হ্যাভারস্যাক পিঠে ঝুলিয়ে ইয়্যুথ হোষ্টেল থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। হাতে মাত্র দু'দিন সময়। এরই মধ্যে দেখে ফেলতে হবে আইফেল টাওয়ার, ল্যুভর মিউজিয়াম আর ডিজনী ল্যান্ড। আজ গন্তব্য ডিজনী ল্যান্ডের পথে। মেট্রো ধরেই যেতে হবে। এ সময়টায় মোট্রোতে ভীড় অনেক। তবু এগিয়ে যাই, টিকেট কেটে পাতালের সিঁড়ি বেয়ে নামি। নেমে আসা মানুষের ঢলে ত্রস্ত অধীর মুখগুলো দেখি। প্যারিসের মেট্রো ষ্টেশনে এক রকম আচম্বিতেই এজরা পাউন্ড এসে ভর করে আমার উপর। মনে হয় আমি যেন দাঁড়িয়ে আছি 'লা কনকর্ডে'। দেখছি পাতালের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে একটির পর একটি সুন্দর মুখ, আরো একটি, আরো একটি, তারপর একটি নিষ্পাপ শিশুর মুখ, তারপর একটি সুন্দরী রমনী। এজরা পাউন্ডের মতো আমিও ভাষা হারিয়ে ফেলি। তারমানে এই নয় যে আমি আমার প্রকাশের ক্ষমতা হারিয়েছি, বরং কলমের চাইতে তুলিই বোধকরি আমাকে বেশী টানে। যেন ছবি আঁকার ইশকুলে ভর্তি হওয়া কোন নবীন শিক্ষার্থী তার নানা রংয়ের আবেগগুলিকে তুলিতে তুলে নিয়ে মনোরম বিন্যাসে ফোটাচ্ছে ক্যানভাসের গায়ে। ভাষার দৈন্যতা আমাকে কবিতা লিখতে দেয় না বরং আমার বোধের মজ্জায় এক ধরণের সমীকরণ জন্ম নেয়। আমার মনের চাতালে লাফিয়ে নামে সেই বিখ্যাত চতুর্দশশব্দীঃ
The apparition of these faces in the crowd;
Petals on a wet, black bough.
[Ezra Pound, 'In a Station of Metro', 1917]
কি অসাধারণ কবিতা! বাহুল্যবর্জিত ও স্ফটিক স্বচ্ছ। একটিও ক্রিয়াপদ নেই। এটিও ছিল কবির পাতাল মেট্রো স্টেশনের অভিজ্ঞতাকে আঁকার প্রয়াস। সেখানের মানুষগুলোর প্রেতায়িত প্রতিচ্ছবিকে আঁকতে কবি বর্ণনা নয় বরং সমীকরণেরই উপযুক্ততা খুঁজে পেয়েছিলেন। তাইতো বর্ণনার ছটা নেই। জাপানী হাইকুর মতো, বিন্দুর বুকে সিন্ধু। প্রথমটায় লেখা হয়েছিলো তিরিশ পঙক্তিতে, পরে কাট-ছাঁটে এসে দাঁড়ালো চৌদ্দ শব্দতে। একটি নিখুঁত ছবি, চিত্ররূপকল্পবাদের যথাযথ নমুনা ।
কবিতার মূল সুরটি খুঁজতে দিয়ে বিস্ময়াভিভূত হই। নিশ্চিতভাবে, সেটি প্রথম পঙক্তিতে খুঁজে পাইনা, দ্বিতীয় পঙক্তিতেও পাইনা, পাই সেই ভাবনাটুকু্তে যা দুটি পঙক্তিকে বিনিসুতো মালায় গেঁথেছে। এজরা পাউন্ড বলেছিলেন, “In a poem of this sort, one is trying to record the precise instant when a thing outward and objective transforms itself, or darts into a thing inward and subjective.” এই লক্ষ্যভেদের মাহেন্দ্রক্ষণ যেন দুই লাইনের মাঝামাঝি বিলীন। প্রথম পঙক্তিটি শেষ হতে না হতেই, দ্বিতীয় পঙক্তিটি জুড়ে প্রকৃতি থেকে নেয়া স্ফটিকস্বচ্ছ রূপকের অভাবনীয় ব্যবহার আমাদের মন কেড়ে নেয়। ভেজা কালো ডালটির প্রতিভাসে পাপড়িগুলি যেন সুকুমারী সৌন্দর্যের রমনীয় রূপ। সনেটে চৌদ্দটি পঙক্তি, আট-ছয় বিন্যাসে। কবিতাটিতে চৌদ্দটি শব্দ, প্রথম লাইনে আটটি, দ্বিতীয় লাইনে ছয়টি। আয়নায় অনুবিম্বিত প্রতিচ্ছবি।
মেট্রো এসে গেছে, আমি উঠে পড়ি। হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে আমার মনে আসে দু'টি চরণঃ
জনতার ভীড় ত্রস্ত অধীর ছম ছমে ছায়া ঘণ;
সিক্ত কালো ডালের বৃন্তে পাপড়ি যেন।
রোমেল চৌধুরী
মন্তব্য
ব্লগর ব্লগর ভাল লাগলো খুব! এর আগে সচলে আপনার লেখা কবিতা পড়েছিলাম, কবিতা ছাড়া অন্য কিছুও কি লিখেছিলেন? মানে, বলতে চাচ্ছি - এটা পড়ে বুঝলাম আপনার গদ্যের হাতও চমৎকার!
