বানানায়তন- ৫ | দন্ত্য-ন বনাম মূর্ধন্য-ণ |

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১৫/১০/২০১০ - ৩:৫২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাংলা বর্ণমালায় আর-একটা বিভীষিকা আছে, মূর্ধন্য এবং দন্ত্য ন’এ ভেদাভেদ -তত্ত্ব। বানানে ওদের ভেদ, ব্যবহারে ওরা অভিন্ন। মূর্ধন্য ণ’এর আসল উচ্চারণ বাঙালির জানা নেই। কেউ কেউ বলেন, ওটা মূলত দ্রাবিড়ি। ওড়িয়া ভাষায় এর প্রভাব দেখা যায়। ড়’এ চন্দ্রবিন্দুর মতো ওর উচ্চারণ। খাঁড়া চাঁড়াল ভাঁড়ার প্রভৃতি শব্দে ওর পরিচয় পাওয়া যায়। –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (বাংলাভাষা-পরিচয়)

রূপকথার সেই সুয়োরানি আর দুয়োরানির মতোই বাংলা বানানে দুটি রানি রয়েছে। আমি সুয়োরানি বলতে দন্ত্য-ন আর দুয়োরানি বলতে মূর্ধন্য-ণ-কেই বোঝাচ্ছি। কখনো কখনো এই দুই রানির মধ্যে কাকে রেখে কাকে বাদ দেব তা যেন আমরা সহসাই বুঝে উঠতে পারি না। এ কারণেই আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন যাঁরা বলেন শুধু শুধু দন্ত্য-ন বনাম মূর্ধন্য-ণ-র লড়াই জিইয়ে রেখে লাভ কী? দুটোর উচ্চারণই যখন এক তাহলে দুটোর বানানও এক করে ফেলা যায় না?

সন্দেহ নেই, এমনটি করা গেলে বানান সহজ হতো। কিন্তু মূর্ধন্য-ণ-এর একটি আলাদা সৌন্দর্য আছে, যেমনটি আছে দন্ত্য-ন-এর। আর তৎসম শব্দে ব্যাকরণগত বাধ্যবাধকতার বিষয়টি তো রয়েছেই।

তা ছাড়া আরও একটি বিষয় আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। বিশ্বের অনেক ভাষাতেই একাধিক বর্ণ বা শব্দাংশের একই উচ্চারণ আছে। অর্থাৎ একই উচ্চারণ অথচ বানান ভিন্ন। ইংরেজির কথাই ধরা যাক। শ-ধ্বনি লিখতে গিয়ে c, s, sh, ss, ti ব্যবহার করা হয় এমন শব্দ ইংরেজি ভাষায় ভুরি ভুরি। উদাহরণ :

c - malicious (ম্যালিশাস)
s - sure (শিওর)
sh - fashion (ফ্যাশন)
ss - profession (প্রফেশন)
ti - fiction (ফিকশন)

আমরা ইংরেজি ভাষার এসব গণ্ডগোলে আপত্তি করি না। তাহলে শুধু মাতৃভাষা বাংলার বেলায়ই এত আপত্তি কেন?

কাজেই মূর্ধন্য-ণ-কে এখনই বিদায় বলার উপায় নেই। বিশেষ করে যখন মাত্র একটি ঘণ্টা বিনিয়োগ করেই যে কেউ ণ-ত্ব বিধান আয়ত্ত্ব করে নিতে পারে, (যাদের আইকিউ শার্প তাদের জন্য আরও কম সময় অর্থাৎ মাত্র আধা ঘণ্টাই যথেষ্ট হাসি ) তাই একে বিদায় করতে চাওয়াটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

তাহলে আসুন আর কথা না বাড়িয়ে জেনে নিই ণ-ত্ব বিধানের খুঁটিনাটি।

শুধুমাত্র তৎসম (যেসব শব্দ সংস্কৃত থেকে অবিকৃত অবস্থায় এসেছে) শব্দে কিছু সুনির্দিষ্ট বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছের পরে ণ বসবে। তবে সাধারণত সাধিত শব্দে (উপসর্গ, সন্ধি বা সমাসযোগে গঠিত শব্দ) এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। মোটা দাগে এই হচ্ছে ণ-ত্ব বিধানের নিয়ম।

যেসব শব্দে ব্যবহৃত হবে

১. সকল অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দের ক্ষেত্রে ন ব্যবহৃত হবে।

উদাহরণ : ঝরনা, রানি, পুরান, ধরন ইত্যাদি।

২. যুক্তাক্ষরের ক্ষেত্রে দুটি মত প্রচলিত। বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মের ৪.০১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে :

অ-তৎসম শব্দের যুক্তাক্ষরের বানানের ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যগণ একমত হতে পারেন নি। একটি মতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ণ্ট ণ্ঠ ণ্ড ণ্ঢ হবে। যথা : ঘণ্টা, লণ্ঠন, গুণ্ডা। অন্যমতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ন্ট ন্ঠ ন্ড ন্ঢ হবে। যথা : ঘন্টা, প্যান্ট, প্রেসিডেন্ট, লন্ঠন, গুন্ডা, পান্ডা, ব্যান্ড, লন্ডভন্ড।

এখন আসুন এই দ্বিমতের কারণ খুঁজে দেখি।

বাংলা বানানরীতির একটি মৌলিক এবং মজার নিয়ম স্মরণ করা যাক :

ঙ ঞ ণ ন ম–অক্ষরগুলো সবই নাসিক্য বর্ণ এবং বাংলা বর্ণমালার পাঁচটি বর্গের (ক-বর্গ, চ-বর্গ, ট-বর্গ, ত-বর্গ, প-বর্গ) শেষ অক্ষর। এ অক্ষরগুলো যখন কোনো অক্ষরের আগে যুক্ত হবে তখন এদের প্রত্যেকটি নিজস্ব বর্গীয় অক্ষর ছাড়া অন্য বর্গের কোনো অক্ষরের সাথে যুক্ত হবে না।

এখন, ট-বর্গ মানে ট ঠ ড ঢ ণ। ট-বর্গের শেষ অক্ষর ণ হওয়ায় ট, ঠ, ড, ঢ–এর পূর্বে ণ যুক্ত হবে, কখনোই ‘ন’ নয়।

যাঁরা সকল অ-তৎসম শব্দ থেকে ণ দূর করতে চান তাঁরা এক্ষেত্রে এই মৌলিক নিয়মটি উপেক্ষা করতে চাইছেন। তাই তাঁরা লিখছেন ঘন্টা, প্যান্ট, প্রেসিডেন্ট, লন্ঠন, গুন্ডা, পান্ডা, ব্যান্ড, লন্ডভন্ড। আবার কেউ কেউ অ-তৎসতম শব্দেও ণ বসাচ্ছেন, কারণ তাঁরা উল্লেখিত নিয়মটি মেনে চলতে চান। তাই, তাঁরা লিখছেন ঘণ্টা, লণ্ঠন, গুণ্ডা।

যেসব তৎসম শব্দে ব্যবহৃত হবে

ক. যেসব বর্ণের পরে ণ হবে

সাধারণভাবে ঋ/র/ষ বর্ণের পরে ণ ব্যবহৃত হবে।

১. ঋ

ঋ-এর দুটি রূপ আছে। যথা, ঋ এবং ঋ-কার। এই দুটো রূপের পরেই ণ হবে। উদাহরণ :

১. ঋ - ঋণ
২. ঋ-কার - ঘৃণা, তৃণ, মৃণাল
.
২. র

র-এর তিনটি রূপ আছে। যথা র, রেফ, র-ফলা। এই সবগুলো রূপের পরেই ণ হবে। উদাহরণ :

১. র - কারণ, ধারণ, মরণ, অরণ্য, আহরণ, উদাহরণ, সাধারণ
২. রেফ - কর্ণ, চূর্ণ, দীর্ণ, পর্ণ, অর্ণব, পূর্ণিমা, বিশীর্ণ
৩. র-ফলা - ঘ্রাণ, প্রণয়, প্রাণ, যন্ত্রণা, ভ্রূণ, মিশ্রণ, স্ত্রৈণ

লক্ষণীয় : এই নিয়মানুসারে রেফ-এর পর ণ হয় বলে তৎসম শব্দে 'রেফ-যুক্ত দন্ত-ন' সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু সাধিত শব্দে ঋ/র/ষ-এর পর সাধারণত (কিছু ব্যতিক্রম আছে, নিচের ‘কিছু বিশেষ নিয়ম’ শিরোনামের অংশটি দেখুন) ণ হয় না। যথা, সন্ধির ক্ষেত্রে : অহর্নিশ (অহ+নিশ), নিষ্পন্ন (নিঃ+পন্ন)। সমাসের ক্ষেত্রে : ত্রিনয়ন (ত্রি নয়ন যার)। উপসর্গের ক্ষেত্রে : পরিবহন (পরি+বহন), দুর্নীতি (দুর+নীতি, নির্নিমেষ (নির+নিমেষ), দুর্নাম (দুর‌+নাম), পরিনির্বাণ (পরি+নির্বাণ)।

৩. ষ

১. ষ - ষণ্ড, ঘর্ষণ, দূষণ, বিষাণ, অন্বেষণ, নিষ্পেষণ, ভাষণ, বিষ্ণু* ইত্যাদি।
২. ক্ষ (ক+ষ) - ক্ষণ, ক্ষণিক, ক্ষীণ, ঈক্ষণ, তীক্ষ্ণ, সমীক্ষণ, লক্ষণ ইত্যাদি।

*ষ-এর সাথে ণ যুক্ত হলে (ষ+ণ) যুক্তবর্ণের চেহারা হবে ষ্ণ। যেমন : বিষ্ণু, কবোষ্ণ, বৈষ্ণব, উষ্ণীষ ইত্যাদি।

এই নিয়মটি সহজে মনে রাখার জন্য সেই পুরোনো ছড়াটার সাহায্য নেয়া যায় :

ঋ-কার র-কার ষ-কারের পর
ন-কার যদি থাকে
খ্যাঁচ করে তার কাটব মাথা*
কোন বাপ তারে রাখে!

