মাহমুদা নাসরিন কাজল
মিউটেশন কি?
কোন জীবের এক বা একাধিক বৈশিষ্টের আকস্মিক বংশগত পরিবর্তনকে মিউটেশন বলে। স্থুল অর্থে কোন জীবের কৌলিক বস্তুর (genetic material) যে কোন পরিবর্তন যেমন- ক্রোমোজোমের গঠনগত পরিবর্তন, সংখ্যাগত পরিবর্তন বা জীনের গঠনগত পরিবর্তন ইত্যাদি সকল প্রকার পরিবর্তনকেই মিউটেমন বলে বিবেচনা করা হয়। সূক্ষার্থে, জীনের ক্ষারক বিন্যাসের পরিবর্তনকেই মিউটেশন হিসেবে ধরা হয়। জীনের এ জাতীয় মিউটেশনকে পয়েন্ট মিউটেশন বলা হয়।
এই রকম পরিবর্তনের ফলে কোন জীবে নতুন ধরনের চরিত্র দেখা দিতে পারে। এই চরিত্র উত্তরাধিকারসূত্রে এক বংশ থেকে পরের বংশে যায়। কোন জীবের বৃদ্ধির সময় প্রত্যেক জীন অসংখ্যবার বিভক্ত হয়। সাধারনত এইসব বিভাজন যথাযথভাবে হওয়ার ফলে অপত্য জীনগুলি মাতৃজীনের অনুরুপ হয়। কিন্তু আকস্মিকভাবে কোন বিভাজনের সময় গোলযোগ দেখা দিলে পরিবর্তিত অপত্য জীনের সৃষ্টি হতে পারে। এর এটাই মিউটেশন।
মিউটেশন কি কি কারনে হতে পারে?
প্রথমত মিউটেশন দুই রকমের। একটা হল স্বতঃস্ফুর্ত (Spontaneous) মিউটেশন যা নানাবিধ প্রাকৃতিক কারণে হয়। যেমন-সুর্যের বিভিন্ন রশ্মি (গামা রশ্মি, বিটা রশ্মি, এক্স রে, আলট্রা ভায়োলেট রে), বিভিন্ন পারমানবিক রশ্মি, তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে বিকিরিত বিভিন্ন রশ্মি, অধিক তাপমাত্রা ও বিভিন্ন রোগ আক্রমণের ফলে এমনকি দীর্ঘদিন স্টেরয়েড বা এ জাতীয় কোন ওষধ সেবন করলে এ ধরনের মিউটেশন ঘটতে পারে। স্বতঃস্ফুর্ত মিউটেশনের হার অত্যন্ত কম। সাধারণত প্রতি ১০,০০০ থেকে ১০০,০০০ গ্যামেট বা কখনো কখনো ১০০০,০০০ গ্যামেটের মাত্র ১টি গ্যামেটে মিউটেশন হয়ে থাকে (উদ্ভিদ প্রজনন,শহিদুর রশীদ ভূইয়া, ১৯৯২)।
অধিকাংশ মিউটেশনই ক্ষতিকর এবং গাছের জন্য তা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তবে কখনো কখনো মিউটেশনের ফলে অনুকূল চরিত্রের সৃষ্টি হয়। ক্ষতিকর মিউটেশনযুক্ত জীব স্বাভাবিক জীবের সাথে প্রতিযোগীতায় অকৃতকার্য হয়ে বাতিল হয়ে যায়। কারন প্রকৃতি সব সময় অনুকুল চরিত্র যুক্ত জীবকে নির্বাচিত করে। সাধারনতঃ মিউটেশনের ফলে কোন জীবের প্রাণশক্তি কমে যায়। আবার কোন কোন মিউটেশনের ফলে জীব অনুর্বরও হয়ে উঠতে পারে।
দ্বিতীয়টা হল আবিস্ট বা induced মিউটেশন যা বিভিন্ন মিউটাজেনিক এজেন্ট প্রয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের মিউটেশন ঘটানো হয়। উদ্ভিদে জেনেটিক ভেরিয়েশন সৃষ্টি করে প্রজননের কাজ এগিয়ে নেয়ার জন্য এ ধরনের মিউটেশন ঘটানোর প্রয়োজন পড়ে।
মানবদেহে মিউটেশন হয় কি?
