো। এই মুজাহেদিনরা আফগানিস্তানে পিডিপিএর ইসলাম বিরোধী ও সোভিয়েতবান্ধব নীতির বিরুদ্ধে জনসাধারণকে খেপিয়ে তুলতে লাগলো এবং বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু করে দিলো। এরা খুবই অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক জনসমর্থন ও সাফল্য পেতে লাগলো।

সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ব্রেজনেভ হাফিজুল্লাহ আমিনের প্রেসিডেন্ট তারিককে হত্যার মতো হঠকারী সিদ্ধান্তে অত্যন্ত রাগন্বিত হলেন। এবং তিনি ও অন্যান্য সিনিয়র সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ আশংকা করতে লাগলেন যে ক্রমর্বধমার মুজাহিদিন কর্মকান্ডের ফলে অচিরেই আফগানিস্তানের সমাজতান্ত্রিক শাসন পরাভূত হতে পারে। তারা আরও ধারণা করলেন যে এই ধরণের পরাজয় বিশ্বের সামনে সোভিয়েত ইউনিয়নেরই পরাজয় হিসেবে তুলে ধরা হবে এবং যা সোভিয়েত ইউনিয়নভূক্ত মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। এমনই এক অবস্থার মধ্যে ১২ই ডিসেম্বর ১৯৭৯ সোভিয়েত আর্মি আফগানিস্তানে এবং ২৫শে ডিসেম্বর কাবুলে ঢুকে পড়ে। এরপর ২৭শে ডিসেম্বর তারা হাফিজুল্লাহ আমিনকে হত্যা করে কাবুলের দখল নেয় এবং বাবরাক কারমালকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্বের এক দশকের সূচনা করে। মস্কোকেন্দ্রিক একটা উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয় যারা মস্কো বসে আফগানিস্তান সরকার পরিচালনা করবে।

সেসময়ে বাংলাদেশের বিশিষ্ঠ ছড়ারাজ কবিরত্ন কাব্যতীর্থ মাওলানা রুহুল আমিন খান বাবরাক কারমালের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শণ করে একটা ছড়া লিখেছিলেন যার শেষ দুটো লাইন ছিলো-

“বাবরাক কারমাল,
স্বজাতির অভিশাপ বয়ে যাক চিরকাল।।”

এরও কিন্তু বেশ আগে, যখন পিডিপিএ সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সহযোগিতার চুক্তিগুলো স্বাক্ষর করছিলো, বিষয়গুলো আমেরিকার জন্যে যথেষ্ঠ উদ্বেগের সৃষ্টি করছিলো। আমেরিকার দক্ষিণ এশিয়ার আজ্ঞাবহ পাকিস্তানের একপাশে ভারতের উপস্থিতি তাদের জন্যে একটা সার্বক্ষণিক উদ্বেগের বিষয় ছিলো। তার উপরে, পাকিস্তানের অপর প্রতিবেশী আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় সোভিয়েত প্রভাব, পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে অবাধ সোভিয়েত উপস্থিতি, সম্ভাব্য সোভিয়েত অর্থনৈতিক আগ্রাসন এবং সর্বোপরী আফগানিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিপাক্ষিক সামরিক সহায়তা চুক্তি আমেরিকাকে বিচলিত করে তুললো। ফলশ্রুতিতে, প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও পোল্যান্ডে জন্মগ্রহনকারী পোলিশ বংশোদ্ভূত্ আমেরিকান ন্যাশনাল সিকিউরিট এ্যাডভাইসর ব্রজেজিনস্কির যৌথসিদ্ধান্তমতো আমেরিকা সরকার আইএসআইএর মাধ্যমে সোভিয়েতবিরোধী উষ্মা ছড়িয়ে দিতে ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ জোরদার করতে মুজাহেদিনদের অর্থায়ন ও প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলো। একইসাথে আমেরিকা, পাকিস্তান চীন এবং সৌদি আরব মুজাদেহিনদের জন্যে ব্যাপক তহবিল সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকলো এবং আমেরিকা পাকিস্তানের মাধ্যমে বিপুল পরিমান অস্ত্র, গোলা-বারুদ ও যুদ্ধ সরঞ্জাম পাঠাতে লাগলো মুজাহেদিনদের জন্যে। এসময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অগণিত মুসলিম যুবক আফগানিস্তানে সমাবেত হয়ে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলো।