* ন-এর মাথা কাটা মানে মাত্রা না-দেয়া, তাহলেই ন হয়ে যায় ণ

বেশ সহজ, তাই না?
তাহলে আসুন আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক।

৪. একই শব্দে ঋ/র/ষ-এর পরে যদি স্বরবর্ণ অথবা ক-বর্গের বর্ণ (ক খ গ ঘ ঙ), প-বর্গের বর্ণ (প ফ ব ভ ম), এবং য য় হ–এই ১৩টি ব্যঞ্জনবর্ণের এক বা একাধিক থাকে, তবে তার পরে ণ হবে।

উদাহরণ : র+ও (স্বরবর্ণ) + প + ন = রোপণ
শ+র + আ (স্বরবর্ণ) + ব (প-বর্গ) + ন = শ্রাবণ
হর + অ (স্বরবর্ণ) + ন = হরণ
অর + প + ন = অর্পণ
কৃ (ক + ঋ-কার) + প + অ (স্বরবর্ণ) + ন = কৃপণ

একইভাবে, অপরাহ্ণ, পরায়ণ, অগ্রহায়ণ, গ্রহণ, প্রবহমাণ, ভ্রাম্যমাণ, শ্রবণ, ভ্রমণ, ব্রাহ্মণ, ইত্যাদি।

এই একই কারণে ঊত্তর, পর, পার, চন্দ্র, নার, রাম–ইত্যাদি শব্দের পরে ‘অয়ন/আয়ন’ শব্দ হলে ণ হয়ে যায়। উদাহরণ :

উত্তর + অয়ন = উত্তরায়ণ [র-এর পর আ (স্বরবর্ণ) + য় (১৩টি ব্যঞ্জনবর্ণের একটি) + ন = ণ]
পর + অয়ন = পরায়ণ [র-এর পর আ (স্বরবর্ণ) + য় (১৩টি ব্যঞ্জনবর্ণের একটি) + ন = ণ]
নার + অয়ন = নারায়ণ [র-এর পর আ (স্বরবর্ণ) + য় (১৩টি ব্যঞ্জনবর্ণের একটি) + ন = ণ]
চন্দ্র + আয়ন = চান্দ্রায়ণ [র-ফলা-র পর আ (স্বরবর্ণ) + য় (১৩টি ব্যঞ্জনবর্ণের একটি) + ন = ণ]
রাম + অয়ন = রামায়ণ [র-এর পর আ (স্বরবর্ণ) + ম (প-বর্গের বর্ণ) + আ (স্বরবর্ণ) + য় (১৩টি ব্যঞ্জনবর্ণের একটি) + ন = ণ]
পার + অয়ন = পারায়ণ [র-এর পর আ (স্বরবর্ণ) + য় (১৩টি ব্যঞ্জনবর্ণের একটি) + ন = ণ]

লক্ষণীয় : ১. অ-তৎসম শব্দে ণ-ত্ব বিধি কার্যকর নয়। যেমন : নগরায়ন।
২. ঋ/র/ষ-এর পরে অন্য বর্গের বর্ণ থাকলে ন হবে। যেমন : দর্শন, প্রার্থনা।
৩. শব্দের শেষ বর্ণটিতে হসন্ত-উচ্চারণ থাকলেও এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। যেমন : শ্রীমান।

খ. যেসব বর্ণের আগে ণ হবে

এখন যে নিয়মটির কথা বলছি এটা আলাদা করে শিখতে হয় না।

ট-বর্গ–ট ঠ ড ঢ ণ। ট-বর্গের শেষ অক্ষর ণ হওয়ায় ট, ঠ, ড, ঢ–এর পূর্বে ণ যুক্ত হবে, কখনোই ‘ন’ নয়।

উদাহরণ : যুক্তব্যঞ্জনে ট-বর্গের বর্ণগুলির (ট ঠ ড ঢ ণ) পূর্বে ণ

১. ণ্ট (ণ+ট) ঘণ্টা, কণ্টক, নিষ্কণ্টক, বণ্টন
২. ণ্ঠ (ণ+ঠ) অবগুণ্ঠন, উৎকণ্ঠা, লুণ্ঠন, কণ্ঠ

৩. ণ্ড (ণ+ড) কলকুণ্ডলি, ঠাণ্ডা, লণ্ডভণ্ড, খণ্ড, দণ্ড, ভণ্ড, কাণ্ড, ঝাণ্ডা, ভাণ্ড, চণ্ডী
৪. ণ্ঢ (ণ+ঢ) ঢুণ্ঢি, ঢেণ্ঢন (তেমন প্রচলিত নয় এই শব্দগুলি)
৫. ণ্ন (ণ+ন) অক্ষুণ্ন, ক্ষুণ্ন, বিষণ্ন

দ্রষ্টব্য : ক্ষুণ্ন শব্দটির সাথে ক্ষুন্নিবৃত্তি (ক্ষুৎ+নিবৃত্তি)-র পার্থক্য লক্ষ করুন। ক্ষুন্নিবৃত্তি সাধিত (সন্ধিজাত) শব্দ, যেখানে ৎ + ন = ন্ন (ন-এর দ্বিত্ব) হয়েছে।

যেসব বর্ণের আগে ন হবে

এটিও একটি মৌলিক নিয়ম, তাই আলাদা করে শিখতে হয় না।

ত-বর্গ–ত থ দ ধ ন। ত-বর্গের শেষ অক্ষর ন হওয়ায় ত, থ, দ, ধ–এর পূর্বে ন যুক্ত হবে, কখনোই ণ নয়। যেমন : অন্ত, শান্ত, প্রান্ত, গ্রন্থ, পন্থা, স্পন্দন, গন্ধ, বন্ধন, সন্ধ্যা ইত্যাদি।

কিছু বিশেষ নিয়ম

সতর্কতা : এ নিয়মগুলোকে কুইনাইনের মতো তেতো লাগতে পারে।

সতর্কতা বিষয়ে সতর্কতা : যাদের প্রায়ই (পাঠকের হুল খেয়ে) কাঁপিয়ে জ্বর আসে (ম্যালেরিয়ার মতো) তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য।

১. প্র, পরি, নির–এই ৩টি উপসর্গের পর কখনো কখনো ণ হয়। যেমন : প্রণাম, প্রহ্ণে, পরিণয়, নির্ণয় [এটি আসলে মূল নিয়মকে অনুসরণ করছে]।

২. অগ্র শব্দের পরবর্তী নী ও হায়ন শব্দের ক্ষেত্রে ণ হয়। যেমন : অগ্রণী, অগ্রহায়ণ ইত্যাদি [এটিও আসলে মূল নিয়মকে অনুসরণ করছে]। ব্যতিক্রম : অগ্রনেতা।

৩. কোনো কিছুর নাম বোঝাতে এক শব্দ বিবেচিত হলে ণ-ত্ব বিধান প্রযোজ্য। যেমন : শূর্পণখা (শূর্প+নখা), অগ্রহায়ণ [এটিও মূল নিয়মকে অনুসরণ করছে]।

৪. গণ ধাতু সহযোগে গঠিত শব্দসমূহে ণ হবে। যেমন : গণিত, গণনা, গণ্য, গণৎকার, গণশক্তি, জনগণ, গণসংগীত।

৫. সাধিত কিছু শব্দে র-এর প্রভাবে ন মূর্ধন্য-ণতে পরিণত হয়। যেমন : গ্রামীণ।

৬. কতকগুলো শব্দে স্বভাবতই মূর্ধন্য-ণ হয়। এগুলোকে নিত্য ণ বলা হয়। যেমন : শাণিত, লবণ, আপণ, ভণিতা, পণ্য, বীণাপাণি, লাবণ্য, বিপণি, চাণক্য, গণেশ প্রভৃতি।

কোনো নিয়মে যেগুলোকে ফেলা যায় না, সেগুলো স্বতঃসিদ্ধ মনে রাখার জন্য মুখস্থ করে বা লিখে লিখে অভ্যাস করে আয়ত্ত্বে আনতে হয়। নিত্য ণ-এর আরও কিছু শব্দ নিয়ে একটি প্রাচীন ছড়া :

কণা নিক্কণ ফণা চিক্কণ কণিকা গণিকা কাণ
উৎকুণ কণ মণি কঙ্কণ বাণ শাণ কল্যাণ
পিণাক কফোণি লাবণ্য ফণী বণিক নিপুণ পাণি
চাণক্য পণ মাণিক্য গণ বীণা বেণু বেণী বাণী
গুণ তূণ ঘুণ অণু মৎকুণ বাণিজ্য কিণ কোণ
পুণ্য গৌণ লবণ পণ্য ভণিতা শোণিত শোণ
স্থাণু শণ ভাণ আপণ বিপণি এণ–এই পঞ্চাশ
নিত্যসিদ্ধ ণ-কার এদের, বিধির বাহিরে বাস।

অবশেষে দেখুন...

ণ/ন লিখতে ভুল হলে অর্থ কীভাবে পালটে যায় :

---------------------------
কোণ (angle)---------------কোন (what)
গুণ (ধর্ম, স্বভাব, প্রকৃতি)----গুন (দড়ি, সুতা, পূরণ)
পাণ্ডা (সর্দার)----------------পান্ডা (চীনের বনাঞ্চলে জাত বিরল প্রজাতির প্রাণী)
করুণ (কাতর)---------------করুন (do it)

তাই আসুন সতর্ক থাকি...