........................................................
মানুষের ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে- যদি দীর্ঘদিন ধরে কোন জীবন্ত মানবদেহ উপরোক্ত প্রাকৃতিক কারণসমুহের সংস্পর্শে একনাগাড়ে থাকে তাহলে তার দেহের জীন লেভেলে মিউটেশনজনিত পরিবর্তন ঘটতে পারে যা তার দেহে বিভিন্ন জটিলতার জন্ম দিতে পারে (ক্যানসার, টিউমার বা এজাতীয় সমস্যা) যা থেকে মৃত্যুও হতে পারে বা তার চরিত্রগত কোন পরিবর্তন এনে দিতে পারে যা কিনা সে তার পুর্বপুরুষ থেকে পায়নি। অথচ মিউটেশনের কারণে পরিবর্তিত এই চরিত্রটি তার পরবর্তী বংশধরে ঠিকই স্থানান্তরিত হবে। কেননা এই পরিবর্তনটি ঘটেছে জিন লেভেলে। মিউটেশন যুক্ত কোষ থেকে সৃষ্ট সব কোষেই মিউটেশন থাকে। এক জেনারেশনে ঘটে যাওয়া মিউটেশন সে জেনারেশনে প্রকাশিত নাও হতে পারে যদি তা রিসিসিভি (প্রচ্ছন্ন) হয়। পরবর্তী কোন জেনারেশনে তা ডমিন্যান্ট (প্রকট) রুপে প্রকাশিতও হতে পারে।
বলাই বাহুল্য- স্বতঃস্ফুর্ত মিউটেশনের হার অত্যন্ত কম।
মানুষর বেলায় Spontaneous মিউটেশন এর একটা প্রধান কারণ হতে পারে তার খাদ্যাভ্যাস, নানা ঔষধ ইত্যাদি। চিকিৎসার প্রয়োজনে ঘন ঘন এক্সরে করা এবং অযোগ্য ও অল্প জ্ঞনসম্পন্ন টেকনিশিয়ান দ্বারা এক্সরে করানো, কৃত্রিমভাবে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য দ্বারা সংরক্ষিত ও পাকানো সব্জি, ফল, মাছ, দুধ ইত্যাদি খাওয়া কারণে মানবদেহের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটছে যা আমাদের সমাজে দৃশ্যমান।
ভারতীয় জেনিটিসিস্ট সুহিতা গুহের মতে, যারা খুব বেশী কফি বা চা পান করেন তাদের দেহে যথেস্ট পরিমাণে ক্যাফিন সঞ্চিত হয়ে মিউটেশনের কারণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। যারা বেশী ধুমপান করেন তাদের দেহে যথেষ্ট শক্তিসম্পন্ন মিউটেশন সৃষ্টিকারী পদার্থ নিকোটিন ক্ষতির কারণ হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন খাদ্য সংরক্ষণকারী পদার্থ (Preservative), কোন কোন ঔষধ (যেমন বিটা প্রপিয়ো ল্যাকটিন), সরষের তেল, বাদাম তেল, রেড়ির তেল এমনকি মদও মিউটেশনের কারণ হতে পারে। সরষের তেলের allylisothiocyanate এ মিউটেশন সৃষ্টিকারী পদার্থ পাওয়া গেছে। মদ তথা ইথাইল অ্যালকোহল দেহে প্রবেশ করে মিউটেশন সৃষ্টিকারী পদার্থ অ্যাসিটালডিহাইডে পরিবর্তিত হতে পারে।
মানুষে কোমোজোমের মিউটেশনের প্রভাবঃ
.....................................................