আমেরিকা ও পাকিস্তানের কূটকৌশলে ক্রমশঃ ডুরান্ড লাইন প্রসঙ্গটা ঢাকা পযে গেলো এবং পশতুন উপজাতিদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে এই চক্রের সৃষ্ট মুজাহেদিন বাহিনী গুলবুদ্দিন হেকমত ইয়ারের মুজাহেদিন বাহিনির সাথে একাত্ম হয়ে গেলো এবং গোটা মুজাহেদিন বাহিনি বাড়তে বাড়তে সংখ্যায় দুই লাখেরও বেশি হয়ে গেলো। এখানে দেখুন আহমাদ শাহ্‌ মাসুদের ছবি-

AFGHANISTAN-MASSOUD

এর মূল নেতৃত্ব থাকলো হিজবে-জামায়াতে-ইসলামী (অথবা শুধু জামায়াতে ইসলামী) এবং সোভিয়েতপরবর্তীকালে শুধু হিজবে ইসলামী পার্টির সামরিক শাখার প্রথান গুলবুদ্দিন হেকমাত ইয়ার এবং তরুন প্রগতিশীল জঙ্গিবাদবিরোধী নেতা আহমাদ শাহ্‌ মাসুদ (যাকে আফগানিস্তানের জাতীয় বীর এবং আধুনিক আফগানিস্তানের জনকের মর্যাদা দেয়া হয়) ও জেনারেল রশীদ দোস্তামের হাতে। এখানে দেখুন জেনারেল রশীদ দোস্তামের ছবি-

rashid dostum

এবং এটা আফগানিস্তান তথা সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্যে একটা চরম মাথাব্যাথা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলো। এর মধ্যে সোভিয়েত সরকার ১৯৮৬ সালের মে মাসে বাবরাক কারমালকে অযোগ্যতার অভিযোগে বরখাস্ত করে বামপন্থী ড. মুহাম্মাদ নাযীবুল্লাহকে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ দিলো। এখানে দেখুন গুলবুদ্দিন হেকমাত ইয়ারের ছবি-

Gul

এসময়ে সোভিয়েত ও মুজাহেদিন বাহিনীর সংঘর্ষে সৃষ্ঠ বিপদজনক পরিস্থিতিতে ৫ মিলিয়ন মানুষ পাকিস্তান ও ইরানে আশ্রয় নেয় এবং ২ মিলিয়ন মানুষ আফগানিস্তানের শহর ছেড়ে গ্রামে ও প্রত্যন্ত সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে আশ্রয় নেয়। সোভিয়েত বাহিনী মুজাহেদিন নিধনের নামে অগনিত সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্য করে। আমার ঘনিষ্ঠ প্রবীন বন্ধু ও সহকর্মী খাজা আলেফ হাকীম বলেছেন তার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা-

