কবরটি রাস্তার পাশেই । সাধারণ কবরের চেয়ে বেশ বড়। পাশেই ধান মাড়াইয়ের কাজ চলছে। মাঝে মধ্যেই ধানের খড় এসে ঢেকে দিচ্ছে কবরের খানিকটা। কবর ঘেরা ছোট্ট দেয়ালে বসে ঝিড়িয়ে নিচ্ছে কয়েকজন গ্রাম্য মজুর। ঘাম মুছতে মুছতে ক্লান্তির থুতুটি আনমনে ছুড়ে দিচ্ছে কবরের দিকে। কবর ভর্তি জংলি গাছ। চেনার উপায় নেই এটি কোন গণকবর। অথচ ১৯৭১ এ এখানেই দাফন করা হয়েছিল ৩৩টি শহীদের রক্তাক্ত শরীর। অনাদর আর অযতেœ এভাবেই পড়ে আছে দক্ষিণ বহলার গণকবরটি।
দিনাজপুর জেলা শহরের নিকটবর্তী হলেও বহলা বিরল উপজেলার বিজোড়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম। গ্রামের সূধিজনেরা উত্তর ও দক্ষিণ দু’ভাগে ভাগ করেছে বহলাকে।
কুমারপাড়া পার হয়ে বহলার দিকে আমরা এগোতে থাকি। অল্প সময়েই পৌছে যাই গণির মোড়ে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আব্দুল গণি। গণি বহলার হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। বহলার গণকবরে শায়িত আছে গনির বাবা তসির উদ্দিন, ভাই নুরু মোহাম্মদসহ আরো অনেকেই।
গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে গণকবরটি। দেখলে মনে হবে জংলা ঘেরা পরিত্যাক্ত কোন জায়গা বিশেষ। কবরস্থানের কবরগুলোও এর চেয়ে বেশি যতেœ থাকে। অথচ যাদের রক্তে দেশ স্বাধীন হলো সে সব শহীদদের গণকবরের এমন অবহেলা আর অনাদর আমাদের ব্যাথিত করে।
গণকবরটির পাশে দাড়িয়ে গণির জবানিতে শুনি ১৯৭১ এ বহলার সেই লোমহর্ষক ঘটনাটি।
২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে পাকসেনারা সারাদেশে আক্রমণ চালালেও দিনাজপুরে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত কোন পাকসেনা ঢুকতে পারেনি। এখানকার ইপিআর হেড কোয়ার্টার কুটিবাড়ী ছিল বাঙালিদের দখলে। কুটিবাড়ীর সবচেয়ে নিকটবর্তী ও নিরাপদ গ্রাম ছিল বহলা। ফলে কুটিবাড়ী থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র সরানো হতো বহলার ভেতর দিয়ে। এ নিয়ে বহলা গ্রামের প্রতি পাকসেনাদের এক ধরণের প্রতিহিংসামূলক মনোভাব ছিল যুদ্ধের শুরু থেকেই।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিক। পাকসেনাদের নিয়ে রাজাকার আর আলবদর বাহিনী সারাদেশে চালাচ্ছে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ। দিনাজপুর শহর তখনও হানাদারমুক্ত হয়নি। পাকবাহিনীর নজর তখনও পরেনি বহলার ওপর।
১৯৭১ এর ১৩ ডিসেম্বর, সোমবার। কয়েকটি গাড়িতে পাকসেনা হানা দেয় বহলায়। ক্যাম্প গড়ার কথা বলে সবাইকে নির্দেশ দেয়া হয় গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার। কিন্ত গ্রামবাসী তা আমলে নেয় না। নিজের বাপ দাদার ভিটা ছেড়ে যাওয়ার কথা তারা চিন্তাও করতে পারে না। বিকেল অবধি গ্রাম খালি না হওয়ায় পাকসেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
