পূর্ণি হোটেল থেকে চা খেয়ে বের হলাম। দশটা বাজে রাত। পর পর তিনটা সিগারেট খেয়ে মাথা কেমন ঝিম ঝিম করছে। তিনটা সিগারেট কি খুব বেশি হয়ে গেল? বের হতে গিয়ে খেয়াল করলাম হাটু কাঁপছে। কি এলোমেলো অবস্হা! । তবে চিন্তা করতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। পরিস্কার ভাবেই চিন্তা করা যাচ্ছে।
আমার নাম টুকুন। আমার এই মূহুর্তে টিউশনি করে বাসায় ফিরবার কথা। এক মেয়ে কে পড়াচ্ছিলাম কিছুদিন যাবৎ । মেয়ে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। সেন্ট্রাল উইমেনস্ কলেজে। সাইন্সে। আমি ইলেক্ট্রিকাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইন্জিনিয়ারিং এ পড়লেও কোন এক অদ্ভুত কারণে আমার টিউশনির সাবজেক্ট গুলো হয় কেমিস্ট্র আর বায়োলজি। এর আগে যে টিউশনিটা ছিলো সেটার ও এই একই অবস্হা। শুধু সাথে ইংরেজী পড়াতে হতো। ঐটাতে অবশ্য বেশ টাকা পেতাম। মাস শেষে ৪০০০ টাকা ছাত্রীর মা মুঠো করে দিয়ে যেত। পড়িয়ে বের হবার সময় আমার মানিব্যাগ এর বুকটা কেমন গর্বে ফুলে থাকতো। পথে হেটে যাবার সময় দোকানের জিনিস গুলো দেখতে দেখতে যেতাম। টাকা না থাকলে যেসব জিনিস দেখলে খুব কিনতে ইচ্ছা হতো, হয়তো খুব গরমে হাফ লিটার 7up, সে সব জিনিস গুলো মনে করে কেমন হাস্যকর লাগতো।
আমার অবশ্য কেমিস্ট্রি বায়োলজি পড়াতে খারাপ লাগে না। ক্লাস টেন এ থাকতে সহপাঠিদের সাথে ভাব ধরতে ৫৪ টা পর্যন্ত পর্যায় সারণীর মৌল আর বেশ কিছু জিনিসের বৈজ্ঞানিক নাম মুখস্হ করে ফেলেছিলাম। কোন বিষয়ের মূল ব্যাপারটার চেয়ে তার মধ্যের কঠিন কঠিন শব্দ গুলোর প্রতিই আমার আগ্রহ বেশি ছিলো। পুরো ব্যাপারটাই আমি গ্রহন করতাম অস্ত্রের মতো। তর্কে জেতার অস্ত্র, মুগ্ধ করবার অস্ত্র। আমি লোহিত রক্তকণিকাকে পড়তাম ইরাইথ্রোসাইট। কেমিস্ট্রির একটা বিক্রিয়া ছিলো অ্যাসাইলেশন, সেটাকে আমি একটু স্টাইল করে বলতাম অ্যাজাইলেশন! এইটা নিয়ে অবশ্য আমার সাথে যারা সত্যিকার পড়ুয়া ছেলেপেলেরা ছিলো খানিকটা হাসি’র পাত্রও হয়ে ছিলাম। আর কাছের এক বন্ধু এগুলোর নাম দিয়েছিলো ‘অ্যাকুয়ারিয়াস দেখানো’! একবার তাকে আকাশে আমার রাশি অ্যাকুয়ারিয়াসের তারা গুলো দেখিয়েছিলাম। সে ব্যাপারটা কে পুরোই ভাওতাবাজি হিসেবে নিয়েছিলো। এবং এরপর থেকে আমার এইসব ব্যাপার দেখলেই তাকে ‘অ্যাকুয়ারিয়াস দেখানো’ বলতো।
বলছিলাম, চিন্তা করতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আসলে চিন্তা করতে দারুন সমস্যা হচ্ছে। এক কথা থেকে আরেক কথায় চলে আসছি। খেই থাকছে না।
কথা হচ্ছিল যে আমার টিউশনি থেকে ফিরবার কথা। আসলে কোন এক অদ্ভুত কারণে আমার টিউশনিটা চলে গেছে। আজ যে চলে গেছে তা না। বেশ কিছুদিন আগেই চলে গেছে। মাস শেষে ২০০০ টাকা নিয়ে এসে যখন ভাবছিলাম, এবার এই টিউশনিটা নিয়ে সিনসিয়ার হতে হবে, টিউশনি হচ্ছে দুধ দেয়া গাভীর মতো। তারপর দিনই ছাত্রীর ফোন পেলাম,
‘ভাইয়া, আমি একটা কোচিং এ ভর্তি হচ্ছি, আপনি আর আইসেন না।’
আমি সাধারনত টিউশনি থেকে মানা করে দেয়াতে অভ্যস্ত না। কারণ আমি তার আগেই ভেগে চলে আসি। আগে যে চার হাজারের টিউশনি’র কথাটা বলেছিলাম তারা দু’মাস পড় হঠাৎ বললো, ‘আপনি ইংলিশটা পড়ায়েন না। ইংলিশ এর জন্য আলাদা টিচার রাখা হচ্ছে। আপনি শুধু কেমিস্ট্র আর বায়ো টাই দেখেন’। বেশ ভালো কথা। কিন্তু এবার যখন মাস শেষে তারা ৪০০০ টাকার বদলে ২০০০ টাকা দিলো ঐ চার হাজারের স্হানে দু’হাজার কে কেমন মিডলক্লাস মিডলক্লাস লাগলো। ‘মিডলক্লাস’ শব্দটা ‘থার্ড ক্লাস’ এর চেয়েও খারাপ গালি। যদিও ২০০০ টাকা খুব কম ছিলো না কিন্তু আমি আর পড়াতে গেলাম না। এরকম একবার না, বহুবার হয়েছে। বেশির ভাগ সময় আধ বা পৌণে মাস পড়িয়ে বেতন না নিয়েই চলে এসেছি। প্রথম কিছুদিন ছাত্র-ছাত্রীকে জ্ঞানী বানিয়ে দিচ্ছি ভেবে আত্মপ্রসাদ পেলেও কিছুদিন পরই আর ব্যাপারটা থাকতো না। জ্ঞান বিক্রি একটা যন্ত্রনামূলক ব্যাপার। পড়াতে গেলে হতে হয় ‘সিরিয়াল কিলারের’ মতো। সেখানে আমি একেবারেই সৌখিন পাখি শিকারী। আবার বেশ কিছুদিন পরই যখন পকেটে টান পড়েছে হন্যে হয়ে আরেকটা টিউশনি খুঁজেছি আর ভেবেছি কি গাধামীটাই না করছি আগেরটা ছেড়ে।
এবার ভেবেছিলাম ঠিকমতো পড়াবো। যেটাকে বলে
‘সারা মাস গাই দুইয়ে,
দুধ খাবো চুইয়ে’।
কথাটা কেমন অশ্লীল হয়ে গেল।
তবু আজ যখন সন্ধ্যা বেলা যখন বাইরে যাচ্ছিলাম, আব্বুকে বলে বের হলাম ‘পড়াতে যাচ্ছি’। সন্ধ্যায় বের হতে হলে যে পড়াতে যাচ্ছি বলেই বের হতে হবে এমন না। তবু বের হবার সময় আব্বু যখন জিজ্ঞেস করলো, ইচ্ছে করেই মিথ্যে কথাটা বললাম।
টিউশনি নাই। এটা নিয়ে আমি খুব একটা চিন্তিত নই। টিউশনি আসবে, টিউশনি যাবে। সত্যি কথা বলতে আগামীকাল আরেকটা পড়াতে যাওয়া’র চাকরিতে জয়েন করার কথা।
ব্যাপারটা নিয়ে আমি বেশ কৌতুহলী। কৌতুহলে’র ব্যাপার অবশ্য ছাত্র না।
ছাত্রের বোন।
বাঁধন।
মন্তব্য
স্টুডেন্ট লাইফ এর কথা মনে পড়ে গেল। টিউশনি আসা যাওয়া...হাহাহাহা...
ইলেকট্রিক্যাল এর স্টুডেন্ট? কোথায় পড়েন? বুয়েট?
নাহ...এ আই উ বি তে পড়ছি। নিজেরই এইসব ছাইপাশ লেখা দেখে মনে আজকাল আসলেই চিন্তা ভাবনা'র কোন ঢাইস নাই। তবু পড়েছেন । আমার লেখা'র প্রথম কমেন্ট হিসেবে অনুপ্রাণিত হয়ে রইলাম
টিউশনি পাইবার চেয়ে টিউশনি রক্ষা করা কঠিন।
অইত্যান্ত সইত্য কথা :-/
নতুন মন্তব্য করুন