“পিডিপিএ ক্ষমতায় এসেই প্রথম ঘোষনা দেয় যে মাওবাদী সমাজতান্ত্রিক মতবাদীরা তাদের এবং আফগানিস্তানের এক নম্বর শত্রু। ব্যস, শুরু হয়ে যায় মাওবাদী দমন-পীড়ন। সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখলের পর পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম। যেহেতু আমি একজন প্রাদেশিক পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতা ও অত্যন্ত সক্রিয় মাওবাদী ছিলাম, সুতরাং কমবেশি সবাই আমাকে চিনতো ফলে আফগানিস্তানের ভিতরে পালিয়ে থাকাও আমার জন্যে খুব সহজ ছিলো না। হেরাত সীমান্ত দিয়ে ইরানে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে গেলাম। অত্যাচার কতো প্রকার হতে পারে তা আমি টের পেয়েছি। সকাল বেলায় এক-দুজন রাশান সৈন্য এসে আচ্ছামতো ধোলাই দিয়ে যেতো। এর কিছুক্ষণ পর আসতো অফিসার আমার জন্যে কফি আর সিগারেট নিয়ে। কফি-সিগারেট খাইয়ে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কত যে চেষ্টা করতো কথা বের করতে। যখন কাজ না হতো, আবার ধোলাই শুরু হতো অফিসারের উপস্থিতিতে। এভাবেই চলতো প্রতিদিন। হঠাৎ ওরা জেনে ফেলে যে আমি্ আহমাদ শাহ্‌ মাসুদের একই এলাকার মানুষ। তারপর থেকে শারিরীক ও স্নায়বিক নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। আমি যতোই বলি যে আমি মাওবাদী আর মাসুদ জামায়াতে ইসলামীর লোক, কে শোনে কার কথা। আমাকে যখন ওরা মারতো, মানে হতো ওরা ভাবছে এই পৃথিবীতে আমিই একমাত্র জানি আহমাদ শাহ্‌ মাসুদের সমস্ত খবরাখবর। মাঝে মাঝে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে গিয়ে চোখ বেঁধে, হাত বেঁধে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখতো। আশে পাশে গুলির শব্দ পেতাম আর মানুষের মরণ চিৎকার শুনতে পেতাম। মাঝে মাঝে আবার মৌলানা এনে তওবা পড়াতো। এভাবে বছর দুই যাওয়ার পর আমার খানিকটা মানসিক বিপর্যয় ঘটে। এরপর আরও প্রায় ৪ বছর পর আমাকে ওরা মুক্তি দেয়। কিন্তু তখন আমার শরীরে কোনওমতে প্রাণটুকু অবশিষ্ঠ আছে। ভাসা ভাসা মনে পড়ে অসুস্থ্য অবস্থায় ওরা মাঝে মাঝে এসে শুধু মেরে যেতো, কিছু আর জানতে চাইতো না। যখনই মস্কো থেকে কোনও বড়কর্তা জেলখানা পরিদর্শণে আসতেন, তার সন্মানে কয়েকজন বন্দীকে তার সামনে কুত্তাপেটা করার রেওয়াজ ছিলো। কর্তা গম্ভীর মুখে পিটানো দেখতো আর মাঝে মাঝে অন্ডকোষে সিগারেটের ছ্যাকা দিতো, এক খাবলা চুল ছিড়ে নিতো বা প্লায়ার্স দিয়ে একটা আঙ্গুল ভেঙে দিতো। আমি যেহেতু বড়মাপের বন্দী ছিলাম, তাই এধরণের প্রদর্শনীতে আমার ধোলাই খাওয়া ছিলো অবশ্যশ্ভাবী।”

(অপ্রাসঙ্গিক হলেও আমাকে একটা ঘটনার উল্লেখ করতেই হবে। ২০০৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের লাঘোর প্রদেশের কুলাঙ্গার থেকে ব্র্যাকের রিজিওনাল ম্যানেজার নুরুল ইসলাম অপহৃত হন। বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্বে তখন বিষয়টা আলোডন তোলে এবং আমার সহকর্মীরা বলেছিলেন যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এবং জাতিসংঘ মহাসচিব এই ঘটনায় ব্যাক্তিগত পর্যায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সাথে কথা বলেছেন। এই অপহরনের ঘটনা বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষই জানেন যারা টিভি দেখেন বা সংবাদপত্র পড়েন। কিন্তু যা খুবই সামান্য কিছু মানুষ জানেন তা হলো নুরুল ইসলামের অপহরনের ঠিক দুই সপ্তাহ আগে এই ব্র্যাকেরই একজন বাংলাদেশী কর্মকর্তা ফাইজাবাদের পাহাড়ি রাস্তায় মরে পড়ে ছিলেন যখন তার আফগান সহকর্মী তাকে খুন করে মাইক্রোফাইনান্স প্রজেক্টের কালেকশনের এক রাকস্যাক ভর্তি টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মৃতদেহ রাস্তার পাশে পড়ে ছিলো, চিল-শকুন বসতে শুরু করেছিলো, তখন কিন্তু নিরাপত্তা হুমকির কথা ভেবে ব্র্যাকের কেউই লাশটা পর্যন্ত উদ্ধার করতে যায়নি, তারা পুলিশে খবর দিয়েই চুপচাপ বসে ছিলো। এই খাজা আলেফ হাকীম বিকেলে যখন এই খবর শোনেন, তিনি নিজেই আমাদের অফিসের গাড়ি নিয়ে আর কয়েকজন এনজিওর লোক ডেকে নিয়ে, সেই সাথে পুলিশের লোক একরকম ধরে নিয়ে গিয়ে সন্ধার সময় চরম ঝুঁকি নিয়ে সেই মৃতদেহ উদ্ধার করে আনেন। পরদিন মৃতদেহ উদ্ধার করতে গেলে হয়তো কঙ্কালটাই পাওয়া যেতো।)।

তালিবানের জন্মকথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো (পর্ব ৪)
তালিবানের জন্মকথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো (পর্ব ৫)

লিংকঃ
http://en.wikipedia.org/wiki/Durand_Line
http://www.ips.org.pk/international-relation/the-muslim-world/986-pak-afghan-relations-the-durand-line-issue.html
http://en.wikipedia.org/wiki/Communist_%28Maoist%29_Party_of_Afghanistan
http://en.wikipedia.org/wiki/Mujahideen
http://www.thirdworldtraveler.com/Afghanistan/Afghanistan_CIA_Taliban.html
http://afghanmirror.tripod.com/id25.html
http://en.wikipedia.org/wiki/History_of_Afghanistan
http://en.wikipedia.org/wiki/Civil_war_in_Afghanistan_%281992-1996%29
http://afghanic.de/images/Docs/peshawar_accord.pdf
http://www.massoudhero.com/English/biography.html
http://en.wikipedia.org/wiki/Gulbuddin_Hekmatyar
http://www.answers.com/topic/soviet-war-in-afghanistan


মন্তব্য

কৌস্তুভ এর ছবি

পড়ে গেলাম। চলুক।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ কৌস্তভ ভাই।

দিগন্ত এর ছবি

ঠিক ক্রনোলজি বুঝলাম না, তবে মনে হল আপনি নব্বই দশকের গোড়া অবধি ইতিহাস পর্যালোচনা করেছেন। সি-আই-এ র শুরু করা আফিম চাষের ব্যাপারটা বাদ পড়ে গেছে।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আফগানিস্তানের পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয় যুদ্ধমান পরিস্থিতি বুঝতে হলে তাজিক+উজবেক+তুর্কমেনদের সাথে পাখতুন আর হাজারাদের দ্বন্দ্বের কথা বুঝতে হবে, পশ্‌তুর সাথে অন্য ভাষাগুলোর দ্বন্দ্ব বুঝতে হবে, খিলজীদের সাথে দুররানীদের দ্বন্দ্ব বুঝতে হবে, খাল্‌কের সাথে পারচামের দ্বন্দ্বের কারণ বুঝতে হবে, শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব বুঝতে হবে, ভূমি ব্যবস্থার অব্যবস্থার কথা বুঝতে হবে, জির্গার সদস্যদের, গাঁয়ের মাতব্বরদের জমিদারী মানসিকতা বুঝতে হবে, বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর ক্রমাগত বঞ্চনার কথা বুঝতে হবে, আর কী? এই একটা দেশ যেটার ইতিহাস অধ্যয়ন করতে গেলে মাথা ঘুরে যায়।