তবে একটা ছোট্ট অনুযোগ - টেকনিক্যালি হয়তো কোন সমস্যা নেই, কিন্তু লেখাটা কলেবরে আরও একটু বড়সড় হলে আরও ভালো লাগতো।
দু'লাইনের ঐ অনুবাদ কি আপনার?
বোন,
আমার গদ্যের হাতের প্রশংসাটি আপনার বদান্যতা, গদ্যকে বড়ই ওজনদার মনে হয় আমার। মাউন্ট নাইরোগংগো ও মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নিয়ে সচলের পাতায় একটি গল্প দিয়েছিলাম, চরিত্রগুলো ঠিকমত ফোটেনি। লিঙ্ক দিয়ে দিলামঃ
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/35018
কবুল করি সবসময়, আমি পোক্ত কোন কবি নই, তেমনটি হবার ধৃষ্টতাও করি না কখনও! গুটিকয়েক অখাদ্য পদ্য সচলের মডারেটরগণ করুণা করে সচলের পাতায় স্থান দিয়েছেন। অনুবাদ, ভাবানুবাদ বা রূপান্তর করার সাহস ও যোগ্যতা দু'টির একটিও আমার নেই। তাই সচলের পাতায় এ ধরণের প্রচেষ্টাগুলি যদিও স্থান পেয়েছে কিন্তু তেমন সফল হয়নি।
একটি জোকস শুনে থাকবেন হয়ত। ছেলেকে তেতো বড়ি গেলাতে মা সেটিকে মিষ্টির ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলে কিন্তু মিষ্টি খেয়েছিলো, বিচি ফেলে দিয়ে। শেষ দু'লাইনে আমার তেমনি প্রচেষ্টা, আপনি জারিজুরি ধরে ফেলেছেন।
ভালো থাকবেন।
রোমেল চৌধুরী
এই যে আপনি প্রথম পাতায় প্রকাশিত আপনার কবিতাগুলিকে অখাদ্য বললেন, তাতে যে শুধু মডুদের বিচারবুদ্ধিকে নিন্দা করলেন তাই নয়, ওগুলি পড়ে যাঁরা প্রশংসা জানিয়েছেন তাদেরকেও অপমান করলেন। অতিবিনয়ের মিছরি ছুরি হয়ে গেলে মুশকিল। আপনার তিন মাসের জেল আর সাতদিনের ফাঁসি চাই।
যথার্থ বলেছেন, এমন বেভুল হওয়া মোটেও ঠিক হয়নি।
যদি বিধান হয় অদ্ভুত কোন কন্ট্রাপ্যাসোতে আমায় ভুগতে হবে আজীবন
আমি মেনে নেব ...
রোমেল চৌধুরী
পারি খাসা জায়গা। ভালো করে ঘুরে দেখেন, আর ব্লগ ছাড়েন। আমরা লুভর-ই দেখতে পাই নাই!
কৌস্তুভ ভাই,
শুনেছি ল্যুভর নাকি একদিনে কাভার করা সম্ভব নয়। তাই ভেবে রেখেছি অন্ততঃ 'ডেননে' রাখা 'মোনালিসা' তো দেখতেই হবে! তারপর না হয় 'রিচেলিউ' তে গিয়ে মধ্যযুগীয় নাইটদের ষ্টাচু দেখতে দেখতে নিজের সাথে নিজেই যুদ্ধ করবো। সবশেষে 'Raft of the Medusa' কিম্বা জলের তোড় থেকে মুক্তি পেতে পলায়নপর মানুষগুলোর প্রতিচ্ছবি ধরে রাখা সেই অতিকায় চিত্রকর্মটি। আসলে আমরা তো সবাই মুক্তির স্বাদ পেতে জীবন থেকে একরকম পালিয়েই বেড়াই!
রোমেল চৌধুরী
সে কথা খুব সত্যি। আমরা নিউ ইয়র্কের দা মেট-এ সারা দিন কাটিয়ে শুধু উত্তর-পশ্চিম উইংটাই দেখতে পেরেছিলাম, তাও তাড়াহুড়ো করে। তবে মোনালিসার সঙ্গে ইন্টুমিন্টু করতে ভুইলেন না। আর ফটুক তোলেন, নাকের ডগা থেকে ফস্কে যাবার দুঃখটা আপনার থেকেই মেটাই।
frommers.com এর পারি গাইড বলছে, "At least call on the "great ladies of the Louvre": the Mona Lisa with her enigmatic smile, the sexy Venus de Milo, and Winged Victory (alas, without a head)." লুভর-এ যে ম্যাপ দেয়, তাতে প্রধান অ্যাট্রাকশনগুলো দাগানো থাকে, খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না।
ভালো লেগেছে। আপনার গদ্যও আকর্ষণীয়।
ভাই,
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, ভীষণ অনুপ্রাণিত হলাম!
রোমেল চৌধুরী
ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন!
রোমেল চৌধুরী
ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন!
রোমেল চৌধুরী
গদ্যটাও ভাল্লাগসে।
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
অনিন্দ্য ভাই,
এবারে আকর্ণবিস্তৃত একটি হাসি দিতে চাই!
রোমেল চৌধুরী
বলছিলাম কি, উনি কি গদ্যও রচনা করেন? মানে, পাউন্ড সাহেব!
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ভাই,
আমার চেনা পাউন্ড সাহেব ষুগপৎ কবি ও কাব্য সমালোচক। এর বাইরে তাঁর কোন পরিচয় থাকলেও থাকতে পারে, আমার জানা নেই।
রোমেল চৌধুরী
নতুন মন্তব্য করুন