এমন কোথাও দন্ত্য-ন লিখব না যেখানে শুধুমাত্র মূর্ধন্য-ণ-ই শুদ্ধ।

আবার যেখানে শুধুমাত্র দন্ত্য-ন শুদ্ধ বিনা কারণে সেখানে মূর্ধন্য-ণ-ও বসাব না। যেমন :

অশুদ্ধ --------------------শুদ্ধ
গোণা---------------------গোনা (গণনা করা)
কোণা/কোণাকুণি----------কোনা (প্রান্ত, ধার, কোণযুক্ত)/কোনাকুনি
ইস্টার্ণ--------------------ইস্টার্ন
কর্ণার---------------------কর্নার

নিশ্চয়ই এখন আর ণ-ত্ব বিধান খটমটে লাগছে না? নিন তাহলে, লিখতে থাকুন হাত খুলে আর বুক ফুলিয়ে বলুন বাংলাটা আমরা ভালোই বুঝি। আপনার পাশেই থাকবে বানানায়তন।

-----------------------------------------------
আরও পড়ুন :
ই-কার বনাম ঈ-কার
অনুস্বার বনাম ঙ, সাথে এ বনাম অ্যা

হ্রস্ব স্বর না দীর্ঘ স্বর
------------------------------------------------
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা : ১. বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান
২. ণ-ত্ব জ্ঞানের গুণী (সাইফুজ্জামান খালেদ)
-----------------------------------------------
---------------------------
কুটুমবাড়ি

---------------------------


মন্তব্য

হলুদ-মডু এর ছবি

একটি লেখা একাধিকবার পোস্ট করার কোনো প্রয়োজন নেই। একবার পোস্ট করে অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। লেখাটি প্রকাশোপযোগী হলে প্রকাশিত হবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রিয় হলুদ-মডু,
লেখাটি প্রকাশ করার জন্য ধন্যবাদ। হয়তো লক্ষ করেছেন প্রতিবার পোস্ট সংরক্ষণ করার পরই কিছু-না-কিছু সংশোধনীর কথা মাথায় আসছিল। লেখা প্রকাশিত হয়ে গেলে তো আর সম্পাদনার সুযোগ নেই... তাই একরকম বাধ্য হয়েই... সে যা-ই হোক, পরবর্তীতে আরও সতর্ক হব আশা করছি। ইয়ে, মানে...

কুটুমবাড়ি

হাসিব এর ছবি

সবই তো বুঝলাম। মাগার কোন তৎসম শব্দ, কোনটা বিদেশী শব্দ সেইটা বোঝার উপায় কী? কোন শর্টকার্ট আছে?
________________________________________________
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি

অতিথি লেখক এর ছবি

আসলে সংস্কৃত থেকে যেসব শব্দ সরাসরি বাংলা ভাষায় চলে এসেছে তা-ই তৎসম শব্দ। এ-জাতীয় শব্দ চেনার কয়েকটি শর্টকাট উপায় : ঈ, ঊ, ী, ূ, ঋ, ৃ, ড়, ঢ়, ষ, ক্ষ, ণ - এসব স্বরবর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণ শুধুমাত্র তৎসম শব্দেই বসে।

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

কুটুমবাড়ি

স্বাধীন এর ছবি

একই প্রশ্ন আমারো। তৎসম শব্দ আর অ-তৎসম শব্দ বুঝার উপায় কি কি, এটা নিয়ে আরেকটি বিস্তারিত লেখা হতে পারে। কারণ সব নিয়মের শুরতেই এটা আসে।

এই লেখাটির জন্যেও ধন্যবাদ লেখককে।

অতিথি লেখক এর ছবি

স্বাধীন ভাই,
এই সিরিজের শুরু থেকেই আপনার মন্তব্যগুলো আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। এই মন্তব্যটিও করল।

তৎসম শব্দ বোঝার উপায় নিয়ে সামনে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

কুটুমবাড়ি

অতিথি লেখক এর ছবি

রাগিব এর সাথে একমত।

অতিথি লেখক এর ছবি

অতিথির নাম কই?

কুটুমবাড়ি

মনমাঝি [অতিথি] এর ছবি

কুটুমবাড়ি

বানানে স, শ, ষ আর স্ব -এর সঠিক ব্যবহারের নিয়ম নিয়ে কিছু লিখুন না। ন/ণ-এর কনফিউশন যেমন পীড়া দেয়, স/স্ব-এর বিভ্রান্তিও তেমনি ভীষন দৃষ্টিকটু। বাংলাদেশের শীর্ষ-স্থানীয় প্রিন্ট মিডিয়া থেকে শুরু করে ব্লগজগতেও এই স/স্ব-এর বিভ্রান্তি ইদানিং খুব দেখা যায়। সবাই কেন জানি মনে হয় সবকিছুতেই 'স্ব' ব্যবহার করতে চান এম্নকি যখন কিছুতেই এর ব্যবহার চলে না। এই সচলায়তনেই এর অনেক উদাহরন আছে।

যেমন ধরুন, 'সাক্ষ্য' হরদম 'স্বাক্ষ্য' হয়ে যায় বা 'সাক্ষী' হয় 'স্বাক্ষী', 'সাক্ষরতা' (লিটারেসি) হয়ে যায় 'স্বাক্ষরতা', 'সপরিবারে' (পরিবার সহ) হয়ে যায় 'স্বপরিবারে', সার্থকতা হয় স্বার্থকতা, ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক বড় বড় লেখক বা পত্রিকাই এই ভুল্গুলি প্রায়ই করেন, আমার মত আম-পাঠকের কথা বাদই দিলাম। সোজাসাপ্টা সহজ-সরল নিরলংকার নিরাভরন একটা অক্ষর 'স' ছেড়ে আমরা কেন জানি যুক্তাক্ষরের নেশায়, অতিরিক্ত একটা ব-ফলার নেশায়, পাগলপারা হয়ে যাই। আচ্ছা, কারো কারো কাছে কি 'স'-কে একটু বেশি সাদামাটা, হালকা, ও আনস্মার্ট বা সিম্পল্টন মনে হয় -- যার সাথে একটা ব-ফলার অলঙ্কার যোগ করে বা ওজন চাপিয়ে একে 'স্ব'-এর মত একটা যুক্তাক্ষর বানালে তার মধ্যে পান্ডিত্যের গ্রাম্ভারিত্ব আসে ??
Just a theory চোখ টিপি

যাই হোক, এই স/স্ব বা শ/শ্ব বা স/শ/ষ বিষয়ে যদি কোন নিয়ম থেকে থাকে তাহলে আশা করি সেটা এখানে বা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করবেন।

ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

মনমাঝি ভাই,
আপনি দারুণ একটি বিষয় তুলে ধরেছেন। তবে আমার মনে হয় কেউ এটা ইচ্ছাকৃতভাবে করেন না। খুব সম্ভবত কনফিউশন থেকেই অনেকে এ ধরনের ভুল করে ফেলেন। পরবর্তী কোনো পর্বে স/শ/ষ/স্ব নিয়ে আলোচনা থাকবে। তখন এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখার ইচ্ছে রইল। হাসি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানবেন।
---------------------------------------------------------------------------
ফুটনোট : যেহেতু এটা ণ-ত্ব বিধানের পোস্ট, তাই অনুগ্রহ করে নিচের বানানগুলো একটু লক্ষ করুন।
ভীষন > ভীষণ (ষ-এর পর ণ)*
উদাহরন > উদাহরণ (র-এর পর ণ)*
নিরাভরন > নিরাভরণ (র-এর পর ণ)*
*এই তিনটি শব্দই তৎসম। অর্থাৎ, ণ-ত্ব বিধান কার্যকর হবে এখানে।

কুটুমবাড়ি

কৌস্তুভ এর ছবি

মন আর মণ এ ধরনের পার্থক্য বোঝানোর জন্যই আপাতত ণ-এর ধরকার। তবে কথা বলার সময় যেমন কনটেক্সট থেকেই বুঝে যাই, লেখাতেও তো যেতেই পারি। সেক্ষেত্রে ণ আস্তে আস্তে তুলে দিলেই ল্যাটা চুকে যায় মনে হয়।

ণ এর ক্ষেত্রে ড়ঁ-এর মত করে ঠিকভাবে উচ্চারণ করেন পাঞ্জাবীরা। ষ কাউকেই উচ্চারণ করতে দেখি না। এটার উচ্চারণ বোধহয় সেই মধ্যপ্রাচ্যের ঘৃষ্ট অভ্যাস থেকে, তারপর আরামপ্রিয় ভারতীয়রা সহজ করে নিয়েছি।

ণত্ববিধানের উপর হিমু ভাইয়ের ণ-ত্ব বিধান গল্পমালা সিরিজ জব্বর লাগে।

অতিথি লেখক এর ছবি

কৌস্তুভ ভাই,
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আসলে ণ-ত্ব/ষ-ত্ব বিধি বাদ না দেয়ার কারণ এই না যে বাংলা লেখা পড়তে তখন সমস্যা হবে। ণ/ষ বাদ দিয়ে দিলে প্রথম প্রথম কিছুটা থতমত খেতে হলেও একটা সময় হয়তো আর ণ/ষ-কে আমাদের মনেই থাকত না। মূল সমস্যাটা একটু ভিন্ন, আর তা হচ্ছে তৎসম শব্দের বানান। তৎসম শব্দের বানানে কোনো রকম পরিবর্তন চলবে না এই রকম বিধান একালেও দেয়া হয়েছে। হাসি

কুটুমবাড়ি

হাসিব এর ছবি

তিনটা স, শ আর ষ-এর পার্থক্য আছে। আমরা উচ্চারণ করি না সঠিকভাবে এই যা। ইংরেজিতে s, sh এর উচ্চারণে পার্থক্য হয়। জার্মানে এরকম ch, sh, s এগুলোর উচ্চারণেও পার্থক্য হয়। স, শ, ষ থেকে কোনটা কমানো মানে ভাষার আওতা সীমিত করে ফেলা।
________________________________________________
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি

কৌস্তুভ এর ছবি

আলিসাহেবের লেখাটা মনে পড়ে গেল। জার্মানিতে হিচহাইকিং করতে বেরিয়ে যে পরিবারে গেছেন, সেখানে ঠাকুমা নাতনীকে বলছে, তোরা তো কির্ষে আর কির্শে (গির্জা আর চেরীফল) এর তফাত করতে পারিস না উচ্চারণে।