বোরহানুদ্দিন রব্বানী আর সিবঘাতুল্লাহ্‌ মোজাদ্দেদীর প্রসঙ্গ একটু আসা দরকার ছিল। স্ট্যালোনের র‌্যাম্বো-৩ ও প্রাসঙ্গিক। জামাতে ইসলামী আর হেজবে ইসলামী যে এক না সেটাও একটু পরিষ্কার করা দরকার ছিল। ইরান ভিত্তিক ৭/৯ টি মুজাহেদীন গ্রুপের কোনঠাসা হবার কথা থাকা দরকার ছিল।

সিরিজ চলুক। মূল অংশতো এখনো আসেইনি।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ দিগন্ত ভাই, ভালো আইডিয়া। এটা নিয়ে আলাদা একটা লেখা তৈরী করতে পারি। আমি ফাইজাবাদের যে বাড়িতে থাকতাম সেটা ছিলো মেইন রাস্তা থেকে একটা বাড়ি পরে, দোতলার একটা রুমে। যেখান থেকে রাস্তার সবকিছু দেখা যেতো। যে রাতে পপির চালান যেতো, সে রাতে আর ঘুম হতোনা। ঘড় ঘড় শব্দে পপিবোঝাই রাশান কামাজ ট্রাকগুলো মন্থর গতিতে এগিয়ে চলতো, একটা পর একটা, মাঝরাত থেকে ভোর পর্যন্ত। ১০ ......... ২০ ........ ৩০ ........ ৫০ ....... গুনে শেষ করার মতো না। মাসে ১টা বা বড়জোর দুটো চালান যেতো। ইশকাশিম সীমান্ত দিয়ে পার হয়ে তাজিকিস্তান হয়ে যেতে যেতে শেষ গন্তব্য মস্কো। আর মজার ব্যাপার, যে রাতে চালান যেতো, সেই রাতে ব্যাপক রকেট লঞ্চিং হতো। প্রথমবার একটু ভয়ই পেয়েছিলাম। পরদিন সকালে জানলাম যে এটাই সিস্টেম। পাহাড়ি ফাঁকা এলাকায়, যেখানে কোনও মানুষ বাস করেনা, সেই এলাকায় রকেট লঞ্চিং হতো পুলিশকে ওইদিকে ব্যাস্ত রাখার জন্যে। যদিও এটা ছিলো নাটক মাত্র, ডিফেন্স ফর দ্য পুলিশ, যে আমরা রকেট আক্রান্ত এলাকায় ব্যাস্ত ছিলাম। পপির বিষয়টা নিয়েও যথেষ্ঠ আগ্রহান্বিত ছিলাম।

রাতঃস্মরণীয়

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ পান্ডবদা, আসলেই মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমি আসলে শংকিত, এমনিতেই লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে; পাছে পাঠকের বিরক্তির কারণ হয়ে যাই। পর্ব ৪ এ অবশ্য প্রফেসর বোরহানুদ্দিন রব্বানী আর পীর সিবঘাতুল্লাহ্‌ মোজাদ্দেদীর প্রসঙ্গ খুবই সংক্ষিপ্তভাবে এসেছে। আর প্রথম প্যারায় আপনি যে দ্বন্ধগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন, তা'ও সংক্ষিপ্ত আকারে পরের পর্বগুলোতে রেখেছি। আফগানিস্তানের দ্বন্ধের চরিত্র ও বিবর্তন এতটাই বহুমাত্রিক যে লিখতে গেলে তাল রাখা দুষ্কর। তবে দাদা, মানতেই হবে, আপনার এবিষয়ে পড়াশোনা ব্যাপক। লোকমুখে শুনে সমস্যার এতোটা গভীরের কথা বলা সম্ভব না।

রাতঃস্মরণীয়

শান্ত [অতিথি] এর ছবি

সিরিজ চমৎকার হচ্ছে।

লেখা বড় হয়ে যাওয়ার চিন্তা করবেন না। চালিয়ে যান। খুবই তথ্যবহুল লেখা।

ধন্যবাদ আপনাকে

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ শান্ত ভাই।

রাতঃস্মরণীয়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।