বিকেলের পর সন্ধ্যা নামে। গ্রামের সবাই দাড়ায় মাগরেবের নামজে। তিন রাকাত ফরজের পর সুন্নত পড়ার সুযোগ হয়না কারো। পাকসেনারা মসজিদ থেকে গনিসহ সবাইকে ডেকে নিয়ে যায় গ্রামের শেষ প্রান্তে। লাইন ধরে দাড় করায় সবাইকে। মসজিদের ইমামও রক্ষা পায়নি পাকসেনাদের রোশানল থেকে।
পাকসেনারা ব্রাশ ফায়ারের গুলিতে ঝাঝড়া করে দেয় গ্রামের নিরীহ নিরপরাধ মানুষের বুকগুলো। সবাই লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। মৃত্যু যন্ত্রণা আর আর্ত চিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে বহলার বাতাস। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে সবাই ডাকতে থাকে তাদের আপনজনদের। দূর থেকে অসহায়ের মতো আপনজনের মৃত্যু যন্ত্রণা দেখছিল গ্রামের মহিলা ও শিশুরা।
সে সময় পেটে ও পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েও পালাতে সক্ষম হয় আনিসুরসহ কয়েকজন। আর গুলি না লাগায় দৈব ক্রমে বেঁচে যায় গণি। হত্যার পরে পাকসেনারা লাশগুলোকে স্তুপ করে খড় দিয়ে ঢেকে রাখে।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বৃহস্পতিবার। দেশ স্বাধীনের দিন। পাকসেনারা বহলা ছেড়ে কুটিবাড়ীর দিকে চলে যায়। ঐদিন বিকেলে গনিসহ গ্রামের তমাজউদ্দিন,কালু মোহাম্মদ,কলিম আহম্মদ, আফজাল হোসেন মিলে গর্ত করে শহীদদের পচে যাওয়া স্তÍপ করা লাশগুলোকে একত্রে মাটি চাপা দেয়।
পাকসেনাদের গুলিতে সে দিন বহলায় শহীদ হয় ৩৯ জন । এর মধ্যে ৩৩ জনকে দাফন করা হয় এই গণকবরে। বাকীদের লাশ পারিবারিকভাবে দাফন করা হয় গ্রামেরই অন্য জায়গায়।
মুক্তিযুদ্ধের ৩৯ বছর পর বহলায় শহীদদের নামের তালিকা খুঁজতে হয়েছে নতুনভাবে। শহীদদের নামের তালিকা সংরক্ষণ করা হয়নি সরকারীভাবে। সঠিকভাবে শহীদদের নাম জানাতে পারেনি বিরল মুক্তিযোদ্ধা সংসদও। শহীদ আমিন আলীর ছোট ভাই আমজাদ হোসেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য নিয়ে বহলার গণহত্যায় ৩৯জন শহীদদের নামের তালিকা তৈরী করেন।
মুক্তিযুদ্ধের ৩৯ বছর পরেও বহলার ৩৯ জন নিরীহ নিরপরাধ মানুষের আত্মত্যাগের কাহিনী তুলে ধরা হয়নি দেশবাসীর কাছে। উদ্যোগ নেয়া হয়নি গণকবরটি সংস্কারের। তৈরী হয়নি কোন স্মৃতি স্তম্ভ।
স্বাধীনতার এত বছর পরেও অসহায় শহীদ পরিবারগুলো অপেক্ষায় আছে। কবে সংরক্ষণ করা হবে বহলার গণকবরটিকে? শহীদ স্মরণে কবে তৈরী হবে একটি স্মৃতিস্তম্ভ? শহীদের সন্তানেরা কবে দেখবে তাদের শহীদ পিতার কবরে সোভা পাচ্ছে শত শত ফুল?
বহলা থেকে ফেরার পথে নানা প্রশ্ন মনে ভর করে। এ দেশে কে বড়? রাজাকার নাকি মুক্তিযোদ্ধা! ৭১ এ পাকবাহিনী আর তাদের দোসর রাজাকার,আল বদর,আল শামসের লোকেরা গোটা দেশেই তৈরী করেছিল হাজার হাজার গণকবর। আর স্বাধীনের পর বিচারের পরিবর্তে সেই সব রাজাকারদের গাড়িতে উড়েছে লালসবুজের পতাকা। অথচ বহলার মতো গণহত্যায় শহীদদের কথা কেউ মনে রাখেনি। এ বরই লজ্জার,বরই দুঃখের।
সালেক খোকন
মন্তব্য
বহলার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা।
...........................
