রাতে গেলাম স্লিপিং লাউঞ্জে। সকাল ৮টা পর্যন্ত ৪০ ডলার। ছোট্ট একটা হার্ডবোর্ডের পার্টিশন দেওয়া খুপরী। দুটো গণ বেসিন, দুটো গণ শৌচাগার এবং দুটো গণ শাওয়ার। শাওয়ারে কোনও দরজা নেই। পর্দা আছে যা না থাকার মত, সব কিছুই বাইরে থেকে দেখা যায়। হঠাৎ শুনি ফিসফিস স্বরে বাংলা কথা। বুঝলাম বাহার মিয়ারা হাওয়া হয়ে কোথায় লুকিয়েছে। আমিও চুপচাপ বসে থাকলাম কোন শব্দ না করে। একটু পর দরজায় নক। দরজা খুলতেই ...রাতে গেলাম স্লিপিং লাউঞ্জে। সকাল ৮টা পর্যন্ত ৪০ ডলার। ছোট্ট একটা হার্ডবোর্ডের পার্টিশন দেওয়া খুপরী। দুটো গণ বেসিন, দুটো গণ শৌচাগার এবং দুটো গণ শাওয়ার। শাওয়ারে কোনও দরজা নেই। পর্দা আছে যা না থাকার মত, সব কিছুই বাইরে থেকে দেখা যায়। হঠাৎ শুনি ফিসফিস স্বরে বাংলা কথা। বুঝলাম বাহার মিয়ারা হাওয়া হয়ে কোথায় লুকিয়েছে। আমিও চুপচাপ বসে থাকলাম কোন শব্দ না করে। একটু পর দরজায় নক। দরজা খুলতেই দেখি ওরা ছয়জন। আমি ওদেরকে ভিতরে আসতে বলে নিজে খাটে পা ঝুলিয়ে বসলাম। ওরা একে একে এস হঠাৎই আমার পায়ে হাত দিয়ে কদমবুসি করা শুরু করলেন। আরে করেন কি করেন কি বলতে বলতেই ওদের কদমবুসি সারা হয়ে গেলো। জীবনে অনেক মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখেছি। কিন্তু এখন যা দেখলাম তাকে আমার বিবেচনায় মর্মস্পর্শীই বলতে হবে। ওরা ছয়জন, লুঙ্গি আর শার্ট পরা, পায়ে মোজা ছাড়া স্যু আর প্রত্যেকের গলায় টাই বাঁধা। আমি লুঙ্গির সাথে টাই পরে থাকার কারণ জানতে চাইলে বাহার মিয়া বললেন যে ওরা কেউই টাইয়ের নট বাঁধতে পারেন না, তাই টাই আর খোলা হয়নি। খুলতে গেলে যদি নট খুলে যায়। আমি বললাম ইচ্ছে করলে আপনারা টাই খুলতে পারেন, নট খুলে গেলে আমি বেঁধে দিতে পারবো। কিন্তু ওরা আগ্রহী হলেন না। ভাবছিলাম এই ফাঁসির দড়ি পরে লোকগুলো রাতে ঘুমাবেন।
বাহার মিয়া জানালেন ওরা এখানে লুকিয়েছেন যাতে পুলিস ধরতে না পারে বা ফেরত পাঠিয়ে দিতে না পারে। ৩টা রুম নিয়েছেন রোজ ৬০ ডলার করে ভাড়া। স্লিপিং লাউঞ্জের লোকের সাথে কথা হয়েছে। ওরা ওই লোকের নাম্বার সোলাইমানকে দিয়েছেন এবং ওই লোকের মোবাইল থেকেই বাইরে যোগাযোগ করছেন। ওই লোকের কল রেটও আর্ট শপের মতো। তবে কল ব্যাক ফ্রি। এছাড়া ওই লোকই ওদের খাবার এনে দিচ্ছেন। বিনিময়ে বখশিশ হচ্ছে একটা বিয়ারের দাম।
