এমন একজন মানুষকে নিয়ে আমি লিখছি যাকে আমি দেখিনি কোনোদিন। আমার জন্মের আগেই তিনি চলে গেছেন এই পৃথিবী ছেড়ে। তারপরও তাকে নিয়ে লিখতে বসেছি, কারণ তিনি আমার অদেখা একজন হলেও তিনি বেঁচে আছেন আমার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে। দাদু আমার মা'র মুখে আমি শৈশব থেকে শুনছি তার গল্প, যে গল্পগুলো আমাকে নাড়া দিয়েছে বারবার। আমাদের পরিবারে তাকে নিয়ে এত গল্প এত কথা এত দুঃখগাঁথা, তাই ইচ্ছে করলেই কি আর ভুলা যায়, ভুলা যায় না, ইচ্ছে করলেই ভুলা যায় শহীদ মুনির ই কিবরিয়া চৌধুরীকে, মৌলবাদ বিরোধী যুদ্ধের এই অগ্রপথিককে।
মুনির ই কিবরিয়া চৌধুরী আমার ছোট চাচা। একান্নবর্তী পরিবারের ছোট ছেলে। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে নুর ই কিবরিয়া চৌধুরী, মা আফসিয়া খাতুন চৌধুরী গৃহিনী। পরিবারের সবার ছোট হওয়ার কারণে তিনি সবার আদরের ছিলেন, মা'র কাছে শুনেছি, ছোট চাচা মাঠকাঁপানো ক্রিকেটার ও অ্যাথলেট ছিলেন। ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন, তার কক্সবাজার ভ্রমণের কিছু ছবি এখন আমার কাছে শুধুই স্মৃতি। ছোট চাচার জমানো ডাক টিকেট ও বিভিন্ন খেলায় পুরস্কার হিসেবে পাওয়া ঘর ভরতি মেডেলগুলো আমাদের খুব নাড়া দিয়ে যায়। ডাক টিকেট জমানো তার শখ ছিলো, এখনো আমাদের বাসার পুরনো একটা আলমারি খুললে দেখা যায় তার শখের বাহার। গল্প শুনে যতটুকু জেনেছি, তিনিই ছিলেন আমাদের পরিবারের সবচেয়ে হাসিখুশি মানুষ।
অনেকেই তাকে বলেন বিপ্লবের অগ্নিপুরুষ, অনেকেই বলেন মিছিলের স্পন্দন। এই মানুষটিই আমাদের পরিবারের সবচেয়ে ফূর্তিবাজ মানুষ ছিলেন। ছোট চাচার কথা উঠলেই আম্মু বলেন, মুনীর কত কি যে করতো তার হিসেব সে নিজেও হয়তো জানতো না ! এই কথা বলার পেছনে কারণ ছিলো, ছোট চাচা একদিকে ভালো ক্রিকেটার ছিলেন, ভালো অ্যাথলেট ছিলেন, নাটক করতেন, সমাজ সেবার ব্রত নিয়ে লিও ক্লাবও করতেন, আবার বিপ্লবের স্বপ্ন বুকে নিয়ে ছাত্র রাজনীতির মাঠে ছিলেন অগ্রপথিক। শুনেছি ছোট চাচা জামাত শিবিরকে দুই চোখে দেখতে পরতেন না। প্রায়ই নাকি বলতেন, একাত্তরের বেজন্মারা আবার নিজেদের ছড়িয়ে দিচ্ছে, শকুনের থাবা মেলছে আমাদের সমাজে, এদেরকে রুখতে হবে। মৃত্যু নিয়ে তার কোনো ভয় ছিল না বলেই হয়তো তিনি মিছিলে সবার সামনে থাকতেন, মৃত্যু নিয়ে ভয় ছিলো না বলেই হয়তো দেশকে জামাত শিবিরের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, শোষিত আর সমাজের পাশে দাঁড়াতে, যুদ্ধ করতে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আর এই কারণেই বিপ্লবের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন জাসদের রাজনীতিতে।
১৯৮৮ সালের জুন মাসে জন্ম নেওয়া আমার বড় ভাইকে নিয়ে মেতে থাকতেন সবসময়। এত আনন্দের মাঝেও হায়েনার দল তাদের নখরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করবে আমাদের পরিবার, এটা কোনোদিন ভাবতেও পারেনি কেউ। কারণ, ছোট চাচা এমন একজন মানুষ ছিলেন, তার কোনো শত্রুই ছিলেঅ না। সদা হাসিখুশি মানুষ তিনি, অথচ তার রক্তেই ভেসে গেল রাজপথ !
প্রতিদিনের মতো সেদিনও ছোট চাচা বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, মা পেছনে পেছনে গিয়ে বললেন, নাস্তা করে যাও। তার খুব তাড়া, মাকে বললেন, সময় নেই, বাসায় ফিরে নাস্তা করবো। শেষবারের মতো তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন, আমাদের বাসায় তার আর জীবিত ফিরে আসা হলো না ! ছোট চাচাকে ফিরে আসতে দেয়নি মানুষরূপী কিছু হায়েনা, একাত্তরের পরাজিত শকুনের দল। নিজেদের লালসা পূরণ করতে সিলেটে শহর তারা রক্তের নদীতে ভাসিয়ে দেয়, আর তাদের হামলার প্রথম শিকার আমার ছোট চাচা মুনির ই কিবরিয়া চৌধুরী।
সেদিন দুপুরে বাসায় খবর আসে চাচা হাসপাতালে। ছোট চাচাকে নাকি জামাত শিবিরের দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে আহত করেছে। বাসা থেকে সবাই ছুটে গেলেন হাসপাতালে, ততক্ষণে চাচার শরীর থেকে বের হচ্ছে রক্তের স্রোতধারা। প্রচুর রক্তক্ষরণে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিলো, রক্তের জন্য তখন আমাদের পরিবারকে হিমশিম খেতে হয়। চাচার সাথে সেদিন তপন ও জুয়েল নামের দুইজনের উপরেও হামলা চালায় হায়েনারা। তারাও চাচার পাশাপাশি হাসপাতালে ছিলেন। জুয়েল মারা গেছেন, চাচা তখন অপারেশন থিয়েটারে, তপন হাসপাতালের বেডে। এই গল্পগুলো আমার দাদার মুখে শোনা।
পরবর্তীতে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে করতে ছোট চাচা মারা যান। দাদা প্রায়ই বলেন, ছোট চাচা মারা যাবেন, এটা তিনি ভাবতেই পারেননি কোনোদিন। চাচার মৃত্যুর পর আমাদের বাসায় মানুষের ঢল নামে, হাজার হাজার মানুষ, পুরো সিলেট শহর যেন সেদিন জড়ো হয়েছিল আমাদের বাসায়। এরপর কত মিছিল মিটিং। একদিন থেমে গেল সব। চাচার বিচারও হলো না আর ! ছোট চাচার জন্য নীরবে কাঁদেন দাদা, চোখের জল ফেলেন দাদু, আর হৃতয়ের গভীরে আমি একটা ব্যাথা পুষি, ছোট চাচাকে দেখতে না পাওয়ার জন্য!
ছোট চাচাকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার হবে কিনা জানি না, তবে তাকে যারা হত্যা, তবে জামাত শিবিরের ঘাতকের দল দেশজুড়ে যে তান্ডব চালাচ্ছে তার বিচার হওয়া প্রয়োজন। এদেরকে রুখে দাঁড়ানো প্রয়োজন। যদি এটা করা না যায় তাহলে মুনির তপন ও জুয়েলের মতো আরো অনেককে এদের হাতে প্রাণ দিতে হবে, অনেক মায়ের বুক খালি হবে এদের হিংস্র ছোবলে !
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দিবসে শহীদ মুনির তপন জুয়েলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
( আব্বু আম্মুর বিয়ের ছবিতে ছোট চাচা। বায়ে চতুর্থ। )
- রুহামা চৌধুরী
মন্তব্য
এই হত্যার প্রতিশেধ চাই।
হত্যার বিচার চাই। ধন্যবাদ।
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
শহীদ মুনিরের প্রতি শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা শহীদ তপন ও শহীদ জুয়েলের প্রতিও। যাঁরা হিংস্র হায়েনা রাজাকার আলবদর আল-শামস সর্বোপরি জামাতিদের রুখতে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন, শ্রদ্ধা তাঁদের প্রতি।
অনেক হয়েছে, আর না। জামাতি, রাজাকার এই শুয়োরের বাচ্চারা আমাদের বাংলাদেশে থাকতে পারবে না। এটাই আমাদের দৃপ্ত শপথ।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
শহীদরা অমর হউক।তাদের শুরু করে যাওয়া আন্দোলন যেনো সফল ভাবে শেষ করতে পারি।ধন্যবাদ।
রুহামা,
যে নিজস্ব ক্ষতি হয়ে গেছে আপনাদের পরিবারের, কিংবা শহীদ জুয়েল ও তপনের পরিবারের কিংবা বলা যায় ঘাতকদের নৃশংসতায় আরো কয়েক হাজার পরিবারের তার কোন পুরন সম্ভব নয়।
গত বাইশটা বছর চরম প্রতিকুল একটা সময়েও এই শহর, শহরের মানুষ তবু ভুলেনি-গোপনে, গভীরে এই তিনশহীদের স্মৃতি পোষে রেখেছে। ঘাতকেরা নির্বোধ আস্ফালনে মেতেছে- বোধ করি শারীরিক হত্যার সাথে সাথে এঁদের মুছে ফেলা গেছে।
নাহ যায়নি। চেতনার আগুন পাখী বারবার ফিরে আসে।
আজকের আলোর মিছিল, আজকের সচলায়তন, আজকের ফেসবুক তার স্বাক্ষ্য।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
ধন্যবাদ।বাইশ বছর যে আবার তাদের স্বরণ করা হয়েছে এটা অনেক বড় ব্যাপার।
আলোর মিছিল থেকে শহীদ মুনির তপন জুয়েলের পুনর্বিচারের দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচারের দাবিও জানানো হয়েছে। দীর্ঘ ২২ বছর পর যদি মুনির তপন জুয়েল হত্যার পুনর্বিচারের দাবি জানানো যায়, তাহলে বাংলাদেশের মাটিতে একদিন ঠিকই হায়েনাদের বিচার হবে।
তারা বেঁচে থাকবেন, শহর সিলেটে তারা তিনজন কিংবদন্তি হয়ে বেঁচে থাকবেন।
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দিবসে শহীদ মুনির তপন জুয়েলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
শহীদ মুনির, শহীদ তপন ও শহীদ জুয়েলের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা।
শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না
মৌলবাদী অপশক্তি এই দেশে থাকবে না
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
শহীদ মুনির, শহীদ তপন ও শহীদ জুয়েলের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা। বাংলার মাটিতে একদিন না একদিন সব হায়েনার বিচার হবেই।।
এই হত্যার বিচার হতেই হবে।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
আজ মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দিবসে শহীদ মুনির তপন জুয়েলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আয়োজিত আলোর মিছিলে শত শত মানুষের ঢল প্রমাণ করেছে বাংলার মানুষ আজো তাঁদের ভুলে নি ভুলবে না কোনদিন ।
তিন বীর সেনানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং তাঁদের খুনিদের পুনঃবিচার দাবি করি ।
রুহামা
আপনার লেখাটা সচলে এক অমূল্য সংকলন।
মুনির তপন জুয়েল হত্যার বিচার আমরা করতে পারিনি।
ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কিছু বলার নেই।
তবু হয়তো কোন একদিন....
ততদিনের জন্য আপনার দাদা দাদুর কাছে আমাদের ক্ষমা প্রার্থনা পৌঁছে দেবেন।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
অনেক ধন্যবাদ।
এই লেখাটা নিজের কিছু স্মৃতি নাড়িয়ে দিল। একেকটা মৃত্যুতে সারা দেশ কাঁদে, মানুষের ঢল নামে বাসায়। তারপর একসময় সব কমে যায়। আপনজনেরাও ব্যস্ত হয়ে যায় নিজেদের জীবন নিয়ে। শুধু থামে না মা-বাবার কান্না। সকাল, দুপূর , রাত্র তাঁরা চোখের পানি ফেলেন নিয়মিত, যতদিন বেঁচে থাকেন।
শহীদের রক্ত কখনই বৃথা যায় না। এক দিন না এক দিন পৃথিবী এর ফল ভোগ করে, করবে।
সব শহীদের আত্মা শান্তিতে থাকুক, কা্রো মৃত্যুই যেন বৃথা না যায়।
-লাবণ্য-
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দিবসে শহীদ মুনির তপন জুয়েলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
মৌলবাদ নিপাত যাক
অনন্ত
শ্রদ্ধা
ধন্যবাদ।
শহীদ মুনির-তপন-জুয়ল হত্যার সঠিক বিচার হবে যদি এই দেশ থেকে জামাত-শিবির-মৌলবাদী ও বিষ্টা মানসিকতার সাম্প্রদায়িক ইতরদের নির্মূল করা যায় ।
কঠিন হলেও সেই কাজ সম্ভব । অবশ্যই সম্ভব । যার যার অবস্থান থেকে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন ।
এ বছর ও ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আলোর মিছিলে মিলিত হবো আমরা সিলেটবাসীরা। একই সময়ে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জে ও এই কর্মসূচী পালিত হবে। দেশের আর সব অঞ্চলে কি ২৪ সেপ্টেম্বর 'মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দিবস' পালন সম্ভব নয়? আমরা সবাই দায়িত্ব নিয়ে অন্ততঃ চেষ্টাটুকু কি করতে পারিনা?...
আমাদের কর্মসূচী:
বিকাল ৫টাঃ শহীদ মিনারে প্রতিবাদী গণসংগীত
সন্ধ্যা ৬টাঃ শহীদ মিনার থেকে আলোর মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ
তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১১ , সিলেট
শুভবোধ সম্পন্ন সকলের অংশগ্রহন একান্ত কাম্য।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
শহীদ মুনির, তপন, জুয়েল এর আত্মার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা...
প্রতিটি মৃত্যুই এক একটি ইতিহাসের মৃত্যু' বলা হয়
তবুও, কিছু মৃত্যু নূতন ইতিহাসের আরম্ভ বলেও বিবেচিত হয়।
শহীদ মুনির, তপন, জুয়েলের হত্যাকারিদের বিচারের মাধ্যমেও একটা ইতিহাস রচনা হবে নিশ্চয়...
নতুন মন্তব্য করুন