এনথ্রাক্স বা তড়কা রোগ
ভূমিকাঃ
এনথ্রাক্স একটি অতি প্রাচীন রোগ। গ্রীক, রোমান এবং হিন্দু পুরাণে এর উল্লেখ আছে। এর অন্য নাম তড়কা, ব্ল্যাক ব্লাড।
এনথ্রাক্স জীবাণুঃ
যে জীবাণু দ্বারা রোগটি হয় তার নাম ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস(Bacillus anthracis)। এটি একধরণের গ্রাম পজিটিভ ব্যাক্টেরিয়া। এই জীবাণুর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি প্রতিকুল পরিবেশে স্পোর তৈরি করে অনির্দিষ্টকাল বেঁচে থাকতে পারে। অনুকুল পরিবেশে এরা স্পোর ভেঙ্গে ফেলে এবং বংশবৃদ্ধি করে। জীবাণুটি বিভিন্ন রকমের টক্সিন তৈরি করতে পারে যাদের এক্সোটক্সিন বলা হয়। এই টক্সিনগুলোই বিভিন্ন রকমের রোগ এবং রোগজনিত জটিলতার জন্য দায়ী।
এনথ্রাক্স এর প্রকোপঃ
ইউরোপ, উত্তর আমেরিকায় এনথ্রাক্স এর প্রকোপ খুবই কম। কিন্তু ভারত উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য-সহ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল,আফ্রিকা এবং ল্যাতিন আমেরিকায় এর প্রাদুর্ভাব লক্ষ্যণীয়। জীবাণুযুদ্ধে এনথ্রাক্স জীবাণু ব্যবহৃত হয়; চিঠি বা প্যাকেটের মাধ্যমে এনথ্রাক্স স্পোর ছড়িয়ে দেয়া হয় অথবা বড় পরিসরে ছড়ানোর জন্য এনথ্রাক্স জীবাণু এরোসল আকারে স্প্রে করা হয়।
কারা আক্রান্ত হয়ঃ
এনথ্রাক্স মূলতঃ গবাদি পশুর (যেমনঃ গরু, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া) রোগ। পাখিদের এ রোগ হয় না। এনথ্রাক্স স্পোর, যা মাটিতে বছরের পর বছর টিকে থাকতে পারে তা গবাদি পশু ঘাস খাওয়ার সময় খেয়ে ফেলে এবং আক্রান্ত হয়। মানুষ বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হতে পারে। মানুষের ত্বকের মাধ্যমে সাধারণতঃ এনথ্রাক্স জীবাণু প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু ত্বকে যদি অতিক্ষুদ্র ক্ষতও থাকে তবে জীবাণু ত্বকের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। যে কোন শ্রেণীর, লিঙ্গের এবং বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। এনথ্রাক্স বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই গবাদিপশুর লালন-পালন, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প এবং পশুজাত দ্রব্যাদির শিল্প সম্পর্কিত মানুষের বেশী হয়, এজন্য তরুণ এবং মধ্যবয়সী কর্মক্ষম মানুষের এ রোগ বেশী হয়। আবার এনথ্রাক্স আক্রান্ত পশুর মাংস খেলে যে কারও এ রোগ হতে পারে, কারণ স্বাভাবিক রান্নার তাপে এর স্পোর নষ্ট হয় না। এনথ্রাক্স যখন জীবাণু অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন যে কেউ এতে আক্রান্ত হতে পারে।
রোগের ধরনঃ
এনথ্রাক্স জীবাণু মানুষের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ আক্রান্ত করতে পারে এবং আক্রান্ত অঙ্গ অনুযায়ী রোগের ধরনও বিভিন্ন রকম হয়। যেমনঃ
১। ত্বকের(cuteneous)এনথ্রাক্সঃ এনথ্রাক্স আক্রান্ত পশু অথবা এনথ্রাক্স স্পোর দ্বারা দূষিত পশুর পশম, চুল বা চামড়ার সংস্পর্শে এলে এনথ্রাক্স স্পোর মানুষের ত্বকের অতিসূক্ষ্ণ ক্ষত দিয়েও প্রবেশ করতে পারে। এ অবস্থায় সাধারণতঃ ১ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ত্বকের ক্ষত তৈরি হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষত দুই হাতে মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে ঘাড় এবং মাথাও আক্রান্ত হতে পারে। ত্বকে ধীরে ধীরে ঘা তৈরি হয় যা ২-৩ সেমি আয়তনের হয়ে থাকে এবং ঘা এর চারদিকের ত্বক একটু উঁচু হয়ে থাকে। ক্ষতে চুলকানি থাকে তবে ব্যথা থাকে না।
২। শ্বসনতন্ত্রীর(inhalational) এনথ্রাক্সঃ
এনথ্রাক্স জীবাণুর স্পোর যদি শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। শুরুর দিকে হাল্কা জ্বর, খুশখুশে কাশি এবং বুকে অল্প ব্যথা হয়। পরবর্তীতে তীব্র জ্বর, শ্বাসকষ্ট, শরীর নীল হয়ে যাওয়া, শরীর বেশী ঘেমে যাওয়া, কাশির সাথে রক্ত বের হওয়া, বুকে ব্যাথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
