দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে | তৃতীয় কিস্তি |

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০৭/০৯/২০১০ - ৩:৫৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হায় ঈশ্বর! কী ওটা? ক্যানভাসের ওপর ওই ভয়ংকর মুখটা কার? ওটা তাঁকে ভেংচি কাটছে! মুখভঙ্গিতে কিছু একটা আছে, তাঁর শরীর সিঁটিয়ে উঠছে ঘৃণায়। এটা ডোরিয়ান গ্রের মুখ-ছবি! আতঙ্ক ছড়ালেও ছবিটার সৌন্দর্য পুরোপুরি মুছে যায়নি। ওই পাতলা চুলে এখনও স্বর্ণালি ছটা, সুদর্শন মুখে এখনও লালিমার ছাপ। ওই বসে যাওয়া চোখগুলো এখনও নীল। হাঁ, এটা ডোরিয়ান গ্রে। কিন্তু কে এমন করেছে?

তিনি চিনতে পারছেন ছবিটা তাঁরই হাতে আঁকা, ফ্রেমের নকশাও তিনিই করেছেন। ধারণাটি দানবীয়, ভয় তাঁকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে।

[প্রথম কিস্তি]

[দ্বিতীয় কিস্তি]

তৃতীয় কিস্তি

পর্ব তেরো ॥ বাঁচানোর চেষ্টা ॥

তেরো বছর পর। নভেম্বরের নয় তারিখ, আটত্রিশতম জন্মদিনের রাতে, ডোরিয়ান হেঁটে ঘরে ফিরছিল। সে লর্ড হেনরির সাথে ডিনার করে এসেছে। রাতটা ঠাণ্ডা আর কুয়াশাময়।

বাড়ির কাছাকাছি হতেই একজন লোককে দেখতে পেল। লোকটি ব্যাগ বহন করছে এবং তার পরিচিত—বাসিল হলওয়ার্ড। একটা অদ্ভুত ভয়ের অনুভূতি, বুঝতে পারে না কেন, তার দিকে ধেয়ে এল। সে বাসিলের সাথে কথা বলতে চায় না। তাঁকে না চেনার ভান করে দ্রুত হাঁটতে লাগল বাড়ির দিক লক্ষ্য করে।

কিন্তু বাসিল ডোরিয়ানকে চিনতে পেরেছেন, তিনি হাত রাখলেন ডোরিয়ানের কাঁধে। ‘ডোরিয়ান! আমি তোমার জন্যে লাইব্রেরিতে বসে অপেক্ষা করছিলাম। আজ মধ্যরাতের ট্রেনে প্যারিস যাচ্ছি। ছয় মাস থাকব। যাবার আগে তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম এটা তুমি। তবে নিশ্চিত ছিলাম না। তুমি আমাকে চিনতে পারনি?’

‘এই কুয়াশায়, বাসিল? কিছুই তো নজরে পড়ছে না। আমি দুঃখিত যে তুমি দেশের বাইরে যাচ্ছ, অনেকদিন তোমাকে দেখিনি।’

‘এই তো দেখা হলো,’ বাসিল বললেন। ‘কিছু কথা ছিল তোমার সাথে। অত্যন্ত জরুরি।’

‘ঠিক আছে। তুমি বরং ভেতরে এসো,’ ক্লান্ত ডোরিয়ান বলল।

ডোরিয়ানকে অনুসরণ করে বাসিল লাইব্রেরিতে এসে ঢুকলেন। একটা বড় অগ্নিকুণ্ডে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কাছেই একটা টেবিলের ওপর ব্র্যাণ্ডি আর সোডা রাখা।

‘আমার হাতে আর সময় নেই, ডোরিয়ান। তোমাকে কিছু কথা না বললেই নয়,’ বাসিল বললেন।

‘কী বিষয়ে কথা বলতে চাও, বাসিল?’ ডোরিয়ান জানতে চাইল। ‘আমি খুবই ক্লান্ত। বিছানা টানছে আমাকে।’

