আমেরিকান কথা সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন কে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই, স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেন্স লিখতেন মার্ক টোয়েন ছদ্মনামে। যারা “এডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন” এবং “এডভেঞ্চার অব টম স্যয়ার” পড়েছেন তাঁদের কাছে একটু অন্যরকম মনে হতে পারে পরিনত বয়সের এই গল্পটি।
এক.
একদিন সকালে একজন জলপরী এসে কড়া নাড়লো দরজায়, তাঁর হাতে একটি ঝুড়ি, বললো- “এই নাও উপহার, যে কোনো একটি পছন্দ করে নিয়ে বাকীগুলো রেখে দাও, বুঝে শুনে বেছে নাও- কোনটি তুমি চাও কারণ এর মধ্যে কেবল একটিই মূল্যবান!”
ঝুড়িতে ছিল ‘সম্মান’, ‘ভালোবাসা’, ‘সম্পদ’, ‘আনন্দ’ আর ‘মৃত্যু’ এই পাঁচটি উপহার। যুবকটি আগ্রহের সাথে বললো- “এখানে বিচার বিবেচনার কিছু নেই” বলে সে আনন্দটি বেছে নিল।
সে বাইরের পৃথিবীতে গেল, যৌবনের আনন্দে মেতে উঠলো। কিন্তু সব আনন্দই তার কাছে ক্ষনস্থায়ী, অপ্রত্যাশিত, এবং সবশেষে অর্থহীন মনে হলো!
যুবকটি মনে মনে ভাবলো, এই বছরগুলো অযথাই নষ্ট হলো, যদি আবার সুযোগ পাওয়া যেত আমি তাহলে খুব বুদ্ধি বিবেচনা করে বেছে নিতাম!
দুই.
একদিন ওই জলপরীটি আবার এলো এবং বললো- “আরো চারটি উপহার বাকী আছে, খুব সাবধানে বেছে নাও আর মনে রেখো কেবল একটিই এখানে খুব মূল্যবান!” মানুষটা এবার খুব দীর্ঘক্ষন ধরে ভাবলো এবং বেছে নিলো- ‘ভালোবাসা’ এবং জলপরীর চোখে জ্বলজ্বল করে ওঠা অশ্রুকনাটুকু তার চোখেই পড়লো না।
অনেক বছর পর, শূন্যঘরে একটি কফিনের পাশে বসে আছে লোকটি, আর নিজেকে বলছে- “একজন একজন করে ওরা সবাই চলে গেছে, এখন সে শুয়ে আছে এখানে, সবচেয়ে প্রিয় এবং সর্বশেষ জন। হাহাকার আর হাহাকার করেই জীবন গেল আমার; ভালোবাসার বিশ্বাসঘাতকতা আমাকে কাঙাল করেছে, আমি অভিশাপ দেই তোকে!”
তিন.
“বেছে নাও।” জলপরিটি বলছে।“এই বছরগুলো তোমাকে ‘জ্ঞান’ দিয়েছে, তাই দেয়া উচিত। তিনটি উপহার বাকী আছে, মনে রেখো শুধু একটিই কাজের সুতরাং ভালোভাবে বেছে নাও!”
দীর্ঘক্ষন তাকিয়ে থেকে লোকটি বেছে নিলো, ‘সম্মান’, জলপরীটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাঁর পথে চলে গেলো।
আরো কিছু বছর কাটলো, জলপরীটি এসে দাঁড়িয়েছে লোকটির পেছনে, যখন ম্লান হয়ে আসা এক দিনের শেষে লোকটি ভাবছে। জলপরীটি জানে সে কি ভাবছে!
“আমার নাম পূর্ণ করেছে এই পৃথিবীকে, সবার মুখে মুখে আমার নাম, এবং কিছু সময়ের জন্য এটা দেখতে ভালোই লেগেছে। কিন্তু কত ক্ষুদ্রতর ছিল সেই সময়টুকু! এর পরপরই আসলো ঈর্ষা, বিভ্রান্তি, ঘৃণা এবং নানা অভিযোগ। এরপর সেই পরিহাস এর পূনরাবৃত্তি।সবশেষে সেই করুণা যা সম্মানকে ধুলিস্বাত করে দিলো!”
চার.
