তালিবানের জন্মকথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো (পর্ব ১)
তালিবানের জন্মকথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো (পর্ব ২)
তালিবানের জন্মকথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো (পর্ব ৩)
তালিবানের জন্মকথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো (পর্ব ৪)
(আবারো ক্ষমা চাইতে হচ্ছে। চেয়েছিলাম এই পর্বে শেষ করতে কিন্তু পারলাম না। আরও একটা পর্ব বাড়াতে হচ্ছে। তালিবানের সৃষ্টি ও উত্থানের সাথে আমেরিকার যোগসূত্রটা একটু না দেখালেই নয়।)।
তালিবানের জন্মে ও বিকাশে সিআইএ তথা আমেরিকার ভূমিকা
একটুখানি পিছন ফিরে দেখতে হবে; আগেই সিআইএ চিফ রবার্ট গেটস্ কিভাবে এবং কি পরিস্থিতিতে তার হাত দিয়ে মুজাহেদিন সহায়তা শুরু করেছিলেন সে সম্পর্কে পরবর্তীকালে তার স্মৃতিচারণে কি বলেছিলেন দেখি-
আফগানিস্তানে সম্ভাব্য সোভিয়েত সেনামোতায়েন পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় আমেরিকার স্বার্থ নিদারূণভাবে ব্যাহত করবে-কার্টার প্রশাসন এই জনসমক্ষে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই প্রচারণা চালায়। এর পিছনের মূল কারন ছিলো কার্টার প্রশাসন কমপক্ষে বিগত ৬ মাস ধরে গোপনে মুজাহেদিনদেরকে যে সাহায্য করে আসছে এবং তার দরূন সামরিক খাতে যে ব্যায় বেড়ে গেছে, এর স্বপক্ষে একটা অজুহাত খাড়া করা। আমেরিকা বিশেষভাবে কামনা করছিলো যে তাদের এই মুজাহেদিন সহায়তার প্রেক্ষিতে রাশিয়া যেনো একটা পাল্টা জবাব দেয়।
১৯৯৮ সালে কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্ঠা বিগনিও ব্রজনস্কি স্বীকার করেন যে কার্টার প্রশাসন সোভিয়েত আগ্রাসন শুরুর আগে থেকেই মুজাহেদিনদের সহায়তা শুরু করে। তিনি আরও বলেন-
যে সত্যটাকে কঠোরভাবে গোপনীয় রাখা হয়েছিলো তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৯৭৯ সালের ৩ জুলাই প্রেসিডেন্ট কার্টার কাবুলের সোভিয়েতবিরোধীদেরকে গোপনীয়ভাবে সাহায্য করার প্রথম নির্দেশনায় স্বাক্ষর করেন। সেই দিনই আমি প্রেসিডেন্টকে একটা নোটে আমার অভিমত ব্যাখ্যা করেছিলাম যে এই সাহায্য আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামরিক আগ্রাসন ডেকে আনতে যাচ্ছে .......... আমরা দৃশ্যত সোভিয়েত ইউনিয়নকে এই আক্রমনে উদ্ধুদ্ধ করিনি কিন্তু আমরা জ্ঞ্যাতসারেই এই আক্রমনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে চলছিলাম। বাস্তবে আমাদের এই পরিকল্পনা চমৎকারভাবে কাজ করছিলো। আমরা দেখছিলাম কিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে তার জন্যে পাতা ফাঁদে আটকা পড়তে যাচ্ছে। যেদিন সোভিয়েত বাহিনী আফগান সীমান্তের ভিতরে ঢুকে পড়ে, সেদিন প্রেসিডেন্ট কার্টারকে একটা নোটে লিখলাম যে আমাদের সামনে এইবার সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাদের জন্যে একটা ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধ’ দেওয়ার সূযোগ এসেছে।
ফেব্রুয়ারী ১৯৮০ তে ওয়াশিংটন পোষ্ট লিখলো যে আমেরিকা সরকারের কাছ থেকে মুজাহেদিনরা অস্ত্র সরবরাহ পাচ্ছে। অপর একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছিলেন-
প্রশ্ন দেখা দিলো সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভারসম্যহীন করার মধ্যে দিয়ে ভৌগলিক-রাজনৈতিকভাবে আমাদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে অপরের প্রাণ ব্যবহার করা আদৌ নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য কি না।
