অনিশ্চিত জীবন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৬/০৯/২০১০ - ৮:০৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দিদিমা এখন প্রায় সময়ই বলেন;
: সময়টা বালা নায়, কুব খারাফ সময় আইছে। দেখছ না, গাঙ্গের পানি তার দাঁতে দাঁত ছাইপ্পা কেমন হুড়মুড় কইরা পাহাড় তনি লামতাছের? গাঙ্গের ফানিত্ ক্ষুধার আগুন। এই আগুন সবার সুক জ্বালাইব, খেউরে সুকে থাকতে দিত নায়। আছকু আমি গাঙ্গের পানিত গোছল করবার সময় টের পাইছি। ইবার বুঝি এর লাইগ্গাই খেতে খেতে অত ধান অইছে?
: খেনে, কিতা অইছে দিদিমা? দিদিমা বিড়বিড় করে এই কথাগুলো বলতে নীতু জিঙ্গেস করে।
: তুই দেকিছ, আমার খথা সত্য অইবই। আমার দাত বত্রিশ। নীতুর প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়েই দিদিমা বলেন। এবং বিড়বিড় করে ক্রমাগত বলতে থাকেন,
: লক্ষনটা আমি আরো আগে টের ফাইছি। যেদিন আমারে হাসপাতাল ত্যাইক্যা ছোটু নায় খইরা বাড়িত আনচিল। হেদিন দেখছি গাঙ্গের তলায় নাওটা আটকিযায়। গাঙ্গের সব খানে চর জাগতাছের। গাঙ্গের তলায় বালুর রেনু রইদে খালি চিক চিক করের। গাঙ্গের গভীরতা এখেবারে খমিগেছে। পাহাইড়া ঢলের ফানি গাঙ্গের এই গভীরতা দিয়া সংকুলান অইতনায়। তখন ঐ রাক্ষস্যা ফানি গাঙ্গের ফার ডিঙ্গাইয়া আওর হামাইব। ফসল তলইয়া যাইব, খেউ কুছতা খরত ফারত নায়। ছাইর মনতেদি অনাহারী অখলতের হাহাকার উঠব। মানুষ না খাইয়া মরব। চোর ডাখাইতের উফদ্রব বারব। দিন দুপুরে এ অরে কুন খরব। নীতুর শুনতে আর ভাল লাগেনা। নীতু উঠে চলে যায় রান্না ঘরে, মা রান্না করছেন।
: মা বাজান কোয়াই?
: তর বাজান হই সাত সখালে বারইয়া গেছইন, দানা ফানি কুছতা মুক দিছইন্না। বেলা খম অইছেনি? এবতনি আইবার কোনু নাম নাই। তুই মাছগুলান দইয়া দেছাই নীতু। আমি ভাতটা দেখরাম।
: খেমনে দইতামতে? যেমেলাখান মেঘ পরের, ইমেঘ খলতলাত গেলে বিজি যাইমুনু।
: ই মেঘের মাঝে খলতলাত যাইবার লাগি খেটায় খর তরে? তাগারিত পানি লইয়া ধইলা। নীতু মাছ ধুতে বসে।

আজ কয়েক দিন থেকে একটানা মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে। থেকে থেকে বিজলী চমকাচ্ছে। সেই সাথে দমকা হাওয়ার বেগ এই কমছে এই বাড়ছে। বিশেষ করে রাতে খুব বৃষ্টি হয়। তাছাড়া ঝড়ের তান্ডব লীলাতো আছেই। যেন কি এক উন্মাদনায় ভেঙ্গে পড়তে চায় বিশাল আকাশখানি ধুলির ধরায়। আতঙ্কগ্রস্থ মানুষজন।

এখন চৈত্রের সতের আঠার দিন। ফসল পাকার সময় হয়ে আসছে। আট দশ দিন পরই বৈশাখী ফসল তোলার ধুম লেগে যাবে। এখন যদি এভাবে দিন রাত বৃষ্টি হয়, তাহলে ফসল পাকা পিছিয়ে যাবে।

