লেখকঃ কুম্ভীলক
মনটা ভালো ছিল না। কোন কারণ নেই। দৌড়-ঝাপ করতে করতে ক্লান্তির মতন এক ধরণের অনুভূতি গ্রাস করে ফেলে বলে মনে হয়। যেরকম জীবন-যাপন করি আর জীবন থেকে যা কিছু আশা করি, তাতে করে অনুভূতিটাও নতুন নয় আর এর পরিণতিও জানা। তবু নেশার মতন এই অবসাদকে টিকিয়ে রেখেছি অনেক বছর। এটাই মাঝে মাঝে হয়ে উঠে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। সত্যি আশ্চর্য! প্রথম প্রথম ঘটনার ঘনঘটা ছিল, এখন সূত্র-বাঁধা। বৈচিত্র্য খুঁজে বেড়াই। মাঝে মাঝে কাউকে খুঁজে পেলে তো কথাই নেই। এবার পেলাম সালাম কে।
সালাম বয়সে আমার চেয়ে পাঁচ বছরের কনিষ্ঠ হবে। গ্রাম থেকে উঠে আসা ছেলে। স্কুলে বাংলা ব্যাকরণ আর ভূগোলটা ঠিকভাবে শিখেছিল। এজন্য কথা বলে স্বস্তি পাওয়া যায়। ওর গ্রাম দেখতে যেতে বললো।
শ্যাওড়াকান্দি। হাওড়ের মাঝে গ্রাম। পল্লীবিদ্যুৎ এখনো সেবা নিয়ে যেতে পারেনি। একটা রাস্তা আছে উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগের, ওদের বাড়ীর পাশেই। তবে বাড়ি-ভিটা রাস্তা থেকে অনেক উঁচুতে। বর্ষা অনুমান করা যায়। গ্রামটা লম্বালম্বি এক কিলোর মতন হবে। দু-তিনটা পাড়া। মুসলমান আর হিন্দু। হিন্দুরা ধীবরগোষ্ঠী, আর মুসলমান চাষা। অনেক আগেই দুই পক্ষই বুঝে গেছে বছরে ছয়মাস শরীরে শুধু হাওড়ের বাতাস লাগালে অনাহারে আয়ু কমে।
পৌছতে পৌছতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে বারান্দায় বসে সিগারেট ধরালাম। মাঘ মাস, তবু তেমন শীত নেই। পাতলা একটা চাদর চাপিয়ে গায়ে হাওয়া লাগাচ্ছিলাম। আবহাওয়া পুরোপুরি মনোবৈকল্য দূর করে দেবার অনুকূলে। পূর্নিমা সামনে। কুয়াশা খুব কম। চাঁদের আলোতে ওদের ভিটের বামদিকটার বিস্তীর্ণ খোলা মাঠের দিকে চোখ গেলো। অনেক দূর পর্যন্ত কোন গ্রামের ছায়া নেই। ধানক্ষেত ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। সালাম বলে উঠলো, "এটা ভাটি।"
পরদিন সকালে গ্রাম ঘুরতে বের হলাম। বিশ্বাস ছিল সালাম প্রথমেই বাজারে নিয়ে যাবে না। একটা পুরোনো মঠ আছে গ্রামের পশ্চিম দিকটায়। সমাধিসৌধের মতন। এক ধারা চৌকোনা কিছু দূর ওঠার পর উপরে একটা কোণক। এখনো হিন্দু গ্রামগুলিতে দেখতে পাওয়া যায়।ঠিক কেন-কবে কে বা কারা রেখে চলে গেছে, তার পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহের চিহ্নটুকু ফেলে, তার হদিস নেই। আর যেগুলি আছে, সেগুলিতে হয়ত মোমবাতি জ্বলে বছরে একবার। শ্যাওড়াকান্দির এই মঠটা সাবেক এক হিন্দু পরিবারের। পয়ষট্টিতে ত্রিপুরায় চলে গেছে। সাতানব্বইয়ের দিকে কেউ একজন পাসপোর্ট করে এসেছিলো দেখে যেতে। তবে এখন আর মোমবাতি জ্বালানোর কেউ নেই এই গ্রামে। পাশেই একটা ক্ষীণধারা তরঙ্গিনী। সালাম বললো, "সুতাং নদী।"
দু'য়েকটা মাছের খলা, কয়েকটা বাড়ির ঘাট, মাঝে মাঝে লগি বেয়ে নৌকা যায়। এই মঠটা পাড়াগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, তবু এখানে লোকের যাওয়া-আসা কম। অন্তত কোন জুয়ার আসর দেখা গেলো না। দুপুরের আগ পর্যন্ত সময়টা এখানেই কাটানোটা স্থির করা গেলো। একাকীত্বকে উপভোগ করা যাক। সালাম বলে গেলো ফিরে আসবে ঘন্টা দুই পরে।
একটা গাছের গুড়িতে আরাম করে বসলাম। সালাম চলে যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে মন চঞ্চল হয়ে উঠলো। মনে হলো এখন ওর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। একটা বিরক্তিভাব আসে নিজের উপর। অস্থিরতা আরো বাড়ে। সিগারেট ধরানো গেলো। সকাল থেকেই উজ্জ্বল রোদ, ধানক্ষেতগুলি সবুজ, সুতাং এর পাড়টা জুড়ে খালি কাঁদা। নয়ত, একটু হেটে আসা যেত। দিগন্তে কোন গ্রাম নেই। হাওড়ের বিশালতা টের পেলাম। কেমন ঘুমোতে ইচ্ছে হলো। ঘটনা-মানুষ-সম্পর্কের অর্থহীন শিকল জোড়াতালি দেয়া শুরু হলো। একটা সময় খেই হারালাম। সম্বিৎ ফিরে এলো কিছু একটা শব্দ শুনে। একটা ছোট ছেলে পাতার ঝোপ পার হয়ে কোথায় গেল। আরো কিছুক্ষণ হাবিজাবি ভাবতে লাগলাম। এবারে এলো এক মধ্যবয়স্কা নারী। রুক্ষ চুল, কাপড় পরিষ্কার অবশ্য, কিন্তু চাউনি ভ্রমাত্মক। কি যেন বিড়বিড় করে চলে গেলো। এবারে সালামকেও দেখা গেল। কাছে এসে বললো, "নিরঞ্জনের বউ"। আমি একটু অবাক হলাম। সালাম জানে আমার কৌতুহল নেই। তবু সে বলে উঠলো, "রাতে একটা গল্প বলবো আপনাকে।" ওদের বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলাম।
২.
চাঁদটা আরেকটু উজ্জ্বল আগের দিনের চেয়ে। রাত মনে হলো অনেক দীর্ঘ। আজকেও আবহাওয়া এখনো অনেকটাই উষ্ণ। আজকেও সিগারেট ধরালাম। তবে বারান্দায় বসে নয়, উঠানে বসে। সালাম বলে,"নিরঞ্জন মাছ ধরত।" আমি বুঝলাম গল্পটা শুনতেই হবে। অদ্ভুত এই গ্রামটা। তক্ষক বা ঝিঁঝির আওয়াজ নেই। শুধু শীতের রাতের বাতাসের এক ধরণের শোঁশোঁ শব্দ। ইচ্ছে হলো বর্ষায় এসে কিছুদিন আটকা পড়ি হাওড়ের মাঝে এই বিছিন্ন দ্বীপের মধ্যে। সেটা হবে আরেকটা রূপ। সালাম বলতে শুরু করেছেঃ
নিরঞ্জন মাছ ধরত। এ গাঁয়ের ছেলে। গায়ের লোকের দেহ গড়নের যে বৈশিষ্ট্যের ফলে এরা অনেক পরিশ্রম করতে পারে, নিরঞ্জন তার চেয়েও সবলদেহী। হাওড়ে সবসময় বাড়ির কাছে থাকেনা, নদীতেও পানি থাকে না সারা বছর। যে দুই মাস শুধুই ফসলের সেই দুই মাসও নিরঞ্জন মাছ ধরা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারতো না। ওর বাড়ীর লোকেরা অনেকেই মুসলমান চাষাদের মতন জমি বর্গা নিত দুই-এক মৌসুমের জন্য। নিরঞ্জন শীতের সময় বাড়ির ভিটার পাশের লাউয়ের টালেরও যত্ন নিতে চাইতো না। বাপ-দাদার থেকে পাওয়া বেড় জাল, নৌকা ইত্যাদি আর অসীম সাহস নিয়ে রাত বিরাত হাওড়-বাওড়ে কাটতো তার। শুকনোর সময় দূরের হাওড়ে চলে যেত। পরিশ্রম করাতে তার কোন আপত্তি নেই, যত আপত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জীবিকাটি বদলাতে। তাতে অবশ্য তার খুব বেশি সমস্যা হচ্ছিল না। কারণ নিরঞ্জন একা মানুষ।
বাড়ির লোকের কথায় অথবা বয়স হয়েছিল নিরঞ্জনের, তাই বিয়ে করতে হলো। কে কোথা থেকে সম্বন্ধ এনেছিল সে কথা জানা যায় না, তবে নিরঞ্জনের শ্বশুরবাড়ি নিতাইগঞ্জ। শ্যাওড়াকান্দি থেকে আট-নয় মাইল উত্তরের দিকে একটা গ্রাম। সেও হাওরের মধ্যেই। নিরঞ্জনের বউয়ের বাপের বাড়ির লোকেরাও সব জেলে। তাই এই মেয়ে যে নিরঞ্জনের জন্য উপযুক্ত এ নিয়ে সবাই ছিলো নিশ্চিত। বাসর রাতেই বউকে মনে ধরে গেলো নিরঞ্জনের। নতুন উদ্যম পেলো রাত-বিরাতে হাওড়ে-বাওড়ে ছোটাছুটি করার। বিয়ে হয়ে ছিল অঘ্রাণ মাসের শেষে। শ্যাওড়াকান্দির হাওড়ে পানি নেই। মাছ ধরতে যেতে হয় দূর-দূরান্তে, সেই মাছ ধরে বিক্রির ব্যাবস্থা করে তার পর ফিরতে হয় বাড়ি। নিরঞ্জন নিজেও এর আগে বহুবার বাড়ির বাইরে থেকেছে, টানা পনের দিন - মাসকাবাড়ি, কখনো কখনো ধর্মপাশা-মোহনগঞ্জেও যেতে হয়। কিন্তু এখন হিসেব একটু ভিন্ন। যদিও এখন তাকে খাটতে হবে বেশি, কিন্তু ঘরে নতুন বঊ। তাকে ফেলে ঠিক কতদিন বাইরে থাকা উচিত, তাও বুঝে উঠতে পারে না নিরঞ্জন। ইচ্ছে হয় রমেশকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু লজ্জা করে। রমেশ বিয়ে করেছে বছর দুই আগে। বিয়ের পর প্রথম দুইমাস শ্বশুরবাড়ি, কুটুম্বাড়ি, ফিরাউল্টা, বৃষ্টিভোজন, ইত্যাদি হাবিজাবি করেই কাটিয়েছিল। সেই রমেশ বছর না ঘুরতেই আবার সেই জাল ও জলের টানে ঘরের বাইরে। নিরঞ্জনের ইচ্ছা হয় বাড়িতে থাকে, বৌকে সাহায্য করে, নতুন জায়গায় বৌয়ের যাতে মানিয়ে নিতে সমস্যা না হয়, সে জন্যে স্বামীর কাছে থাকা দরকার এরকম কিছু একটা ভাবতে চায় নিরঞ্জন। মা থাকলে ভালো হতো, এরকমও চিন্তা করে। “চিন্তা করিস না রে।” –আশ্বাস দেয় রমেশ।
বউয়ের অবস্থা কি? নতুন বাড়ি। তার নিজের বলা যায়। শ্বাশুড়ি নেই, এটা যেমন সুবিধা, অন্য বউদের জন্য ঈর্ষার, তেমনি কিছু অসুবিধারও। বউ মানিয়ে চলতে শুরু করে। নিজের বাড়িতে যেভাবে দেখেছে বউদের কাজ করতে, এখানে বাকি বউয়েরা যেভাবে চলে সেসব মিলিয়ে চলতে থাকে। জীবন প্রায় সার্থক মনে হয়। মাঘের বর্ত্য বৃথা যায় নাই – এই রকমটা ভাবতে শুরু করে। যেভাবেই হোক স্বামীকে খুশি করার চেষ্টা করবে বউ।
নিরঞ্জন গেছে দূর হাওড়ে। ফেরার কথা সপ্তাহখানেকের মধ্যে। বউ তিন বেলা ইষ্টদেবতার কাছে স্বামীর মঙ্গল কামনা করে। নিরঞ্জন আসে না। রমেশ ফিরে আসে বন্ধুকে ফেলেই। কোথায় কিভাবে নিরঞ্জন নিখোঁজ হলো কেউ বলতে পারে না। সে মৃত নাকি জীবিত এটাও নিশ্চিত না। নতুন বউ কাকে কি জিজ্ঞেস করবে তাও বুঝে উঠতে পারে না। বাড়ির লোকেদের মুখে কিছু শোনে, কিছু আশ্বাসের কথা, কিছু বিপদের কথা, স্বামীর অমঙ্গল কিছুতেই ভাবতে পারে না। স্বামীর জন্য কান্না জুড়ে দেবে, তাও করতে পারে না। স্বামী ফিরবে।
রমেশ নিরঞ্জনের ঘনিষ্ঠ। সে নিজে থেকেই আসে বউয়ের কাছে। রাতে এক সাথেই শুয়েছিল নৌকায়। মাঝরাতেও সে টের পেয়েছে বন্ধু আছে। “দরফাব্যালা টের পাইছি হে নাইক।” সেই যে নাই সারাদিনে আর তার দেখা নাই। নৌকা বাঁধা ছিল করমপুর ঘাটে। বেঁচাকিনি শেষ। সেই দিনই ফিরে আসতো। পরের দিন সকাল পর্যন্ত দেখে নিরঞ্জনের জন্য। নিরঞ্জন আসে না। হাওড়ের ছেলে নিরঞ্জন। জলে ভেসে যায় নাই এটা নিশ্চিত। কিন্তু কোথায় যে গেলো। বউকে নিরঞ্জনের ভাগের টাকা বুঝিয়ে দেয় রমেশ। “আর কিছু লাগলে খফর কয়ো ।”
“ফিরলো না মানে? কোথায় উধাও হলো?”
“জানি না, ফিরে নি এটুকুই জানি।”
“শেষ করো...”
হাওড়ের বাতাসে তাপমাত্রা একটু একটু করে কমতে থাকে। গ্রামগুলি ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। মঠের চূড়াটা এখান থেকে দেখা যায় না। বাঁশঝাড়টার অবয়ব বোঝা যেতে থাকে। বাঁশঝাড়টা কাঁপে। সালামের দিকে তাকাই। সে বোঝার চেষ্টা করছে আমি কতটুকু বিরক্ত। আমি ঐ আলোর মধ্যে ওর চোখ দুটো খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।
৩.
নিরঞ্জন নিখোঁজ হবার পর আরো মাস দুই পেরিয়ে গেছে। বউ নতুন কোন আশ্বাসও পায় নি। কোন আশার আলোও নেই। কত লোক করমপুর-বহররমপুর, শীতলাঘাট থেকে ফিরে আসে এই গ্রামে। কারো মুখে কিছু শোনা যায় না। কেউ নিরঞ্জনের টিকিটিও দেখেনি এই ক’মাসে। ইষ্টদেবতা ছাড়াও অন্যান্য দেবতার কাছেও প্রতিজ্ঞা বাড়াতে থাকে বউ। রমেশ আসে মাঝে মধ্যে।
সন্ধ্যায় প্রায়ই ঝড় উঠতো। সেই রাতেও বাতাস বড় বেশি ছিল। কুপি জ্বালানো। রাতে তো আর খাওয়া হয় না। মুড়ি-টুড়ি কিছু একটা মুখে পুড়ে চিবোচ্ছিল। এমন সময় দুয়ারে কার যেন পায়ের শব্দ শোনে। পুরুষ মানুষ। কুপি উচিয়ে ধরে দেখে। থির থির করে কেঁপে উঠে বউ।
“নিরঞ্জনের বাড়িটা এই আটির একবারে শেষ মাথার বাড়ি। এর পরেই হাওড়। সুতাংয়ের ঐপারে আরেকটা আটি। এর পরের দিন সকাল থেকে নিরঞ্জনের বউয়ের এ অবস্থা। লোকে বলে পাগল হয়ে গেছে। আমি ছোটবেলা থেকেই এরকমই দেখছি।”
“খায় কি?”
“লোকজনের বাড়ি থেকে কিছু পায়।”
“থাকে কোথায়?”
“নিরঞ্জনের ঘরটা আছে এখনো, একটু জীর্নদশা আর কি।”
“ঐ বয়সে, আর কোন সমস্যা হয় নি?”
“ঐ একটা ঘটনাই যথেষ্ট ছিল।”
“কে এসে ছিলো রাতে?”
“পরের দিন সকালে নিরঞ্জনের লাউয়ের টালের নিচে রমেশের লাশ পাওয়া যায়। শ্বাসরোধ করে হত্যা। ঘরের ভিতর নিরঞ্জনের লাশ। লোকজন বলে সেই লাশ থেকে নাকি গন্ধ বের হচ্ছিল।”
আমি পরের দিন সকালেই ফিরে আসি ঢাকায়। ভুলে যাই নিরঞ্জনের বউয়ের কথা। বেশকিছুদিন পর সালাম একদিন বলে, “নিরঞ্জনের বউ মারা গেছে।” আমার চোখমুখ দেখে কিছু বোঝার চেষ্টা করে। আমি একটু হাসার চেষ্টা করে সালামকে মুক্তি দেই।
মন্তব্য
ঘটনা কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছিলো, কিন্তু কিছুই মনে করতে পারিনি... সত্য ঘটনা কি?
ভাল লাগলো পড়ে।
চমৎকার লেখা, ভাল লাগল পড়ে।
নতুন মন্তব্য করুন