‘এটা তোমার বিষয়ে। মনে হয় আমি কী বলতে চাইছি তুমি বুঝতে পারছ। এই লন্ডন শহরে তোমার নামে কীসব আজেবাজে কথা রটছে। তোমার খ্যাতি ধ্বংসের মুখে,’ বাসিল ব্যথিত গলায় বললেন।

‘পরের কান-কথাকে আমি গ্রাহ্য করি না,’ ডোরিয়ান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ‘আমি শুধু তাদের কলঙ্ক সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।’

‘তোমার গ্রাহ্য করা উচিত, ডোরিয়ান। অবশ্যই লোকে যেসব ভয়ংকর কথা বলছে তা আমি বিশ্বাস করি না। আমার ধারণা পাপ এমন একটি জিনিস যা মানুষের মুখে ছাপ ফেলে যায়। এটা আড়াল করা যায় না। কিন্তু আমাদের প্রথম সাক্ষাতে তুমি যেমনটা ছিলে, এখনও দেখতে তেমনি তরুণ আর পবিত্র আছ।’

‘যদিও আমি তোমাকে খুব কম দেখেছি,’ তিনি বলে চললেন, ‘এবং আমি এমন সব কুৎসিত কথা শুনেছি তোমার সম্পর্কে! বিশিষ্ট লোকজন তোমার বাড়িতে আসতে চান না কেন? তাঁরা তোমাকে নিমন্ত্রণেও আগ্রহী নন! কেন তোমার বন্ধুত্ব অন্যদের এত বিড়ম্বিত করে?’ বাসিল কিছু প্রসিদ্ধ ব্যক্তির তালিকা তুলে ধরলেন যাঁরা ডোরিয়ান গ্রের কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে।

তিনি উল্লেখ করলেন এক তরুণ রাজপুত্র যে নৌবাহিনীতে ছিল এবং আত্মহত্যা করেছে, লর্ড কেন্টের ছেলে যে বিয়ে করেছে একটি পতিতাকে এবং আদ্রিয়ান সিঙ্গেলটনের কলঙ্ক, যে দণ্ড ভোগ করছে জালিয়াতির অভিযোগে। এরা সবাই একসময় ডোরিয়ান গ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল।

‘শুধু তা-ই নয়,’ বাসিল শোচনীয় ভঙ্গিতে যোগ করলেন, ‘বলা হয় ভয়ংকর সব বাড়ি থেকে তোমাকে ভোর রাতে বেরোতে দেখা যায়। বন্দরের সবচেয়ে খারাপ আখড়াগুলোতে তোমার গোপন অভিসারের কথা উচ্চারিত হচ্ছে জোরেশোরে। এ ধরনের চুটকি কি সত্য হতে পারে? তুমি কি মোটেও খ্যাতির পরোয়া কর না?’

ডোরিয়ান শুধু শ্রাগ করে। তাকে সম্পূর্ণ দ্বিমত দেখায়। যেসব ভয়ংকর গুঞ্জন আকাশে-বাতাসে ভাসছে সেসবকে সে পাত্তাই দিতে চায় না।

‘আমার অবাক লাগে,’ বাসিল চিন্তামগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘সত্যি আমি তোমাকে চিনি কি না। উত্তর দেয়ার আগে, আমি যদি তোমার আত্মা দেখতে পেতাম!’

‘আমার আত্মা!’ সোফা থেকে লাফিয়ে উঠল ডোরিয়ান গ্রে, ভয়ে একদম সাদা হয়ে গেছে মুখ। ‘ন্যায্য কথা। আজ রাতে নিজের চোখে আমার আত্মা দেখতে পাবে। আমাকে অনুসরণ করো। এটা তোমার হাতের কাজ, কেন তুমি দেখবে না? আমার দুর্নীতি ও অধঃপতন নিয়ে যথেষ্ট বকবক করেছ। এখন তুমি এটা সামনাসামনি দেখবে।’

বাসিল আতঙ্কিত হলেন। বন্ধুকে খুবই বেপরোয়া লাগছে তাঁর কাছে। ডোরিয়ান গ্রের মুখে অবশ্য অবজ্ঞাপূর্ণ হাসি। ‘ওপরে এসো, বাসিল,’ সে শান্ত ভাবে বলল। ‘আমি আমার জীবনের দিনপঞ্জি রাখি। এসো, নিজের চোখে দেখো।’

ডোরিয়ানের বলা প্রতিটি শব্দে বিকৃত অহংকার প্রকাশ পেল। সে বাচ্চা ছেলের মতো মাটিতে পা ঠুকল। কারও সাথে রহস্যটি ভাগ করতে পেরে যেন বুনো আনন্দ পাচ্ছে সে।

পর্ব চৌদ্দ ॥ সত্য উদ্ঘাটন ॥

তাঁরা দু জন চুপিসারে স্টুডিওর দিকে হেঁটে গেলেন। ঝাড়বাতির আলোয় আজগুবি সব ছায়া তৈরি হলো সিঁড়ি এবং দেয়ালে। বেড়ে চলা বাতাস জানালায় খটখট শব্দ তৈরি করছে।

‘তুমি জানতেই চাও, বাসিল?’ ডোরিয়ান নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ,’ তাঁর উত্তরে দৃঢ়তার ছাপ।

‘তোমার পেছনের দরজাটা বন্ধ করো,’ ডোরিয়ান আদেশ করল। ‘আমার সম্পর্কে সবকিছু জানার অধিকার শুধু তুমিই রাখ। আমার জীবনের সঙ্গে তুমি অনেকখানি জড়িত, তুমি যতটুকু ধারণা কর তার চেয়ে অনেক বেশি।’

বাসিলের কাছে এসবই হেঁয়ালি মনে হয়। তিনি ঘরের চারদিকে তাকান। দেখে মনে হচ্ছে জায়গাটাতে অনেকদিন কেউ বাস করে না। দেয়ালজুড়ে লাগানো পর্দা বিবর্ণ হয়ে এসেছে। একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা ছবি, প্রায় শূন্য বইয়ের দেয়াল, একটা টেবিল ও চেয়ার—আসবাব বলতে এগুলোই। ডোরিয়ানের হাতে আধ-গলা মোমবাতি, তার আলোতে তিনি দেখতে পেলেন সবকিছুর ওপর ধূলা জমে আছে, কার্পেটে বড় বড় গর্ত।

‘তো তোমার ধারণা শুধু ঈশ্বরই আত্মা দেখতে পান, বাসিল? কাপড়টা সরাও এবং দেখো আমার আত্মা!’ ডোরিয়ানের কণ্ঠ শীতল ও নিষ্ঠুর শোনাল।

‘তুমি উন্মাদ হয়ে গেছ ডোরিয়ান,’ বাসিল বললেন। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

‘আমি নিজেই সরাব,’ রাগী যুবকটি বলে উঠল। এক টানে কাপড়টা সরিয়ে ছুড়ে মারল মেঝের ওপর।

বাসিলের বুক চিরে একটা ভয়ার্ত চিৎকার বেরিয়ে এল।

হায় ঈশ্বর! কী ওটা? ক্যানভাসের ওপর ওই ভয়ংকর মুখটা কার? ওটা তাকে ভেংচি কাটছে! মুখভঙ্গিতে কিছু একটা আছে, তার শরীর সিঁটিয়ে উঠছে ঘৃণায়। এটা ডোরিয়ান গ্রের মুখ-ছবি! আতঙ্ক ছড়ালেও ছবিটার সৌন্দর্য পুরোপুরি মুছে যায়নি। ওই পাতলা চুলে এখনও স্বর্ণালি ছটা, সুদর্শন মুখে এখনও লালিমার ছাপ। ওই বসে যাওয়া চোখগুলো এখনও নীল। হাঁ, এটা ডোরিয়ান গ্রে। কিন্তু কে এমন করেছে?

