একটি সূর্যাস্তের গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৩/০৯/২০১০ - ৭:২৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

---নিশা---

১.

"বুঝলি টুকটুক, মাথায় দারুণ একটা তত্ত্ব এসেছে। একেবারে নতুন।" চেয়ারে বসে টেবিলের উপর পা তুলে দিয়ে বিজ্ঞের ভঙ্গিতে ভাইয়া বললো।

"তোমার মাথায় তো সবসময় নতুন নতুন সব 'তত্ত্ব' গিজগিজ করে। তা কী সেই তত্ত্ব, শুনি।" মুখ বাঁকিয়ে আমি বললাম।

"তোর মতন এমন বাচাল, ঝগড়াটে আর গুণ্ডি মেয়ের নাম 'ঝাণ্ডু' কিংবা 'বকবকানি বেগম' না হয়ে কী করে 'নীরব' হলো, তা-ই আমার তত্ত্বের বিষয়।" মুখে দার্শনিক ভাব ফুটিয়ে ভাইয়া ওর "নব্য আবিষ্কৃত তত্ত্ব" জাহির করলো।

আহারে, কী আমার তাত্ত্বিক এসেছেন! ফাজিল কোথাকার!

রেগেমেগে আগুন হয়ে বললাম, "আর তোমার নামটা 'অপরাজিত' না হয়ে হওয়া উচিত ছিলো 'অশ্বডিম্ব' অথবা 'অকালকুষ্মাণ্ড'। এমন কাব্যিক নাম তোমার মতন অপদার্থকে মানায় না..." কথা শেষ করতে না করতেই "তবে রে..." বলে হুংকার দিয়ে আমার বেণি ধরে ভাইয়ার হেঁচকা টান। আমিও কম যাই না! ওর চুল ধরে সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বেণি ছাড়িয়ে দৌঁড় দিয়ে বারান্দায় গিয়ে রাগে এটম বোম হয়ে বসে রইলাম। ফাজিলের ফাজিল কোথাকার!

কিছুক্ষণ পর ভাইয়ার কণ্ঠ শোনা গেলো, "টুকটুক সোনা, লক্ষ বোন আমার, এক কাপ চা দিয়ে যা না! তোর হাতের চা না খেলে সারাদিন ভালো লাগে না রে।"
ইশ, কত দরদ! তখন তো খুব চুল টানা হলো, এখন আবার ফোলানো হচ্ছে!
"পারবো না, নিজে বানিয়ে নাও গে।" চিত্‍কার করে বললাম।

কিন্তু কীসের কী! ঠিকই একটু পর চা বানিয়ে নিয়ে গেলাম। বান্দরটার সাথে রাগ করা যায়!

"এই তো আমার সোনা বোন। শোন তো, এই মিউজিকটা কেমন হয়েছে।" মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে কাপটা পাশে রেখে গিটারটা হাতে নিতে নিতে ভাইয়া বললো।

মিষ্টি একটা সুর বাজলো গিটারে। অন্যরকম সুন্দর। মন দিয়ে শুনলাম।

শেষ হলে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, "দারুণ হয়েছে ভাইয়া! গানটা লিখেছ?"

"না রে। এখন লিখবো। তুই যা।" ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাগজ কলম হাতে নিতে নিয়ে ভাইয়া বললো।

ভাইয়াকে লিখতে দিয়ে বাইরে আসলাম। এখন ও একমনে গান লিখে যাবে।
গানের প্রতি ওর নেশাটা অদম্য। আরেক নেশা বই পড়ার দিকে। লেখাপড়াতে তো তুলনাহীন মেধাবী আমার ভাইয়াটা, বুয়েটের অসাধারণ ছাত্র। ভাইয়ার সবই ভালো, কিন্তু আমার সাথে ঝগড়াটাই একটু বেশি করে আর কি!

কিন্তু আমি জানি, ভাইয়া আমাকে ভালোবাসেও সবচাইতে বেশি।

২.