জবাবে পরবর্তী সিআইএ ডাইরেক্টর ষ্টানসফিল্ড টার্ণার বলেছিলেন-
এটা করেও আমি বেঁচে থাকতে পারবো।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সহায়তায় সিআইএ ৩০ লাখ মুজাহেদিনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলো। এসময়ে আমেরিকা চিন, মিশর, পোল্যান্ড, ইসরায়েল, এইসব দেশ থেকে অস্ত্র আমদানী করতে লাগলো। বলা হয়, মুজাহেদিনদের পিছনে আমেরিকার খরচ ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের সবথেকে বড় সামরিক খরচ। তারা এসময়ে পাকিস্তানের ডিরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনস ব্রিগেডিয়ার মিয়া মোহাম্মদ আফজালকে সিআইএ’র কর্মী হিসেবে তাদের পেরোলে বেতন দিতো সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলছে এটা নিশ্চিত করার জন্যে। এসময়ে সিআইএ আইসিআইকে অনুমতি দেয় ইসলামি চরমপন্থীদের এই মুজাহেদিন বিদ্রোহীদের সাথে সম্পৃক্ত করার। পাকিস্তানী সাংবাদিক আহমেদ রশীদের রিপোর্টে-
মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, উত্তর এবং পূর্ব আফ্রিকা ও দূরপ্রাচ্য থেকে ৩৪,০০০ এরও বেশি মানুষ মুজাহেদিনদের সাথে যোগ দেয়। সৌদি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং বিশাল কন্সট্রাকশন ব্যবসায়ী ওসামা বিন লাদেন সৌদি আরব থেকে ৪,০০০ যোদ্ধা রিক্রুট করে প্রথম দিকেই মুজাহেদিন বাহিনীতে যোগ দেন। তিনি বহির্বিশ্ব থেকে আফগান যুদ্ধে অর্থ, অস্ত্রসংগ্রহ ও মুজাহেদিন নিয়োগের কাজ করতে থাকেন। এসময় লাদেন সিআইএর সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
সিআইএ ৯/১১ এর পর থেকে বলতে শুরু করে যে লাদেনের সাথে তাদের কখনও কোনও সম্পর্ক ছিলো না। কিন্তু এই দাবী টেকেনি। ১৯৯৮ সালে কেনিয়ায় আমেরিকান দূতাবাসে হামলার সন্দেহভাজন ব্যাক্তিরা আদালতের সামনে ফাঁস করে দেয় যে সিআইএ ১৯৮৯ সালে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন স্নাইপার রাইফেলের একটা চালান সরাসরি লাদেনের কাছে পাঠিয়েছিলো।
১৯৯৪ সালে আমেরিকা, বৃটেন এবং সৌদি আরবের অর্থায়নে সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলো কেন্দ্র করে তালিবান (পশতুন ভাষায় ‘ছাত্র’) উদ্ভুত হয় যারা সেখানে বিশেষায়িত ধর্মীয় শিক্ষা ও সামরিক প্রশিক্ষণ পেতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তায় তালিবান ১৯৯৬ সালে কাবুলের দখল নেয়। তালিবানদের ইসলামী চরমপন্থার কোনও ইতিহাস কিন্তু আফগানিস্তানের ছিলো না। তালিবানের সাফল্য এসেছিলো মূলতঃ ২০ বছরের রাশিয়া বিরোধী যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরীন গৃহযুদ্ধের ধ্বংসস্তুপ থেকে। প্রাথমিকভাবে দক্ষিনাঞ্চলীয় পশতুন এলাকাবাসীরা তালিবানকে সমর্থন করেছিলো মুলতঃ একই জাতিসত্বার (এথনিসিটি) কারণে এবং তারা আশা করেছিলো যে তালিবান হয়তোবা ২০ বছরের যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশটাকে একটা শান্তির দিকে নিয়ে যেতে পারবে। কাবুলের ক্ষমতা দখলের আগেই তারা কিছু সাবেক সেনাপতিকে নারী ও বালক ধর্ষণের দায়ে শাস্তি দিতে শুরু করলো। এখানে একটু বলে রাখি, কান্দাহার প্রদেশে সমকামিতা বহুল প্রচলিত। আফগানিস্তানে সমকামীদেরকে ‘কান্দাহারী’ বলে গালি দেওয়া বা বিদ্রুপ করা হয়। পাকিস্তানের অর্থ ও সামরিক সাহায্য ছাড়া তাদের পক্ষে এতো দ্রুত সাফল্য অর্জন মোটেও সম্ভবপর ছিলো না।