ভাটির দেশ নামে খ্যাত সুনামগন্জের বিস্তৃত অঞ্চল বর্ষার পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যায়। ফলে বর্ষায় কোন কিছু উৎপাদন করা অসম্ভব হয়ে পরে। এক ফসলী জমি। বৈশাখী ফসলই এখানে মানুষের জীবিকা নির্বাহের বা বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্ভন। সারা বছরের আশার ধন। অনেক শ্রম সাধনার ফল, সুখের নির্যাস, আনন্দের কল্লোল, এবং সর্ব কালের সত্য ও সুন্দর স্বপ্ন। অথচ এই সত্য সুন্দর স্বপ্নটাই বার বার আঘাৎ প্রাপ্ত হয়। ভেঙ্গে যায়। কখনও অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, বেশী ঠান্ডা, খরা কিংবা বিশেষ করে পাহাড়ী অথৈ ঢল।

নীতু ভাবে এতে কারো হাত নেই। এ নাকি বিধির বিধান। নীতু বুঝে উঠতে পারেনা, এ কেমন বিধান? নাকি সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার হেয়ালীপনা? থমকে উঠে নীতুর সমস্ত অন্তরাত্মা। আপনার মন থেকে বিধাতার প্রতি এমন একটা রূঢ় বাক্য কি করে সে ভাবতে পারল, কি করে উচ্চারিত হলো তার আপন সত্বার অস্তিত্বে। নাকি বিধাতার প্রতি এ একটা প্রচন্ড ক্ষোভেরই আত্মপ্রকাশ? নীতু আর কিছুই ভাবতে পারেনা।

দিন রাত বৃষ্টি আর বৃষ্টি। কখনো অঝোর ধারায়, কখনোবা সয়ে সয়ে। সকাল হয়েছে সেই কখন। তবুও বাইরে অন্ধকারের প্রলেপ। মেঘে ঢাকা সুর্যের নিস্তেজ আলো প্রকৃতিকে পুরোপুরি জাগিয়ে তুলতে পারেনি। হারিকেনে মৃদু আলো জ্বলছিল তখনও। ঘরে গোমট আঁধারের ছড়াছড়ি।
: মা! মা! হুইনচনি? হুইনচনি মা?
: কিতাগো, কিতা অইছে? তুই ইলাখান হাফায়রে খেনে?
: সুনামগন্জের দেখার আওর পাইন্নে নিছেগি মা। এখটা দানাও কেউ তুলত পারছেনা।
: তুই ইতা কিতা খছবে নিতু? অনে তাইলে মানষে খাইব কিতা, বাছব কিলা?
: খালি দেখার আওরই নায়, শনির আওর, জয়ার আওর, জামাই কাটা, মহাই আওর, নলুয়ার আওর সব পাইন্নে নিছেগি মা।
: তুই ইতা কোয়াই থাইক্কা হুনলে?
: মনু মামায় খইয়া গেছইন। তারা অনে গাওর হখলরে লইয়া আমরার বরামের আওর পানি থাইক্কা বাছাইবার লাগি বান বানতা গেছইন। বাজান বুলে হই সখাল থাইক্কা কুড়ুঙ্গের বানদের ধার আছইন।
: গাঙ্গের পানি কিলাখান বারেরতে?
: পরতি দিনওত্ব আধ আত, তিনপোয়া আত কইরা পানি বাড়ের।
: আমরার আওর যুদি ফানি হামায়, তাইলে আমরার অবস্তা কিতা অইব? আমরা কিতা খাইয়া বাছমু? গাই দুইওটারেইবা কিতা খাওয়াইমু?
: তুমি অত্তা চিন্তা কইরনাছাই, তোমার সবসময় সবতাত খালি চিন্তা আর চিন্তা। আমি বড় অয়রাম, আমারে লইয়া চিন্তা। আমার ভবিষ্যত লইয়া চিন্তা। দিদিমার অসুক, ইটা লইয়া চিন্তা। ফাইন্নে ধান নিবগি ইটা লইয়া চিন্তা। গাই লইয়া চিন্তা।
: চিন্তা কি আর সাদে খরিরে মা?
: সাদে নানিতে? তুমি চিন্তা খইরা কুছতা খরতা পারবায়নি?
: ইতা তুই বুছতে নায়গো সোনা। বলেই নীতুর মা ঘুরে দাঁড়ান। মাথাটা ভার ভার লাগে তার কাছে।

