চোর

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১১/১০/২০১০ - ১১:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

-- অনন্ত আত্মা

জীবনে প্রথম গ্রামে এসেছি, উৎসাহ-উদ্দীপনায় তাই একদম ফেটে পড়ছি। খোলা আকাশ, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, হাজামজা পুকুর – যাই দেখছি তাতেই মুগ্ধ হচ্ছি। এখন শীতকাল তাই সরষে ক্ষেতে সরষে ফুলের সমারোহ। মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে দু’পাশের সরষে ক্ষেত থেকে সরষে ফুলের মন কেমন করা গন্ধে মাতাল হতে হয়।
সারাদিন দৌড়-ঝাঁপ ছুটোছুটির পর রাতে যে মরার মতো ঘুমাবো এতো জানা কথা। রাত আটটা বাজতেই তাই ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া ছেলেটির চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে; কোন মতে খেয়েই ঘুম। অনেক মানুষের শোরগোলে সকালে ঘুম ভাঙে আমার। আঁধো ঘুম, আঁধো জাগরণের মধ্যেই চোর, চুরি এসব টুকরো কথায় ঘুম পুরোপুরি ভেঙে যায়। বিছনায় উঠে বসতেই সিঁধ কাটা জায়গাটা নজরে পড়ে। কি নিয়েছে আর কি নেয়নি এই জাতীয় আলোচনায় সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মাঝে মা এসে আমাকে বলছে –
- কালকে রাতে যে ঠিক মত খেলি না, তোর ভাগের জিনিস তো চোর খেয়ে গেছে।
আমি বললাম –
- মানে?
- রাতে যে তোরে মুরগীর রান দিতে চাইলাম তুই যে বললি 'সকালে খাব'; তোর সেই রান তো চোর এসে খেয়ে গেছে।
ব্যাপার যেটা ঘটেছিল সেটা হচ্ছে – চোর দুই-চারটা শাড়ী, চাদর ছাড়া নেয়ার মত আর কিছু না পেয়ে ভাত আর মুরগীর সালুন দিয়ে ডিনার করে গেছে। চোর 'হাতে-কলমে' থুক্কু 'ভাতে-মুরগীর রানে' আমাকে ভাল একটা শিক্ষা দিয়ে গেছে। এরপর থেকে আমি কোন রিস্কে যেতাম না -‘এখন খাব না, কালকে খাবনে’ এই নীতি পরিহার করে নগদের পিঠে সওয়ার হলাম। বড় হয়ে মহাজ্ঞানী, মহাজনদের এ বিষয়ক বাণী পড়লাম –
‘যা তুমি আজ করতে পার তা কালকের জন্য ফেলে রেখ না।’
মোদ্দা কথা –
‘যা তুমি আজ রাইতেই খাইতে পার তা সকালের জন্য ফ্যালায়া রাইখো না।’

গ্রামের বাড়ি থেকে চলে আসি ময়মনসিংহ। আব্বার বদলীর চাকুরির সুবাদে ময়মনসিংহে একটা টিনশেড ঘরে আমরা ভাড়া থাকতাম। এক দিন দুপুরের ঘটনা – দুপুরের খাবার শেষে মা একটু ঘুমিয়েছে, হঠাৎ রেডিও’র তীক্ষ্ম শব্দে মা’র ঘুম ভেঙে যায়। বিছনায় শুয়ে শুয়ে মা দেখতে পেল একটা কম বয়েসী ছেলে রেডিওর নব ঘুরাচ্ছে। মা বলল –
- এই তুমি কে?
ছেলেটি কাঁপতে কাঁপতে বলল –
- কাকা পাঠাইছে রেডিওডা নিয়া যাইতে।
- কোন কাকা?
মা’র এই কথা শেষ হয়েছে কি হয় নাই; ঠাস করে টেবিলের উপর রেডিওটা নামিয়ে রেখেই খোলা দরজা পথে ছোকরা টেনে দৌড়। চোর পালালে বুদ্ধি তো বাড়ারই কথা, মা’রও বাড়ল; মা বুঝতে পারল কম বয়সী ছেলেটা উদীয়মান চোর ছিল। বড়ই সাবধানী চোর, রেডিও ঠিকমত চলে কিনা নেয়ার আগে টেস্ট করে দেখছিল।