Every Picture Tells a Story
শ্রদ্ধা রইলো বহলার শহীদদের প্রতি।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
বহলার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা রইলো।
এই রক্তের ঋণ শোধবার নয়। শহীদদের জন্যে সালাম।
রাতঃস্মরণীয়
আমাদের বিবেকবোধ যে কবরের ভেতরে বসবাস করে, সেখানে এই গণকবরদের খবর পৌঁছায় না।
-------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
সালেক খোকন, লেখায় ৫ তারা। লিখা থাকুক এই ইতিহাস। যতভাবে পারা যায়, লিখে যাওয়া হোক।
তবে একটা কথা। আমার ব্যক্তিগত অভ্যাস বলতে পারেন। পাক শব্দটা পবিত্র অর্থে ব্যবহার হয় বলে আমি কষ্ট করে পাকিস্তানি শব্দটা টাইপ করার পক্ষে। পাক বাহিনী, হানাদার বাহিনী এই শব্দগুলা আমাদের সিলেবাসে খুব যত্ন করে ঢুকানো হয়েছে যাতে 'পাকিস্তান' নামক অশ্লীল ফিনোমেননটাকে লেখ্য ভাষাতে হলেও আড়াল করা যায়।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
শহিদদের শ্রদ্ধা জানানোর কথা মানেই তো নিজেদের ভণ্ডামি আর দুর্বলতার কথা নির্লজ্জভাবে প্রকাশ করা। এই বাংলাদেশের জন্যে মানুষ প্রাণ দিয়েছলো, এই দেশের জন্যে? এতোদিনেও জানা গেলো না দেশে মুক্তিযুদ্ধ করলো ক'জন, কারা রাজাকার ছিলো, কোথায় গণকবর, কোথায় নির্যাতনকক্ষ, ক'জন মারা গেলেো, ক'জন লাঞ্ছিত হলো। এখনো শুনতে হয় সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকবে, এখনো দেখতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে রাজাকারদের হাত-মেলানোর তৈলাক্ত চিত্র। এদেশে বাস করি বলে, আর নিজে মেরুদণ্ডহীন বলে আমি নিজেকেই ধিক্কার দেই।
নাঃ, আমি আর শ্রদ্ধাপ্রকাশের নামে এসব শহিদদের অবমাননায় নেই। যদি কখনো সত্যিই পারা যায় তাঁদের স্বপ্নের দেশ গড়তে, তাহলে আবারো পাঠ করবো হুমায়ুন আজাদের 'একজন নামপরিচয়হীন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা।'
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
বাংলার সন্তানেরা বাংলার মাটিতেই ঘুমিয়ে আছেন শান্তিতে......জাতির অকৃতজ্ঞতায় তাঁদের কি আর এসে গেলো? সিমেন্টের মিনার লাগবে না.......আমাদের হৃদয়ে, স্মৃতিতে থাকাটাই জরুরি। আপনার লেখাটা সে কাজটিই করেছে সুন্দরভাবে। ধন্যবাদ।
.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা
.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা
আমরা যে যেখানি থাকি এরকম তথ্যগুলোর সন্ধান পেলে অবশ্যই তা প্রকাশ করা দরকার। আপনার প্রচেষ্টাকে সম্মান জানাই, পাশাপাশি সেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
ডকুমেন্ট হিসেবে আরো ভালো হতো যদি সেই গণকবরের জায়গাটার একটা ছবি পোস্টে সংযুক্ত করে দেয়া সম্ভব হতো। আর যে ৩৯জন শহীদের নাম সংগৃহিত হয়েছে তার তালিকাও যদি এ লেখায় যোগ করা যেতো, তাইলে তো কথাই ছিলো না ! তথ্য হিসেবে কালের খাতায় আঁকা রয়ে যেতো।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
নতুন মন্তব্য করুন