যদি কথা বলার সময় শ আর ষ এর উচ্চারণে তফাত না করা সত্ত্বেও শব্দটা বুঝতে অসুবিধা না হয়, তাহলে লেখার সময়েও তো হবার কথা নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে উচ্চারণ এক হওয়ায় সমস্যা হয়, সেটা মানছি। কিন্তু, একটা শব্দের যখন একাধিক অর্থ থাকে, তখনও তো ব্যবহৃত অর্থটা বুঝতে হয় কনটেক্সট থেকেই। পাতা খাওয়া জিনিসটার অর্থ কনটেক্সট থেকেই বুঝে নিতে হয়, ছাগল না নেশাড়ু কে খাচ্ছে। মন আর মণ এক হয়ে গেলেও নাহয় কনটেক্সট থেকেই মন এর দুটো অর্থ বুঝে নেওয়া যাবে। দুই মন চাল দিন, এটার অর্থ বুঝতে পারছি বলেই না যে লিখেছে তাকে গিয়ে বলতে পারছি, ওটা মণ হবে।

ভাষার আওতা সীমিত করে ফেলা বলতে কি বোঝাচ্ছেন বুঝলাম না। মণ এর বানান মন করে ফেললে তো অর্থটা ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে না, মন এর আরেকটা অর্থ বাড়ছে।

আমার মতামত বললাম। চটে গেলেন না আশা করি।

হাসিব এর ছবি

একটা উদাহরণ দেই ভাষার আওতা সীমাবদ্ধ করার ব্যাপারে। জার্মান ভাষায় আমি অর্থ Ich। এটা উচ্চারণ ইষ। উচ্চারণ মুখের সামনের দিকে না হয়ে মুখের একদম ভেতরের দিক থেকে হয়। দুটো শ. ষ কমিয়ে ফেললে এই জাতীয় উচ্চারণ লেখা যাবে না।

আরেকটা বিষয় বলি। যখন যতিচিহ্নের প্রচলন হয় তখন একটা আর্গুমেন্ট ছিলো ভাষায় অব্যয় দেখেই বলে দেয়া যায় কোনটা কখন কোথায় কী বলা হচ্ছে। আদতে এই নতুন চিহ্নগুলো যোগ করে ভাষা আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রত্যেক ভাষায় উচ্চারণ একরকম বানান একরকম এরকম প্রচুর উদাহরণ আছে। আমি শুধু বাংলাতেই দেখলাম অনেকেই এই ব্যাপারে নাখোশ।

________________________________________________
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি

কৌস্তুভ এর ছবি

রাগিব ভাইয়ের সঙ্গে সহমত। যদি জার্মান 'নাখট' এর মত Ich এর ch উচ্চারণ হয়ে থাকে, তাহলে সেটা খ দিয়ে লেখাই ভাল আমার মনে হয়। সংস্কৃত ষ এর উচ্চারণ ওই ch এর মত হলেও, বাঙালি অভ্যাস ইষ কে ইশ এর মতই উচ্চারণ করবে, ইখ্‌ এর মত নয়।

রাগিব ভাই অন্য যে কথাটা বলেছেন তাতেও সহমত। বাংলা ভাষায় ইংরাজি z এর উচ্চারণ আছে, বাঙালদের মধ্যে, কিন্তু লেখার মত অক্ষর কোথায়? এটাতে বরং পরশুরাম সরাসরি z কেই আমদানি করে 'z‍ানতি' করেছেন। এইটা ভাল প্রচলন। আপনি বলছেন যতিচিহ্ন আমদানি করে বাংলা লিখতে আরো সুবিধা হয়েছে। কথা সত্যি। তেমনই যখন দরকার তখনই আমদানি হোক, আর দরকার না থাকলে বাদ দিতেও কুন্ঠা হওয়া উচিত না।

আমার মত, যদি ষ এর আদি উচ্চারণ বোঝানোর জন্য অক্ষরটাকে বাংলায় রেখে দেওয়া হয়, তো বেশ। কিন্তু যখন মুখে বলব কোশ, তখন কোষ লেখার জন্য আর ষ এর প্রয়োজন নেই।

বাংলায় ব এবং অন্তস্থ্য ব দুটো অক্ষর দেখতে একই। সংস্কৃতে দুটোর উচ্চারণ আলাদা, কিন্তু বাংলায় উচ্চারণও একই করি। এরকম ইকুয়ালাইজেশন হলে, মন্দ কি?

উচ্চারণ এক আর বানান আরেক এমন অনেক শব্দ নিয়ে ইংরেজরা নিজেরাই তো কম কান্নাকাটি করে না। ছদ্মবেশী সিনেমাটা দেখেছেন কি? 'নিউমোনিয়ার বোবা পি' নিয়ে পেছনে লাগা, বা 'টি ও টু, ডি ও ডু, জি ও... অ্যা ছি ছি', এসব নিয়ে তো ওরাও দুঃখ করে। দাদাঠাকুরের এসব ইংরাজি নিয়ে রসিকতা শুনে ইংরেজ সাহেবও প্রশংসা করে গেছেন।

আর ইংরাজির এই ফাও ঝামেলা বাদ দিয়ে সরলীকরণ তো আমেরিকানরা করছেও। colour কে color করেছে, কোনো সমস্যা হয় নি তো।

অতিথি লেখক এর ছবি

কৌস্তুভ ভাই,
আপনি লিখেছেন-

যদি কথা বলার সময় শ আর ষ এর উচ্চারণে তফাত না করা সত্ত্বেও শব্দটা বুঝতে অসুবিধা না হয়, তাহলে লেখার সময়েও তো হবার কথা নয়।

আপনি কি নিশ্চিত যে লেখার সময়ে কোনো অসুবিধা হবে না? নিচের বানানগুলো দেখুন তো -

১. ষ্ণ = ষ + ণ; যেমন- কৃষ্ণ
স্ন = স + ন; যেমন- কৃস্ন (?)
শ্ন = শ + ন; যেমন- কৃশ্ন (?)
২. ক্ষ্য = ক + ষ + য; যেমন- লক্ষ্য
ক্স্য = ক + স + য; যেমন- লক্স্য (?)
৩. ক্ষ = ক + ষ; যেমন- পক্ষ
ক্স = ক + স; যেমন- পক্স (?)

বোঝাই যাচ্ছে 'ষ' বাদ দিলে সম্পূর্ণ নতুন কিছু বানান যোগ হবে বাংলা ভাষায় (একই কথা ণ-র জন্যও প্রযোজ্য)। এসব বানান সবাইর ভালো লাগবে তো? আমি 'ণ'-র কথা জোর দিয়ে বলতে পারছি না, তবে 'ষ' বাদ দিলে ভাষার আওতা কিছুটা সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে কিন্তু! আপনারও কি তাই মনে হয় না?

কুটুমবাড়ি

কৌস্তুভ এর ছবি

একটা কথা পষ্ট করে নিই, আমি স শ ষ তিনটেকেই এক করে দিতে বলছি না। শুধু ষ এর উচ্চারণ শ এর মত বলে সেটাই করে নিতে বলছি। রাস আর রাশ এর উচ্চারণ আলাদা, মিলাবার তো কোনো প্রয়োজন নেই।

ষ বাদ দিয়ে যদি শ-ওয়ালা কিছু শব্দ বাংলায় নতুন আসে, তাহলে তো খুবই ভাল, কারণ তার অর্থ এই সরলীকরণের ফলেও কোনো কনফিউশন হবার সম্ভাবনা নেই সেক্ষেত্রে। কৃষ্ণ'র বদলে কৃশ্ন লিখলেও আপনি বুঝে যাবেন ওই বাঁশি হাতে লুল্পুরুষটার কথাই হচ্ছে।

সমস্যা বরং যখন ষ শ দুটো নিয়েই শব্দ থাকে, যেমন বিষ/বিশ। সেটা নিয়ে আগে বলেছি, তাই আর বিস্তারিত করছি না।

হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছেন, এসব বানান অনেকের ভাল না-ই লাগতে পারে। কিন্তু যখন প্রচণ্ড ধার্মিক লোকেরাও ধর্ম্ম থেকে বদলে ধর্ম লিখতে পেরেছেন, তখন এটাই বা পারবেন না কেন?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বিশেষণে সব-ই শেষ, বলিতে না পারি
জানোতো স্বামীর নাম নাহি ধরে নারী

(এখানে শ, ষ, স ও স্ব-এর উচ্চারণ লক্ষ করুন)



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কৌস্তুভ এর ছবি

লক্ষ্য করলাম। কিন্তু আমার কাছে ষ=শ এবং স্ব=স ই লাগল। আপনি কি অন্য কিছু বোঝাতে চাইছেন পাণ্ডবদা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এখানে শ, ষ, স ও স্ব-এর উচ্চারণ "শ"-এর মতো।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কৌস্তুভ এর ছবি

ও। আসলে আমি এখানেও স আর স্ব কে শ এর মতন করে উচ্চারণ করি নি, তাই বুঝতে পারি নি।

অতিথি লেখক এর ছবি

অর্থাৎ শ, ষ, স ও স্ব-এর উচ্চারণ কখনো কখনো এক হতে পারে। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে বাদ দিতে হলে শুধু ষ-ই কেন! স্ব বা স কেন বাদ দেয়া যাবে না? হুমম... চিন্তিত

সংযোজন : ওপরে রাগিব ভাইয়ের মন্তব্যের উত্তরে বিস্তারিত বলেছি। হাসি

কুটুমবাড়ি

অতিথি লেখক এর ছবি

কৌস্তুভ ভাই,
আপনি লিখেছেন-

ষ বাদ দিয়ে যদি শ-ওয়ালা কিছু শব্দ বাংলায় নতুন আসে, তাহলে তো খুবই ভাল, কারণ তার অর্থ এই সরলীকরণের ফলেও কোনো কনফিউশন হবার সম্ভাবনা নেই সেক্ষেত্রে।

