শুধুই একটা অ্যালগরিদম

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২৬/০৯/২০১০ - ৬:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ব্যাপারটা ভুলে গুলে খেয়েছিলাম বহুবছর আগেই। স্মৃতির পাতায় বাহুল্য জিনিষ জমা থাকলেও তার পাতা উল্টায় অনেক দ্রুত। পড়াশোনা আর তারপর জীবিকার তাড়নায় এসব ছোটখাট জিনিষ মনে রাখার সময় কই। নতুন নতুন ব্যাপার স্যাপারের বিচিত্রকথন মনের খাতায় লিখতে লিখতেই তখন সময় চলে যাচ্ছিল। আর সাধারণত যা হয়, যার সাথে যোগাযোগ থাকে না তার কথা মনে পড়েও কম। তারপরও মনে ছিল, হালকা অস্পষ্ট কিছু কথা, এক পলকের একটু চাহনি। হয়ত তাতে ছিলনা কোন মানে। আমার অবাধ্য মনই বানিয়ে নিয়েছিল অনেক অর্থহীন অর্থ।

ভাল ছাত্র আমি কোনকালেই ছিলাম না। বন্ধুদের কল্যানে গ্রুপে পড়তে যাওয়া আর সেই সাজেশনে এইচএসসি পাশ। পদার্থবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান আমাকে অপদার্থ ঠাউরে বলেছিলেন, তোকে দিয়ে পাশ হলেও ‌‌‍‌‌‌'পালি' ছাড়া আর কিছু হবে না। গোঁয়ার অবশ্য ছোটবেলা থেকেই, আর তাতে কি করেই জানি কি হয়ে গেল। সেইসব ডাঁহা ছাত্রদের মাঝখান থেকে টিকে গেলাম এক জটিল পরীক্ষায়। বন্ধুরা তো পারলে গোপন প্রস্তুতির অভিযোগে ফাঁসীতে ঝোলায় আরকি। যাই হোক, যথারীতি ক্লাস শুরু হল আর আমিও ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে (ঊনিশ বছরে যতটুকু হয় আরকি) দেখা দিতে শুরু করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আঁকাবাঁকা করিডোরে।

গোঁয়ার্তুমি ফল পাকার আগেই পড়ল চাঁদি বরাবর। চারিদিকে ইংরেজীর জয়জয়কার। "হাই", "হাউ আর ইউ?" -এর চতুর্বিধ আক্রমণে আমার কান লাল, চিত্ত বেহাল। ট্রানসলেসন পারা বাংলা মিডিয়ামের পাতিকাক, ইংরেজি মিডিয়ামের স্পোকেন পারঙ্গম ময়ুরাক্ষীদের মাঝে বড়ই বেমানান। মনের মধ্যে অনেক রং-এর মেঘ আনাগোনা করলেও, গলা দিয়ে চুপসান কাকের মত বারদুয়েক "ইয়েস" ছাড়া আর কিছু বার হয় না। জীবনে প্রথম উপলব্ধি হল, বোবার কত কষ্ট। সব বুঝি, কিন্তু কিছু আর বলা হয় না। ক্লাসের মোটামুটি সবাই নতুন নতুন গ্রুপ বানায়ে ঘুরতে-টুরতে যায়। আর আমি, কলেজ জমানার প্রথম এবং একমাত্র প্রতিদ্বন্দীর কৃপায় তার গ্রুপে অতিরিক্ত সদস্য থেকে সাধারণ সদস্যে উত্তরণের গ্লানিকর চেষ্টা চালাই। যাক সে গল্প।

এই দূর্বিষহ ঘটনাক্রমের মাঝে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল অংক ক্লাস। কোন এক বিচিত্র কারনে, আমাদের প্রফেসর ভূলে গেলেন যে তার অংক পড়ানর কথা। তার বদলে তিনি শুরু করলেন, অ্যালগরিদম পড়ানো। ছেলেপেলে তো কাবিল কম না। দিন দুয়েক চুপচাপ, এর মাঝে কে জানি খবর আনল, স্যারের পরীক্ষায় কেউ ফেল করেনা। একই প্রশ্ন ঘুরায়ে ফিরায়ে আসে, খালি উত্তর লিখে আসলে পাশ, আর অংক করার চেষ্টা করলেই ৮০% মার্ক। ব্যাস আর কি। ক্লাসে নরক গুলজার। কে আর ক্লাসে মনযোগ দেয়? স্যার বোর্ডে ডিসিশন ট্রি আঁকেন আর মাঝে মাঝে গোলমাল চরমে উঠলে "হুমম" করে একটা শব্দ করেন। তাতে গোলমালে একটু ছেদ পড়ে, মিনিট খানিকের মধ্যে যেই কে সেই।

আর দুই ব্যতিক্রম হলাম আমি আর ও। আমি কম্পিউটারে মহা উৎসাহী, পারলে ধুয়ে পানি খাই। ও ভাল ছাত্রী, দুইবার বোর্ড স্ট্যান্ড। টার্গেট ফুলমার্কস। ও মনযোগ দিয়ে ক্লাস করে। আমিও, তবে আধা। সামনের বেঞ্চে বসে, স্যারের টাক দেখি। মাঝে মাঝে আড়চোখে ওকে দেখি। বেশি দেখিনা, আবার যদি ছ্যাবলা ভাবে! ক্লাসে হোমওয়ার্ক করি খালি আমরা দুজনাই। বাকিরা গন-টুকলি আমাদের খাতা থেকে। ৭/৮ ক্লাস যাওয়ার পর একটু পরিবর্তন। একদিন সকাল সকাল আমার খাতা যথারীতি চলে গেছে বন্ধুদের দখলে। ও আসলো। বাকিরা ওর খাতা চাওয়ার আগেই ও হেঁটে আসলো আমার কাছে। খাতা চাইলো। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, "টোমারটা মিলে নাই?" চুড়ীভাঙ্গা হাসির শব্দে আমি অপ্রস্তুত!!

কথার শুরু। কথার পরে কথা। অ্যালগরিদম, ফ্লো-চার্ট, লজিক ফর্মেশন। ফোন নম্বর অদল-বদল। সন্ধ্যাবেলা ফোনে সল্যুশন মেলান। হালকা এদিক সেদিকের কথা। বলল এই সাবজেক্ট ভাল লাগছেনা। ছেড়ে দিবে। একটু মন খারাপ হল। তার কিছুদিন পরেই চলে গেল, সেমেস্টার ফাইনাল না দিয়েই। আমি তখন সেমেস্টার ফাইনাল আর পুরোদমে কথ্য ইংরেজীর চর্চায় মগ্ন। সেমেস্টার পাশ করাটা আমার জন্য জীবন-মরণ প্রশ্ন। ইয়ার লস না দিয়ে কোথাও যাবার যায়গা নাই। বারদুয়েক ফোন করেছিল। আমিও বোধহয় একবার। আমার অনিচছাকৃত নিস্পৃহতায় মর্মাহত হয়ত। আর যোগাযোগ নাই।

যে সাবজেক্ট পড়েছে, সেটা খুবই ভাল। রেজাল্টও করেছে ভাল। আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি, সর্বোচ্চ ডিগ্রীর জন্য বিদেশে যাওয়া, দেশে ফেরা, বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়া। সব খবরই পাই। জানি না আমার খবর রাখে কিনা। রাখার কথা না।

ফেসবুকের নানান নিউজ ফিড দেখতে দেখতে ওর একটা আপডেটে চোখ পড়ল। ইউ টিউবের কি একটা ফাইল শেয়ার করেছে। ক্লিক করে বসে আছি আর ইন্টারনেট স্পিডের মুন্ডুপাত করছি মনে মনে। এমন সময় আমার মেয়ে তার পেন্সিল কোলের মধ্যে রেখে বললো, "টোমারটা মিলে নাই?"

-----------------------------------------------------------------------
অমিত্রাক্ষর
অমিত্রাক্ষর@জিমেইল ডট কম


মন্তব্য

কাজী মামুন এর ছবি

বেশ মজার হয়েছে। (গুড়) জব!
=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"

=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"

annya এর ছবি

awesome boss!

অর্বাচীন [অতিথি] এর ছবি

ট্র্যাজেডি!!!!!!!!!!!

guest write rajkonya এর ছবি

ভেবেছিলাম অ্যালগরিদম নিয়ে কোন লেখা হয়ত। ছেঁদো প্রেম কাহিনী না। তাই মন দিয়ে লেখাটি পড়তে বসলাম। পড়তে গিয়ে দেখি, ওমা!! আমি যা ভেবেছি তা নয়! কোথা থেকে একটু ভাললাগার কথা চলে এসেছে। কিন্তু পড়তে গিয়ে একটুও বিরক্ত হইনি। ভালো লেগেছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, সহৃদয় মন্তব্য আর ভাললাগার জন্য। আপনাদের ভাললাগা সাহসের পালে বেশ হাওয়া দেয়।

অমিত্রাক্ষর
অমিত্রাক্ষর@জিমেইল ডট কম

সিরাত এর ছবি

পাঁচ। সত্যি তো? চোখ টিপি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।