বসার ঘরে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা নিয়ে আমি আর বাবা মা বসে আছি। রাত একটা বাজতে চললো, কিন্তু ভাইয়া এখনও বাসায় ফিরে নি। ও তো কখনও এতো রাত করে না। মোবাইলটাও বন্ধ। ভাইয়ার বন্ধুদের কেউই খবর জানে না। খুব ভয় লাগছে। আল্লাহ, তুমিই জানো!

হঠাত্‍ কলিং বেল বেজে উঠলো। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। ভাইয়া দাঁড়ানো। কিন্তু এমন দেখাচ্ছে কেন ওকে? লাল চোখ, উদ্ভ্রান্তের মতো ভাব।
চিত্‍কার করে উঠলাম, "ভাইয়া এসেছে!"

"কী হয়েছে অপু? কোথায় ছিলি এতোক্ষণ?" মায়ের উদ্বেগভরা প্রশ্ন।

অস্থির কণ্ঠ বাবার, "এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে অপু?"

"সরো তো এখান থেকে। কিছুই হয় নি আমার। অযথা বকবক করো না।" কর্কশ কণ্ঠে কথাগুলো বলে ভাইয়া সশব্দে দরজা লাগিয়ে দিলো।

আমরা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

কী হয়েছে আমার ভাইয়াটার?

৩.

সেই রাত থেকে আমার ভাইয়াটা আর আগের মতো নেই। প্রাণচঞ্চল হাসিখুশি ভাইয়া এখন রুক্ষ মেজাজের হয়ে গেছে। খুব বেলা পর্যন্ত ঘুমায়, খেয়ে না খেয়েই চলে যায়। ফেরে গভীর রাতে। কেউ কিছু বললে রেগে উঠে। কাউকে সহ্য করতে পারে না, এমনকি...এমনকি... আমাকেও না। ভাইয়ার বন্ধুরা বললো, ও এখন ভার্সিটিও নাকি যায় না। কিছু বাজে ছেলের সাথে ঘুরে বেড়ায়। বন্ধুরা ভাইয়াকে বুঝাতে গেলে খুব খারাপ ব্যবহার করে সে।

মা সারাদিন বাসায় বসে কাঁদেন। বাবা নিস্তব্ধ হয়ে থাকেন, কলেজে যান না। আর আমি নীরবে চোখের জল ফেলি আর দোয়া করি, আল্লাহ, আমার ভাইয়াটাকে তুমি ভালো করে দাও।

৪.

এভাবে প্রায় দুই মাস দুঃস্বপ্নের মতো কেটে গেলো। হঠাত্‍ একদিন রাত এগারোটার দিকে ভাইয়ার বন্ধু শ্রাবণদার ফোন, "এই নীরব, তাড়াতাড়ি আঙ্কেল আন্টিকে নিয়ে মেডিকেলে চলে আয়। অপু হাসপাতালে।"

পৃথিবীটা দুলে উঠলো আমার।

চিত্‍কার করে উঠলাম, "কী হয়েছে ভাইয়ার?"

"আয় না তাড়াতাড়ি।" অস্থির কণ্ঠে বলে ফোনটা রেখে দিলো শ্রাবণদা। এক ভয়াবহ ঘোরের মধ্য দিয়ে আমরা হাসপাতালে পৌঁছলাম।

পৌঁছে দেখি, সব শেষ।

হাসপাতালের সাদা বিছানায় আমার ভাইয়াটা শোয়া। চোখ দুটো বোজা। নিষ্পাপ মুখটা হাসিমাখা। মনে হচ্ছে, এই এখনই বলে উঠবে, "টুকটুক মণি, চুলটা একটু টেনে দে না রে। মাথাটা খুব ব্যথা করছে।"

কিন্তু কোথায়, ভাইয়া তো আমাকে ডাকছে না!

ভাইয়ার পাশে দাঁড়িয়ে ওর হাতটা ধরে চারপাশে তাকালাম। আকুল হয়ে ভাইয়ার বন্ধুরা কাঁদছে।

তারপর আর কিছুই মনে নেই আমার। সব অন্ধকার হয়ে আসার আগে মায়ের তীব্র বুকফাটা আর্তনাদ আবছাভাবে কানে এলো।

এরপর সব আঁধার।

সব নীরব।

৫.

আমার ভাইয়ার নাম ছিলো অপরাজিত। কিন্তু তাকে পরাজিত হতে হলো মাদকের কাছে। মৃত্যুর কাছে। আর সেই সাথে মৃত্যু হয়েছে আমাদের স্বপ্নের।

আমার পৃথিবীতে এখন কোন রং নেই, কালো ছাড়া ।

আমাকে এখন কেউ গিটার বাজিয়ে গান শোনায় না। কথায় কথায় ঝগড়া করে না। মারে না। কাছে টেনে চুমু দেয় না।

কেউ আমাকে আর বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলে না, "কীরে সোনা, এই বুকটার মাঝ থেকে ছুটে যেতে পারবি কখনো?"


মন্তব্য

জাহামজেদ এর ছবি

একটানে পড়ে গেলাম, পড়তে পড়তে মনে হলো স্মৃতিচারণ করছে যেন কেউ।

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ । অনেকদিন নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলাম বলে উত্তর দিতে দেরী হলো ।

। নিশা ।

তিথীডোর এর ছবি

চলুক
আরো লেখা পড়তে চাই...

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ দিদি । হাসি

আমার (কু)লেখা পড়বেন ক্যামনে, আমিই তো পড়তে পড়তে শ্যাষ ! সামনে পরীক্ষা কি না !

শিশিরকণা এর ছবি

আমি তো ভাবছিলাম ব্লগর ব্লগর পড়ছি। দমকা হাওয়ার মত বৃষ্টির ঝাপটা দিয়ে ভিজিয়ে গেল। কিছু বুঝে উঠার আগেই দ্রবীভূত হয়ে গেলাম।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

অতিথি লেখক এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ । এবং শুভকামনা রইলো ।

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পের নামটা দেখে মনে হচ্ছিল শেষটা পড়ে মন খারাপ হবে...তবু একটানে পড়ে গেলাম...লেখা ভাল লাগল...হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

আমারও ভালো লাগলো । হাসি ধন্যবাদ এবং শুভকামনা ।

কৌস্তুভ এর ছবি

আপনার লেখার হাত ভাল। তবে প্লটটা বহুল ব্যবহৃত। পরবর্তীকালে প্লটেও নতুনত্ব দেখতে চাই। সচল থাকুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ ।
ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষার সময় ধর্ম পরীক্ষার আগের রাতে এই গল্পটা লেখা । ছোট বাচ্চাদের প্লট কিনা !

অতিথি লেখক এর ছবি

হুম! গল্প ভালো লেগেছে। আরও লিখুন।

কুটুমবাড়ি

অতিথি লেখক এর ছবি

পরীক্ষা শেষ হোক । ;-(

অনেক ধন্যবাদ ।

বাউলিয়ানা এর ছবি

গল্প হলেও ভাইয়ার জন্য সমবেদনা। তবে বাস্তবে ২ নং পয়েন্টের পর পরই মূলত মাদকাশক্ত ছেলে-মেয়েদের আরও বেশি পারিবারিক সহচর্য আর সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। এতে অনেক সময় বিপদ এড়ানো সম্ভব হয়।

লেখালেখি জারি থাকুক।

অতিথি লেখক এর ছবি

তা তো অবশ্যই । পারিবারিক সহমর্মিতা অতি প্রয়োজনীয় । ধন্যবাদ অনেক ।

নিজাম কুতুবী [অতিথি] এর ছবি

আসলেই পৃথিবীটা দুলে উঠার কথা। মাদকের কাছে আমরা সকলেই আজ পরাজিত। ভাইয়ার জন্য সমবেদনা জানাই

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রার্থনা করবেন আর কোন বোনের ভাইরা যেন এরকম না হয় । আমার ভাইয়াকে নিয়ে আমার অনেক ভয় থাকে সবসময় ।

অতিথি লেখক এর ছবি

বেশ ভালো লেগেছে!

রোমেল চৌধুরী

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ । হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

লগইন না ক'রেই ব্লগের লিখাগুলো পড়ে যাচ্ছিলাম। এখন তা না করে পারলাম না।
ভাল লাগল। শুভকামনা।

সুবীর কর

অতিথি লেখক এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ । হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।