আসুন বানানগুলোর চেহারা কেমন হবে এখন থেকেই ভাবতে শুরু করি। দেঁতো হাসি

বর্তমান বানান-----------------------------বিকল্প বানান
ক্ষ = ক + ষ; যেমন- পক্ষ---------------------পক্শ
ক্ষ্ণ = ক + ষ + ণ; যেমন- তীক্ষ্ণ---------------তীক্শ্ণ
ক্ষ্ব = ক + ষ + ব; যেমন- ইক্ষ্বাকু-------------ইক্শ্বাকু
ক্ষ্ম = ক + ষ + ম; যেমন- লক্ষ্মী---------------লক্শ্মী
ক্ষ্ম্য = ক + ষ + ম + য; যেমন- সৌক্ষ্ম্য------সৌক্শ্ম্শ
ক্ষ্য = ক + ষ + য; যেমন- লক্ষ্য--------------লক্শ্য
ঙ্ক্ষ = ঙ + ক + ষ; যেমন- আকাঙ্ক্ষা--------আকাঙ্ক্শা
ষ্ক = ষ + ক; যেমন- শুষ্ক---------------------শুশ্ক
ষ্ক্র = ষ + ক + র; যেমন- নিষ্ক্রিয়-------------নিশ্ক্রিয়
ষ্ট = ষ + ট; যেমন- কষ্ট-----------------------কশ্ট
ষ্ট্য = ষ + ট + য; যেমন- বৈশিষ্ট্য-------------বৈশিশ্ট্য
ষ্ট্র = ষ + ট + র; যেমন- রাষ্ট্র------------------রাশ্ট্র
ষ্ঠ = ষ + ঠ; যেমন- শ্রেষ্ঠ----------------------শ্রেশ্ঠ
ষ্ঠ্য = ষ + ঠ + য; যেমন- নিষ্ঠ্যূত--------------নিশ্ঠ্যূত
ষ্ণ = ষ + ণ; যেমন- কৃষ্ণ----------------------কৃশ্ণ
ষ্প = ষ + প; যেমন- নিষ্পাপ------------------নিশ্পাপ
ষ্প্র = ষ + প + র; যেমন- নিষ্প্রয়োজন-----নিশ্প্রয়োজন
ষ্ফ = ষ + ফ; যেমন- নিষ্ফল-------------------নিশ্ফল
ষ্ব = ষ + ব; যেমন- মাতৃষ্বসা------------------মাতৃশ্বসা
ষ্ম = ষ + ম; যেমন- উষ্ম----------------------উশ্ম

সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে বোধ করি ক্ষ শব্দের শুরুতে চলে এলে।
যেমন : ক্ষীর> ক্শীর, ক্ষুর> ক্শুর, ক্ষেত> ক্শেত

আপনি কি নিশ্চিত মানুশজন এইসব বানান মেনে নেবে? চোখ টিপি

কুটুমবাড়ি

--অজানা-- এর ছবি

[বেশ কিছুদিন আগের লেখা... তবুও]:

ক্ষ এর বদলে খ লিখলে সমস্যা কী?! এখন তো ক্ষুর শব্দের বদলে খুর বেশ ব্যবহৃত হচ্ছে!

আপনার যুক্তবর্ণের তালিকা দেখে বেশ মজা পেলাম!!

অতিথি লেখক এর ছবি

বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মের ২.০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী-

ক্ষীর, ক্ষুর ও ক্ষেত শব্দ খির, খুর ও খেত না লিখে সংস্কৃত মূল অনুসরণে ক্ষীর, ক্ষুর ও ক্ষেত-ই লেখা হবে। তবে অ-তৎসম শব্দ খুদ, খুদে, খুর, খেপা, খিধে, ইত্যাদি লেখা হবে।

তবে কথা সেইটা না। আমি বোধ হয় ভুল উদাহরণ দিয়ে ফেলেছি। কারণ বাংলায় অনেক শব্দের শুরু ক্ষ দিয়ে যেগুলো খ দিয়ে লেখা হলে খুবই অচেনা মনে হবে (ব্যাকরণের কথা না হয় বাদই দিলাম)। যেমন, খমা, খেত্র, খান্ত ইত্যাদি। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।

-কুটুমবাড়ি

কাজী মামুন এর ছবি

আমার জন্য দরকারী, তাই প্রিয়তে।

================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"

=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

কুটুমবাড়ি

কুলদা রায় এর ছবি

নত্ব বিধান বা ষত্ব বিধান তুলে দেওয়া যাবে না। সংস্কৃত ও তৎসম শব্দের প্রতিটি বর্ণই (ধ্বনিই) অর্থ বহন করে, পৃথিবীর আর কোনো ভাষাতেই সে নিয়ম নেই। পৃথিবীতে বাংলাই একমাত্র জীবিত ভাষা, যাতে এখনও এই নিয়ম কমবেশি প্রচলিত আছে।
কলিম খান জানাচ্ছেন, পৃথিবীর আর কোনও ভাষায় শব্দের বর্ণেরা (ধ্বনিরা) মানে ধারণ করে না। এটিই সমস্ত ভাষার সঙ্গে আমাদের বাংলা ভাষার মূল ও প্রধান পার্থক্য। ফলে, অন্য কোনও ভাষায় একটি শব্দ থেকে একটি বা বর্ণ বাদ দিলে , বা নতুন এক-দুটি বর্ণ জুড়ে দিলে শব্দের মানে বদলায় না। কিন্তু বাংলা ক্রিয়ার্থভিত্তিক ভাষা হওয়ায় বাংলা ভাষায় অর্থাৎ তৎসম শব্দের বেলায় সেরকম করলেই মানে বদলে যায়। যেমন ইংরেজরা আগে লিখতেন cometh, এখন লেখে comes, কোনও অসুবিধা হয় নি। কিন্তু মৎস্য, আচার্য্য শব্দের য-ফলা বাদ দিলে মানে বদলে যাবে।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

অতিথি লেখক এর ছবি

কুলদাদা,
আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। তৎসম শব্দের বানানে পরিবর্তন হয় না বা হয়নি এ কথাটা কি ঠিক? বাংলা বানানের ইতিহাস কিন্তু বলে যে বহু তৎসম শব্দের বানান যুগে যুগে বদলে গেছে।

অন্য কোনও ভাষায় একটি শব্দ থেকে একটি বা বর্ণ বাদ দিলে , বা নতুন এক-দুটি বর্ণ জুড়ে দিলে শব্দের মানে বদলায় না। কিন্তু বাংলা ক্রিয়ার্থভিত্তিক ভাষা হওয়ায় বাংলা ভাষায় অর্থাৎ তৎসম শব্দের বেলায় সেরকম করলেই মানে বদলে যায়।

উনিশ শতকে মন, জ্যোতি, চক্ষু প্রভৃতি শব্দের বানান ছিল যথাক্রমে মনঃ জ্যোতিঃ চক্ষুঃ। শুধু সন্ধি-সমাসেই না, আলাদা শব্দ হিসেবেও বানানগুলো চালু ছিল। এই কিছুদিন আগেও রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব-বিধান প্রচলিত ছিল (যেমনটি রাগিব ভাই উল্লেখ করেছেন, ধর্মের বদলে লেখা হতো ধর্ম্ম)। সম্রাট, অবাক, দিক এইসব শব্দের বানান ছিল সম্রাট্, অবাক্, দিক্। আবার সংস্কৃতে যা উত্সব, বাংলায় তা-ই উৎসব। কারণ খণ্ড-ৎ বর্ণটি সংস্কৃতে নেই। সংস্কৃত ত্ এবং বাংলা ৎ একই ধ্বনিগত মানবিশিষ্ট। আমরা এই পরিবর্তনও করে নিয়েছি। এ ছাড়া বহু সংস্কৃত শব্দ আছে যেগুলোর বানান বাংলায় স্বাভাবিক প্রবণতার জন্য বদলে গেছে।

কাজেই তৎসম শব্দের বানানে কোনো পরিবর্তন আনা হলেই অর্থাৎ 'কোনো বর্ণ বাদ দিলে বা যোগ করলেই মানে বদলে যাবে' আপনার এই কথাটির মর্মার্থ বুঝতে ব্যর্থ হলাম। আরেকটু বুঝিয়ে বলবেন কি? হাসি

কুটুমবাড়ি

কৌস্তুভ এর ছবি

সংস্কৃত শব্দের প্রতিটি ধ্বনিই অর্থ বহন করে, এটা একটু ব্যাখ্যা করে বলুন। ক ব্যঞ্জনবর্ণটি, যার উচ্চারণ ক্‌, সেই ধ্বনিটির অর্থ কি? চলচিত্তচঞ্চরীতে শ্রীখণ্ডদেবের আশ্রমে শোনা সেই শব্দার্থ-খণ্ডিকা মনে পড়ে গেল, অপরাধ নেবেন না।

আর সংস্কৃতে যদিও বা থাকে, বাংলায় আছে এরকম তো আদৌ মনে পড়ছে না। একটু বিস্তারিত বলুন না।

আপনার অন্য বক্তব্যটির ক্ষেত্রে, আপনারই দেওয়া উদাহরণ দুটো নিয়ে একটু কথা বলি বরং।
মৎস্য এর য-ফলা বাদ দিলে অর্থ বদলে যাবে? কেন? মৎস শব্দের এখন কোনো অর্থ নেই ঠিকই, কিন্তু যদি আমরা ঠিক করি যে ওটার মানেই হবে মাছ, তাহলে? যদি আমরা ঠিক করি, য-ফলার যেহেতু উচ্চারণ নেই, মৎস বলতেও মাছই বোঝাবো, আর মৎস্য কে মৎস করেই লিখব, তাহলেই তো হল।
আর মৎস এর এই যে বর্তমান অর্থহীনতা, সেটা কি য-ফলা কোনো বিশেষ 'অর্থ বহন করে' বলে? না তো। স্রেফ মৎস শব্দটার কোনো অর্থ এখনও সংজ্ঞায়িত হয়নি বলেই।

দুই, আচার্য্য। আচার্য্য কে আচার্য লেখার কথা বরং বাংলা অ্যাকাডেমিই বলছে। এক্ষেত্রে মানলাম, য-ফলা বাদ দিলে অর্থে কিছু তফাত হচ্ছে। কিন্তু সেই তফাতটা কি য-ফলা কোনো বিশেষ 'অর্থ বহন করে' বলে, নাকি সেটা স্রেফ আমাদের অভ্যাসের জন্য? এখন আমরা গুরুমশাই অর্থেও আচার্য লিখতেও অভ্যস্ত হচ্ছি, তাই এখন আচার্য শব্দটার দুটো অর্থ হিসাবেই নাহয় শিখলাম, অসুবিধা কি? 'আচার্য নিয়মগুলি আচার্য মানবদেব শিখাইয়া দিলেন' এই কথাটায় আচার্য শব্দটার দুটো আলাদা মানে কি বুঝতে কিছু অসুবিধা হচ্ছে?

