তালিবানের জন্মকথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো (পর্ব ৪)

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি
লিখেছেন রাতঃস্মরণীয় [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৯/০৮/২০১০ - ২:৪০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তালিবানের জন্মকথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো (পর্ব ১)
তালিবানের জন্মকথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো (পর্ব ২)
তালিবানের জন্মকথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো (পর্ব ৩)

(চিন্তা করছিলাম সংক্ষেপে সেরে ফেলবো লেখাটা কিন্তু হলো না। ভূমিকাতেই কয়েকটা পর্ব চলে গেলো। ইচ্ছে করলে এই পর্বগুলো বাদ দিয়ে সরাসরি তালিবান রিজিমে চলে যেতে পারতাম কিন্তু মন সায় দিলো না। লেখা বিরক্তিকর হয়ে উঠলে ক্ষমাপ্রার্থী। আগামী পর্বই হবে এই লেখার শেষ পর্ব। আর এই লেখা তৈরী করতে গিয়ে শতাধিক ওয়েবসাইট ঘাটতে হয়েছে। তবে সবথেকে বেশি সাহায্য পেয়েছি উইকপেডিয়া থেকে। গুরুত্বপূর্ণ লি ...(চিন্তা করছিলাম সংক্ষেপে সেরে ফেলবো লেখাটা কিন্তু হলো না। ভূমিকাতেই কয়েকটা পর্ব চলে গেলো। ইচ্ছে করলে এই পর্বগুলো বাদ দিয়ে সরাসরি তালিবান রিজিমে চলে যেতে পারতাম কিন্তু মন সায় দিলো না। লেখা বিরক্তিকর হয়ে উঠলে ক্ষমাপ্রার্থী। আগামী পর্বই হবে এই লেখার শেষ পর্ব। আর এই লেখা তৈরী করতে গিয়ে শতাধিক ওয়েবসাইট ঘাটতে হয়েছে। তবে সবথেকে বেশি সাহায্য পেয়েছি উইকপেডিয়া থেকে। গুরুত্বপূর্ণ লিংকগুলোই শুধু এখানে দিচ্ছি। তবে এই প্রসঙ্গে গুগলে সার্চ দিলে হাজার হাজার রেফারেন্স পাওয়া যাবে। ধন্যবাদ)

১৯৭৯ সালে সৌদি ধনাঢ্য বিন-লাদেন পরিবারের সন্তান ওসামা বিন লাদেন আবদুল্লাহ আজমের সাথে যোগ দিয়ে আফগানিস্তানে মুজাহেদিন বাহিনীতে যোগ দেন এবং পাকিস্তানের পেশাওয়ারে ঘাঁটি গড়ে তোলেন। পরে ১৯৮৪ সালে ওসামা আর আজম মিলে গড়ে তোলেন মকতব-আল-খিদমাত। এই সংগঠনের মাধ্যমে তারা দুজনে আরব বিশ্ব থেকে মুজাহেদিনদের জন্যে অর্থ ও সামরিক সাহায্য সংগ্রহ করতেন। লাদেন বিশেষ করে ভিনদেশী মুজাহেদিনদের জন্যে থাকা-খাওয়া, প্লেনের টিকেট, পাকিস্তানে আসার জন্যে ভিসা সংক্রান্ত পেপারওয়ার্ক এগুলো করতেন এবং আফগানিস্তানে একটা বিশাল মুজাহেদিন ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদায়ের পরও ওসামা সেখানে বিচ্ছিন্নভাবে আসা যাওয়া করতেন ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। এরপর তিনি পেশাওয়ারে ফিরে যান। উল্লেখ্য, ওসামা দাবী করেন যে তিনি যে রাশান এ্যাসল্ট রাইফেলটা সবসময় সাথে রাখেন ওটা নাকি পেয়েছিলেন ওটার মালিক এক সোভিয়েত সৈন্যকে খালি হাতে কিলিয়ে হত্যা করে। সেই গৌরবের স্মৃতি হিসেবে তিনি ওই রাইফেলটা সাথে রাখেন।

আমেরিকা ১৯৮৬ সালে মুজাহেদিনদেরকে ষ্ট্রিংগার এন্টি এয়ারক্র্যাফট মিসইল সরবরাহ করলে রাশিয়ার বিমান আক্রমনক্ষমতা কমে যায়। রাশিয়া মূলতঃ মুজাহেদিনদের বিপক্ষে বড়সড় সাফল্যগুলো বিমান আক্রমনের মাধ্যমেই পাচ্ছিলো। এছাড়া জাতিসংঘে জোটবহির্ভূত দেশগুলোও আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাপ্রত্যাহারের পক্ষে ভোট দিয়েছিলো।

১৯৮৫ সালের মার্চে মিখাইল গর্বাচেভ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে সামরিক ব্যায়ের বোঝা কমিয়ে কারিগরী সহায়তা অর্জনের জন্যে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের উন্নতি করা প্রয়োজন। তিনি উপলব্ধি করলেন যে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আফগান যুদ্ধ একটা প্রতিবন্ধকতা এবং এই যুদ্ধ একইসাথে সোভিয়েত জনগনের জন্যেও অস্বস্তির কারণ। এমতাবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৪ই এপ্রিল ১৯৮৮তে জেনেভায় জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আফগানিস্তানকে একরকম বাধ্য করে চুক্তি স্বাক্ষর করতে যে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করবে। ১৯৮৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী সম্পূর্ণ সেনাপ্রত্যাহার সম্পন্ন হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষনা করে যে এই যুদ্ধে তাদের মোট ১৪,৪৫৩ জন সৈনিক নিহত হয়েছে এবং ১১,৬০০ আজীবনের জন্যে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। পক্ষান্তরে, এই একই সময়ে ১০ থেকে ১৫ লাখ মুজাহেদিন এবং আফগান বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সৈন্য প্রত্যাহারের পরও আফগানিস্তানে তাদের সাহায্য চালিয়ে যেতে থাকলো। পক্ষান্তরে, আমেরিকা, পাকিস্তান ও সৌদি আরব মুজাহেদিনদের জন্যে তাদের বিপুল সহায়তা চালিয়ে যেতে থাকলো।

২০০৭ সালে ঢাকার আফগানিস্তান দূতাবাসে গিয়েছিলাম দ্বিতীয় দফার ভিসা আনতে। সিএনজি ড্রাইভার আমার কাছে জানতে চাইলেন যে আমি এই দূতাবাসে কি চাই। তারপর তিনি বলেছিলেন যে তিনি একজন আফগান ফেরত মুজাহেদিন। আমি ভাড়া মিটিয়ে দিতে গিয়েও থেমে গেলাম, বললাম যে তার সাথে আমার কথা আছে। দূতাবাসে ১০ মিনিটের কাজ ছিলো এবং পিএস টু দ্য এ্যামব্যাসেডর মি. ওয়ায়েজ-এর সাথে ভালো পরিচয় থাকায় দেরী হলোনা। তারপর এক চায়ের দোকানে বসলাম তাকে নিয়ে এবং প্রায় ঘন্টা খানেকধরে চা সিগারেট খেতে খেতে তার অভিজ্ঞতা শুনলাম। বড়ই বিচিত্র-

“প্রতি মাসে আমার গ্রামের বাড়িতে অচেনা লোক এসে টাকা দিয়ে যেতো কোনওরকম সই-স্বাক্ষর ছাড়াই। বিদেশী মুজাহেদিনদের জন্যে কয়েক মাস পর পর পেশাওয়ারে রেষ্ট এন্ড রিকিউপিরেশনের ব্যবস্থা ছিলো। এই রেষ্টের সময়ে যাদের আগ্রহ ছিলো তাদের জন্যে মদ এবং নারীর ব্যাপারে কোনও বিধিনিষেধ ছিলোনা। তবে আফগানিস্তানে অবস্থানকালে মদ ও নারী কঠোরভাবে নিষেধ ছিলো এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হতো। আমাদের ওরিয়েন্টেশন হয়েছিলো মহাখালী মাওলানা মান্নানের আস্তানায়। মাওলানা রুহুল আমিন খান ছন্দে ছন্দে আমাদের মনে জিহাদী মন্ত্রণা ঢুকিয়ে দিতো। আমরা যারা বিদেশী মুজাহিদিন, অল্প কিছু বাদে সবাই যার যার দেশে ফিরে আসি ১৯৯০ সালের দিকে।”

মদ এবং নারীর বিষয়ে আমার একটু সন্দেহ থাকলেও পরে একজন সাবেক মুজাহেদিন কমান্ডার বিষয়টার সত্যতা স্বীকার করলেন। আরও অনেক কিছু জানলাম।

[img=auto]babrak-karmal-1[/img]
বাবরাক কারমাল

১৯৯১ সালে সোভিয়েট ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ মারাত্মক রূপ ধারণ করে। ১৯৯২ সালে আফগানিস্তানের শীর্ষ তিন মুজাহেদিন কমান্ডারের একজন জেনারেল রশীদ দোস্তাম প্রেসিডেন্ট ড. নাজীবুল্লাহকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। তিনি আহমাদ শাহ্‌ মাসুদের বাহিনীকে পিছনে ফেলে রেখে কাবুল দখল নিতে আরম্ভ করেন। একইসাথে এপ্রিল মাসে আহমাদ শাহ্‌ মাসুদের নেতৃত্বাধীন বাহিনি পারওয়ান প্রদেশের একটা বড় অংশ দখল করার পাশাপাশি কাবুলে ২০,০০০ সৈন্য পাঠায়। এপ্রিলের মধ্যেই কাবুলস্থ সেকেন্ড ব্রিগেড মাসুদের অধীনস্থতা স্বীকার করে নিয়ে তার বাহিনিতে অঙ্গীভূত হয়ে যায় এবং মাসুদের আরেকটা বাহিনি বাঘরাম এয়ার ফোর্সের ঘাঁটি দখল করে ফেলে। এর ফলে গোটা কাবুল প্রতিরক্ষাহীন হয়ে পড়ে এবং এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া দূরুহ হয়ে পড়ে। ড. নাজীবুল্লাহ ১৭ ই এপ্রিল পালিযে যেতে চাইলে রশীদ দোস্তামের বাহিনী তাকে কাবুল এয়ারপোর্ট থেকে ফিরিয়ে দেয়। এরপর তিনি কাবুলের জাতিসংঘ মিশনের কমপাউন্ডের ভিতরেই থাকতে থাকেন তালিবানদের হাতে তার নির্মম মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত।

[img=auto]U88334006[/img]
ড. মুহাম্মাদ নাযীবুল্লাহ

আহমাদ শাহ্‌ মাসুদ নিজে কাবুলে ঢোকার ব্যাপারে ইতস্ততঃ করছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন যে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তির মাধ্যমে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাক। ১৯৯২ সালের এপ্রিলে পেশাওয়ার এ্যাকর্ডের মাধ্যমে ‘ইসলমিক জিহাদ কাউন্সিল’ নাম দিয়ে একটা অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার ও একটা সুপ্রিম লিডারশীপ কাউন্সিল গঠিত হয়। এতে পীর সিবঘাতুল্লাহ মোজাদ্দেদীকে ২ মাসের জন্যে প্রেসিডেন্ট মনোনীত করা হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় যে এই দুই মাসের পর প্রফেসর বোরহানুদ্দিন রাব্বানী প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হবেন। এই ক্যাবিনেটে গুলবুদ্দিন হেকমাতইয়ারকে প্রধানমন্ত্রীর পদ দেওয়া হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন কারণ তিনি ক্ষমতার ভাগাভাগিতে বিশ্বাসী ছিলেন না এবং পাকিস্তান তাকে মদদ দিচ্ছিলো নিরংকুশ ক্ষমতাদখলের জন্যে। এসময়ে একটা ঐতিহাসিক টেলিআলাপে মাসুদ হেকমাত ইয়ারকে শান্তিচুক্তি মেনে নিয়ে কাবুলে না ঢোকার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু হেকমাত ইয়ার তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন যে তিনি খোলা তরবারী হাতে নিয়ে কাবুল জয় করবেন। (এই ঐতিহাসিক টেলিআলাপের ভিডিও ইউটিউবে পাওয়া যায়। কিন্তু আলাপটা পার্সী ভাষায় হওয়ায় আর সাবটাইটেল না থাকায় এখানে দিলাম না।)। হেকমাত ইয়ার তার বাহিনী নিয়ে কাবুলের দিকে অগ্রসর হলেন। এরপর মাসুদের সামনেও আর পথ খোলা থাকলো না কাবুলের পথে এগোনো ছাড়া কারণ তার উদ্দেশ্য ছিলো স্বৈরাচার হেকমাত ইয়ারের হাত থেকে কাবুলকে রক্ষা করে শান্তিচুক্তিকে বাস্তবায়ন করা।

