শাপলা বাজার মোড় পাড় হতেই ভাগ হয়ে যায় রাস্তাটি। পাল্টে যায় চারপাশের দৃশ্য । রাস্তার ওপাশে দূরে বড় বড় পাহাড়। দৃষ্টির দুই পরতেই শুধু পাহাড় আর পাহাড়। একটির পেছনে আরেকটি। যেন একটি আরেকটির ছায়া। সবগুলো পাহাড় আকাশমুখি। কোন কোনটিকে ঘন মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে। সেখানে মেঘের সাথে পাহাড়ের যেন মিতালী চলছে। কোন কোন পাহাড়ে নেমেছে ঝুম বৃষ্টি। আবার মেঘের ফাঁক বুঝে একরাশ রোদের আলো এসে পরেছে কোন কোনটিতে। এক পাহাড়ে বৃষ্টি, অন্যগুলোতে তখন শুধুই রোদ। এভাবে প্রতিদিন পাহাড়ের গায়ে চলে রোদবৃষ্টির খেলা। মনে হতে পারে এটি কোন পার্বত্য জেলার নয়াভিরাম কোন স্থানের বর্ণনা। কিন্ত এ সব ধারণাকে তুরি বাজিয়ে উড়িয়ে দেয়া যায় যদি কেউ চলে আসে হালুয়াঘাটের কড়ইতলীতে।
ঢাকার খুব কাছের জেলা ময়মনসিংহ। এ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলাকে ঘিরে রেখেছে মেঘালয়ের মেঘ ছোয়া বড় বড় সব পাহাড়। তুরা পাহাড়টিকেও নাকি দেখা যায় এখান থেকেই।
নামটি কেন এমন? হালুয়াঘাট। যদি ফিরে যাই পেছনের দিকে। ১৬৫০-১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি কোন এক সময়ের কথা। তখন দর্শা নামক নদীর ঘাট হয়ে নৌপথে এ অঞ্চলের সকল ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালিত হতো। হালুয়া অর্থ চাষী। হাল চাষীরা নানা কাজে এ ঘাট ব্যবহার করত বলেই এর নাম হয়েছে হালুয়াঘাট। অর্থ দাড়ায় হালুয়াদের ঘাট। আবার অনেকেরই এ বিষয়ে মত একেবারে ভিন্ন। ঘাটটি হালুয়া নামক ব্যক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল বলেই নাকি এর নাম হয়েছে হালুয়াঘাট। নাম নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে কিন্তু কোন মতভেদ নেই।
পাহাড় ভালোলাগা থেকে সুনীল বলেছিলেন পাহাড় কিনবেন। সে রকম ইচ্ছে করার দুসাধ্য না থাকলেও দূর পাহাড়ের ধারে যেতে কার না ভালো লাগে। পাহাড় দেখার আনন্দ পেতে কাক ডাকা এক ভোরে শহর থেকে চলে আসি পাহাড়ের পাদদেশের শহর হালুয়াঘাটে। খবর পেয়ে সফর সঙ্গি হয় দুই বন্ধু সোহরাব আর মৃদুল।
হালুয়াঘাটে যখন পৌছি তখন বাজে সকাল সাড়ে নয়টা। একটি রিক্সায় চেপে আমরা চলে আসি বাজারের শেষ প্রান্তে হোটেল ই-ম্যাক্স ইন্টারন্যাশনালে। এখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়।
হোটেল বয় রাসেল বেশ চটপটে। র্হ র্হ করে বলতে থাকে হালুয়াঘাটের কিছু জায়গার নাম। সূর্যপুর, পানিহাতা আর কড়ইতলী। এ জায়গাগুলো থেকেই মেঘালয়ের সব পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে কাছের জায়গাটি কড়ইতলী।