চার জন মানুষের সংসার। দুইটা গাভী। সমান্য জমি থেকে যা ফসল পাওয়া যায়, তা দিয়ে কোন রকমে টেনেটুনে সংসার চলে। এইবার বৃদ্ধা মায়ের চিকিৎসায় অনেক টাকা ঋণ হয়েছে। মেয়েটাও ডাঙ্গর হয়েছে। এখন থেকে যদি টাকা পয়সা সঞ্চয় না করা যায়, মেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। একটা মাত্র মেয়ে, তাও যদি সমান্য টাকার অভাবে একটা ভাল পাত্রের হাতে তুলে দেওয়া না যায়, তাহলে এর মত দুঃখ আর কি হতে পারে? এখনতো আবার যৌতুকের যুগ। যৌতুকই যোগান দেয় পাত্রের। সেদিন বৃদ্ধা মা ডেকে বল্লেন;
: নীতুর বাইদি তোমরার কিয়াল আছেতো? অনে থাইক্কা মনে মনে কোজ খবর নেও, বালা ফাত্র ফাইলে আত ছারা খইর না।'
কিন্তু বৃদ্ধা মা হয়ত জানেন না। তার পুত্রের হাতে এখন কোন টাকাই নেই। সামান্য চিকিৎসার টাকা জোগাতে ধরনা দিতে হয়েছে কত জনের কাছে। কেউই বিনা সুদে টাকা ধার দিতে চায় না। এখন একমাত্র অবলম্ভন বৈশাখী ফসল। তাও পানিতে যায় যায় অবস্থা।
আচছা, যেখানে এই বৈশাখী ফসলই মানুষের একমাত্র অবলম্ভন। বৎসরে একটা মাত্র ফসলের চাষ। সেখানে নদীগুলোকে খননের মাধ্যমে পর্যাপ্ত পানি সংকোলানের ব্যবস্থা করা হয় না কেন? প্রয়োজনীয় বেড়ীবাঁধের মাধ্যমে হাওরের চারদিক আরো উঁচু করা হয়না কেন? নেতৃ স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে, নিত্য নন্দিত হবার লক্ষ্যে, চিৎকার করে, গলা ফাটিয়ে, অহেতুক মিথ্যে আশ্বাস দেওয়া ছাড়া আর কিইবা করতে পারছেন সাধারন মানুষের জন্য? অনেকেই ক্ষমতার মোহে, পক্ষে প্রতিপক্ষে, সংঘাত আর সংঘর্ষে মেতে উঠেন এবং উঠছেন। অথচ এদেরকেই আমরা নেতা মানি, সম্মান করি, অধিকার আদায়ে প্রতিনিধি করে বাইরে পাঠাই। আসলেকি এটাই নিয়ম? নাকি আমরাও নষ্ট হয়ে গেছি? তা নাহলে আমরা জানি যে এরা ক্ষমতায় গেলে সাধারন মানুষের জন্য কিছুই করবে না, বরং নিজেদের আখের ঘোচাতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে। তার পরও কেন ওদেরকে সর্মথন করি, নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধি করি? নীতুর মা বেশী কিছু ভাবতে পারেন না। বিছানায় গড়াগড়ি যান। ভাল লাগেনা। ঘুমোতে চেষ্টা করেন। ঘুম আসেনা। একটা অশুভ ছায়ার হাতছানি বার বার চোখে ভাসে। নীতু কিছুই বুঝতে পারেনা, ব্যাকুল হয়ে জিঙ্গেস করে;
: মা ইতা খররায় খেনে? তোমার কিতা অইছে?
: নারে মা, কুছতা অইছেনা। মাথাটা এখটুক ধরছে।
: আমি তাইলে দেইক্কা আই বাইরে কিতা অবস্থা। মেঘ এখটুক ছারছে লাগে।
: যারে মা দেইক্কা আয়।
নীতু চলে যায় বাইরে, হাওরের কি অবস্থা জানার জন্য। আর নীতুর মা ভাবেন, লোকটা দিনরাত এতো পরিশ্রম করে যে জমিতে ফসল বুনলো। সকাল বিকাল দেখতে দেখতে যে আশায় বুক বেঁধে রাখলো, যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে লোকটা পাগল হয়ে যাবেনাতো? আয় প্রভু ফিরে থাকাও, ফিরে থাকাও আমাদের দিকে। রহম কর, আপন শ্রমের ন্যায্য পাওনা আমাদের ভিক্ষা দাও, তবু পথের ভিখারি করোনা, ভিখারি করোনা।