[img=auto]Mujaddedi[/img]
সিবঘাতউল্লাহ মোজাদ্দেদী

বিভিন্ন মুজাহেদিন দলগুলো কাবুলে ঢোকা শুরু করলো। হেকমাত ইয়ার এসময় হরকতে ইনকিলাবে ইসলামসহ অন্যান্য কয়েকটা দলকে তার সাথে যোগ দিতে বললে তারা প্রত্যাখ্যান করে মাসুদের মতোই পেশাওয়ার একর্ডের পক্ষে তাদের মত দেয়। এসময় পাকিস্তান হেকমাত ইয়ারকে অর্থ ও সামরিক সাহায্য পাঠাতে থাকে। পক্ষান্তরে, মাসুদের হাতে চলে আসে বাঘরাম, ছারিকার, তাখার, কুন্দুজ, ফাইজাবাদ এবং অন্যান্য উত্তরাঞ্চলীয় গ্যারিসনগুলোর বিপুল পরিমান সমরাস্ত্র। একই সাথে জবনিশ-ই-মিলি মাসুদের নেতৃত্বাধীন জামাতের সাথে একাত্মতা ঘোষনা করে এবং সাবেক সোভিয়েতসময়কালীন সরকারের সব সদস্য তাদের সমস্ত সামরিক সরঞ্জাম হিজবের পরিবর্তে জামাতের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। এসময়ে জামাতের দখলে আসে বিপুল সংখ্যক টি-৬২ ও টি-৫৫ ট্যাংক, স্কাড মিসাইল এবং মিগ-২১ যুদ্ধবিমান।

মুজাহেদিনদের বিভিন্ন দলগুলো বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের অবস্থান ধরে রেখে প্রতিপক্ষের উপর হামলা চালাতে থাকে। এক পর্যায়ে হিজব কাবুল মূল শহর থেকে বিতাড়িত হলেও শহরের বাইরে থেকে মুহুর্মুহু পাকিস্তানের সরবরাহ করা মিসাইল ছুঁড়তে থাকে থাকে কাবুলের উপর। অবশেষে ২৫ মে ১৯৯২ গুলবুদ্দিন হেকমাত ইয়ার শান্তি আলোচনায় আসেন এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। কিন্তু এই শান্তি আলোচনার সুফল ১ সপ্তাহও স্থায়ী হয়নি। এটা ভেঙে যায় যখন হেকমাত ইয়ার প্রেসিডেন্ট সিবঘাতুল্লাহ মোজাদ্দেদী বিমানে রকেট হামলার চেষ্টা চালান এবং তার পর জেনারেল রশীদ দোস্তামকে কাবুল ত্যাগ করানোর চেষ্টা চালাতে থাকেন।

জুনে প্রফেসর বোরহানুদ্দীন রাব্বানী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। এসময়ে হেকমাত ইয়ারের বাহিনীর বেপরোয়া রকেট হামলায় কাবুলের অগণিত বেসামরিক মানুষ নিহত হয়। এর প্রতিউত্তরে সুরা-ই-নাজার এবং জেনারেল দোস্তামের বাহিনীও হিজবের ঘাটিগুলোর উপর গুলি ও রকেটবর্ষণ শুরু করে। বিশেষকরে পশ্চিম কাবুল এলাকায় ইরান সমর্থিত শিয়া ওয়াহদাত বাহিনীর সাথে সৌদিআরব সমর্থিত ওয়াহহাবী ইত্তেহাদ বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ঘ পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। এসময়ে ইত্তেহাদ বাহিনী সংখ্যালঘু হাজরা উপজাতীদের বাড়িঘরে ব্যাপক লুঠতরাজ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়।