তিনি চিনতে পারছেন ছবিটা তাঁরই হাতে আঁকা, ফ্রেমের নকশাও তিনিই করেছেন। ধারণাটি দানবীয়, ভয় তাঁকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে। তিনি জ্বলন্ত মোমবাতিটি তুলে ধরলেন ছবির সামনে। বাম দিকের কোনায় তাঁর নিজের সই জ্বলজ্বল করছে, লাল রঙে টানা টানা অক্ষরে।

তাঁরই আঁকা ছবি! কী এর মানে? কেন এটা বদলে গেল? এবং কীভাবেই বা হলো?

‘এর অর্থ কী?’ চেঁচিয়ে উঠলেন বাসিল। দৃশ্যটি দেখে হকচকিয়ে গেছেন। ঘুরে তাকালেন ডোরিয়ান গ্রের দিকে, চোখে ঘোর-লাগা দৃষ্টি। হাত ও মুখ কাঁপছে, কথা বলার শক্তি নেই। তিনি কপালে হাত দিলেন, সেখানে ঘাম ফুটে আছে।

ডোরিয়ান কথা বলল। ‘বহু দিন আগে, যখন আমি কেবলই বালক, তুমি আমার একটি ছবি এঁকেছিলে। তুমি আমার প্রশংসা করলে। রূপ নিয়ে অহংকার করতে শেখালে। তারপর একদিন পরিচয় করিয়ে দিলে লর্ড হেনরির সাথে, যে আমাকে বলল শুধু একটি জিনিসের মূল্য আছে, আর তা হলো সৌন্দর্য।’

‘ছবিটা আমাকে এই ধারণা দিল যে আমি অত্যন্ত সুদর্শন,’ ডোরিয়ান বলল, হাতের মুষ্ঠি পাকাল একই সাথে। ‘আমি আমার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলতে চাইনি। এক পাগলপারা মুহূর্তে, আমি একটা ইচ্ছা প্রকাশ করি। খুব সম্ভব তোমার মনে আছে?’

‘মনে আছে! কিন্তু এ তো অসম্ভব।’

‘কী অসম্ভব?’ ডোরিয়ান মৃদু কণ্ঠে অভিযোগ করল, ইঙ্গিত করছে আতঙ্ক ছড়ানো ছবিটির দিকে। ‘এই যে আমার আত্মা।’

‘একসময় বলেছিলে ছবিটা তুমি ধ্বংস করে ফেলেছ,’ বাসিল বললেন।

‘মিথ্যে,’ ডোরিয়ান বলল, ‘ছবিটা আমাকে ধ্বংস করে ফেলেছে।’

‘তুমি ছিলে আমার আদর্শ,’ বাসিল বললেন, বিস্ময়ে মাথা নাড়লেন। ‘এই কুৎসিত ছবিটার চোখগুলো শয়তানের! এটাই যদি সত্যি, তা হলে লোকে যা বলে তার চেয়ে তুমি অনেক বেশি জঘন্য।’ বাসিল কেঁপে উঠলেন। ‘ছবিটা ভেতর থেকে আতঙ্ক ছড়ায়। এটাই জন্ম দিয়েছে যত নোংরামির।’

----------------------------------
কুটুমবাড়ি

******
ছবিসূত্র : ১. petshopboxstudio.com

২. soundtrackcollector.com


মন্তব্য

রোমেল চৌধুরী [অতিথি] এর ছবি

আগের পর্বগুলির চাইতে বর্ণনা আরো সাবলীল হয়েছে। খুব ভালো লাগলো। চলুক।

অতিথি লেখক এর ছবি

এ রকম মন্তব্য আরও ভালো লেখার অনুপ্রেরণা দেয় বৈকি। ভালো থাকবেন সব সময় হাসি

কুটুমবাড়ি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।