ওদের মধ্যে বাহার মিয়ার অবস্থা একটু ভালো। বরকতউল্লা ভুলু বাহারকে ঢাকায় ফুটপাথ দখলদারির কিছু ব্যবসা দিয়েছিলেন যা করে বাহার বেশ কিছু টাকা বানিয়েছেন আর বিদেশে আসার খরচটা জোগাড় করেছেন। অন্য প্রায় সবারই জমি বিক্রি বা বন্ধক রাখতে হয়েছে, এছাড়া প্রচুর ধার দেনাও করতে হয়েছে। ফারুক (সম্ভবতঃ ভূলও হতে পারে) নামের সবথেকে অল্পবয়ষ্ক তরুন জানালেন যে তিনি মরে গেলেও তার লাশ ইউরোপ যাবে। তিনি আগে একবার অন্য লোকের একটা শেনজেন ভিসাওয়ালা পাসপোর্ট কিনে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে রওনা করেছিলেন। ঢাকা এয়ারপোর্ট ভালোভাবে পার হলেও ধরা পড়ে যান দুবাই এয়ারপোর্টের বোর্ডিং ডেস্কে। এরপর দুবাই পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আচ্ছামতো প্যাঁদানী দেয়। তারপর ওকে উঠিয়ে দেয় ঢাকাগামী প্লেনে। এর মধ্যে তারা দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিসের সাথেও যোগাযোগ করে। এরপর ঢাকায় নামার পর ওকে বাংলাদেশের পুলিস প্লেন থেকে এ্যারেষ্ট করে এবং আরেকবার আচ্ছামতো ধোলাই দিয়ে কোর্টে পাঠায়। বেশ কয়েকমাস পর ও জেল থেকে ছাড়া পান। কিন্তু জেলে বসে ইউরোপ যাবার স্বপ্ন আরও তীব্র হয়।
প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, দুবাই পুলিস অত্যন্ত রুড। এদের হাতে পড়লে ধোলাই মাস্ট। এরা বাগে পেলে ইউরোপিয়ান-আমেরিকানদেরও ছাড়েনা। আর এদের ধোলাই দেওয়ার অন্যতম প্রিয় মাধ্যম হচ্ছে গুহ্যদারের মধ্যে লাঠি ঢোকানো। দয়া করে কেউ কখোনোই দুবাই পুলিসের সাথে ঝগড়া করবেন না। একবার আমার এক বৃটিশ বন্ধুর সামনে জনসমক্ষে কয়েকজন বাংলাদেশীকে বিবস্ত্র করা হলে তিনি তার প্রতিবাদ করে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন দুবাই পুলিসের হাতে এয়ারপোর্টের নিরাপত্তাবিঘ্নকারী কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকার দায়ে। এরপর তাকে কাষ্টডিতে নিয়ে বলা হয়েছিলো যে তার ব্যাগের মধ্যে এখন এক প্যাকেট ড্রাগস ঢুকিয়ে দিয়ে তারপর তল্লাসী করা হবে। যখন ড্রাগস রিকভারী হবে, তখন তাকে রামধোলাই দেওয়া হবে এবং জীবনের মত তার কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে দেওয়া হবে (আশাকরি বুঝতে পারলেন)। মাঝবয়সী ইন্সপেক্টর বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলছিলো। এসব শুনে আমার বন্ধুটা খুবই নার্ভাস হয়ে পড়েছিলো। ধোলাই তাকে দেওয়া হয়েছিলো না তবে যে পুলিসের সাথে ঝগড়া হয়েছিলো, সেই পুলিসের জুতা রুমাল দিয়ে মুছে দিতে হয়েছিলো, এবং সেই রুমাল দিয়ে আবার নিজের মুখ মুছতে হয়েছিলো।