[img=auto]Rabbani[/img]
বুরহানুদ্দীন রাব্বানী

ঠিক একই সময় সীমান্তবর্তী কান্দাহার প্রদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে সাথে সম্পর্কবিহীন তিনটি পশতুন উপদল পরষ্পরের সাথে ব্যাপক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধ ক্রমশঃ প্রতিদ্ধন্ধী পশতুন গোত্রগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে পরে এক ব্যাপক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করে।

১৯৯৩ সালের শুরুর উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো অপারেশান আফশার। রাব্বানীর সরকারী বাহিনী হেকমাত ইয়ারের হিজবের সাথে আফসারে এক ভয়ানক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পরে মার্চে হেকমাত ইয়ার রাব্বানীর সাথে এক সমঝোতায় উপনীত হন প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহন করতে। তবে তার শর্ত ছিলো মাসুদকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। মাসুদ একটা সম্ভাব্য শান্তির প্রত্যাশায় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন। কিন্তু মাত্র একটা ক্যাবিনেট মিটিংএ অংশ নেওয়ার পরই হেকমাত ইয়ার আবার কাবুলে বেপরোয়া হামলা শুরু করেন যার ফলশ্রুতিতে ৭০০ বেসামরিক মানুষ প্রান হারায়। এই অবস্থাতে মাসুদ আবারও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ নেন কাবুলকে রক্ষা করার জন্যে। পাকিস্তান ও সৌদিআরব হেকমাত ইয়ারকে এবং রাশিয়া ও ইরান মাসুদকে অর্থ ও সামরিক সাহায্য চালিয়ে যেতে থাকে। লাদেন এই সময়ে হেকমাত ইয়ারের পক্ষে ব্যাপক তহবিল ও সৈন্যসংগ্রহ করে পাঠাতে থাকন।

১৯৯৪ সালে গৃহযুদ্ধ নাটকীয় একটা মোড় নেয় যখন জেনারেল রশীদ দোস্তাম স্বেচ্ছায় হেকমাত ইয়ারের সাথে যোগ দেন। এরই পর হেকমাত ইয়ার এবং তার সমস্ত সহযোগি ও অনুসারীরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং মাসুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। জবনিশ্-ই-মিলি বাহিনী মাসুদের জামাতের যোদ্ধাদের উপর মুহুর্মুহু বিমান হামলা চালাতে থাকে। হিজব, জবনিশ এবং তাদের সহযোগি বাহিনী কাবুলের বেশ বড় একটা অংশের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে। এসময় জবনিশ যোদ্ধারা ব্যাবক হত্যাকান্ড, লুঠতরাজ এবং ধর্ষনের ঘটনা ঘটায়। তবে ডিসেম্বরের দিকে এসে মাসুদ বাহিনীর পাল্টা আক্রমনে জবনিশ এবং রশিদ দোস্তমের বাহিনী বেশ বেসামাল হয়ে পড়ে এবং মাসুদ কাবুলের বিভিন্ন এলাকায় দখন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে থাকেন।

অগাষ্ট ১৯৯৪ তে তালিবান প্রথম দৃশ্যপটে হাজির হয়। বর্তমান দুর্নিতীগ্রস্থ এবং যুদ্ধবাজ আফগানিস্তান সরকারের কবল থেকে আফগানিস্তানকে মুক্ত করে একটা খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরের লক্ষে তারা সামরিকভাবে নিজেদের প্রকাশ করে। হেকমাত ইয়ারের ক্রমাগত ব্যার্থতায় তার প্রথান পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তান হতাশ হয়ে তালিবানকে সর্বাত্মক সমর্থনদানের সিদ্ধান্ত নেয়। পাকিস্তান এখানে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থটাকে বড় করে দেখে। তারা আফগানিস্তানে তাদের সমর্থিত এমন একটা সরকার বসাতে চায় যে সরকার কেবলই তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে এবং আফগানিস্তানের উপর দিয়ে মধ্য এশিয়ায় পাকিস্তানের ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ সর্বাত্মক ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও পাকিস্তান চাচ্ছিলো যে তাদের তাবেদার সরকার গত ১৫ বছর ধরে যে ৩০ লাখ শরণার্থী পাকিস্তানে থাকছে তাদেরকেও প্রত্যাবাসন (রিপ্যাট্রিয়েশন) করবে। তালিবানদের যাত্র শুরু হয় অক্টোবর মাসে কাবুলের এক বিয়ের অনুষ্ঠানে বোমা বিষ্ফোরণ দিয়ে যেখানে ৭০ জন নিহত হয়। তারা অক্টোবরেই কান্দাহারে প্রকাশ্যে বিপ্লব ঘোষনা দেয় এবং নভেম্বরের মধ্যে্আফগানিস্তানের প্রায় গোটা দক্ষিণাঞ্চল দখলে নিয়ে আসে।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

তালিবানের জন্মকথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো (পর্ব ৫)

লিংকঃ
http://en.wikipedia.org/wiki/Mujahideen
http://www.thirdworldtraveler.com/Afghanistan/Afghanistan_CIA_Taliban.html
http://en.wikipedia.org/wiki/Civil_war_in_Afghanistan_%281992-1996%29
http://en.wikipedia.org/wiki/History_of_Afghanistan
hrw.org/reports/2005/afghanistan0605/afghanistan0605.pdf
http://en.wikipedia.org/wiki/Afshar_Operation


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

পুরা সিরিজটাই পড়ছি। খুবই কাজের একটা সিরিজ
এটাকে ছোট্ও করার দরকার নেই। বড়োও করার দরকার নেই
বরং যেভাবে আছে সেভাবেই চলুক

০২

আফগান রাজনীতি আলোচনায় আমার হিসাবে গোষ্ঠী এবং বংশ/বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী একটা বড়ো ফ্যাক্টর

সেই বিষয়গুলো কি আসবে?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ মাহবুব ভাই। আমি চেষ্টা করছিলাম পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটাতে কারণ অধিকাংশ পাঠকই তালিবানের অধ্যায় পড়তে উৎগ্রীব। তার পরও কিন্তু এটা বেশ বড় হচ্ছে।

আফগানিস্তানের গোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতি বড় একটা ফ্যাক্টর, আপনার হিসেব ঐতিহাসিকভাবে সত্যি। তবে এই ইতিহাস এতোটাই ব্যাপক যে সংক্ষেপে লিখে শেষ করা যাবেনা। আগামীতে সময় ও সূযোগ পেলে লিখবো।

অবাঞ্ছিত এর ছবি

সিএনজি চালক প্রাক্তন মুজাহেদিন? অবাক হব না শংকিত হব ঠিক বুঝলাম না..

সিরিজ চলুক..
__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...

__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...

অতিথি লেখক এর ছবি

অবাঞ্চিত ভাই, অবাক বা শংকিত, কোনটাই হওয়ার দরকার নেই। বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে বহু মুজাহেদিন খুঁজে পাওয়া যায়। আর মহাখালীতে মাওলানা মান্নানের খানকা শরীফে গেলে এরকম অনেক মুজাহেদিনের দেখা পাবেন। আসলে মুজাহেদিনরা তো বাংলার সাধারণ মানুষেরা। ধর্মীয় সালসা খাইয়ে সাধারণ মানুষকে ............... এভাবেই কাহিনীর শুরু।

ফারুক হাসান এর ছবি

অসাধারণ সিরিজ হচ্ছে। চলুক!

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ ফারুক ভাই।

অতিথি লেখক এর ছবি

১ম থেকে ৩য় পর্বগুলোর লিংক দিলে ভালো হতো। আগেরগুলো পড়া হয়নি।

অতিথি লেখক এর ছবি
সুমন [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ এই সিরিজ টা লেখার জন্য ... অনেক দিনের আগ্রহ আফগান রাজনীতির এই জ়টিল ইতিহাস জানার ...
আবারো ধন্যবাদ...

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ সুমন ভাই।

রেজওয়ান এর ছবি

লেখার জন্যে ধন্যবাদ।

সিরিজটি পড়ছি। আলাদা আলাদা করে বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনেছিলাম। সব একসাথে মিলে একটি চিত্র স্পষ্ট হচ্ছে। সিরিজ শেষ হলে আবার সব পড়ব একসাথে।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ রেজওয়ান ভাই, আমি কিন্তু আপনার লেখাগুলো পড়ছি। আপনি দারুন লেখেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।