“আবার বেছে নাও” আবার সেই জলপরীর কন্ঠস্বর।
“দুটো উপহার এখনো আছে বাকী, এবং আফসোস করো না, শুরুতে যেমন একটি মাত্র মূল্যবান উপহার ছিল এখনো তা আছে”
“সম্পদ… যার মানে হলো ক্ষমতা! কি অন্ধ ছিলাম আমি!এতদিনে জীবন হবে অর্থপূর্ণ” বলে উঠলো লোকটি।“এই পৃথিবী এখন আমার কথায় উঠবে বসবে, আমি সমস্ত বিত্ত, বৈভব, প্রাচুর্য, এবং আনন্দ সবকিছু, সম্মান, প্রভুত্ব সবকিছু আমি কিনে নেবো। এখন পর্যন্ত আমি ভুল উপহার বেছে নিয়েছি…”
তিনটি ক্ষুদ্র বছর কাটলো, একদিন লোকটি এক সাধারণ চিলেকোঠায় বসে কাঁপছে; সে ছিল অস্থি চর্মসার, চোখে ঢুকে গেছে গর্তে। শুকনো স্বরে সে বিড়বিড় করছে- “অভিশাপ পৃথিবীর সমস্ত উপহারকে, পরিহাসকে এবং সাজানো মিথ্যাকে! ওগুলো কোনো উপহার ছিল না, বড়জোর ‘দায়’ ছিল। আনন্দ, ভালোবাসা, সম্মান, সম্পদ সব কিছুই এত ক্ষনস্থায়ী যে সব শেষ হয় যন্ত্রণা, লজ্জা আর দৈন্যতার মাঝে। জলপরী ঠিকই বলেছিল একটি মাত্র উপহারই মূল্যবান ছিল! আমি ক্লান্ত, শ্রান্ত অনেক, আমি বিশ্রাম চাই...”
পাঁচ.
জলপরীটি আবার আসলো, চারটি উপহার নিয়ে কিন্তু মৃত্যু ছাড়া। সে বললো- “আমি ওটা অন্য একজনকে দিয়ে এসেছি, সে ছিল উপেক্ষিত কিন্তু সে আমাকে বিশ্বাস করেছিল, আমাকে বলেছিল পছন্দ করে দিতে।তুমি তো কখনো আমাকে পছন্দ করে দিতে বলো নি!”
লোকটি বললো, “কি আর বাকী আছে আমার জন্য?”
জলপরীটি উত্তর দিলো, “যার যোগ্যও তুমি নও, বৃদ্ধকালের লাঞ্চনা!”
[গল্পটি কিছুটা সংক্ষেপিত। একটু নৈরাশ্যবাদী, মার্ক টোয়েনকে এমন রুপে আগে আমি দেখিনি!]
কাজী মামুন
মন্তব্য
খুব ঝড়ো বেগে শেষ হল, আরেকটু কম ছোট করলে অনেক ভাল লাগত, এমনিতেও অনেক ভালই লেগেছে।
ধন্যবাদ
এমনিতেই মানুষ আজকাল গল্প কবিতা পড়তে চায় না। বড় গল্প হলে তো কথাই নেই, (একটু রগরগে ধরনের হলে ভিন্ন কথা! ) তাই বাড়তি কিছু লাইন ঝেড়ে ফেলেছি, আর অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাবানুবাদই আমার পছন্দ এজন্য কিছুকিছু লাইন ভাবার্থ ঠিক রেখে লিখেছি নিজের মতো।
পড়ছেন জেনে ভালো লাগলো!
কাজী মামুন
মার্ক টোয়েনের চোর ঘন্টা গল্পটা পড়ে দেইখেন
আপনি লেখেন তারপর পড়ব
ইংরেজী নামটা বলুনতো! বাংলা পড়ার তো উপায় নেই এখানে!
কাজী মামুন
kisu jiniser onubaad hoy na ..
The McWilliamses and the Burglar Alarm - Mark Twain
text -> http://www.classicreader.com/book/1370/14/
audio/mp3-> http://www.archive.org/details/MarkTwain-TheBurglarAlarm
ইংরেজী নামতো আমিও জানিনা। আমার কাছে বাংলা গল্প সমগ্র আছে মার্ক টোয়েনের সেটাতে পড়া। খুবিই মজার। আপনি বোধহয় শায়লা আপুর পরিচিত
ইংরেজী নামটা হলো "The McWilliamses and the Burglar Alarm"
খুব ভালো লাগলো গল্পটা। টোয়েন এভাবে সবগুলো উপহারকেই ব্যবচ্ছেদ করে দেখালেন ঠিকই। কিন্তু মনে হচ্ছে এবার আমাকে যদি সেই জলপরী একটিমাত্র উপহার বেছে নিতে বলে, আমিও সেই মূল্যবান উপহারটি যাচাই করে বেছে নিতে পারবো না ! ক্ষণস্থায়ী জীবনের সব চাওয়ার স্থায়ীত্বই যে আরো বেশি ক্ষণস্থায়ী, সম্ভবত এই উপলব্ধিটাই গল্পটির গোপন মাহাত্ম্য !
ধন্যবাদ মামুন ভাই। এরকম আরো লেখা চাই। ভালো থাকবেন।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
দাদা যে কোনো অনুবাদই পরিশ্রম সাধ্য কাজ। যখন ইংরেজী জ্ঞান খুব একটা ছিল না, তখন খুব অনুভব করতাম, আহা, এই গল্পগুলো যদি বাংলায় থাকতো! এমন মন্তব্য পেলে উৎসাহ বেড়ে যায় অনেক। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে! সিরিজটা চালিয়ে নিয়ে যাবো আশা করছি, প্রিয় গল্পগুলো দিয়ে সাজাবো।
কাজী মামুন
ভাল্লাগল লেখাটা।
কুটুমবাড়ি
মৃত্যু যার পরিত্রানের জন্য সর্বোত্তম উপহার হয়ে ওঠে সে আর কিসের যোগ্য হতে পারে বলুন! এমনই মানব জীবন!
ভালো লাগলো
...........................
Every Picture Tells a Story
মুস্তাফিজ ভাই, আপনাদের এমন উৎসাহ পেলে সিরিজটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা রাখছি!
অনেক ধন্যবাদ!
কাজী মামুন
চমৎকার গল্প।
চমৎকার অনুবাদ।
অনুবাদ একটু বেশিই সংক্ষিপ্ত হয়েছে।
...মার্ক টোয়েনের স্বভাবসুলভ রসমুখর যেই পরিচয়টা আমরা জানি, আশ্চর্যজনক ভাবে তাঁর বেশিরভাগ ছোটগল্পেই এর উল্টোটারই পরিচয় পেয়েছি। গল্পকার টোয়েন অধিকাংশ সময়ই চমকে দিয়েছেন বিষয়টার গভীরতায়- বুদ্ধির চমকে নয়...
_________________________________________
সেরিওজা
অনেক আগে পড়েছিলাম গল্পটা। আবারও পড়ে ভাল্লাগলো
গল্প ভাল্লাগসে।
শিরোনামে বানান অণুগল্প হবে।
আর অনূদিত শব্দটার ব্যুৎপত্তি জানি না।
--------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
গল্পটি থেকে রসস্বাদন করলাম আর কোথায় থেকে যেন ‘মৃত্যু’ নামক একটি প্রতিধ্বনি মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে লাগল। ’মৃত্যু’! ’মৃত্যু’! ’মৃত্যু’! কোথায় খুজে পাই মৃত্যুকে! আমার আমি ধিক্কার দিচ্ছে আমাকে -‘তোর স্মরণশক্তি ক্রমহ্রাসমান। তুই লাঞ্চিতদের দলে। মৃত্যু নামক অমরতার স্বাদ কি তুই পাবি!’ হ্যাঁ অবশেষে পেয়ে গেলাম কাগজে লেখা মৃত্যুকে। তাকে নামিয়ে আনলাম থরে থরে সাজানো কাগজের শিলালিপী থেকে। প্রতিধ্বনি থেমে গেল। মন বললো ‘এবার পেশ কর কাজী সাহেবের দরবারে ’মৃত্যু’ নামক অমরতার কথা।‘
“চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়
সত্য যে কঠিন
কঠিনেরে ভালবাসিলাম
সে কখনো করে না বঞ্চনা
আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে......’’
-রবীন্দ্রনাথ
...................................
মহসীন ঢালী
ভাল লাগল।
নতুন মন্তব্য করুন