আমেরিকার এশিয়াসম্পর্কবিশেষজ্ঞ সেলিগ হ্যারিসন বলেছিলেন-
তালিবানের সৃষ্টি সিআইএ ও আইএসআই’র সক্রিয় অনুপ্রেরণার মাধ্যমে। আমেরিকা তালিবানের ক্ষমতায় আরোহনসহ যাবতীয় ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলো।
পাকিস্তানী সাংবাদিক আহমাদ রশীদ বলেন-
আমেরিকা তালিবানদেরকে কাবুল দখল করা পর্যন্ত সহায়তা করতে পাকিস্তান ও সৌদি আরবকে উৎসাহিত করে।
তালিবান ক্ষমতায় বসার পর ষ্টেট ডিপার্টমের্ন্টের মূখপাত্র গ্রেইন ডেভিস বলেন-
কঠিন ইসলামী আইন বাস্তবায়নের জন্যে তালিবানদের যে পরিকল্পনা, আমি তাতে আপত্তিজনক কিছু দেখছি না।
সিনেটের বৈদেশিকসম্পর্কবিষয়ক সাব-কমিটির চেয়ার সিনেটর হ্যাঙ্ক ব্রাউন নিকট প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার নতুন যুগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন-
যা ঘটেছে তার মধ্যে একটা ভালো দিক হলো এর মাধ্যমে একটা সরকার গঠনের সক্ষমতার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে।
অন্য একজন আমেরিকান কূটনীতিবিদ বলেছিলেন-
তালিবানরা সম্ভবতঃ সৌদি আরবের মতো কিছু একটা করতে যাচ্ছে। যার মধ্যে থাকছে আরমাকো (সৌদি তেল নিয়ন্ত্রণকারী কোম্পানীগুলোর কনসোর্টিয়াম) থাকবে, তেলের পাইপলাইন থাকবে, একজন আমীর থাকবে, কোনও পার্লামেন্ট থাকবে না, এবং অজস্র শরীয়া আইন থাকবে। এতে আমাদের কোনও অসুবিধা নেই, আমাদের এতে চলবে।
এসময় আমেরিকার সাবেক দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক এ্যাসিষ্ট্যান্ট সেক্রেটারী রবিন রাফেল সম্ভাব্য তেল অনুসন্ধান এবং উত্তোলনের জন্যে ইউনোকলের হয়ে ব্যাপক কর্মকান্ড পরিচালনা শুরু করেন।
কিন্তু তালিবানদের ক্ষমতা দখলের পিছনে আমেরিকার আগ্রহ নিয়ে সেখানে মানবাধিকার ও নারী অধিকার সংক্রান্ত সংগঠনগুলোর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ক্লিনটন প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় যে খুবই সতর্কতার সাথে তালিবান প্রশ্নে এগোতে হবে এবং তার প্রশাসন আপাততঃ তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া থেকে বিরত থাকে। তা সত্বেও ইউনোকল ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্রিস ট্যাগার্ট ক্রমাগতভাবে বলে যেতে থাকেন যে-
যদি তালিবান শাসন আফগানিস্তানকে স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দিকে নিয়ে যেতে থাকে, তবে তা ইতিবাচক।
আবার আসল কাহিনীতে ফিরে আসি, মোল্লা মুহাম্মাদ ওমর একজন স্বল্পশিক্ষিত মাদ্রাসা শিক্ষক .......................
তথ্যসূত্রঃ http://www.thirdworldtraveler.com/Afghanistan/Afghanistan_CIA_Taliban.html
মন্তব্য
[b]Please write in more details, and eagerly waitting to read the next part
ধন্যবাদ মধুশ্রী, দুএক দিনের মধ্যেই শেষ পর্ব লিখবো। একটু কাজের চাপ যাচ্ছে তাই সময় করে উঠতে পারছি না। তবে এর মধ্যে আপনি আগের পর্বগুলো পড়া না থাকলে পড়ে নিতে পারেন।
রাতঃস্মরণীয়
কি বলা উচিত - ফ্রান্কেনস্টাইন, না বাপ কা বেটা?
দৃটোই বলা যায়। ধন্যবাদ।
রাতঃস্মরণীয়
শনিবার ভোরের ঘটনা ঘটার পর জিনিসটা নিয়ে ভাবছিলাম। কি হইতে কি হয়!
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
নতুন মন্তব্য করুন