সংস্কৃতি একটি জাতির সতন্ত্রতার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত । একটি জাতিগোষ্ঠি থেকে অন্য জাতিগোষ্ঠি পৃথক করার মূল হাতিয়ার সংস্কৃতি । সম্মৃদ্ধ সংস্কৃতি জাতির সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সম্পদ । বিশ্বের বুকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের দ্বীপশিখা প্রজ্জ্বলিত হয় সংস্কৃতির মাধ্যমে । আমরা বাঙালি জাতি সম্মৃদ্ধ সতন্ত্র সংস্কৃতিতে । আমাদের জনসাধারণের ধমণীর প্রতিটি লোহিত কণিকায় ছড়ানো আমাদের সংস্কৃতি। কিন্তু তারপরও প্রতিনিয়তই চলছে এ কণিকা ভাঙ্গার অপচেষ্টা । জাতিগতভাবে আমরা যেমন কর্মঠ তেমনি আবার তদাপেক্ষা অন্যের মুখাপেক্ষী । আর এ মুখাপেক্ষীতার কারণেই অন্যেরা চাচ্ছে তাদের প্রতি আমরা অনুরক্ত হয়ে পড়ি । সেই অনুরাগ তখনি সর্বোচ্চ রূপ পরিগ্রহ করবে যখন আমরা তাদের সংস্কৃতির প্রতি অতিমাত্রায় আসক্ত হয়ে পড়বো । আর এ সুযোগে তারা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিবে তাদের ভাষা , কৃষ্টি , অভিরুচি , আচার-অনুষ্ঠান । আমরাও আবার লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি কখন তারা তাদের এ উচ্ছিষ্টগুলো আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেবে । আমরা আমাদের সম্মৃদ্ধ সংস্কৃতি ভুলে ডুবে যাচ্ছি তাদের সংস্কৃতিতে যারা আমাদের ব্যাবহার করছে তাদের পণ্যেব Ÿাজার হিসেবে । তাইতো আজ সকালের সূর্যোদয় থেকে শুরু করে পরদিনের উদয়ক্ষণ পর্যন্ত সকল কর্মকাণ্ডই নিয়ন্ত্রণ করছে তারা । আমরা কী খাবো , কোন কাপড় পড়বো , কীভাবে হাটবো , কীভাবে ঘুমাবো , কীভাবে ঝিমাবো , এমন কী কীভাবে প্রেম করবো তাও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অন্যের সংস্কৃতি দ্বারা । আজ আমাদের সংস্কৃতির আচার অনুষ্ঠানগুলোও মলিন হয়ে যাচ্ছে অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে । তাইতো এখন বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান হিসেবে আয়োজন করা হয় র্যাম্প মডেল শো, ডি জে পার্টির । আর আমার একতারা, দোতারা নিভৃতে কাঁদে আজ যন্ত্রের কম্পোজিসনে । আর তাই আমরা কষ্ট করে গান শিখতে যাবো কেনো ? জন্মর পর পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয়ে কান্নার সুরে প্রথম যেভাবে ঘোষণা করেছিলাম নিজের অস্তিত্ব সেই সূরটাই নানা ভাবে ,নানা যন্ত্রের সহায়তায় গড়ে তুলছি আমরা সংগীত হিসেবে । এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর হয়তো কেউ আর সা-রে-গা-মা শিখতে যাবে না , চাইবে শুধু যন্ত্রের কম্পোজিসন শিখতে ।
বিজাতীয় ভাষার অত্যাচারে আমাদের আজ ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা । অসংখ্য টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে সারাদিনই আমাদের নতুন প্রজন্ম শিখছে ‘কিউ’ ! ‘আপ কৌন'হে ’। আমাদের দেশী চ্যানেলগুলো কেউ আর খুব বেশি বিপদে না পড়লে দেখে না । কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে কোনো কোনো দেশীয় টিভি চ্যানেল ইতোমধ্যেই প্রচার শুরু করেছে বিজাতীয় ভাষার চলচ্চিত্র ; তাও আবার আমাদের জাতীয় উৎসবের দিনে উৎসব উপলক্ষে । আমরা কি জাতিগত ভাবে এতোটাই দুর্বল হয়ে পড়েছি যে আমাদের নির্মাতারা জাতীয় উৎসবে প্রচার করার মতো কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারে না ? নাকি আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো বিজাতীয়দের সেবাদাসবৃত্তি করার জন্য মুখিয়ে আছে বলে এ অবস্থা ?