৩। মুখবিবরীয়(oropharyngeal) এনথ্রাক্সঃ
এনথ্রাক্স স্পোর খেলে এ অবস্থা দেখা দেয়। গলাব্যথা, খাবার গিলতে অসুবিধা হওয়া এর লক্ষণ। এক্ষেত্রে মুখের তালু বা মুখবিবরে(pharynx) ক্ষত দেখা দেয়।
৪। পরিপাকতন্ত্রের(intestinal) এনথ্রাক্সঃ
এটাও এনথ্রাক্স স্পোর খেলে দেখা দেয়। বমি অথবা বমিবমি ভাব, অস্বস্তি, পেটব্যথা, রক্তবমি, বারবার রক্তযুক্ত পায়খানা হওয়ার সাথে জ্বর হয়।
৫। সেপটিসেমিক(septicaemic) এনথ্রাক্সঃ
এটি এনথ্রাক্স জীবাণুর দুর্দম ইনফেকশনের জন্য হয়। শ্বসনতন্ত্রীর(inhalational) এনথ্রাক্স এর জটিলতা থেকেও এটি হতে পারে। রক্তের মাধ্যমে জীবাণু সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে, বংশবৃদ্ধি করে এবং টক্সিন তৈরির মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গে রক্তক্ষরণ ঘটায়। এই রক্ত গাঢ় কালো রঙের। আক্রান্ত গবাদিপশুর ক্ষেত্রে পশুর মৃত্যুর ঠিক আগে অথবা মৃত্যুর পরপরই শরীরের বিভিন্ন ছিদ্র থেকে কালো রক্ত বের হয়ে আসে। এ ধরণের রোগ খুবই ভয়ংকর।
৬। এনথ্রাক্স মেনিনজাইটিস(anthrax meningitis)
উপরের যে কোন ধরণের রোগ থেকে এটা হতে পারে।এক্ষেত্রে জীবাণু প্রথমে রক্ত এবং তারপর কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে(CNS) প্রবেশ করে।
রোগের পরিণতিঃ
বেশীর ভাগ এনথ্রাক্স ত্বকের এনথ্রাক্স, যা চিকিৎসা করলে, এমনকি চিকিৎসা না করলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ভাল হয়ে যায়। অন্যান্য ধরণের এনথ্রাক্স এর পরিণতি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই খারাপ। এর মধ্যে সেপটিসেমিক এনথ্রাক্স এবং এনথ্রাক্স মেনিনজাইটিস এ মৃত্যহার খুবই বেশী। শ্বসনতন্ত্রের এনথ্রাক্স চিকিৎসা করলেও মৃত্যুহার প্রায় ৪৫%। পরিপাকতন্রের এনথ্রাক্স নির্ণয় করা খুব কঠিন এবং এতে মৃত্যহার ২০-৬০%।
রোগ নির্ণয়ঃ
ত্বকের এনথ্রাক্স রোগীর গবাদি পশুর সংস্পর্ষে আসার ইতিহাস এবং ক্ষতের ধরন দেখেই বুঝা যায়। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ক্ষত থেকে রস নিয়ে নির্দিষ্ট উপায়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করলে জীবাণু দেখা যায়। শ্বাসতন্ত্রের রোগ সন্দেহ করলে বুকের এক্সরে, সিটি স্ক্যান করা হয়। সেপটিসেমিক এনথ্রাক্স নির্ণয় করার জন্য ব্লাড কালচার করা হয়। মেইনজাইটিস সন্দেহ হলে লাম্বার পাংকচার করে সেরিব্রোস্পাইনাল রস পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া ELISA নামক পরীক্ষাও এ রগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়।
চিকিৎসাঃ
ত্বকের সংক্রমণের ক্ষেত্রে রোগীকে বহিঃবিভাগেই চিকিৎসা দেয়া যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্বাবধানে হাসপাতালে ভর্তির মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে হবে। বিভিন্ন রকমের এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে এনথ্রাক্স রোগের চিকিৎসায় পেনিসিলিন কে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এছাড়া কুইনোলন গ্রুপের এন্টিবায়োটিক (যেমনঃ সিপ্রোফ্লক্সাসিন, লেভোফ্লক্সাসিন, গ্যাটিফ্লক্সাসিন), ডক্সিসাইক্লিন, এমক্সিসিলিন, এম্পিসিলিন, ক্লোরামফেনিকল ইত্যাদি এরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
প্রতিরোধঃ
মানুষের জন্য এনথ্রাক্স এর প্রতিষেধক(vaccine) আবিষ্কৃত হলেও তা দুষ্প্রাপ্য। তাই গবাদিপশুকে টীকা দেয়ার মাধ্যমে এনথ্রাক্স প্রতিরোধ করা যেতে পারে। আক্রান্ত পশু মারা গেলে মাটিতে পুঁতে না ফেলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এনথ্রাক্স আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে এলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কুইনোলন গ্রুপের এন্টিবায়োটিক অথবা ডক্সিসাইক্লিন ৬০ দিন সেবন করতে হবে।
…………………………………………………………………………………………..