কুলদা রায় এর ছবি

য-ফলার অর্থ আছে।
স্থিত থাকে যাহাতে।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

অতিথি লেখক এর ছবি

মৎস্য এর য-ফলা বাদ দিলে অর্থ বদলে যাবে? কেন? মৎস শব্দের এখন কোনো অর্থ নেই ঠিকই, কিন্তু যদি আমরা ঠিক করি যে ওটার মানেই হবে মাছ, তাহলে? যদি আমরা ঠিক করি, য-ফলার যেহেতু উচ্চারণ নেই, মৎস বলতেও মাছই বোঝাবো, আর মৎস্য কে মৎস করেই লিখব, তাহলেই তো হল।

আচার্য্য। আচার্য্য কে আচার্য লেখার কথা বরং বাংলা অ্যাকাডেমিই বলছে।

কৌস্তুভ ভাই, আসুন মৎস্য এবং আচার্য শব্দ দুটোর ব্যুৎপত্তি খতিয়ে দেখি একটু।

মৎস্য = \/মদ্+স্য (স্যন্)
আচার্য = আ+\/চর্+য

আশা করি এখন পরিষ্কার হয়েছে কেন আচার্য বানানে য-ফলা নেই। বাংলা একাডেমী মৎস্য বানানে য-ফলা দিতে পেরেছে, আচার্য বানানেও দিতে পারত। দেয়নি কারণ তাতে শব্দের অর্থ এবং বুৎপত্তি বুঝতে সমস্যা হবে না মনে করা হয়েছে। তা ছাড়া রেফের পর ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব-বিধান পরিত্যাজ্য বলেই বিবেচিত। আপনারও কি তাই মনে হয় না? ধন্যবাদ।

কুটুমবাড়ি

স্বাধীন এর ছবি

আমরা ছোট বেলায় পড়েছি একই শব্দ "মাথা", কিংবা "হাত" এর নানাবিধ ব্যবহার। একই শব্দ যদি বাক্যের ব্যবহার ভেদে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করতে পারে সেক্ষেত্রে ণ-ত্ব বা ষ-ত্ব বিধান উঠিয়ে দিলে যারা ভাবছেন যে শব্দের মানে পরবর্তন হয়ে যাবে সেটা কতটা যুক্তি সঙ্গত? ভাষা তো কোন চিরস্থায়ী কিছু নয়, বরং ভাষা পরিবর্তনশীল। মানুষের জন্যই ভাষা, ভাষার জন্য তো মানুষ নয়। মানুষ তার নিজের ব্যবহারের জন্যই ভাষাকে পরিবর্তন করে। রাগিবের সাথে সহমত আমারও। ভাষাবিদদের উচিত, বর্ণমালা নিয়ে, ব্যাকারণ নিয়ে চিন্তা করা।

অতিথি লেখক এর ছবি

ষ-ত্ব বিধান সম্পর্কে আমি ওপরে রাগিব ভাইয়ের মন্তব্যের উত্তরে বলেছি। তেমনি আমার মনে হয় ণ-ত্ব বিধানও সহসাই উঠিয়ে দেয়াটা সম্ভব হবে না। যদিও আশায় আছি, ভাষাতাত্ত্বিকরা হয়তো কিছু একটা ভেবে বের করতে পারবেন। আপাতত সেই সুদিনের অপেক্ষায় থাকি বরং, নাকি বলেন?

কুটুমবাড়ি

কুলদা রায় এর ছবি

আলোচনাটি গুরুত্বপূর্ণ। ভাল লাগছে।
সময় নেই'র মধ্যেও তাই সময় বের করে পড়ছি।
বাংলা ভাষার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন কলিম খান। সঙ্গে আছেন রবি চক্রবর্তী। মুশকিল হল ওঁদের কাজের প্রচারটা কম। সে কারণে আমাদের অনেকের কাছেই তাঁদের ভাবনাটা অজানা থেকে যাচ্ছে। ভাবছি--তাঁদের বইগুলো পিডিএফ কপি করে দেব। এর জন্য সময়ের অপেক্ষা করছি।
সংস্কৃত ভাষা সংস্কার শব্দ থেকে এসেছে। তৎকালে যে সকল ভাষা প্রচলিত ছিল সেগুলো সংস্কার করে পণ্ডিতগণ সংস্কৃত নামে একটি ভাষা নির্মাণ করেন। এই ভাষাটি মানুষের মাথায় যে নিয়মে বর্ণ উৎপন্ন হয় সেভাবে অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়মে বানানো হয়েছিল। বাংলা তারই উত্তরাধিকার বহন করে। বাংলা একটি জীবন্ত ভাষা। অন্য ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষার সম্ভাবনা অনেক।
বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার পার্থক্য হল--বাংলাভাষা ক্রিয়ার্থভিত্তিক। আর অন্য ভাষাগুলো প্রতিকভিত্তিক। কোন একটি শব্দ যখন উচ্চারণ করা হয় তখন তাঁর একটি মাত্র প্রতিক আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। শব্দের অর্থ তখন সংকুচিত হতে হতে তার বহুমাত্রিকতা হারিয়ে ফেলে। ফলে তা দিয়ে কোন একটি কাজ চালানো যেতে পারে। কিন্তু বহুকাজের সম্ভাবনাটি লুপ্ত হয়। কাজ চালানো মানে যেন তেন ভাবে চলা। এভাবে একটি ভাষা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। করিম খান বলেন কাজ চালানোর মত কাজ করা হলে পৃথিবীতে শুধু বেঁচে থাকবে বেশ্যরা আর গুণ্ডারা। সেখানে মনুষ্যত্ব থাকে না। ভাব থাকে। প্রাণ থাকে না। শুধু একটিমাত্র কাঠামো থাকে। কোনো রমণীর বদলে তার কঙ্কালটি দিয়ে কি হয়?
ক্রিয়ার্থভিত্তিক শব্দের বৈশিষ্ট্য হল--কোনো শব্দ তার কোনো প্রতিককে নির্দেশ করে না। তার ক্রিয়া বা কাজকে নির্দেশ করে। ফলে অদৃশ্য কর্মকে চেনা যায়। সেজন্য একটি নয় ঐ কর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আরও শব্দের উন্মেষ ঘটে। ভাষার ক্ষমতা বেড়ে যায়।
এ বিষয়ে কলিম খানের পরমাভাষার সংকেত, অবিকল্পসন্ধান ইত্যাদি বইগুলোতে বিস্তারিত জানা যায়। উনি বঙ্গীয় শব্দার্থকোষের প্রথম খণ্ডটি গত বছর প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয় খণ্ডটির কাজ করছেন।
১) ক্ বর্ণের অর্ত : ক্ বর্ণটি একটি ক্রিয়ার ধারক। ক্রিয়াটি হল 'ক-অন'। একটি অস্তিত্ব যদি অন্য অস্তিত্বের বদল ঘটায় তাহলে প্রথম অস্তিত্বের এই কাজকে ক-অন বলে। এ যেন ক-বিন্দু থেকে খ-বিন্দুতে সক্রিয় হওয়া। ক্ এর সঙ্গে অ যুক্ত হয়ে ক উৎপন্ন হয়। ক এর মানে দাঁড়ায় --করে যে (কারী)। করে যে সে হল কারী।
যেমন পালন করে যে= পালক, ধারণ করে যে= ধারক। কী করে? কাজ করে, পড়া করে, জ্ঞানার্জন করে, ভাল করে, মন্দ করে, রোজগার করে, খরচ করে, আয় করে, খুশি করে, ইত্যাদি এবং ..কী করে না। ইংরেজিতে এরকম ধারণাই নেই। doing income, doing sad, doing pleasure, doing play... এধরনের বাক্যবন্ধ ইংরেজিতে দুএকটা বলা গেলেও খুব বেশি বলাই যায় না। কিন্তু বাংলায় রীতিমত তা বলা যায়। অতএব ক মানে (যে-কোনো বস্তু বা বিষয়) করে যে। অর্থাৎ ক= কারী। সমাজের ইতিহাসে যে যুগে যাকে সব কিছুর কর্তা মনে হয়েছে, তাকেই ক বর্ণের সাহায্যে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাভারতে স্পষ্ট করে উল্রেখ আছে যে, 'ক' বর্ণে 'দক্ষ' জানিবে।
ক= ক্ -অন্ (on) করে যে=কারী,
ক-এর আধার যে= কা,
ক গতিশীল যাহাতে= কি,
কি-এর আধার যে=কী,
ক নবরূপে উত্তীর্ণ যাহাতে= কু,
কু-এর আধার যে =কূ,
ক আবর্ত্তিত যাহাতে= কৃ,
কৃ-এর আধার যে= কৃৃ,
ক দিশাগ্রস্থ যাহাতে= কে,
কে-র আধার যে= কৈ,
ক-এর নর্বরূপ যাহাতে= কো,
কো-র আধার যে = কৌ।