সারা রাত শিলাবৃষ্টির পর ভোরের দিকে বৃষ্টিটা একটু থেমেছে। জেগে উঠতে শুরু করেছে মানুষজন পশু-পাখি। নীতু চোখ মুখ ঘষতে ঘষতে এই মাত্র উঠোনে এসে দাড়িয়েছে। উঠোনের দিকে থাকালেই বুঝা যায়, এই মাত্র বৃষ্টি থেমেছে। কারণ, এখনও জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে উঠোনের উপর দিয়ে। আকাশটা খুবই পরিষ্কার। আকাশের দিকে থাকালে কিছুটা আশ্বস্ত হওয়া যায়। মনের ভিতর একটা আনন্দ দোলা দেয়। নিজেকে অনেকখানি হালকা লাগে। এমন সময় মসজিদের মাইকে ধ্বনিত হয় 'জরুরী ঘোষণা, জরুরী ঘোষণা। সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, কুড়ুঙ্গের বাঁধ ফেটে গেছে। বাঁধ ভেঙ্গে যাবার আশঙ্কা। আপনারা ওড়া-কোদাল নিয়ে তাড়াতাড়ি কুড়ুঙ্গের বাঁধে চলে আসুন।' দুই তিন বার মাইকে এই ঘোষণাটি ঘোষিত হবার পর সবাই যেন আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠে। দিকে দিকে শুরু হয় হাকডাক ছোটাছুটি। সারা গ্রামময় একটা কোলাহল উঠে, বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ওড়া-কোদাল নিয়ে তড়াতাড়ি বাঁধে চল। অগণিত মানুষ ছুটে চলে বাঁধ বাধতে। এক সময় সকলের প্রচেষ্টায় বাঁধ বধা সফল হয়।
এদিকে আকাশে আবার মেঘ জমতে শুরু করেছে। ক্ষন পরে শুরু হয় মুষল ধারে বৃষ্টি। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষনই নেই। ইতি মধ্যে কয়েক দফা শিলাবৃষ্টিও হয়ে গেল। সেই সাথে বিদ্যুৎ চমকানি আর গুরুগুরু ডাকতো আছেই।

নদীর পানি বেড়েই চলেছে, এবং দুদিনের মধ্যেই নদীর পানি তীর ডিঙ্গিয়ে হাওরে প্রবেশের জন্য যেন উঠেপরে লেগেছে। মানুষ তবু নিরাশ হয়নি। আশায় আশায় বুক বেধে মহা উদ্যামে নদীর তীরও বাধতে শুরু করে দিয়েছে, এবং তিন মাইলের উর্ধে নদীর তীরও বাঁধা হয়ে গেছে। বাঁধ বাধতে বাধতে ক্লান্ত মানুষ, তবু পিছু হটেনা। এমন সময় কেউ একজন চিৎকার দিয়ে উঠে;
: ঐ হালা সোবান মেম্বার আয়। আরেক জন বলে উঠে;
: না ও এমদি আইতনায়। ঐ হালায় জানে, এমদি আইলে খবর আছে। হালা সোবাইন্না। বেড়ীবান্দের হখল টেখা লুইট্টাফুইট্টা খাইছে। আর অনে আমরার ই অবস্থা। এর উফরে আল্লার গজব নাজিল অইব। কেউ একজন বলে উঠে;
: আরে ভাই, বড় লোকের লাগি গজব টজব আছেনাতা? গজবত হখলতা গরীবের লাইগ্গা। সোবান মেম্বার হে অনে টাউন বাসা বানাইছে। পুরুত্তারে বাসাত রাইক্কা লেখা পড়াও করার। আরেক জন বলে;
: ইলেকশনের সময় বুঝলায়না। ইরশাদ ভাইরে যুদি মেম্বার বানাইতাম, তে আমরার আজকু ই কষ্ট করা লাগতনি? আরেকজন কেউ বলে উঠে;
: ইরশাদ ভাইরেত হখলেই চাইছি মেম্বার বানাইতাম। ইলেকশনের দিন সোবাইন্নায় ভোট কেন্দ্র দখল খইরা ভোট ফাস করল। কেউ কুছতা খরত পারলনা।
: আরে ভাই, টেখার জোর থাখলে রাইতরে দিন আর দিনরে রাইত বানানি যায়। ইতা মাত বাদ দেউ, তাড়াতাড়ি বান বান্দ। সবচেয়ে প্রবীন লোকটি বলে উঠে। তার পরও কথার রেশ টেনে কেউ আরেকজন বলে উঠে;
: বেড়ীবান্দের টেখা যেসময় মাইরা খাইল, ইরশাদ ভাই এর ফতিবাদ খরলা, ফলে কিতা অইল? ইরশাদ ভাইর পোয়ারে রাইতের আন্দাইর মাইরা, আতপাও ভাইঙ্গা আতুর বানাইয়া তরাখল। তখন আরেকজন বলে উঠে;
: আরে ভাই, তোমার টেখা আছেত সব আছে, টেখা নাইত কুছতা নাই।

এমন সময় খবর আসে, কাইতা বিলের বাঁধ ভেঙ্গে হাওরে পানি প্রবেশ করছে। ওড়া-কোদাল নিয়ে মানুষ ছুটে চলে কাইতা বিলের বাঁধ বাধতে। সকলের প্রচেষ্টায় বাঁধ বাধা সফল হয়। খবর আসে মাচ্চার খারা ভেঙ্গে গেছে। মানুষ ছুটে চলে ওখানে। একসময় খারার বাঁধ বাধা সফল হয়। এদিকে নদীর পানি ক্রমাগত বেড়েই চলে। দিন দিন মানুষের মনে একটা চাপা ভয় জমাট বাধতে থাকে। যদি কিছু হয়ে যায়? নদীর ওপর পারে থাকালে বুঝা যায়, এই রাক্ষুসে পানির করাল গ্রাসে ফসলের চিহ্ন ধোয়ে মোছে যাবে। থৈ থৈ রবে চারি দিকে জেগে থাকবে শুধু পানি আর পানি।

শুনা যায় পানিতে ফসল তলিয়ে যাবার পর কোন এক গ্রামের জনৈক ব্যক্তি, পাঁচ টাকার চিরার সাথে বিশ মিশিয়ে, স্ত্রী সহ তিনটি ছেলে মেয়ে নিয়ে একসাথে চিরা খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। বেঁচে থেকে কি খাবে এবং খাওয়াবে এই ভেবে।

ইতিমধ্যে আরো কয়েকটি হাওর পানিতে তলিয়ে গেছে। দিদিমা খবর শুনে বির বির করে বলেন;
: আমি আগে খইছিনা ? এমন একটা কুছতা অইব? আমার খথা সত্য অইলত। অনে দুব্বিক্ষ দেখা দিব। দুব্বিক্ষ দেখা দিব? আমরার ইকান মানুষ না খাইয়া মরব? না না আমি আর বাঁচতে চাইনা, আমি দুব্বিক্ষ দেখতে চাইনা। আমি মরতে চাই।
'আমি মরতে চাই।' এমনি কথা এখন তাদের সত্মায় প্রায়ই ধ্বনিত হয়। যারা মহাজনের বাড়িতে কাজ করে। পরিশ্রম করে কঠোর। অথচ পায়না তাদের ন্যায্য পাওনা। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শক্ত মাটির বুক ফুড়ে আনে ফসলের জোয়ার। অথচ বঞ্চিত হয় ফসল প্রাপ্তি থেকে। যারা যুগ যুগ ধরে নির্যাতনের নির্মমতায় নিষ্পেষিত হচ্ছে মহাজন নামের মহা দানবের হাতে।

বাঁধ আর টিকিয়ে রাখা গেল না। নদীর তীর ডিঙ্গিয়ে বেশ কয়েক দিকে হাওরে পানি প্রবেশ করতে লাগল। এখনও ধান কাটার উপযুক্ত হয় নাই। মনুষ স্তব্ধ নির্বাক। কিছুই করার নেই।

ফসল হারানোর শোকে নীতুর বাবা শয্যা নিলেন। নীতুর মা একেবারে ভরকে গেলেন। যা ভেবে ছিলেন তাই যদি হয়ে যায়? যদি কোন অঘটন ঘটে যায়? মেয়েকে নিয়ে কোথায় দড়াবেন? কি করে সামাল দেবেন গোমটা মথায় বালা হাতে দুর্যোগে টলমান সংসার নামের এই জীবন তরী? যেখানে শুধু স্বার্থের সংঘাত, ক্ষমতার লড়াই, অনিশ্চিত জীবন, অনিশ্চিত জীবনের সকল চাওয়া পাওয়া।

অহিদ


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।