আমাদের রন্ধ্র্রে রন্ধ্র্রে প্রবেশ করছে অপসংস্কৃতির বিষবাস্প । আর তাই হয়তো আমাদের মাথায় চেপে বসে চরম কদর্যভাবে বাংলা ভাষা ব্যাবহার করার ভুত । আঞ্চলিক ও বিদেশী ভাষার সাথে মিশিয়ে এমন এক জগাখিচুড়ি উদ্ভাবন করে বাংলার সর্বনাশ ডেকে আনছি যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হুমকিস্বরুপ ।
বিদেশী চ্যানেলগুলো হাজারো অনুষ্ঠানের পসরা সাজিয়ে আমাদের সামনে উন্মুক্ত । কিন্তু দেশীয় চ্যানেলগুলো ন্যূণতম কোনো সুযোগ নিয়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশেও পৌছাতে পারছে না । আমাদের সংস্কৃতি আমরা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছি । ফলে আমরা পরিণত হচ্ছি একটি মুক-বধির জাতিতে ।
আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পের মেরুদণ্ড অত্যন্ত সুকৌশলে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে । তাই দেশের সকল অঞ্চলে সিনেমা হলের সংখ্যা কমছে বিপদজনকভাবে । হয়তো আর কিছুদিন পরে এ শিল্পটির নাম উঠবে রুগ্ন শিল্পের কোঠায় ! আর আই. এম .এফ বা বিশ্বব্যাংকের কাছে সাহায্য চাইবে কর্তাব্যক্তিরা! অন্যদিকে দোর্দণ্ড প্রতাপে চলছে বাইরের দেশ থেকে আসা চলচ্চিত্রগুলো । যার কারণে আজ গ্রাম-গঞ্জের লোকেরাও বাংলা সিনেমা বলতেও বোঝে টালিগঞ্জের সিনেমাকেই । আমাদের গুণীণ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কৌশলে আটকে দেয়া হচ্ছে নানাবিধ নিয়ম-কানুনের ধুয়া তুলে , আর বাইরের যেগুলো অকাতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে সেগুলো নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যাথা নেই । সেগুলো এতোটাই মানসম্মত যে ষোড়ষীর রগরগে নিতম্বের ওঠা-নামা আর উদ্ভট কাহিনীর সমন্বয়ে নতুন প্রজন্মকে মানসিকভাবে বিকৃত করে দিচ্ছে ।
আমাদের জাতীয় উৎসব ,পালা-পার্বণ আজ ক্রমাগত প্রভাবিত হচ্ছে অপসংস্কৃতি দ্বারা । আমাদের পোশাক, চিন্তা-চেতনা, শরীর-মন ভেসে গেছে অপসংস্কৃতির অবগাহনে । মস্তিষ্কও আক্রান্ত হয়ে পতনান্মুখ । তবুও হয়তো শেষ চেষ্টা হিসেবে সকলের জাগ্রত করা উচিত নিজের মস্তিষ্ককে, জাগ্রত করা উচিত নিজের বিবেককে । পরখ করে দেখা উচিত নিজের সংস্কৃতি ও নিজের ভাষার প্রতি কতোটা সুবিচার আমরা করতে পেরেছি । দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হাতে গড়ে উঠুক দেশের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ । রক্ষা পাক বাংলা সংস্কৃতি ।
তারেক মাহমুদ তন্ময়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২৫.১২.২০০৯ খ্রি.
মন্তব্য
প্রিয় তারেক মাহমুদ তন্ময়,
আপনার লেখাটি বিজয় থেকে ইউনিকোডে বদলে প্রকাশ করা হয়েছে। এটা কীভাবে করতে হয় সেটা জানতে পারবেন এখান থেকে: http://www.sachalayatan.com/faq/show/762#q_1453
অনুগ্রহ করে ইউনিকোডে আপনার লেখা জমা দিবেন। ভবিষ্যতে অ্যস্কিতে লেখা প্রকাশের জন্য বিবেচনা নাও করা হতে পারে। আপনার সাময়িক অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখিত।
ধন্যবাদ।
একটি চতুর্দশশব্দী
আকাশ থেইক্যা আইলো নাইমা এক আজব কিসিম পরী:
রূপের থেইক্যা পরীর দেহি ঠমকই ভারী।
রোমেল চৌধুরী
নতুন মন্তব্য করুন