২) আচার্য শব্দটিকে বর্তমানে ইংরেজি Professor বা Teacher অর্থে প্রতিকীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ য-ফলা দিয়ে যে আচার্য্য শব্দটি পাই তার ভিতরে উঁকি দিয়ে ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ পাওয়া যায়--আচার গতিশীলরূপে স্থিত হয়ে (ধৃত) থাকে যাহাতে। আচার্য্য শব্দের আরও প্রতিকী অর্থ--বেদাধ্যাপক, শাস্ত্রবিশেষের অদ্যাপক, মতপ্রবর্ত্তক শঙ্করাদি, শিক্ষকমাত্র, পূর্জমাত্র, দ্রোণ, যজ্ঞাদিতে ধর্ম্মোপদেশ গুরু, ভক্তিশাস্ত্রের উপদেশক। আচার বলতে--আচরণের পূনরাবৃত্তি যাহাতে থাকে। ইংরেজিতে culture.
য-ফলাটির অর্থ-- স্থিত থাকে যাহাতে বোঝায়।
য-ফলাহীন আচার্য শব্দের দ্বারা কোনো গ্রন্থ বোঝায়।

৩) মৎস্য--আমিত্ব স্বভাব স্থিত হয়ে থাকে যাহাতে। এভাবে মৎস্য শব্দ দিয়ে অনেকগুলো শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে মৎস শব্দটি দিয়ে একটি মাত্র প্রতিকী অর্থ মাছ বোঝানো হয়ে থাকে।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

কৌস্তুভ এর ছবি

আপনার বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য অনেক ধন্যবাদ। চলচিত্তচঞ্চরীর ওই অংশটা একটা অন্য রকম দিক থেকে দেখতে পেলাম।

মুশকিলটা হল, এত কিছুর থেকে বাংলা ভাষা যে অনেকটা সরে এসেছে। আজ যদি কেউ মৎস্য শব্দের অন্য কোনো মানে দিয়ে একটা বাক্য লেখে, তাহলে শুধু আমি কেন অনেকেই বুঝবে না। এমতাবস্থায় মৎস্য=মৎস=মাছ হয়ে গেলে আমার মতে কিছু সমস্যা হবে না।

সংস্কৃতের এই অ্যালগোরিদমিক ব্যবস্থা, অর্থযুক্ত root-এর উপর ভিত্তি করে শব্দ গঠন, তা থেকে আরো শব্দ গঠন, এ ব্যাপারটা খুবই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু বাংলায় শব্দগুলি ব্যবহারের সময়...

কুলদা রায় এর ছবি

কদিন আগে আমার বান্ধবী ফিওনা একটি বই দিয়েছিল---ডিকশনারী অব স্ল্যাং ইংলিশ অব জ্যামাইকা। সেখানে দেখি মুখবন্ধে প্রথম বাক্যটিতে লেখা--শব্দের মধ্যে ইতিহাস লুকিয়ে থাকে।
আমাদের প্রাচীন ইতিহাস কিন্তু ক্রিয়ার্থভিত্তিতে লেখা। সে ভাষাটা বুঝতে হলে ভাষার বহুরৈখিক অর্থ দরকার। শুধুমাত্র বর্তমানের কথাবার্তা বললেই তো চলবে না। আমাদের অতীতটাকেও উদ্ধার করতে হবে।
ধন্যবাদ।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

অতিথি লেখক এর ছবি

শব্দের মধ্যে ইতিহাস লুকিয়ে থাকে।
সহমত। শব্দ দেখে যেন তার ব্যুৎপত্তি বোঝা যায় এটাই কাম্য। এমনকি বানান কতটা ধ্বনিসংবাদী হলো তার চেয়েও এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। ধন্যবাদ আপনাকে।

কুটুমবাড়ি

অতিথি লেখক এর ছবি

কৌস্তুভ ভাই, একটু দ্বিমত জানাই।

আজ যদি কেউ মৎস্য শব্দের অন্য কোনো মানে দিয়ে একটা বাক্য লেখে, তাহলে শুধু আমি কেন অনেকেই বুঝবে না। এমতাবস্থায় মৎস্য=মৎস=মাছ হয়ে গেলে আমার মতে কিছু সমস্যা হবে না।

তাহলে দেখুন এক মৎস্য শব্দের কত অর্থ!

মৎস্য একটি রাশির নাম,
মৎস্য বিষ্ণুর প্রথম অবতার,
মৎস্য একটি হিন্দু পুরাণের নাম,
মৎস্য একটি প্রাচীন রাজ্যের নাম।

আপনি মৎস্য=মাছ লিখলে কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু মৎস্য লিখতে পারলে শুধু শুধু য-ফলা কেন বাদ দিতে যাবেন? বিশেষত তৎসম শব্দের অহেতুক বিকৃতি কারোই কাম্য নয়। যেমনটি কুলদাদাও বলেছেন, 'শব্দের মধ্যে ইতিহাস লেখা থাকে' কথাটি কিন্তু মিথ্যে নয়। তাই মাতৃভাষা বলেই সতর্ক হব না এমনটি ভাবলে ভুল হবে বলে মনে করি। আপনার কী মত?

কুটুমবাড়ি

অতিথি লেখক এর ছবি

কুলদাদা,
আপনার মন্তব্যটি সত্যিই চমৎকার। প্রচুর ভাবনার খোরাক পাওয়া গেল। কিন্তু আপনার মন্তব্যের বেশকিছু অংশ আমার বোধগম্য হয়নি, তাই আবারও কিছু প্রশ্ন করছি। হাসি

তৎকালে যে সকল ভাষা প্রচলিত ছিল সেগুলো সংস্কার করে পণ্ডিতগণ সংস্কৃত নামে একটি ভাষা নির্মাণ করেন। এই ভাষাটি মানুষের মাথায় যে নিয়মে বর্ণ উৎপন্ন হয় সেভাবে অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়মে বানানো হয়েছিল। বাংলা তারই উত্তরাধিকার বহন করে।

হরপ্রসাদ শাস্রী রহস্য করে বলেছিলেন সংস্কৃত বাংলার 'অতি-অতি-অতি-অতি-অতি-অতিবৃদ্ধ পিতামহী'। কাজেই বাংলা যে সংস্কৃতের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে তাতে আর সন্দেহ কী। কিন্তু দাদা, এত যোগ্যতা নিয়েও, এত সুন্দর, এত সুচিন্তিত প্রাকৃতিক নিয়মে তৈরি করা সত্ত্বেও সংস্কৃত ভাষার মৃত্যু হলো কেন বলতে পারেন?

বাংলা একটি জীবন্ত ভাষা। অন্য ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষার সম্ভাবনা অনেক।

এটা আপনিই যথার্থই বলেছেন। তবে আমার মনে হয় আরও বেশি সম্ভাবনা থাকত যদি এটাকে 'সংস্কৃতানুযায়িনী' করার চেষ্টা না করে 'বাংলা' করার চেষ্টা করা হতো। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্রী, যোগেশচন্দ্র রায় এঁরা বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য কারণ বাংলা ব্যাকরণকে 'বাংলা' করার প্রাথমিক প্রস্তাব ও প্রচেষ্টা ওনারাই নিয়েছিলেন।

বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার পার্থক্য হল--বাংলাভাষা ক্রিয়ার্থভিত্তিক। আর অন্য ভাষাগুলো প্রতিকভিত্তিক।
এখানে কি বাংলা না বলে সংস্কৃত ভাষার কথা বলতে চেয়েছিলেন? কারণ বাংলাভাষা তো ক্রিয়ার্থভিত্তিক নয় (জানি না কখনো ছিল কি না)।

মৎস্য--আমিত্ব স্বভাব স্থিত হয়ে থাকে যাহাতে। এভাবে মৎস্য শব্দ দিয়ে অনেকগুলো শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে মৎস শব্দটি দিয়ে একটি মাত্র প্রতিকী অর্থ মাছ বোঝানো হয়ে থাকে।
আমি তো অভিধানে মৎস বলতে কোনো শব্দ খুঁজে পেলাম না। তবে হ্যাঁ, মৎস্য শব্দটি বহাল তবিয়তে আছে এবং মাছসহ তার অনেকগুলো শব্দার্থও দেয়া আছে।

কুটুমবাড়ি

কুলদা রায় এর ছবি

আপনার প্রথম প্রশ্নটির জবাব পরে দেব।
দ্বিতীয় প্রশ্নটির জবাবে বলা যায়--সংস্কৃত যেহেতু মৃত ভাষায় পরিণত হয়েছে--সেজন্য সংস্কৃত দুহিতা বাংলার উপরই তার উত্তরাধিকারত্ব বা দায়-দায়িত্ব জন্মায়। সেজন্য বাংলা ভাষার জননী যেহেতু সংস্কৃত ভাষাটির ক্রিয়ার্থবিধিত্ব বাংলারই আছে।
আপনার এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।
ধন্যবাদ।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

অতিথি লেখক এর ছবি

সংস্কৃত যেহেতু মৃত ভাষায় পরিণত হয়েছে--সেজন্য সংস্কৃত দুহিতা বাংলার উপরই তার উত্তরাধিকারত্ব বা দায়-দায়িত্ব জন্মায়। সেজন্য বাংলা ভাষার জননী যেহেতু সংস্কৃত ভাষাটির ক্রিয়ার্থবিধিত্ব বাংলারই আছে।

বাংলাকে সংস্কৃত দুহিতা বা সংস্কৃতকে বাংলা ভাষার জননী কি বলা যায়? কোনো রেফারেন্স দিতে পারেন? ধন্যবাদ।