মানুষে ক্রোমোজোমের সংখ্যার বা গঠনগত তথা আকৃতির পরিবর্তনের জন্য নানা রকম অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। সাধারনত মানবদেহে ক্রোমোজোম সংখ্যা ২৩ জোড়া (৪৬টি)। ২২ জোড়া দেহকোষীয় যাদেরকে বলে অটোজোম এবং এক জোড়া প্রজননকোষের, এদেরকে বলে সেক্স ক্রোমোজোম। সেক্স ক্রোমেজোম আবার স্ত্রী প্রজাতিতে xx রুপে এবং পুরুষ প্রজাতিতে xy রুপে বিদ্যমান থাকে।
বিজ্ঞানীদের গবেষণায় জানা যায় যে, ক্রোমোজোমীয় অস্বাভাবিকতার জন্য মানুষের নানা রকম রোগ দেখা দিতে পারে। একুশতম ক্রোমোজোম একটা অতিরিক্ত থাকলে মানুষে mongolism বা Down’s syndrome সৃষ্টি হয়। xxy ক্রোমোজোম বিশিষ্ট লোকে kleinfelter’s এবং xo ক্রোমোজোম বিশিষ্ট লোকে turner’s syndrome দেখা দেয়।
mongolism বা Down’s syndrome : এদের ক্ষেত্রে দেহের প্রায় সব টিস্যুতেই কম বেশী অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। এদের চওড়া ছোট মাথা, বাঁকা চোখ, চ্যাপ্টা নাক, বড় জিভ, ছোট ছোট হাত-পা থাকে। এদের বুদ্ধিও খুব কম থাকে। এছাড়া এরকম লোকেদের নানারকম রোগ যেমন-ক্যাটার্যাক্ট, হৃদরোগ, হার্নিয়া, শ্বাসযন্ত্রের রোগ ইত্যাদি বেশী হয়। অস্থি মজ্জায় রক্ত সৃষ্টিকারী কোষে (Stem cell) অটোজোমীয় ক্রোমোজোমের ঘাটতির কারণে ক্রনিক গ্রানুলোসাইটিক লিউকেমিয়া দেখা দেয়।
kleinfelter’s syndrome : এ অবস্থা সাধারণত পুরুষদের বেলায় ঘটে। এদের বদ্ধি কম থাকে। তবে এরা এগ্রেসিভ, রুক্ষ ও উগ্র মেজাজী হয়। এরা সমাজ বিরোধী ও অপরাধপ্রবণ হয়। সহজেই সন্ত্রাসী কর্মকান্ণ্ডের সাথে এরা সম্পৃক্ত হয়ে যায়।
turner’s syndrom : এ অবস্থা সাধারণত স্ত্রীদের বেলায় দেখা যায়। turner’s syndrome বিশিস্ট স্ত্রীতে কেবল একটা x ক্রোমোজোম থাকে। প্রতি ৩০০০ জনের মধ্যে একজনের এ রোগ হয়। এদেরও বদ্ধি স্বাভাবিকের তুলনায় কম থাকে। এদের ব্রেস্ট এর গঠন ঠিকমত হয় না। হিজড়া ও মানসিক প্রতিবন্ধিত্ব একারণে হতে পারে।
কৃত্রিম মিউটেশনের গুরুত্বঃ
বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রানীর উন্নতিকল্পে কৃত্রিম উপায়ে সুবিধাজনক মিউটেশন সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। ছত্রাক থেকে মুল্যবান ঔষধ পেনিসিলিন তৈরী হয়। এই ঔষধ যখন প্রথম আবিস্কৃত হয় তখন ছত্রাক থেকে খুব কম পরিমাণে ঔষধ পাওয়া যেত। পরে বিকিরণ প্রয়োগ করে এমন ছত্রাক পাওয়া গেছে যার উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশী। বিজ্ঞানী H. Stubbe দেখিয়েছেন, মিউটেশনের মাধমে উৎপাদিত বার্লির উৎপাদন ক্ষমতা ও প্রেটিনের পরিমাণ বেশী। আমেরিকায় চিনাবাদাম গাছে এক্সরে প্রয়োগ করে অধিক উৎপাদনশীল গাছ পাওয়া গেছে। M.S. Swaminathan গমে আলট্রা ভায়োলেট ও গামা রশ্মি প্রয়োগ করে দ্রুত ফলনশীল ও অধিক প্রোটিনযুক্ত উদ্ভিদ পেয়েছিলেন। এই উদ্ভিদে লাইসিনের পরিমাণ বেশী হয়। এছাড়া সর্ষে গাছে তেলের পরিমাণও মিউটেশনের মাধ্যমে বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।
স্বপরাগী উদ্ভিদে বিশেষত যে সব উদ্ভিদে সহজে সংকরায়ণ করা যায় না তাদের বেলায় কৃত্রিম উপায়ে মিউটেশনের মাধ্যমে উন্নতি করা সম্ভব (পাট)। মিউটেশনের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ানো সম্ভব হয়েছে (চীনাবাদাম)। মিউটেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন ফলের উৎকর্ষ সাধন হয়েছে (বীট)। ফুলে বৈচিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে (ডালিয়া)।
বাংলাদেশে মিউটেশন এর অবদানঃ
বাংলাদেশ আনবিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) আমাদের দেশে প্রবর্তিত আই আর-৮ জাতে এবং দেশী জাত নাইজারশাইলে গামা রশ্মি প্রয়োগ করে যথাক্রমে ইরাটম-২৪ ও বিনাশাইল নামক দুটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। বিনা থেকে একই প্রক্রিয়ায় ফরিদপুর-১ নামক ছোলাতে গামা রশ্মি প্রয়োগ করে উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ হাইপ্রোছোলা নামক নতুন জাতের ছোলা ও পাটের ডি-১৫৪ জাতে গামা রশ্মি প্রয়োগ করে উফসী এটম পাট-৩৮ জাত সৃষ্টি করা হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরিষাতে রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়াগ করে সম্বল নামক রাই সরিষার একটি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
শেষ কথাঃ
যারা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রাজয়েট এবং পেস্ট গ্রাজুয়েট পর্যায়ে পাটোয়ারী স্যারের ক্লাস পেয়েছেন তারা জানেন, স্যার ক্লাসের শরুতেই বলতেন- ‘আমি কেউ না। আমার অর্ধেক আমার মায়ের আর অর্ধেক আমার বাবার’। এই যে বাবা মায়ের থেকে পাওয়া ক্রোমোজোম সেট নিয়ে আমাদের বিকাশ, তাদের যাবতীয় দোষ-গুণ-চরিত্র আমাদের মধ্যে- তারপরও আমরা হুবহু তাদের মত নই। স্বাতন্ত্র্যতা যেটুক পাই তা মুলতঃ পারিপার্শিক বিভিন্ন কারণে ক্রোমোজোম তথা জীন লেবেলের পরিবর্তনের কারণেই যা আমাদের মাঝে ভিন্নতা তৈরী করে দেয়
..........................................
মাহমুদা নাসরনি কাজল
।
মন্তব্য
ভাল লাগল।ধন্যবাদ।
লেখা ভালো লেগেছে কাজল আপু।
আপনার নামের ভেতর নাসরনি জায়গাটায় কেমন মিউটেশন মিউটেশন গন্ধ পাচ্ছি।
আমারও তাই মনে হচ্ছে। তবে প্রকৃতি অস্বাভাবিক কিছু সহ্য করে না। তা শুধরে দেয়।
প্রিয় এডমিন কি এই ভুলটি শুধরে দেবেন প্রকৃতির মত?
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
ভাল লেগেছে
মানিক চন্দ্র দাস,
আপনি ঠিকই ধরেছেন। ট্যালেন্ট!
ছোটবেলায় আমার আব্বা নাছরিন বানানটা নাসরিনই রেখেছিলেন। আমি নবম শ্রেণীতে উঠার পর রেজিস্ট্রেশনের সময় মাতুব্বরী করে নিজের নামের বানানের এমন হতশ্রী করেছি। এখন ভাবি, কি বোকামী করেছি! তবে ইংরেজীতে লিখলে বোঝার উপায় নেই বলে বাংলাটা আর পরিবর্তনের ঝামেলায় যাইনি।
নতুন মন্তব্য করুন