গতকাল (১৪ অক্টো ০৯) রাতে বসে বসে সচলায়তনে বিচরণসহ অন্যান্য কিছু কাজের ও আকাজের ওয়েবসাইটে ঘোরাঘুরি করছিলাম। হঠাৎ রাত ৯ টার দিকে শুনি খুব কাছে কোথাও মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। তারপর শব্দ পেলাম আমার বাসার ভিতরের ৬ জন হাউজ গার্ড আর গেটের বাইরে অবস্থানরত ৬ জন স্পেশাল প্রোটেকশন ইউনিটের কমান্ডোর একে ৪৭ কাক করার শব্দ। আমি একটা সলিড প্রোটেকশনের আড়ালে দাড়িয়ে বাইরে কি হচ্ছে তা দেখার চেষ্টা ...গতকাল (১৪ অক্টো ০৯) রাতে বসে বসে সচলায়তনে বিচরণসহ অন্যান্য কিছু কাজের ও আকাজের ওয়েবসাইটে ঘোরাঘুরি করছিলাম। হঠাৎ রাত ৯ টার দিকে শুনি খুব কাছে কোথাও মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। তারপর শব্দ পেলাম আমার বাসার ভিতরের ৬ জন হাউজ গার্ড আর গেটের বাইরে অবস্থানরত ৬ জন স্পেশাল প্রোটেকশন ইউনিটের কমান্ডোর একে ৪৭ কাক করার শব্দ। আমি একটা সলিড প্রোটেকশনের আড়ালে দাড়িয়ে বাইরে কি হচ্ছে তা দেখার চেষ্টা করছিলাম। বাইরে অন্ধকার, তার উপরে গুলি শুরু হতেই হাউজ গার্ডরা স্পট লাইট অফ করে দিয়েছে। শুধু দৌড়াদৌড়ি, হুড়োহুড়ির শব্দই পেলাম। এর মধ্যে আমার একজন কমান্ডো আবার গুলি চালালো শব্দের দিকে। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। প্রথমে গুলি শুরু হতেই সিকিউরিটি অফিসারকে একটা টেক্সট করেছিলাম। একটু পরে গোলাগুলি থেমে গেলে ও কল দিলো আমাকে। জানালো যে আমাদের কম্পাউন্ডের সামনের একটা বাড়ি পরে সশস্ত্র চোর এসেছিলো। টের পেয়ে বাড়িওয়ালা ভিতর থেকে ফায়ার ওপেন করলে চোরও এলোপাতাড়ি ফায়ার ব্যাক করতে করতে পালিয়ে যায়। এইরকম একটা গোলমালের ভিতরে আমাদের একজন কমান্ডোও ফায়ার করে বসে। এরপর গার্ড লিডার এসে একই সংবাদ দিয়ে চলে গেলো। আমি আবার ল্যাপটপে মনোনিবেশ করলাম এবং রাত প্রায় দুটোর দিকে ঘুমাতে গেলাম।
ভোররাতে মোবাইলের রিংএর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কলার আমাদের স্থানীয় হেড অফিসের সিকিউরিটি অফিসার, একজন রিটায়ার্ড কর্ণেল। সে জানালো ভয়ংকর সংবাদটা, গতরাতে ফ্রানস বারনার্ড কিডন্যাপড হয়েছে একজন সোমালি দোভাষীসহ। হতবাক হয়ে গেলাম।
ফ্রানসকে আমি তার নাম এবং কাজের সুবাদে অনেক বছর ধরে চিনি যদিও নিশ্চিত না কখনও সাক্ষাত হয়েছে কিনা। হলে হয়তো ইন্দোনেশিয়ায় হতে পারে তবে আমি নিশ্চিত মনে করতে পারছিনা। সেই হিসেবে নাম ও কাজের সাথে বহুল পরিচিত সেই ফ্রানসের সাথে পরিচয় হলো গতবছর কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে। সে তখন আমাদের সংস্থার রিজিওনাল সিকিউরিটি এ্যাডভাইসর। ফ্রানস আমাকে সিকিউরিটি ব্রিফিং দিলো। কয়েকদিন পর কেনিয়ার এক জঙ্গলে গেলাম সিকিউরিটি ট্রেনিং করতে, ফ্রানস সেখানেও গেলো আমাদের ট্রেনিং করাতে। এরপর থেকে পেশাগত কারণে তার সাথে দৈনন্দিন যোগাযোগ যার থেকে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে লাগলো। এবছরের গোড়ার দিকে ফ্রানস আমাদের সংস্থা ছেড়ে আমাদের হোষ্টেড অন্য সংস্থায় চলে গেলো। আর গতমাসে সেটা ছেড়ে স্বাধীন পরামর্শকের কাজ শুরু করলো। এখন কাজ করছিলো ইউকে ভিত্তিক একটা আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে।
ফ্রানস প্রথম জীবনে তার দেশের সেনাবাহিনীর এলিট ফোর্সের একজন কর্মকর্তা ছিলো। ওই চাকরির শেষে সে কাজ করার জন্যে বেছে নিলো বেসরকারি উন্নয়ন সেক্টর বা এনজিও। অত্যন্ত সাহসী ফ্রানস সবসময়ে বড় ঝুঁকিগুলো নিজেই নিয়েছে। চলে গেছে তালিবানদের একদম ঘাঁটিতে, বসেছে তালিবান নেতৃত্বের সাথে। চলে গেছে ইন্দোনেশিয়ার বান্দা আচেহ প্রদেশের গ্যাম (গোরকানা আচেহ মারদেকা বা আচেহ ফ্রিডম মুভমেন্ট) গোরিলাদের আস্তানায়, বসেছে আলোচনায়। চেচনিয়ায় চেচেন বিদ্রোহীদের সাথে কথা বলেছে বারবার এবং সেখানে কাজ করেছে কয়েকটা বছর। এখন ফ্রানস চেষ্টা করছিলো সোমালিয়ার বিভিন্ন উগ্র মৌলবাদী দলগুলোর সাথে আলোচনার। তার এইসব আলোচনা বা বসাবসির উদ্যেশ্য ছিলো একটাই, এনজিওগুলোর জন্যে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করা। তার এই কাজের সুফল অন্ততঃ ব্যাক্তিগতভাবে আমি ভোগ করেছি ইন্দোনেশিয়ায় কাজ করতে গিয়ে। বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার কাজটা সবসময় ফ্রানসকেই করতে হয়।
গতকাল রাত ১০ টায় ফ্রানস সোমালিয়ার সাউথসেন্ট্রাল রিজিওনের একটা ছোট্ট ষ্টেট ‘হিমান এন্ড হিব’ (পাহাড় ও সাগর) এর রাজধানী আডাডোতে তাদের সংস্থার গেষ্ট হাউসে থাকছিলো। সারাদিন বেশ কয়েকটা জঙ্গীদলের সাথে মিটিং করে একটু ক্লান্তও ছিলো। এসময়ে ২০ জনের মতো একটা সশস্ত্র দল এসে তাকে আর তার দোভাষীকে তুলে নিয়ে অজ্ঞাত জায়গায় চলে যায়। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে ফ্রানসের সাথেও সশস্ত্র সৈন্য ছিলো এবং গেষ্টহাউজটাও দেয়াল এবং বড় লোহার গেটওয়ালা। একটা গুলিও হলোনা একটু প্রতিরোধও হলোনা। প্রত্যক্ষদর্শী বলেছে যে তারা এসে ফ্রানসকে তার রুম থেকে ধরে রাইফেল দিয়ে পিটাতে পিটাতে নিয়ে চলে যায় আর ফ্রানসের সৈনিকেরা তা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। জানা গেছে যে ওকে কিডন্যাপ করেছে সোমালিয়ার সাম্প্রতিক কালের আতংক আল-শাবাব। আল কায়েদার সোমালি শাখা। এইমাত্র একটা ফোনকল থেকে অসমর্থিত সূত্রের খবর পেলাম যে আল-শাবার ফ্রানসের দোভাষীকে ছেড়ে দিয়েছে আর ফ্রানসকে নিয়ে জলদস্যুদের সাথে দরকষাকষি করছে। ভালো দাম পেলে ফ্রানসকে জলদস্যুদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। আর তারপর জলদস্যুরা মুক্তিপণ চেয়ে পরের অধ্যায় শুরু করবে।
সোমালিয়া ১৯৯১ সালে পতনের পর থেকে এখনই সবথেকে খারাপ সময় অতিক্রম করছে। চরমপন্থী আল-শাবাব আর হিজবুল ইসলাম আর সুফি আহলে সুন্নাহ ওয়াল-জামেয়া সম্প্রদায় প্রায় সর্বত্রই বিস্তার লাভ করেছে। যদিও এদের মাঝে আহলে সুন্নাহ সাধারণের জন্যে অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় কিন্তু শাবাব বা হিজবুলের জন্যে আজরাইলতূল্য। ধারণা করা কঠিন যে সামনে কি দিন আসছে। প্রার্থনা করি ফ্রানস যেনো ভালোভাবে সুস্থ্যভাবে আমাদের মাঝে ফিরে আসে।
ছবিঃ ফানসের ফেসবুকের বর্তমান প্রোফাইল ফটো।
মন্তব্য
মন্দের মধ্যেও একটুকরো আশাজাগানো সংবাদ এই যে লেখার মধ্যে যে অসমর্থিত সূত্রের সংবাদ দিয়েছিলাম, সেটা সঠিক সংবাদ না। সঠিক হচ্ছে ফ্রানস এখনও আল-শাবাবের হাতে পড়েনি। সে এখনও অপহরণকারী ক্লান মিলিশিয়াদের কাছেই আছে।
রাতঃস্মরণীয়
দুঃখজনক। কিন্তু ফ্রানসের রক্ষীরা কোনো প্রতিরোধ করল না কেন? তারা কি টাকা খেয়েছে জঙ্গিদের থেকে?
আপনার লেখা পেয়ে ভাল লাগল। এমন জায়গায় থাকেন, অনেকদিন সচলে না দেখলে চিন্তা হয়, যে আবার কিছু গণ্ডগোল হল কি না।
ধন্যবাদ কৌস্তভ ভাই। আমার মনে হয় টাকা খাওয়াখায়ি এখানে হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শী বলছে যে অপহরণকারীরা এতটাই আচমকা ঢুকে পড়ে যে কেউই তাদের প্রতিরোধ করতে পারেনি। তৈরী হওয়ার আগেই কুপোকাৎ। তারা মেশিনগান আর টেকনিক্যাল ভেহিকলস নিয়ে এসেছিলো। ফ্রানসের সৈনিকদের ধুলোর মতো উড়িয়ে দিতে পারতো। তবে ঘটনার জট একটু একটু করে খুলছে।
আপনি হয়তো জেনে থাকবেন যে সোমালিয়ার সমাজব্যবস্থা গোত্রভিত্তিক বা ক্লান-বেইজড। শান্তিপ্রিয় সূফী সম্প্রদায় আহলে সুন্নাহ ওয়াল-জামেয়া সামরিকভাবে ভিষন শক্তিশালী। তারা বিশাল একটা এলাকা নিয়ন্ত্রন করে। তাদের নিয়ন্ত্রিত বিশাল এলাকার মাঝখানে ছোট্ট একটা বৃত্তের মতো ষ্টেট হিমান এন্ড হিব। তাদের প্রেসিডেন্ট আছে-সরকার আছে। এই হিমান এন্ড হিব ষ্টেটে মুলতঃ দুটো ক্লানের আধিক্য দেখা যায়। এরা আহলে সুন্নাহকে দেখতে না পারলেও কিছু বলতে সাহস পায়না। আর আহলে সুন্নাহ ইচ্ছে করলে হিমান এন্ড হিব দখল করতে পারে আধা ঘন্টায় (গতকাল ১৫ অক্টো ০৯ সকালে রক্তপাতবিহীন যুদ্ধে দখল করেছিলো আবার বিকেলে ছেড়ে দিয়েছে) কিন্তু করেনা কারণ সরকারবিহীন দেশের অন্তবর্তীকালীন সরকার (ট্রানজিশনাল ফেডারেল গভর্ণমেন্ট বা টিএফজি) হিমান এন্ড হিবের সরকারকে সমর্থন দেয় এবং আহলে সুন্না একমাত্র ইসলামি দল যাদের সাথে টিএফজির লাভ এন্ড হেইট সম্পর্ক আছে।
কাহিনী হচ্ছে অপহরণের দিন ফ্রানস আহলে সুন্নাহর কয়েকটা এলাকার নেতৃবৃন্দের সাথে মিটিং করেছিলো। এতে করে হিমান এন্ড হিবের ক্লানগুলো ফ্রানসের উপর সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ে। এর ফলেই সম্ভবতঃ এই অপহরণ। আহলে সুন্নাহও বিষয়টা সহজভাবে না নিয়ে হিমান এন্ড হিব দখল করে ফেলে কিছু ক্লান এলডারকে আচ্ছামত প্যাঁদানি দিয়েছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ফ্রানসকে পাওয়া যায়নি। পরে আবার দখল ছেড়ে দিয়েছে।
তবে এখন ফ্রানসের অবস্থান পরিষ্কার। দেখা যাক হয়। ফ্রানস খুবই একজন পরোপকারী মানুষ।
রাতঃস্মরণীয়
সোমালিয়ার গোষ্ঠীভিত্তিক ক্ষমতার সমীকরণ সম্বন্ধে কিছু জানতাম না, তাই আপনার লেখার শেষ প্যারাটাও ভাল বুঝি নি তখন। এই ব্যাখ্যাটা পড়ে বুঝলাম।
ভয়ংকর। কামনা করছি উনি ভালই থাকবেন এবং ফিরে আসবেন।
ধন্যবাদ প্রকৃতিপ্রেমিক ভাই, আমরা অপেক্ষা করছি।
রাতঃস্মরণীয়
কী ভয়ংকর! আশা করছি ফ্রানস সুস্থভাবে ফিরে আসবেন।
নতুন মন্তব্য করুন