কুটুমবাড়ি

রানা [অতিথি] এর ছবি

রাগিব ভাই ও কৌস্তভ ভাই,
আমার মনে হয় এত সহজে ণ এবং ষ উঠিয়ে দেওয়া যাবে না।
১। কারণ বাংলা ভাষায় এমন অনেক শব্দ রয়েছে যাদের অর্থের পার্থক্য কেবল মাত্র এই "ণ" কিংবা "ষ" দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই দু'টো অক্ষর তুলে দিলে ভাষার ব্যবহার অবশ্যয়ই সংকুচিত হবে। একটা উদাহরণ দেই। ধরা যাক, "ণ" বা "ন" কে এক করে "ন" করা হল। এখন আমি যদি বলি - "আমি পানি প্রার্থী।" আপনি কী বুঝবেন? আমি পানি পান করতে চাই, না কাউকে বিয়ের প্রস্তাব জানাতে চাই??
২। আবার স, শ , ষ এর ব্যবহারেও অনেক ভিন্নতা রয়েছে। যেমন, ধরেন, সব, শব। উদাহরণ দেই। "পাখি সব করে রব।" কিন্তু কেউ যদি লিখে, "পাখি শব করে রব।" কী হবে, এক্ষেত্রে? ভুল না শুদ্ধ?? "ক্ষ" এর ব্যাপারটা কুলদা রায় বলেছেন।
৩। আর স, শ, ষ এর ব্যাপারটা উচ্চারণের উপর খুব বেশি নির্ভর করে। ষ এবং শ এর উচ্চারণ যেমন এক, তেমনি স ও শ এর উচ্চারণ ও অসংখ্য স্থানে একই। সেক্ষেত্রে কী নিয়ম হবে? যেমন সোনা, শোনা। ভাষা। ভাসা। উচ্চারণ কিন্তু এক্ষেত্রে একই। আবার ধরেন। শোল। আর ষোল। একটি মাছ, আরেকটি সংখ্যা। আপনার কথা মত, দু'টোই শোল হবে। তাহলে আমি যখন শোল শব্দটি দেখব, তখন কী বুঝব? বাক্যতেই যে সব সময় শব্দ ব্যবহার হবে এবং তার ভাব দেখে অর্থ বুঝতে হবে তা কিন্তু নয়। যতদূর মনে পড়ে প্রাথমিক শ্রেণীতে শব্দার্থ লিখতে দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে শিশুরা ঝামেলায় পড়বে(যদি শোল অর্থ লিখতে দেয়?)। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার অফুরন্ত। এখানে সমার্থক এবং একই উচ্চারণের অসংখ্য শব্দ রয়েছে যা আলাদা আলাদা ভাবে চেনার জন্য ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধান জানা জরুরী।
৪। আর এই মুহূর্তে যদি ণ, ন, কিংবা ষ পরিবর্তন করা হয়, তাহলে বাংলা বানানে বিশাল এক গোলযোগের আশংকা রয়েছে। কারণ, আমি এই পঁচিশ বছর ধরে যে বানান শিখেছি, তা সহজেই বাদ দিতে পারব না। তেমনিভাবে সকল বই, সাহিত্য উপন্যাসে যে বানান রয়েছে তাও কি বাদ দিতে হবে?? নাকি সেগুলো আগের বানান রীতিতেই থাকবে? তাহলে শিশুরা যখন নতুন বানান শিখবে আর গল্প-উপন্যাসে অন্য বানান দেখবে তখন কী হবে? নতুন আর পুরনো বানান মিলে এক জগাখিচুড়ি অবস্থার সৃষ্টি হতে বাধ্য। আর ণ, ন, স, ষ, শ সমৃদ্ধ এই সুবিশাল শব্দ ভাণ্ডারের প্রতিটিকে নির্দিষ্ট বানানের আওতায় আনা কতটা শ্রম ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার তাও মনে রাখতে হবে। কারা এই কাজ করবে সেটাও দেখতে হবে।
৫। অনেকে বলেছেন, উচ্চারণে পার্থক্য নেই, তারপরও কেন কষ্ট করব? আমার মতে, মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে বলা, শেখা ও উচ্চারণের জন্য একটু কষ্ট করার দরকার আছে।কারণ মাতৃভাষা সবাই বলতে পারে, সেজন্য ণ-ত্ব, ষ-ত্ব বিধান কিংবা ব্যাকরণ লাগে না। কিন্তু শুদ্ধ উচ্চারণে সবাই বলতে ও শুদ্ধভাবে লিখতে পারে না। এজন্যই ব্যাকরণ পড়া আর এত নিয়ম। এটাকে অহেতুক ঝামেলা মনে না করে, একটু শ্রম দিলেই শেখাটা অনেক সহজ হবে আশা করি।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই রানা,
খুব ভালো বলেছেন। চমৎকার এই মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ জানবেন।

তবে ভাই দু-একটা কথা বলি। চটে যাবেন না আশা করি।

"ক্ষ" এর ব্যাপারটা কুলদা রায় বলেছেন।

কই না তো! ঠিকঠাক লক্ষ করেছেন কি? চিন্তিত

আমি এই পঁচিশ বছর ধরে যে বানান শিখেছি, তা সহজেই বাদ দিতে পারব না। তেমনিভাবে সকল বই, সাহিত্য উপন্যাসে যে বানান রয়েছে তাও কি বাদ দিতে হবে?? নাকি সেগুলো আগের বানান রীতিতেই থাকবে?

বাংলা এখনও চঞ্চলা পাহাড়ি নদীর মতো। উচ্ছ্বল, ঝলমল। নিত্যনতুন বাঁক নেবে সে, বস্তুত এই আচরণই তার কাছে কাম্য। যখন যে পরিবর্তন প্রয়োজন হবে তা সেরে ফেলতে কার্পণ্য করা ঠিক হবে না মনে হয়। এখন প্রত্যেকের ভাবনা যদি এমনটাই হয় তাহলে সংস্কার হবে কীভাবে? বাংলা বর্ণমালা, বানান থেকে শুরু করে বহু ক্ষেত্রেই যে সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান এবং ভবিষ্যতেও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে তাতে কি ভাই কোনো সন্দেহ আছে? হাসি

অবশ্য তার মানে এই না যে, বিচার-বিবেচনাহীন, নিজ নিজ স্বাধীনতামতো বানান ব্যবহার করতে হবে। কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন হলে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতেই করা উচিত বলে মনে করি। ধন্যবাদ।

কুটুমবাড়ি

কুলদা রায় এর ছবি

আমি এই নোট এবং মন্তব্য পড়ে আনন্দিত। কিন্তু সময় পাচ্ছি না। অনেক বিষয় শেয়ার করার ইচ্ছে। পারছি না বলে দুঃখিত।

ক্ষ শব্দটির অর্থ : বুৎপত্তি : ক্ষ = ক্ + ষ্ + অ।

ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ : দিশাগ্রস্থ চিন্তন, আধার।

কোনো কারণ (ক্) যদি পুনরাবৃত্ত হতে থাকে, তখন নিঃন্দেহে সে করণ দিশাগ্রস্থ শক্তি প্রয়োগে (ষ্) পরিণত হয়। আর, দিশাগ্রস্থ একটানা করণ মাত্রেই একধরনের গড্ডালিকা স্রোতের মত। তাই ক্ষ মানেই ক্ষয়ণ ও গোপন অর্থাৎ ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া বা করা ও গোপন করা। এই ক্ষয়ণ ক্রিয়াটির ভিতরে স্বভানতই আরও দিুটি ক্রিয়া শায়িত থাকে। এক--নিজ দেহ থেকে খানিকটা ত্যাগ করা; এবং দুই--অন্য অবয়ব থেকে একটু একটু করে কেটে নেওয়া। একে ক্ষ-করা বা খাবলে নেওয়া এবং ক্ষসানো বা খসানোরূপেও উল্লেখ করা চলে।

প্রতীকি অর্থ বা প্রচলিত অভিধানিক অর্থ : ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া, খসিয়া পড়া, ক্ষয় করা, নষ্ট করা।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

অতিথি লেখক এর ছবি

সময় নিয়ে শেয়ার করলে সত্যিই খুশি হব। বিশেষ করে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবেন সেই প্রত্যাশায় থাকলাম। ধন্যবাদ।

কুটুমবাড়ি

রানা [অতিথি] এর ছবি

কুটুমবাড়ি ভাই, ঐটা ভুলে হয়ে গেছে। আপনার নাম হবে। আশা করি মাইন্ড করেন নাই...
আর আমি যে পরিবর্তনের বিপক্ষে তা নয়। আমি আসলে জানতে চেয়েছি, এই নির্দিষ্ট টপিকে (ণ ষ শ) পরিবর্তন হলে এক্ষেত্রে কী সমাধান হবে। বিশেষ করে গল্প, উপন্যাস,কবিতায় যা ইতোমধ্যে রচিত হয়েছে। সেটা কেউ বলে দিলে ভাল হত।
ভাষা গতিশীল, তা পরিবর্তন হবেই। আপনার মতেই বলি -সেই পরিবর্তনটা বিচার-বিবেচনা করে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে, সময় নিয়ে করা উচিত। ধন্যবাদ, ভাল থাকবেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

ঠিকাছে ভাইয়া, ব্যাপার্না। হাসি

গত এক শ বছরে বানানের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তাই বলে শত বছরের পুরোনো সাহিত্য উপভোগেও কিন্তু অসুবিধে হয় না। ঠিক একইভাবে আগামী এক শ বছরেও অনেক পরিবর্তন হবে। আজ যে বানানে আমরা লিখছি তার অনেক কিছুই তখন অপাঙক্তেয় মনে হবে। যদিও এটা আদৌ কোনো সমস্যা নয় বলেই মনে হয় আমার কাছে। ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।

কুটুমবাড়ি

সিয়াম এর ছবি

অপরাহ্ণ কে অপরাহ্ন দেখাচ্ছে। সম্ভবত এটা ফন্টের সমস্যা। ব্যাকরণবিষয়ক লেখায় লেখক বানান ভুল করার কথা না।

কুটুমবাড়ি [অতিথি] এর ছবি

ঠিকই ধরেছেন, ফন্টের সমস্যার কারণেই এমনটা দেখাচ্ছে। অপরাহ্ণ বানানে হ-এর সাথে ণ যুক্ত হবে, আমিও তা-ই দিয়েছি, কিন্তু ইউনিকোডে বানানটা ঠিকঠাক আসছে না। কার্যত (হ+ন) = 'হ্ণ' হলেও ফন্টের সমস্যার কারণে এখানে (হ+ণ) চাপলেও সেই একই অক্ষর অর্থাৎ 'হ্ন' দেখাচ্ছে।

উত্তর দিতে দেরি হলো বলে দুঃখিত। আমার এখনও অ্যাকাউন্ট না হওয়ায় আপনার মন্তব্যটি চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। অন্য একটি লেখায় এই লিংকটি শেয়ার করতে গিয়ে চোখে পড়ল।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।