কড়ইতলী বিডিআর ক্যাম্পের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা চলে গেছে শেরপুরের দিকে। আর অন্যটি সূর্যপুর হয়ে ধোবাউরায়। এই দীর্ঘ রাস্তার একপাশে মেঘালয় সীমান্তে ছায়ার মতো ঘিরে আছে শুধুই পাহাড়। পাহাড় থেকে সীমানা অতিক্রম করে মাঝে মধ্যে দলভেদে নেমে আসে হাতি কিংবা মায়াবি হরিণ। গল্পের মতো এরকম তথ্যে আমরা ঠিক থাকতে পারি না। রওনা দেয়ার প্রস্তুতি নেই। ঠিক সে সময় রাসেল জানালো কড়ইতলীতে মিলবে না কোন দোকানপাট। অগত্যা অসময়েই খেতে হবে দুপুরের খাবার। রাসেলের কাছ থেকে জেনে নেই খাবার হোটেলের ঠিকানাটি।
বাজারের ভেতর বেশ কয়েকটি হোটেল। কিন্তু সেগুলো ফেলে আমরা চলে আসি থানার পাশে জসিমের ছোট্ট হোটেলটিতে। খানিকটা ঘরোয়া ঢঙের ছোট্ট হোটেলটিতে মিলে হাঁসের মাংস। বাড়ীর স্বাদের রান্নায় খেয়ে নেই জটপট। খাওয়া শেষে পান চিবুতে চিবুতে দু’টি রিক্সায় রওনা হই কড়ইতলীর উদ্দেশ্যে।
কড়ইতলী গ্রামটি গোবরাকুড়া ইউনিয়নে, হালুয়াঘাট শহর থেকে মাত্র ৭ কিলো ভেতরে। রিক্সার প্যাডেল ঘুরতেই বাজারকে পেছনে ফেলে আমরা উত্তরদিকে এগুতে থাকে। যতই সামনে যাচ্ছি ততই যেন ভালোলাগা সব দৃশ্য আমাদের ঘিরে ধরছে। রাস্তার দুদিকে ধানক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে নানা জাতের সবুজ গাছ। কোথাও তাল গাছ, কোথাও বা খেজুর। কোথাও বীজ তলার টিয়া রঙ, কোথাওবা সবুজে সবুজ ধানক্ষেত। এভাবে ছবির পরে ছবি ফেলে আমরা সামনে এগুই।
একটি জায়গাতে অন্য রকম এক গন্ধ। রিক্সাওয়ালা জানালো এটি পাট পচানি গন্ধ। তাকিয়ে দেখি রাস্তার পাশের ডোবার মধ্যে জনাকয়েক কৃষক পাটের আশ ছাড়াচ্ছে। অন্য একটি জায়গায় এসে আমরা রিক্সা থামাই। রাস্তার পাশে ধান ক্ষেতে জমেছে হাটু অবধি বৃষ্টির পানি । লম্বা লম্বা পা নিয়ে সে পানিতে নিঃশব্দে মাছ ধরছে এক ঝাক পাহাড়ী বক। সবুজের বুকে সাদা বক। কি যে অদ্ভুত! মনে হচ্ছিল সবুজ আচলে কোন শিল্পী যেন ভালবাসার তুলি দিয়ে সাদা আচর বসিয়ে দিয়েছে।
গ্রামের আঁকাবাকা রাস্তা হয়ে আমরা চলে আসি শাপলা বাজার মোড়ে। মোড়ের দুদিকে চলে গেছে রাস্তার দুটি অংশ। একটি গেছে অনেক দূরে দৃষ্টি সীমার ওপারে, সবুজ প্রান্তরে। ঠেকেছে একেবারে সূর্যপুর বাজারে গিয়ে। আমরা ওপাশটায় এগোই না। মোড় থেকে বামদিকে কড়ইতলীর রাস্তা। আমাদের রিক্সাটি এগোয় সে পথে।
কড়ইতলীর দিকে যতই এগুচ্ছি ততই আমাদের দৃষ্টি যেন স্থির হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন স্বপ্নময় দেশে যেন আমরা চলে এসেছি। স্বর্গীয় পরশ নিয়ে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে চারপাশে। দৃষ্টির সামনে পাহাড়গুলো যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। গাঁয়ে গাঁয়ে লাগানো উচু নিচু সব পাহাড়।
মৃদুলের এসএলআর ক্যামেরার শব্দ যেন থামছেই না। রাস্তার পাশেই ফসলের মাঠ। গোটা মাঠেই ধানের চারা রোপনে ব্যস্ত গারো নারীরা। একজন গারো নারীর সাথে কথা হয় আমাদের। নাম জানালো বন্যা রংমা। এ সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের বিশ্বাস নারীর হাতে রোপিত গাছ থেকে অধিক ফসল মিলে। তাই হাটু অবধি কাদায় নেমে আর্শিবাদের পরশ দিয়ে চারা রোপন করছে তারা।