মিরপুরে আসার পর চোর আমাদের জীবনের নিয়মিত অনুসঙ্গ হিসেবে দেখা দিল। প্রতি সপ্তাহেই কিছু না কিছু চুরি হোত। অভ্যাসটা এমনই দাড়াল কোন সপ্তাহে কিছু চুরি না গেলে আমরা একটু টেনশনে পড়ে যেতাম, একটু একটু মনও খারাপ হত। শাড়ী, চাদর, ঘড়ি, জুতো এমনকি ছাদ থেকে টিভির এ্যারিয়াল পর্যন্ত চুরি গেল তিন-তিনটা। একদিন দুপুরে, ময়মনসিংহের দুপুর ফিরে এল। মা ছাদে গিয়ে দেখে এক মধ্য বয়সী লোক ছাদে শুকোতে দেয়া বিছনার চাদর, শাড়ী নিজ উদ্যোগে তার থেকে নামিয়ে কোমরে প্যাচাচ্ছে। এবার মা’র বুদ্ধি ঝিলিক দিয়ে উঠল; অসীম সাহসিকতায় মা লোকটার হাত চেপে ধরল। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চোর সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে আসার সময় মা’র পাড়া কাঁপানো চিৎকার – চোর! চোর!! আমি ছিলাম গেটের কাছে সিঁড়ি’র ঠিক নিচে। মা’র চিৎকার শুনে ছাদের দিকে ধুপ-ধাপ করে উঠতে যাব, দেখি চোর নেমে আসছে; আমার সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় হয় অবস্থা, তাও দেখি চোর রাস্তা ছাড়ে না। শেষ পর্যন্ত আমি এক পাশে সরে চোরকে নেমে যাবার রাস্তা দিয়ে, চোরের পিছন পিছন দৌড় শুরু করলাম। বেচারা চোরের কপাল খারাপই বলতে হবে, সে যাত্রায় বেচার ধরা পড়ে গিয়েছিল। এরপরের পিটা-পিটির ইতিহাস আর নাইবা বললাম।

আর একবার এক চোর ধরা পড়েছিল আমাদের বাসায়। আমাদের একমাত্র র‌্যাম্প মডেল (প্রচন্ড রকমের স্লিম) মুরগীকে চোর বেচারা চুরি করতে গিয়েছিল। এলাকার রিটায়ার্ড এস.পি (সবাই বলত এসপি সাব, আমি আড়ালে বলতাম এস পিসাব) ব্যাপক শাস্তি দিয়ে চোরকে ছেড়ে দিয়েছিল। থু থু চাটানো, নাকে খত, কানে ধরা – এসব যে ব্যাপক শাস্তির পর্যায়ে পড়ে সেবারই এসপি সাবের মাধ্যমে প্রথম জানতে পাড়লাম।


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

লেখা ভালো লেগেছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

সবাই বলেন আলহামদুল্লিলাহ্।

অনন্ত আত্মা

কৌস্তুভ এর ছবি

মজাদার। 'সামনের জিনিস পেছনে করতে নেই' এই মূল্যবান শিক্ষাটা যে দিয়ে গেছে সে চোর হলেও শ্রদ্ধার্হ। আর উদীয়মান তথা সাবধানী বালকই বা কম যায় কিসে।

অতিথি লেখক এর ছবি

এই জন্যই তো বাসের কন্ডাকটররা বলেন 'পিছন দিয়া আগে বাড়েন'।
ধন্যবাদ, মন্তব্যের জন্য।

অনন্ত আত্মা

নাশতারান এর ছবি

দেঁতো হাসি

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি

অনন্ত আত্মা

অতিথি লেখক এর ছবি

মজারু হইছে।

অনন্ত

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ অনন্ত।

অনন্ত আত্মা

কামরুল হাসান রাঙা [অতিথি] এর ছবি

মজা পাইলাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগলো।

অনন্ত আত্মা

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো
রোমেল চৌধুরী

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

অনন্ত আত্মা

নীড় সন্ধানী এর ছবি

‍‌ব্যাপক শাস্তির কথা শুনে ব্যাপক মজা পেলাম হাসি

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
এ ভ্রমণ, কেবলই একটা ভ্রমণ- এ ভ্রমণের কোন গন্তব্য নেই,
এ ভ্রমণ মানে কোথাও যাওয়া নয়।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

এস.পিসাব বলে কথা।

অনন্ত আত্মা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।