২৭ তারিখে তো কিছুই করার নেই শুধু খোঁজ নেওয়া ছাড়া যে এনডোর্সমেন্ট লেটার এসেছে কি না। সকালে ঘুম থেকে উঠে চেক আউট হলাম কারণ ২৪ ঘন্টার ভাড়া ৬০ ডলার। ট্রান্সফার ডেস্কে গেলে ক্লার্ক জানালেন যে এয়ার মালাউই থেকে এনডোর্সমেন্ট এসেছে কাল বেশ রাতে। এদিকে পকেটের পয়সা তো শেষ হয়ে আসছে। বাড়িতে ফোন করলে ওদিক থেকে কলব্যাক করলেন। সব জানালাম। বসকে ফোন করলে তিনিও কলব্যাক করলেন। তাতেও তো পয়সা যাচ্ছে অনেক। রাতে একবার স্লিপিং লাউঞ্জের লোকটাকে কলব্যাকের কথা বলেছিলাম কিন্তু সে তখন অল আউট ড্রাংক। আমার কথা শুনলোই না। বাড়ি থেকে ৮০০ ডলার নিয়ে রওনা করেছিলাম। ঢাকা এয়ারপোর্টে খোয়ালাম ১০০ আর দুবাইতে সামান্য কিছু। এরপর বাকী প্রায় সমস্ত পয়সা গেছে ফোনে ফোনে। আজ রাতে যদি আবার স্লিপিং লাউঞ্জে থাকতে হয় তবে তো পকেটে আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। এখন খাবো কি? একটা সবথেকে শস্তা বিফ বার্গার, ডিসপোজেবল গ্লাসের এক গ্লাস চা আর একটা ছোট্ট পানির বোতল কিনলাম। এই দিয়েই পুরো ২৪ ঘন্টা কাটাতে হবে। মাঝে মাঝে ছোট্ট এক কামড় বার্গার খাই, এক চুমুক ঠান্ডা চা আর এক চুমুক পানি খাই। বাকী বার্গারটা আবার কাগজে মুড়ে ল্যাপটপের ব্যাগে রেখে দেই। সিগারেট কেনা ছিলো আগে থেকেই। এভাবেই সারাটা দিন কাটিয়ে দিলাম। নিশ্চিন্তে আছি কাল সকালেই ফ্লাইট। সন্ধ্যায় জেরাল্ডের সাথে দেখা করলাম। জেরাল্ড বললেন যে আমাকে খালি সিটের একটাতে বোর্ডিং দেওয়া হবে। ঘন্টা খানেক পর জেরাল্ড একজন ষ্টাফকে বুকিং ষ্ট্যাটাস জিজ্ঞেস করলে ষ্টাফ বললেন যে এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না। আবার চলে গেলাম স্লিপিং লাউঞ্জে খিদে পেটে। ব্রাশ করতে পারছি না গত কয়েকদিন কারণ ব্রাশ, পেষ্ট সব ব্যাগের ভিতরে, ব্যাগ এখনও পাইনি। আর এমনিতে যে অবস্থার ভিতরে আছি যে জেরাল্ডকে আর ব্যাগের কথা বলা হয়নি। রাত যখন অনেক, আশেপাশের রুমগুলোর সবাই যখন ঘুমিয়ে, আস্তে আস্তে উঠে শাওয়ার ছেড় পুরো দিগম্বর হয়ে লম্বা একটা গোসল দিলাম। মনে পড়লো সকাল বেলার কথা, দুইজন শ্বেতাঙ্গ লোক পুরো দিগম্বর হয়ে গোসল করছিলেন্ আর হাসছিলেন। দেখে খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। আর এখন আমার নিজের সেই অবস্থা। বাহার মিয়াদের সাথে আবার কথা হয়েছিলো। তারা বললেন যে সবকিছু প্রসেস হচ্ছে। এয়ার মালাউইর পার্সার ভাগের টাকা অগ্রীম পেয়েছিলো না তাই ‘বেঈমানী’ করেছে। এখন সব ঠিক হয়ে গেছে। ঘুম আসছিলো না তাই ল্যাপটপ খুলে ইন বিল্ট গেমস খেলতে বসলাম। খেলতে খেলতে একসময়ে মনে হলো আর পারছি না। কোনমতে ল্যাপটপ বন্ধ করে ঘুমে ঢলে পড়লাম।
২৮ তারিখ খুব সকালে উঠে হাজির হলাম চেক ইন ডেস্কে। পরিচিত ক্লার্ক স্বভাবসূলভ হাসি দিয়ে বললেন যে ফ্লাইট ফুললি বুকড। কোনও ক্যানসেলেশনের চাঞ্ছ নেই। সুতরাং আমাকে অপেক্ষা করতে হবে সব প্যাসেঞ্জার চেক ইন করা পর্যন্ত। যদি শেষ মুহুর্তে কোনও প্যাসেঞ্জার ‘নো শো’ হয় তবেই আমার চাঞ্ছ। শেষপর্যন্ত কেউই শেষ পর্যন্ত আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে নো শো হলেন না। আমাকে আবার আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে আগামীকাল কেনিয়ান এয়ারওয়েজ এবং এয়ার মালাউই উভয়েরই ফ্লাইট আছে। সো, নো প্রব মা ফ্রেন্ড। আমি টেমপারমেন্ট হারালাম না। বাসায় একটা সংক্ষিপ্ত ফোন করে আপডেট জানালাম। তারপর এয়ারপোর্টে আমার দেখা সবথেকে স্লো গতির একটা সাইবার ক্যাফে আছে, ১৫ মিনিট ৪ ডলার, ওখানে বসে বসকে মেইল করলাম এবং জানতে চাইলাম যে আমি এখন কি করতে পারি। টাকা পয়সা শেষ এটাও লিখলাম। আর লিখলাম যে আগামী কাল যদি আবার ফ্লাইট মিস করি তবে সোজা দুবাইয়ের প্রথম যে ফ্লাইট পাবো তাতে চড়ে বসবো। মনে মনে ভাবছিলাম ফেরার প্লেনে উঠলে অন্ততঃ দুটো খেতে তো দেবে। তারপর সাইন আউট করলাম।
খিদে পেটে ঘুরছি। শরীরও আর কথা শুনতে চাচ্ছে না। মাথা ঘুরাচ্ছে। কাঁধের ল্যাপটপের ব্যাগটা মনে হচ্ছে কাঁধ ছিড়ে নিয়ে পড়ে যাবে যে কোনও সময়ে। একসময়ে ভাবলাম ব্যাগটার একটা খোঁজ নেই। অন্য বড় দুটো লাগেজ তো ঢাকা থেকেই বুক করে দিয়েছি ব্লানটায়ার পর্যন্ত। চেক ইন ডেস্কের একটা মেয়েকে বললাম যে আমাকে একটু ব্যাগটার ব্যাপারে হেল্প করতে পারবে কি না। মেয়েটা আমার লাগেজ ট্যাগ নিয়ে একজন স্টাফকে বললেন নিচে থেকে ঘুরে আসতে। প্রায় ১০ মিনিটের মধ্যে স্টাফ এসে আমার ব্যাগের বিবরণ দিলেন। আমি মাথা নাড়লাম। এরপর মেয়েটা তার ডেস্ক ছেড়ে আমাকে নিয়ে ইমিগ্রেশন ডেস্কে গিয়ে বললেন যে এই জেন্টলম্যানের একটা ব্যাগ আছে নিচে, ওটা আনা প্রয়োজন। ইনি ট্রানসিট প্যাসেঞ্জার, সামহাউ ফ্লাইট মিস করেছেন। ইমিগ্রেশন অফিসার একগাল হেসে বললেন এজন্যে তো তোমার আসার প্রয়োজন ছিলো না। উনি আমার পাসপোর্ট, টিকেট দেখে বললেন যে আমি কেনো গত তিনদিন ব্যাগ নিতে আসিনি। মেয়েটা জবাব দিয়ে দিলেন যে ইনি গত তিনদিন ধরে খুবই হ্যাসলের মধ্যে আছেন। এরপর অফিসার আমাকে নিচে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। নিচে গিয়ে আরেক বিপত্তি। যেসব লাগেজ থেকে যায় সেগুলো বিশাল খাচার মধ্যে রাখা হয়। ওই খাচার দুটো তালার চাবি থাকে দুইজনের কাছে। একজনকে পেলাম কিন্তু অন্যজনের খবর নেই। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে অন্যজন এসেই আমাকে জেরা শুরু করলেন। আমি তাকে শুধু বললাম যে আমি ফ্লাইট মিস করেছি। ব্যগটা পেয়ে অন্ততঃ একটা উপকার হলো যে এখন আর ল্যাপটপ কাঁধে নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে না। চাকাওয়ালা ব্যাগ, হ্যান্ডেলের সাথে ল্যাপটপের ব্যাগ আটকে দিলাম।
সময় কাটানো তো খুব সমস্যা। একটু বসি এবার একটু হাঁটি। কেউ কোনও নিউজপেপার ফেলে রেখে গেলে তা নিয়ে পড়ি। সিগারেটে টান দিলেই বমি চলে আসছে। দুপুর হয়ে আসলো। স্মোকিং কর্ণারে বসে ব্যাগের হ্যান্ডেল আর ল্যাপটপের ব্যাগের স্ট্র্যাপ, এই দুটো মাঝে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে থাকতে এসময়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের ঘোরেই কেমন যেন শুনতে পেলাম কেউ পিএ সিস্টেমে আমার নাম ধরে ডাকছে, আমাকে ইনফরমেশন ডেস্কে জরুরীভাবে যেতে বলছে। মনে হলো যেন এটা স্বপ্নে দেখছি। মনে হতে হতে ঘুম পুরোই ভেঙে গেলো। ওয়াশরুমের আয়নায় দেখি চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে। যেন রক্ত বেরিয়ে যাবে। টলতে টলতে আর্ট শপের কাছে গেলাম, বসকে একটা ফোন দিতে হবে। বস ফোন পেয়েই বললেন যে আমাকে অনেক বার এ্যানাউন্স করেও পাওয়া যায়নি, এতে বস খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এরপর বস কলব্যাক করলেন। তিনি বললেন যে আগামীকাল এয়ার মালাউইর ফ্লাইটে আমার জন্যে সিট থাকবে। আর আমার এই কয়দিনে যত খরচ হয়েছে তার সব এয়ার মালাউই পরিশোধ করবে। তবে এখন আমি যেন মুজাফ্ফরকে একটা ফোন করি। মুজাফ্ফর আমার জন্যে এয়ারপোর্টে টাকা পাঠিয়েছেন এবং টাকা ভিতরে ঢোকানোরও ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমি বসকে বললাম যে এয়ার মালাউইতে কি না গেলেই নয়। বস বললেন যে কেনিয়ান এয়ারওয়েজেও আমি আসতে পারি তবে সেজন্যে আমাকে আবার লিলংওয়ে থেকে ব্লানটায়ার ফ্লাই করতে হবে। আমি বললাম তাই হোক, বস যেন লিলংওয়ে থেকে ব্লানটায়ারের টিকেটের ব্যবস্থা করে রাখেন।
মুজাফ্ফরকে ফোন করতেই তিনি হাহাকার করে উঠলেন যে আমার কোনও খবর নেই বলে। তারপর লাইন কেটে দিয়ে কল ব্যাক করলেন। বুঝলাম কলব্যাকের বিষয়টা বসই তাকে বলে দিয়েছেন। এরপর তিনি আমাকে জানতে চাইলেন যে আমার কত টাকা লাগবে। আমি এবার খুব আবেগপ্রবন হয়ে পড়লাম। চোখের পানি তো আর মুজাফ্ফর দেখতে পাবেন না, গলাটা স্বাভাবিক রেখে বললাম যে ১০০ ডলার পাঠিয়ে দিন ব্রাদার, এতেই হয়ে যাবে। তিনি বললেন কিছু বেশি নিতে কিন্তু আমি রাজী হলাম না। আমি বললাম যে আবার যদি লাগে তবে তাকে ফোন করবো। এরপর তিনি জানতে চাইলেন যে আমি কোথায় বসবো যেখানে লোক টাকা নিয়ে যাবে। আমি বললাম ঠিক ৪ নাম্বার গেটের সামনে। আমার পোষাকের বিবরণ, ব্যাগ, ল্যাপটপ, এসবের বিবরণ বলে দিলাম। তারপর পিছনে তাকিয়ে দেখি বাহার মিয়া। আমাকে বললেন যে স্লিপিং লাউঞ্জের লোকটা বাইরে গেছে তাই এখানে ফোন করতে এসেছেন। এরপর আমাকে বললেন যে আপনি একটু সুলাইমানের সাথে কথা বলেন। সুলাইমানকে সালাম দিতেই তিনি চিৎকার করে নোয়াখালীর ভাষায় আমাকে বলতে লাগলেন যার মানে এরকম যে আমি কোনও কাজেরই না, কিভাবে আমাদের ডিপোর্ট করে দিলো, কোন কলেজে পড়াশোনা করেছি যে এইটুকু ম্যানেজ করতে পারিনা, ইত্যাদি। রাগে আমার সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছিলো। এবার আমি শুরু করলাম অশ্রাব্য গালি দিয়ে। যে গালিগুলো সুলাইমানকে দিলাম তার মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র গালিটা ছিলো বেয়াদবের বাচ্চা। বললাম এই বেয়াদবের বাচ্চা, আমি কি তোর স্টাফ নাকি যে আমার ঝাড়ি দিয়ে কথা কইস, শালা কুত্তার বাচ্চা কুত্তা। তাকে আরও বললাম যে বাংলাদেশে তার যে আত্মীয় এই ব্যবসার এজেন্ট তাকে আমি ২৪ ঘন্টার মধ্যে জেলে ঢুকানোর ব্যবস্থা করছি এখনই। তারপর ফোন দিলাম বাহার মিয়াকে। বাহার মিয়াও তাকে আচ্ছামতো ঝাড়লেন যারমধ্যে একটা আওয়াজও ছিলো যে ভুলু মিয়া এই ভাইজানের আব্বার পিছে পিছে ঘুরে। বাহার আবারও ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিতেই শুনতে পেলাম সুলাইমানের মিহি স্বর, ভাইজান আঁরে মাফ করি দ্যান। আঁই আ’নেরে চিনত ফারি নাই। আমি চরম বাজে একটা গালি দিয়ে লাইন কেটে দিলাম।
৪ নাম্বার গেটের সামনে যেই বসেছি শুনি উর্দু ভাষার চিৎকার। তাকিয়ে দেখি এক সুদর্শন যুবক, উর্দূতে অশ্রাব্য ভাষায় দুজনকে গালি দিচ্ছেন। ওরা দুজন শুধু তাকে ইংরেজীতে বোঝানোর চেষ্টা করছেন আর যুবক সমানে গালি দিয়ে যাচ্ছেন। ওই দুজন টার্গেট করে আমার কাছে আসলেন এবং পরিচয়পত্র দেখালেন, ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার দুজনেই। বিনীতভাবে আমার ন্যাশনালিটি জানতে চাইলেন। তারপর বললেন আমি পাকিস্তানের ভাষা জানি কি না। আমি মাথা নাড়লাম, না সূচক। কিন্তু যুবক আমাকে বাংলা মিশ্রিত উর্দূতে বললেন যে আপ বাংলা মে বাত করেন, ম্যায় সমঝ হবে। এ এক মহা জ্বালাতন। যুবকের ভাষ্যমতে তিনি ক্যামেরুনের ডৌয়ালা গিয়েছিলেন। কিন্তু ওখানে তার হোষ্ট তাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে না আসায় তাকে আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে কেনিয়াতে ১ মাসের অন এ্যারাইভাল ভিসা নিয়েছেন। তারপর পুনরায় ইমিগ্রেশনের মাধ্যমে এক্সিট না করে, এক ফাঁকে আবার এয়ারপের্টের ভিতরে ঢুকে পড়েছেন। অফিসারদের কথা যে তিনি অবৈধভাবে এয়ারপোর্টের ভিতরে ঢুকেছেন, আইনতঃ এটাই সঠিক। যুবক বলছেন যে তাকে কেনো কেউ আটকায়নি, এটা তাদের দোষ, যুবকের না। এবার অফিসাররা কাজের কথায় আসলেন। বললেন যে আমরা তার জন্য সমস্যা করবো না যদি তিনি আমাদের দাবী পুরন করেন। আমাদের ৫০০ ডলার দিলে আমরা তাকে কিছুই বলবো না। যুবক বললেন যে আমি সর্বোচ্চ ২০ ডলার দিতে পারি। অফিসাররা রেগে না গিয়ে বললেন যে আমরা আপনাকে এখনই এ্যারেষ্ট করতে পারি কিন্তু তা না করে সহযোগিতা করতে চাচ্ছি। পাকিস্তানী যুবকের একই কথা, সর্বোচ্চ ২০ ডলার। এবার তারা যুবককে বললেন যে তাদের সাথে তাদের বসের রুমে আসতে। সাথে তারা আমাকেও আসতে বললেন। আমি যতোই বলি আমি কেনো আসবো, তারা বলেন আমাদের একটু হেল্প করেন অনুবাদ করে দিয়ে। এক পর্যায়ে বাধ্য হলাম ওদের সাথে যেতে। ওদের বসের চেম্বারে যাবার পথেই অফিসাররা আমাকে বললেন ২০০ ডলারের কথা এ্যাপ্রোচ করতে। যুবক এবার বললেন যে তিনি একটা পয়সাও দেবেন না। উপরন্তু বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে এবার গালি দিতে শুরু করলেন। মহিলা অফিসারটার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, এ লান্ডি, সোওগে মেরা সাথ, ৫ ডলার সে জাদা নেহি দুংগা। এবার পুরুষ অফিসারটা বললেন যে টেক হিম এওয়ে এন্ড লেট হিম হ্যান্ডল হিজ ওউন প্রবলেমস।
আবার মুজাফ্ফরকে ফোন করলাম। তিনি রিসিভ না করে কেটে দিয়ে কল ব্যাক করলেন। আমি তাকে জানালাম যে আমাকে একটু ওদের অফিসে যেতে হয়েছিলো, তাই ৪ নাম্বার গেটের সামনে থাকতে পারিনি। মুজাফ্ফর জিজ্ঞেস করলেন আবার কোনও সমস্য হয়েছিলো কি না। আমি বললাম না। আবার গিয়ে বসলাম গেটের সামনে। প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর দেখি আমার বারবার দেখা একজন এয়ারপোর্ট স্টাফ আমার দিকে হেঁটে আসছেন আর মিটিমিটি হাসছেন। তিনি আমাকে প্রায় ৭,৩০০ কেনিয়ান শিলিং দিয়ে বললেন যে আমার বন্ধুকে একটু জানিয়ে দিতে। আমি মুজাফ্ফরকে জানিয়ে দিয়ে ধন্যবাদ দিতে গেলে তিনি খুব লজ্জিত হলেন। বারবার বলতে লাগলেন যেন কোনও অসুবিধা হলে তাকে জানাই।
আবার বসকে ফোন করলাম, বাসায়ও ফোন করলাম। তারপর কিছু খেতে গেলাম, দেখি একেবারে খিদে নেই। খাবারে কামড় দিতেই বমি আসতে লাগলো। সোজা চলে গেলাম স্লিপিং লাউঞ্জে। ব্রাশ করলাম প্রথমে। তারপর লজ্জা শরমের বালাই না করে সোজা শাওয়ারে। বাইরের দিকে পিছন ফিরে অনেক্ষণ ধরে গোসল করলাম। গোসলের পরে একটু খেতে পারলাম। রাতে আবার বাহার মিয়ারা রুমে আসলেন। আগামীকাল দুপুরের এয়ার মালাউইর ফ্লাইটে ওরা ব্লানটায়ার যাচ্ছেন। এবার আর কোনও রিস্ক নেই। সোলাইমানের লোক অলরেডি নাইরোবি চলে এসেছেন। তিনি এদের পিছনে থাকবেন। তারপর আমি ওদের বললাম যে আমি আগামীকাল সকালের কেনিয়ান এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে যাবো। এরপর ওরা ৬জনেই আবার আমার কদমবুসি করলেন। আবার দেখা হবে এই প্রত্যাশা করে ওরা ৬জন বিদায় নিলেন।
সকালে চেকইন ডেস্কের কাছে যেতেই ক্লার্ক হাসিমুখে বললেন যে আজ আপনার ফ্লাইট কনফার্মড। জেরাল্ডকেও হাই মর্নিং করলাম। ওরা বললেন যে নতুন বোর্ডিং পাস লাগবে না। ক্লার্ক মেয়েটা আমার লাগেজ ট্যাগগুলো চেক করে বললেন যে ৪০ ডলার দিতে হবে যেহেতু এটা অন্য ক্যারিয়ার। আমি তাকে বললাম যে আমার কাছে অবশিষ্ট ৩০টা মাত্র ডলার আছে। মেয়েটা জেরাল্ডের দিকে তাকালে জেরাল্ড মাথা ঝুকলেন, তার মানে এ্যাপ্রুভড। ৩০ ডলার তার হাতে দিয়ে সত্যিকার কপর্দকশুন্য হলাম। এরপর মেয়েটি তার ওয়াকিটকিতে কাউকে ট্যাগ নাম্বার বলে লাগেজ লোড করতে বলে দিলেন। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা এসে আমার হাতে ৩০ ডলার ফিরিয়ে দিয়ে বললেন যে আপনার লাগেজ এখানে নেই। মনে হচ্ছে ব্লানটায়ারে চলে গেছে।
আমি বোর্ডিং গেটে গেলে ক্লার্ক আমার টিকেট দেখে বললেন যে আপনি তো এই ফ্লাইটে যেতে পারবেন না। আপনার টিকেট তো ব্লানটায়ারের। আমি তাকে বললাম যে এয়ার মালাউইর এনডোর্সমেন্ট আছে, জেরাল্ড জানে বিষয়টা। এবার ক্লার্ক ওয়াকিটকিতে জেরাল্ডের সাথে কথা বলতে বলতে জেরাল্ড হাজির। তিনি নিজে হাতে ‘বিএলজেড’ কেটে ‘এলএলডব্লিউ’ লিখে দিলেন আমার কুপনে। এরপর সেই বহু প্রতিক্ষীত যাত্রা। ঢাকা থেকে রওনা করার ৪ দিন পরে।
যথাসময়ে ল্যান্ড করলাম লিলংওয়েতে। কিন্তু তারপর এয়ারপোর্টে ঘটলো জীবনের আরেক স্মরণীয় ঘটনা। সেটা অন্যদিন লিখবো।
মন্তব্য
বাব্বাঃ! আপনাকে কি বাঘের প্রপিতামহে ছুঁয়েছিল মশাই, এ তো আঠারো টু দি পাওয়ার আঠারো ঘা! প্রাণ এবং শরীর দুইটাই যে আস্ত ছিল আপনার ভাগ্যি...
কৌন্তভ ভাই, প্রাণ ও শরীর আস্ত ছিলো কিন্তু সারা জীবন বয়ে বেড়ানোর মতো একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিলো।
রাতঃস্মরণীয়
ভাই, এত সিনেমাকেও হার মানানো কাহিনী!
কিন্তু নায়িকা ছিলোনা যে!
রাতঃস্মরণীয়
দি টার্মিনাল
ধন্যবাদ
রাতঃস্মরণীয়
নতুন মন্তব্য করুন