পাহাড় দেখতে দেখতে আবিস্কার করি মাঠের পাশে একটি ছোট্ট খালের। তার ওপরে বাঁশ বিছিয়ে তৈরী করা হয়েছে একটি পুল বিশেষ। এ পথেই যাতায়াত করে আদিবাসী আর বাঙালিরা।
কথা হয় কিরিত তিছিম নামের এক গারো যুবকের সঙ্গে। সে জানালো খাল মনে হলেও এটি আসলে পাহাড় থেকে নেমে আসা একটি ছোট্ট নদী। বর্ষায় পাহাড়ী ঢলের জলরাশি নিয়ে এটি আছরে পড়ে কংস নদীর বুকে। আর সে সময় ভেসে যায় দুপারের লোকালয়।
আমাদের চোখের সামনেই পাহাড় থেকে উড়ে আসে বকের ঝাক। বকের দিকে তাকিয়ে হঠ্যাৎ দেখি দূর পাহাড়ে মেঘ ঝরছে। খানিক পরেই বাতাসের ধাক্কায় মেঘ যেন ধেয়ে আসে আমাদের দিকে। আমরা পিছু হটি। সে সুযোগে এক পসলা বৃষ্টি ভিজিয়ে দেয় শরীরটাকে। ভেজা শরীরে পাহাড়ের দিকে তাকাতে দেখি অন্য দৃশ্য। গোটা পাহাড়ে কুন্ডলী পাকানো ধোয়া উড়ছে। মনে হচ্ছে পাহাড়ের বুকে যেন কষ্টের আগুন লেগেছে। স্থানীয়রা জানলো প্রচন্ড গরমের পর অল্পবৃষ্টি হলেই পাহাড়ে এ রকম ধোয়ার মতো বাস্প ওঠে। এখান থেকেই দেখা যায় মেঘে ঢাকা তুরা পাহাড়টি। তবে সে জন্য আসতে হবে শরতে।
এখানে ক্ষণে ক্ষণে বদলায় দূর পাহাড়ের রুপ। কড়ইতলীতে বসে আমরা সেগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখি বিকেল পর্যন্ত। বিকেল হতেই কড়ইতলীতে নানা ঢঙের মানুষদের আনাগোনা বেড়ে যায়। নানা জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে গারো নারীরা। আমরাও মিশে যাই কড়ইতলীর মানুষদের মাঝে। মজে যাই দূর পাহাড়ের হাতছানিতে।
ছবি: মৃদুল আহমেদ সালেক খোকন
মন্তব্য
ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে, একসময় অনেক কাছে থেকেও কর্মব্যস্ততার কারণে তুরা পাহাড়ের হাতছানি দেখতে পাইনি, শুনিনি গারো সুন্দরীর মন ভোলানিয়া গান। আপনার লেখাটি পড়ে খুব ভালো লাগলো !
রোমেল চৌধুরী
চোখ জুড়িয়ে গেল ছবিটা দেখে - কচি সবুজ আর ধূসর-নীলের সম্ভারে।
আরে গত ডিসেম্বরেই ঘুরে এলাম!
ছবি দেন নাই কেন আরো? লেখা বিস্তারিত পড়বার সময় পেলাম না। পরে এসে পড়ব।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
ভাই, দিলেন তো মাথাডা আউলা কইরা। দেখি কিছুদিন বাদে যাইতে পারি কিনা। আমার মেইলে (rrs0211@gmail.com) আপনার ফোন নাম্বার পাঠান। কথা আছে ভাই ... ...
আপনের বর্ণনা কিন্তু জবর ... আরো কিছু ছবি দিলেও পারতেন।
===============================================
ভাষা হোক উন্মুক্ত
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
আমি প্রায় এক মাসে মতো ঐ এলাকায় ছিলাম। কিন্তু এতটাই ব্যাস্ততার মধ্যে ছিলাম যে কোন দিকে তাকানোর সময় মেলে নাই।
সশরীরে না গেলেও লেখাটির সাথে সাথে ঘুরে এলাম কড়ইতলী।ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন