৭২৯…
ভর্তি রোল নম্বর।
ভীড় ঠেলে স্কুলের গেট-এ লাগানো A-4 সাইজের কাগজটায় নিজের রোল টা খুজে পেতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। তেমনি বেগ পেতে হয়নি স্কুল থেকে পাশ করে বের হয়ে যেতে। বেগ যা পাওয়ার পাই এখন, যখন হাজারো ক্লাসমেটদের মাঝেও কাওকে বন্ধু করে নিতে লক্ষাধিক বার চিন্তা করে নিতে বাধ্য হই। মনের রসায়ন ভীষন কঠিন…!
চান্স পেয়েছি দেখতে পেয়ে যেমন এক দৌড়েই বাসায় চলে এসেছিলাম, তেমনি স্কুল টাও এক দৌড়েই পার হয়ে গেলো। পার হয়ে গেলো স্মৃতি কাতর করা দিনগুলো। নাহ, দিন গুলো বললে মুহুর্তগুলো গুরুত্ব হারাবে, মুহুর্ত বলাই ভালো।
মনে হয় এইতো তষ্যু দিন সারা ক্লাস রুমে দশ বারো জনে মিলে কুউউউ ঝিকঝিক করতে করতে ঘুরলাম, বেঞ্চের পাশে লুকিয়ে লুকিয়ে যুদ্ধ করলাম। অস্ত্র ছিলো বোতলের পানি। ঝাপ্সা বোতলগুলোর ক্যাপ এ কলম দিয়ে ফুটো করে বানানো কামান! তৃতীয় শ্রেণীর র্যগ ডে ছিলো সেদিন। দুটো করে পুরি কিনে করে ফেলেছিলাম বর্ষ পূর্তি!
পরশু দিন আলী ভাইয়ের ছাগল টা কে টিফিনের দুই টাকা থেকে বুট কিনে খাওয়ালাম পলাশ রাফি কে সাথে নিয়ে। প্রতিদিনই টিফিনের ঘন্টা দিলেই ছুটছুট। ছাগলটা বেশি দিন ছিলো না। কত টুকু খারাপ লেগেছিলো ছাগলটা কে যেদিন থেকে আর দেখিনি সেই অনুভুতি এখন ঝাপ্সা হয়ে গেছে, এইটুকু বলতে পারি এরপর আর কোনদিন ছাগল দেখে এতো মায়া লাগেনি।
ক্লাস ফোরেই হঠাৎ করে স্কুলে হইহই রইরই পড়ে গেলো যে নিচতলায় বাথরুমে ভুতের (!) আগমন শুরু হয়েছে। বড়ো কোন এক ভাইকে নাকি ধরেছে। নিচতলাতেই আমাদের ক্লাস রুম। সে সময় কয়েকটা দিন যার পর নাই ভয়ে কেটেছিলো! কেউ দেখেনি নিজ চোখে অথচ ভুত বাবা তার প্রভাব দিব্যি বজায় রেখেছিলো বেশ কয়েকদিন। স্যার ক্লাস রুম থেকে বের হলেই কয়েকজন দল পাকিয়ে বাথরুমে সামনে গিয়ে দেখে আসতে প্রস্তুত হয়ে যেতাম। আমি ছোট বেলা থেকেই প্রচন্ড সাহসী তাই আমার অবস্থান সবার এক্কেবারেই পিছনে হতো । অন্যদের সু্যোগ করে দিতে চাইতাম আরকি! যাই হোক নিজের কথা নিজে বলার অভ্যাস নেই আমার একদম। তো সেই “ব্যটা”লিয়ন(LION!) নিয়ে ব্যপক গতিতে(ঘন্টায় পাচ-সাত মি.) তিনটে রুম পার হয়ে বাথরুমের কাছাকাছি যাওয়া মাত্রই এই LION দের কি যেনো হতো, আমরা বিপুল বিক্রমে পশ্চাৎপদ হয়ে ঘাটিতে( ক্লাস রুমে ) ফিরে আসতাম! দরজা জানালা লাগিয়ে দিয়ে ঐ অতটুকূ বাচ্চা বয়সে কি যেনো দরুদ পড়তাম, ভয়ে কাপতে থাকতাম, ভাবতাম এই বুঝি শেষ, সব শেষ!
সময় কতো দ্রুত পালিয়ে যায়!
এইতো সেদিন বড় হুযুরের ভয়ে সজীব নামায ঘরে পুর্ব দিকে ফিরেই নামায পড়ে ফেললো। যেদিন বড় হুযুর আসতো না সেদিন চার তলা স্কুল বিল্ডিং জুড়ে ছোয়াছুয়ি অথবা বরফ-পানি অথবা অছি খেলতাম। প্রতিদিন পিটি করতে হাজির হয়ে যেতাম ভর দুপুরে। একসাথে সুরা পাঠ, শপথ, জাতীয় সংগীত গেয়ে গলা ভেঙ্গে গেছে কতোবার! প্রতিবেদন না আনার জন্য আব্দুল মালেক স্যারের অতো মোটা বেতের সর্বশক্তি দিয়ে মার যে খায়নি সে কি করে বুঝবে প্রতিবেদন বইটা কতটুকু যন্ত্রণার ছিলো! কামরুল হাসান স্যারের বা হাতের থাপ্পর খেয়ে যার এখন মনে নেই তাকে আমার একটাই পরামর্শ- ভাই শীঘ্রই ডাক্তার দেখা...! আনিস স্যারের স্বাস্থ্যবান বেতের বাড়ি খেয়ে পশ্চাদ্দেশ কচলাতে কচলাতে সবাই কেনো উহ, আহ করে হাসতো তার রহস্য বের করার জন্য কয়েক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করাই আবশ্যক। ফরহাদ স্যারের গায়ের সুগন্ধি এখনো নাকে লেগে আছে, যে সুগন্ধির ঘ্রাণ পেলে সহজেই বোঝা যেতো দশ মিনিটের ভেতরে স্যার এদিক মাড়িয়ে গেছেন।
খুব বেশী কিছু এই ছোট্ট মাথায় কখনোই এক সাথে রাখতে পারি না কিন্তু ইস্কুল বেলার মুহুর্ত গুলো ক্ষণে ক্ষণেই কড়া নাড়ে, ক্ষণে ক্ষণেই পা দুটোকে আকুল করে দৌড়ে চলে যেতে অতীতে-যেখানে "আমাদের ছোটো নদী চলে বাকে বাকে-বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে......" অথবা "এক যে ছিলো মজার দেশ-সব রকমের ভালো, রাত্রিরেতে বেজায় রোদ দিনে চাদের আলো......"।
আচ্ছা, "কাজলা দিদি" মুখস্থ করতে শুধু আমার-ই এতো কষ্ট হয়েছিলো......?? 'হৈমন্তি"-র অপু-কে কার ধুম করে সোয়া দুই মণ ওজনের একটা চড় মারতে ইচ্ছা হয়নি......??
ক্ষণে ক্ষণে- পা ছুটে যায় ইস্কুলের মাঠে যেটাতে তারেক, সম্পদ, পলাশ, মুন্না, রাইসুল গরুর মতো দৌড়ে বেড়াতো......আর তাই আমাকেই সারা টিফিন জুড়ে চোর থাকতে হতো... ......! যেখানে বলের অভাবে আমাদের ফুটবল খেলা কোনদিন বন্ধ থাকেনি...! প্লাস্টিকের বোতল, বড়ো ইটের টুকরা যাই হোক, মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা ছিলো আমাদের অসাধারণ। ব্রাজিল-ফ্রান্স হলে এই খান থেকেই হয়তো দুই-একটা রোনালদো-জিদান বের হয়ে আসতো, কে জানে??
আমাদের ক্লাস রুমের একটা বেঞ্চেরও পায়ের তলার কর্ক গুলো বাকি নেই, শুধু আমাদের কেনো, আশেপাশে-র যতো সেকশন ছিলো কোনোটার-ই বাকি থাকেনি...ব্যাল্কনি তে ওইগুলি আমাদের জাবুলানি ছিলো। মারুফে-র গায়ের ঘামের গন্ধে এখনো নাক সিটকে আসে! শালা যেভাবে বল(!) টা নিয়ে পায়ের তলায় আটকে ধরে রাখতো ! আরেক প্রতিভা ছিলো তারেকের। ব্যালকনির গ্রিল আকড়ে ধরে এক জায়গায় দাড়ায়ে থাকতো পায়ের নিচে বল নামক অ-গোল বস্তু টাকে। আমরা ও কম কিসে, ওটা ছুটাতে না পারি সর্ব শক্তি দিয়ে লাত্থি তো মারতে পারি, দেদারসে লাত্থি মারতাম চার-পাচজনে আর চার-পাচ জনে মিলে গ্রিল থেকে গাবরটার হাত ছুটাতে চেষ্টা করতাম নিরন্তর, কিন্তু আফসোস ! এত-জনে মিলেও পারতাম না খুব একটা। ছুটাতে ছুটাতে স্যার চলে আসতো...দে দে ছুট! ক্লাসে গিয়ে চুপচাপ বেঞ্চে স্থাপিত হয়ে যেতাম। ক্লাস শেষে আবার। ক্যাপ্তেন ভেটকি তার কাপ্তেন্সি রেখে আমাদের সাথেই লাত্থি মারার সুখ ভোগে লিপ্ত থাকতো, অতএব কিসের ভয়, আরো জোরে হেইও, জোরসে মারো হেইও!
তবে স্কুল ছুটি হলেই একটা-ই প্রশ্ন......কিরে তোরা চলে যাস...??...উত্তর ও একটা-ই "আমরা?...চলে যাইতেছি!! কে বলে??" নেমে যেতাম আমি(বাওয়া), পলাশ, টেপা(নাকিব), সম্পদ, রাশেদ, সালেহিন, সিয়াম, মৃদুল, বাবু, জিকো, মুন্না, রাইসুল, শাওন, আরাফাত, সানিব, সজিব প্রমুখ ব্যক্তি বর্গ। শুকনা থাকলে প্লাস মানুষ বেশী থাকলে ক্রিকেট আর ঝুম বৃষ্টির দিনে মাঠ ভরা কাদায় অথবা থইথই পানিতে ফুটবল। বল নড়তো না বটে, পৃথিবীটা ঠিক-ই নড়ে উঠতো, ক্ষণে ক্ষণে আকাশ টাকে সরাসরি দেখতে পেতাম নরম কাদায় শুয়ে!
টেনিস বল না পেলে নারিকেল গাছের তলায় গিয়ে ছোট ডাব নিয়ে আসতাম, পরীক্ষার বোর্ড দিয়ে ব্যাট বানিয়ে দিব্যি খেলা হয়ে যেতো। বেঞ্চ ক্রিকেট খেলেছি ডায়েরি আর কাগজের বল দিয়ে। প্রতিদিন কি রকম উত্তেজনা নিয়ে স্কুলে যাবার আধা ঘন্টা-এক ঘন্টা আগে থেকে কাগজ শক্ত করে মুচড়ে গোল আকার দিতে থাকতাম, তার উপর থাকতো কস্টেপ। তখন সবে মাত্র টিফিনের টাকা দুই থেকে তিন এ উন্নীত হয়েছে। ও দিয়েই দুইতিন জনে মিলে একটা পাচ টাকা দামের কস্টেপ; চলে যেতো বেশ কয়েকদিন। আয়াতুল্লাহ ব্যাট করার সময় পুরো শরীর টা নাড়িয়ে উহ জাতীয় একটা শব্দ করে ধেয়ে আসতো বলের দিকে। আম্পায়ার ব্যাটিং দলের কেউ হলে তো যতক্ষণ ছয় না হচ্ছে ততক্ষণ ওটা নো-বল অথবা ডেড বল, ওভার শেষ করতে দিন পার !
সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে দোস্তদের টিফিন বাক্সের কথা...!
নিজে খুব একটা টিফিন নিতাম না, টাকা যা নিতাম মেরাজ ভাইয়ের চটপটি(টক বলাই ভালো) খেয়ে বা তেতুলের আচার শাদা শার্টে মেখেই( যা খেতাম তার চেয়ে বেশি শার্টে লেগে যেতো!) অথবা কস্টেপ কিনেই শেষ হতো। দুই একদিন আনলেও প্রথম পিরিয়ড শেষ করেই খতম! টিফিন এর জন্য রেখে টিফিন এর মুহুর্ত নষ্ট করতাম না... গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হতো। টিফিনের ঘন্টা পড়লেই আদিবের টিফিন বাটি টা- আমি উদ্বোধন করতাম, তারপর শুভ, তারপর রিয়াদ, তারপর শিশির, তারপর রাফি, তারপর রাইসুল...... একে একে সবাই, সব্বাই। কাওকে বাদ দিতে মায়া লাগতো। "এ"-সেকশন শেষে "বি" -তে ঢু মারতাম। বেঞ্চ ক্রিকেট খেলতাম আর ঘুরে ঘুরে খেতাম। আমি আসতেছি দেখে মৃদুল তো একদিন পুরো তিনটে না চারটে রুটি দুটো চমচম সহ এক্কেবারে মুখে দিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে থাকলো! না পারে চাবাতে, না পারে গিলতে!
সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে বাইরে গিয়ে কি নির্লজ্জের মতো টাকা চাইতাম অথবা এইটা খাওয়া ওইটা খাওয়া বলে কান ঝালাপালা করেছি। ইস্কুল টা পার হয়ে যাওয়ার পর আর কোন দিন কোন ক্লাস মেট এর কাছে টাকা চাইতে পারিনি, টিফিন খাবো বলতে পারিনি নিঃসংকোচে! অথচ ইস্কুল বন্ধুদের কাছে চাইতাম যখন তা বাইরের কেও দেখলে মনে করতো আমার খাবার বুঝি আমি ওদের কাছে রেখে এখন ফেরত চাইছি। এই আমাদের রসায়ন...
একেক জন একেক জায়গায় এখন। সবাই ব্যস্ত, জীবন তাড়িত, সময়ের ভেলায় ভেসে যাচ্ছি সবাই। এক সময় চাইতাম কবে বড় হব, কবে দুনিয়াটা দেখবো। এখন দুনিয়া টা দেখে মনে হয় আর না, অনেক হয়েছে দেখা। আমি আবার দেখতে চাই ভুতের ভয়ে অন্ধকার হয়ে থাকা ক্লাসরুম, শশী-র মুখ, যে আমার জন্য আলাদা করে টিফিন নিয়ে আসতো, শুনতে চাই বড় হুজুরের "ওরে হারামখোরের দল", সিরাজ স্যারের "মানচিত্র কই?" , রেজওয়ানুল হক স্যারের "বোতল নামা"। দৌড়ে বেড়াতে চাই সারা মাঠ জুড়ে তারেক পলাশ সম্পদ মুন্নার পেছনে; না ধরতে পারি, আমার কোন আক্ষেপ নেই। মাঠ ভরা পানিতে ফুটবল আর বেঞ্চের ওপর ক্রিকেট, মাতুব্বর স্যারের পেট ফাটানো হাসির গল্প, ঘুরে ঘুরে টিফিন খাওয়া , শার্টে আচার এর দাগ, অষ্টম শ্রেণীর বৃত্তি কোচিং, সব্দার আলী(প্রধান শিক্ষক) স্যারের ভয়ে কাপতে থাকা সহপাঠি-র চেহারা, স্যারের বাসায় দল বেধে পড়তে যাওয়া- সব চাই, সব! আয় রে ফিরে ইস্কুল বেলা......!
কিন্তু জানি সময় আমার সবচেয়ে বড় শত্রু............(
---------------------------------------------------------------------------
উদ্ভট রাকিব
সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে উদ্ভ্রান্ত হলেম!
মন্তব্য
দারুন লেখা,বেশ ভাল লাগলো।
আসলেই,ইস্কুলবেলার কোন তুলনা হয়না।।
ভাল থাকুন,লিখতে থাকুন।।
উদ্ধৃতি
"সময় আমার সবচেয়ে বড় শত্রু"
লেখালেখি চলুক...
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ আপু......
------------------------------------------------------------------------
সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে উদ্ভ্রান্ত হলেম!
অষ্টম শ্রেণীর বৃত্তি কোচিং, আহা সেই গোলগাল হলদেটে মুখ! কোনো এক ভয়ানক বৃষ্টির দিনে কাকভেজা হয়ে ক্লাশে ঢোকার পর নিজের ভাজ করা ওড়নাটা এগিয়ে দিয়েছিলো মাথা মোছার জন্য।
লিখেছেন ভালো। কিন্তু বস, ডুয়েল পোস্টিং হলো যে!
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
বস, পরবর্তি কাহিনী জাতি জান্তে চায়... ;)
- মুক্ত বয়ান
সচল-এ কখন অচল রাখে আর কখন সচল করে দেয় এই ব্যাপারটায় আমার ইস্কুলের অংকবিদ্যা কাজে লাগতেছে না। আগেও পোষ্টাইসি কিন্তু সিক্যুয়েল হওয়া সত্ত্বেও তা পাবলিশ হয় নাই, তাই মনের দ্বন্দায়িত হয়ে দুই জায়গাতেই পোষ্টাইয়াছি......
উদ্ভট রাকিব
---------------------------------------------------------------------
সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে উদ্ভ্রান্ত হলেম...!
নস্টালজিক লেখা।
- মুক্ত বয়ান
নতুন মন্তব্য করুন