কামরুল হাসান রাঙা
মন্তব্য
ধন্যবাদ যুগোপযোগী এই পোস্টের জন্য। আজকেই টিভি তে দেখছিলাম এনথ্রাক্স এ মৃত গরু বাছুর মাটিতে পূতে ফেলা হচ্ছে, পানিতে ভেসে যাচ্ছে। এখন তো ভয় ই লাগছে। জনসচেনতা আরো বাড়াতে হবে। সরকারের উদ্যোগ যথেষ্ট মনে হচ্ছেনা।
ধন্যবাদ। সরকারের উদাসীনতা সম্পর্কে তো পত্রিকায়ই লেখা হচ্ছে। আর মিডিয়াও খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে বলে আমার মনে হয় না।
ডাক্তার সাহেব, বৈজ্ঞানিক নাম বাঁকা করে লিখতে ইংরেজী অংশটুকু সিলেক্ট করে i বাটনে ক্লিক করে দিলেই হবে।
ধন্যবাদ সৎ পরামর্শের জন্য।
ডাক্তার সাহেব-
আমার একটাই প্রশ্ন, গবাদিপশুর ব্যথানাশক ওষুধ ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না কেন? শুনতে পাই, ডাইক্লোফেনাক ওষুধ খাওয়া কোনো মৃত গরুর মাংস খেলে শকুন কিডনি বিকল হয়ে ভুগে অল্প সময়ের মধ্যে মারা যায়। কথাটি কি সত্যি?
কুটুমবাড়ি
ডাইক্লোফেনাক শকুনের কিডনীকে ধীরে ধীরে অকার্যকর করে দেয়। আসলে সব ধরণের ব্যাথার ওষুধই মানুষের কিডনীতেও অল্পবিস্তর ক্ষতি করে। অনেক দেশই ডাইক্লোফেনাক উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।
যুগোপযোগী এই পোস্টের জন্য ধন্যবাদ অতিথি লেখক ভাইকে। গ্রামে আমাদের বেশ কিছু গরু ও ছাগল আছে। মাকে ফোনে বলেছি,ওগুলোকে এনথ্রাক্স-এর টীকা দিয়ে দিতে।৩০০ টাকায় ৬টি পশুকে টীকা দেয়া হয়। এখন পর্যন্ত সবগুলো ভালোই আছে। আজকেই টিভি তে দেখছিলাম এনথ্রাক্স এ মৃত গরু বাছুর মাটিতে পূতে ফেলা হচ্ছে, পানিতে ভেসে যাচ্ছে। এখন তো ভয় ই লাগছে। জনসচেনতা আরো বাড়াতে হবে।
লেখা চালিয়ে যান।
আপনি উপযুক্ত তথ্যসূত্র সহ এই লেখাগুলো বাংলা উইকিতে যোগ করে দিতে পারেন। আর যদি ইংরাজি উইকির সাহায্য নিয়ে থাকেন, তাহলে তো আরো সুবিধা, সরাসরি ওই রেফারেন্সগুলোই যুক্ত করে দিতে পারবেন।
ধন্যবাদ। পরের লেখাগুলোতে চেষ্টা করব।
ফেসবুক এ শেয়ার করা যাবে কি ? ... ধন্যবাদ ।
ফেসবুক-এ শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
কৌস্তুভ-এর মতোই আমিও অনুরোধ করবো, লেখাগুলো বাংলা উইকিপিডিয়ায় যোগ করার জন্য। ইতোমধ্যে সেখানে "অ্যানথ্রাক্স" নামে নিবন্ধ আছে। আপনাকে বাংলা উইকিপিডিয়ায় স্বাগতম।
বাংলা উইকিপিডিয়ার ঠিকানা:
http://bn.wikipedia.org/
অ্যানথ্রাক্স সম্পর্কিত পাতা:
http://bn.wikipedia.org/wiki/অ্যানথ্রাক্স
উপজেলা হাস্পাতালগুলোতে মানুষ এখন হঠাত সোয়াইন ফ্লু'র টিকা নিচ্ছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে যা জানা গেল তারা আন্থ্রাক্স এর ভয়ে এই টিকা নিচ্ছে। আমরা বোঝানর চেষ্টা করছি। কিন্তু প্যানিক কাটছেনা।
এই ইনফরমেশন গ্যাপ দূর করতে সরকার এবং মিডিয়া'র সহায়তা প্রয়োজন।
এর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
যারা কুরবানীর মাংস খবার জন্য অস্থির হয়ে আছে তাদের কী হবে!
শেখ নজরুল
শেখ নজরুল
গরুর মাংস খেলেই যে এনথ্রাক্স হবে তা নয়, কেবল রোগাক্রান্ত গরুর মাংস খেলেই এ রোগ হয়। তাই অহেতুক ভয়ের কোণ কারণ নেই।
তথ্যবহুল কার্যকরী পোস্ট। অনেক ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন