ছেলেবেলায় একটা অদ্ভুত খেলার সাথী ছিল আমার। লাবু পাগলি।
লাবু পাগলি চেঁচাতো না, লাফাতো না। মানুষ দেখলে তেড়ে যেত না। শুধু কেমন কেমন করে যেন হাঁটতো, কেমন কেমন করে যেন কথা বলতো। আর খালি হাসতো। পাগল তো, তাই।
খুব ছোটবেলার কথা তো, ভাল করে কিছু মনেও নেই। শুধু মনে পড়ে, লাবু পাগলি আমার পুতুলের শাড়িটা পরিয়ে দিত, নারকেল পাতা দিয়ে চশমা বানিয়ে দিত। আর আমার অসুখ হলে মুখের উপর উবু হয়ে মাথায় ইলিবিলি কেটে বলত, বাবুমণি কষ্ট পায়, বাবুমণি কষ্ট পায়।
আমি ধাক্কা মেরে বলতাম, সর পাগলি, তোর মুখ থেকে লুল পড়ে।
মা বলেছিল, ওকে দিদি ডাকতে। আমি ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলাম, ডাকবো না। ও হলো পাগলি। পাগলি পাগলি পাগলি। ছোট হলে কি হবে, এসব আমি খুব বুঝতাম।
আরেকটা জিনিস বুঝতাম। পাগলেরা কখনো ব্যথা পায় না। পাবে কেন? পাগলরা কি মানুষ? তাইতো লাবু পাগলিকে ঢেলা ছুড়লে কাঁদতো না। গায়ে থুথু ছিটালে রাগতো না। মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকতো।
একদিন আস্ত একটা থান ইট নিয়ে ওর মাথায় বাড়ি বসিয়ে দিলাম। এম্নি এম্নি দিলাম।
জানতাম ও কাঁদবে না। ঠিক তাই। লাবু পাগলি কাঁদল না। শুধু ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। আমি বললাম, যথেষ্ট ভান করেছিস। এবার ওঠ।
লাবু উঠল না।
ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম সেদিন। দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলাম। মরে গেছে লাবু। এবার পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। আমার জেল হবে, আমার ফাঁসি হবে।
সারাদিন আমি ভাত খেলাম না, ঘুমালাম না। গো ধরলাম, আমাকে আজই মামাবাড়ি দিয়ে আস। নইলে আমি ইস্কুলেও যাব না। মা বলল, এ তো ভালো যন্ত্রণা।
দিন আটেক বাদে মামাবাড়ি থেকে ফিরলাম। তদ্দিনে পুলিশ আমার কথা ভুলে গেছে।
তারপর লাবু পাগলিকে আর দেখিনি। শুধু বিকেলে আমরা যখন চোর-পলানতিস খেলতাম, তখন মাঝে মাঝে দূর থেকে লাবু পাগলির ভূত আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইত। দেখে বড় মায়া হত আমার। আহারে, বেচারি মরে গেছে বলে এখন খেলতেও পারে না আমাদের সাথে।
তারপর একদিন বাবা ঢাকায় বদলি হয়ে আসে। সাথে আমরাও। লাবু পাগলির ভূতের কি হলো আমি আর জানি না।
২.
বহুদিন বাদে ভার্সিটির কয়েকজন বন্ধু নিয়ে এ শহরটায় আমি বেড়াতে আসি। বেড়াবো আর কোথায়? এই নিরেট মফস্বলে তামাশা দেখবার মত কিছুই নেই। বিরক্ত হয়ে বিকেলেই বন্ধুরা ঢাকার ট্রেন ধরে। আমি থেকে যাই একদিনের জন্যে।
কত না প্রিয়মুখের সাথে দেখা হল এদ্দিন পর। অরু আপা, নগেন স্যার, আদুভাই কামরুল।
পরদিন ফিরে আসি ঢাকায়। বেশ আরামেই আসি।
আসার পথে অবশ্য ছোট্ট একটা ঝামেলা হয়।
আমাদের বাসটা রাস্তার এক পাগলিকে পিষে মেরে ফেলে।
সাত্যকি
মন্তব্য
বেশ মন খারাপ করা গল্প। পাগলদের প্রতি অমানবিক আচরণ করতে দেখলে বেশ খারাপ লাগে। লেখা ভালো লেগেছে।
সজল
প্রথম গল্প তো। অত ভাল করে কিছু বোঝাতে পারিনি । আসলে "A beautiful mind" দেখার পর মনটা অনেক খারাপ হয়ে ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, নিজে একবার পাগল হয়ে যদি ওদের জগৎটা দেখতে পেতাম !
হয়তো লাবুদি পাগল ছিল না। হয়তো ও সিজোফ্রেনিক ছিল। কিংবা অটিস্টিক।
আমাদের কাছে এরা সবাই পাগল। এবং অবাঞ্ছিত।
মন্তব্যের জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ সজল ভাই।
:|
:|
ভাল লাগলো আপনার লেখা। আসলে আমাদের সমাজই আমাদের শেখায় - পাগলরা মানুষ না; যেটা সত্যিকারের একটা মিথ্যা কথা, অন্যায় কথা।
ভাল থাকুন আর লিখতে থাকুন।
অনন্ত আত্মা
ঠিক এই কথাটাই আমি ভাবছিলাম।
বেশ মনে পড়ে, ছেলেবেলায় পাশের বাসার এক প্রতিবন্ধী মেয়েকে সুযোগ পেলেই ভেঙচি কাটতাম। একদিন বাবা দেখতে পেয়ে শক্ত ধমক লাগান।
এখন বড় হয়ে ভাবি, এমন কেন করতাম তখন ? কেউ তো শিখিয়ে দেয়নি।
শিশুরা কি সহজাত নিষ্ঠুরতা নিয়ে জন্মায় ?
উৎসাহ দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ অনন্ত আত্মা ।
সাত্যকি
সাত্যকি, বেশ তীব্র আপনার এই লেখাটা।ভালো লাগলো খুব। প্রমিথিয়ুস
ভাই প্রমিথিউস, ছেলেবেলায় সত্যি সত্যি এক পাগলকে আমি আঘাত করেছিলাম। সেটাই একটু এদিক ওদিক করে লিখে দিয়েছি এখানে।
আমার আঘাতে না মরলেও হয়তো এমনি কোন বাস চাপায় সে একদিন মরে যাবে। কিংবা হয়তো গেছে।
আমরা কোনদিন সেকথা জানবোও না।
সাত্যকি
আপনার ভাবনাটা ভালো। আরও লিখুন।
-মাইনুল এইচ সিরাজী
সবার ভালো লাগাতেই আমার ভালোলাগা। ধন্যবাদ মাইনুল ভাই। লিখার চেষ্টা করব।
সাত্যকি
অন্যরকম।মন ছুঁয়ে গেল।
লেখা চালিয়ে যান।ভাল থাকুন।।
ভীষণ ভালো লাগলো আপনার এই কথাটায়।
চাইলে কি যায় হৃদয়টাকে
সত্যি করে ছোঁয়া !
সাত্যকি
চমৎকার।
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
একজন পূর্ণ সচলিয়ানের কম্পলিমেন্ট পাওয়াটাও আনন্দের। অনেক ধন্যবাদ।
সাত্যকি
এই কথাটা ঠিক বুঝলাম না। পূর্ণ সচলের কম্পলিমেন্ট পাওয়ার সাথে হাচল বা অতিথির দেওয়া কম্পলিমেন্টের কি কোনো তফাত আছে?
না ভাই, একটুও না। আমারই ভুল ।
:|
অনুগল্প ভাল লেগেছে।
আরও চাই।
অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা বাউলিয়ানা।
দেখি মাথা খুঁড়ে আরো কিছু বের করা যায় কিনা !
সাত্যকি
ছোটদের ইনসেন্সিটিভিটি'র ব্যাপারটা সুন্দরভাবে লিখেছেন। ভাল লাগল।
ভাই কৌস্তুভ, আমরা সবাই হয়তো ইন্সেন্সিটিভ।
পার্থক্য হল, বড়রা ইন্সেন্সিটিভিটা লুকিয়ে রাখার কায়দা জানে, ছোটরা জানে না।
সাত্যকি
মেনি থ্যাঙ্কস দাদা
সাত্যকি
সহজ, সুন্দর, চমৎকার লেখা। আপনি পেরেছেন, আমি পারিনা কেন?
পৃথিবীর সকল প্রতিবন্ধীর জন্য সমবেদনা।
সাফায়েত
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
------------------------------------------------------------------------------------
তোমায় দেখলে ইচ্ছে করে শুরু থেকে শুরু করি আবার জীবন...........
সুদূর মেলবোর্নবাসী ভাইয়াকে হৃদয় থেকে কৃতজ্ঞতা।
আজকে এক আন্টি তার পিচ্চি মেয়েকে দেখিয়ে বলছিল, দেখ বাবা, আমার মেয়েটা না একটু বোকাসোকা।
এই কথাটা বলতে গিয়ে তার বুকটা কি একেবারে ভেঙে যায় নি?
আমিই তো থ হয়ে গিয়েছিলাম। কি বলব তাকে উত্তরে ?
সাত্যকি
ব্যাপার কি! আজকে সবই যা পড়ছি সবই মন খারাপ করে দিচ্ছে। খুব ভাল লাগল।
অনন্ত
অনন্ত ভালোবাসা অনন্তদাকে।
মন একটু খারাপ হলোই বা। ওদের কষ্ট কি আর আমরা বুঝব ?
সাত্যকি
নতুন মন্তব্য করুন