জহিরুল ইসলাম নাদিম
বাবাকে তখন খুব একটা বুঝতাম না আমি।
এখনো যে খুব বুঝি তাও নয়। আসলে বাবা আমার কাছে সব সময়ই এক চির রহস্যের মানুষ। এত কাছের হয়েও কেমন দূরের! অনেকটা চাঁদের মতো! আদ্যিকালের ওই চাঁদটির সাথে সব মানুষের কী নিবিঢ় সৌর্হাদ্যের সম্পর্ক অথচ ছুঁতে গেলেই কেমন পর পর লাগে। যদি ছয় বছর বয়স থেকে বাবাকে ঠিকমতো দেখে এসে থাকি তবে প্রায় চোদ্দ বছর হলো বাবার কাছাকাছি আছি। এই চোদ্দ বছরের পরিচিত বাবাও আমার কাছে অপরিচিত!
প্রায় বিকেলে বাবা আমাকে নিয়ে বেড়াতে বেরুতেন। যাওয়ার ঠিক আগে আগে আমাকে বলতেন, 'শহীদ! যাবি আমার সাথে?', খুবই আস্তে আর মিষ্টি করে বলতেন কথাটা। বাবা কখনোই আদেশের সুরে কথা বলতেন না। বলতেন না, 'শহীদ যা -কাপড় বদলে আয় -বেড়াতে যাবো'-এই জিনিসটা আমার খুব ভালো লাগত। ছোট 'আমি'র মতামতও বাবার কাছে দামি ছিল! আমি যেতাম বাবার সাথে। বাবা আমাকে নিয়ে হেঁটে বেড়াতেন। হাঁটতে হাঁটতে আমি একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। বাবা ক্লান্ত হতেন না-বাবারা ক্লান্ত হন না। তখন বাবা আমাকে তাঁর কাঁধে উঠিয়ে নিতেন। আমার বয়েসী ছেলেদের তখন কোলে ওঠা নিষেধ কিন্তু কাঁধে উঠতে অসুবিধে ছিল না। বাবার কাঁধের ওপর আমি কেমন বাতাস কেটে কেটে এগুচ্ছি যেন উড়ে যাচ্ছি- বড় ভালো লাগত আমার। বেশির ভাগ দিন আমাদের গন্তব্য ছিল শহীদ মিনার। বাবা শহীদ মিনারে গিয়ে জুতো খুলে ফেলতেন। দেখাদেখি আমিও। সিঁড়ি বেয়ে মাঝামাঝি একটা সোপানে বসে পড়তেন। তারপর কেমন করে যেন তাকাতেন। হয়তো শূণ্য দৃষ্টিতে। তখন বাবা আমার কাছে অচেনা হয়ে যেতেন। বাবা মাঝেমাঝে বেশ অদ্ভুত কথা শোনাতেন আমাকে। শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলো দেখে একদিন আমি বলেছিলাম, 'ওগুলো কী বাবা?' বাবা তখন বললেন,' ওই যে মাঝখানেরটা দেখছিস সোজা উঠে কেমন বেঁকে গেছে -ওটা আমাদের মা। আর সামনের চারটি হলো তার সন্তান। সন্তানদেরকে মা বুকে করে আগলে রেখেছে। দেখছিস না কেমন ঝুঁকে আছে!' কী আশ্চর্যের কথা শহীদ মিনারে মা আবার ছেলে! আমি অবাক হয়ে যেতাম। শহীদ মিনারের প্রতি বাবার কেমন একটা টান ছিল। হয়তো শুধু টান নয় তার চেয়ে বেশি কিছু ছিল। বাবার কাঁধে সওয়ার হয়ে কতবার যে আমি ওখানে গেছি তা গুণে শেষ করতে পারবো না।
আস্তে আস্তে শহীদ মিনারের প্রতি আমার নিজেরও কেমন একটা ভালোবাসা জন্মে গেল। খুব আপন জায়গা মনে হোতো ওটাকে। এখনো সে ভালোবাসায় এতটুকু ঘাটতি পড়েনি। বরিশালে যখন প্রথম আসি লঞ্চঘাট থেকে রিকশায় করে যাচ্ছি হঠাৎ চোখে পড়ল হাইস্কুলের মাঠের মধ্যে বেশ বড়সড় একটা শহীদ মিনার। আলোড়িত হলাম। আরেকটু এগুতেই বিস্মিত হয়ে গেলাম। বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘেঁষে তখন এগুচ্ছি। একদম আসলটার মতো। খুব খুশী লেগেছিল তখন। অপরিচিত স্থানে আপন জনের দেখা পেলে যেমন লাগে। খুশী হয়ে বলেছিলাম, 'এটা শহীদ মিনারের শহর নাকি!'
শহীদ মিনারের প্রতি বাবার যে গভীর মমতার একটা ব্যাপার ছিল তা আমি বুঝতে পারি একটা ঘটনা থেকে। বাবার সাথে একবার জাদুঘরে গেছি। হঠাৎ দেখি একটা জিনিসের ওপর বাবা ঝুঁকে আছেন। আর তাঁর হাত দিয়ে ওই জিনিসটাকে আদর করে দিচ্ছেন। আমাকে ডেকে বাবা বললেন, ‘শহীদ দেখ এটা আমাদের প্রথম শহীদ মিনার। আমাদের চেতনার উৎস। ওরা ভেবেছিল এটাকে গুড়িয়ে দিলেই আমরা স্বাধীনতার দাবী থেকে পিছিয়ে আসবো। শহীদ মিনারটিকে বহির্জনিষ্ণু মনে করেছিল ওরা। ওরা...’ কথাগুলো বলতে বলতে বাবার কন্ঠ কেঁপে যাচ্ছিল প্রচন্ড আবেগে। এতো আবেগ উনি কোত্থেকে পান! আমি দেখেছিলাম একটা ভাঙ্গা সুড়কির স্তম্ভে বাবা কীভাবে মমতার হাত বুলালেন। এখনকার আমি তখন হলে ওই স্তম্ভটার হয়তো ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠতাম। আমার আদরে ভাগ বসাবার জন্য! তখনকার ওসব কথা তখন আমি বুঝতাম না। এখন বুঝি। আসলেই শহীদ মিনার কোনো বহির্জনিষ্ণু ব্যাপার ছিল না যে টান দিলেই উপড়ে আসবে। পঁচিশ এর রাতে ওরা যখন শহীদ মিনার গুড়িয়ে দিল খবরটা জানার পর সবার শিরায় শিরায় লক্ষ শহীদ মিনার গজিয়ে গিয়েছিল। ওই অন্তর্জনিষ্ণু মিনারের কাছাকাছি ওরা পৌঁছুতে পারেনি। পারা সম্ভব ছিল না।
সবচে মজার ব্যাপার হলো বাবা কখনো একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে যেতেন না। বাঙালী জাতি সৌভাগ্যবান যে তারা শহীদ দিবসের মতো একটি দিন পেয়েছে। কিন্তু সেই অপরিসীম চেতনার উৎসটিকে মানুষ যখন উৎসবের গেরোতে বেঁধে ফেলছে –ছোট করে ফেলছে – বাবা এটাকে সহ্য করতে পারতেন না। এর প্রতিবাদই হয়তো ছিল ওই দিনটায় মিনারে না যাওয়া।
বাবা খুব করে চাইতেন শহীদ দিবসের চেতনা আমার মনে প্রাণে লেপ্টে থাকুক। আমাকে নিয়ে বার বার শহীদ মিনারে যেতেন – হয়তো এটা তাঁর পরিকল্পনার অংশ ছিল। আমি জানতে চেয়েছিলাম, ‘বাবা তুমি এতো বেশি বেশি এখানে আসো কেন?’ বাবা জবাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘মায়ের কাছে সন্তানেরা বারে বারে আসবে না কী বলিস! আমরা এখন শহীদ মিনারে আছি ভাবছিস কেন? ভাব আমরা মায়ের কোলে বসে আছি। চির ধ্রুব এক মায়ের কোলে। যে মা একজন পিতার মা আবার তার সন্তানেরও মা!’
কথাগুলো আমার মনে ধরেছিল খুব। কী সুন্দর উপমা! মায়ের কোল। বাবা এরপর বলেছিলেন, ‘যখনই তোর কোন কারণে মন টন খারাপ লাগবে এখানে চলে আসিস। দেখবি সব দুঃখ গুলো কেমন স্নিগ্ধ স্নিগ্ধ লাগছে। বাবার এই কথাটিকে আমি কাজে লাগাই। মাঝে মাঝে কী যে হয় আমার। উদভ্রান্তের মতো পথে বেরিয়ে পড়ি। কোন কিছু খেয়ালে আসে না। যখন আসে তখন দেখি শহীদ মিনারে বসে আছি। বন্ধুরা এই নিয়ে ঠাট্টা করতেও ছাড়ে না। বলে, ‘শহীদ তোর নামের শেষে একটা মিনার যোগ করে নিস। অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হবে!’ আমার নামটাও বাবার পরিকল্পনার একটা অংশ বলে আমার মনে হয়। শহীদুজ্জামান শহীদ। আমাকে স্থায়ী ভাবে একুশের চেতনায় বেঁধে ফেলতে এই নাম হয়তো সহায়ক হবে – বাবা ভেবেছিলেন। বাবা বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন। বাবার একটি কথা আমার মনে প্রায়ই বেজে চলে। শেষ হলে আবার রিউইন্ড হয়ে বাজে। আমরা নাকি যতদিন একুশকে একুশে ফেলে রাখবো ততদিন আমাদের দুর্ভাগ্যের মেঘ কাটবে না। আমাদেরকে একুশের বিস্তৃতি ঘটাতে হবে। তাকে বিশে নিয়ে আসতে হবে! বাইশে নিয়ে যেতে হবে! আমি এই কথাটিকে শত ভাগ বিশ্বাস করি। বাবার মতো আমিও একুশকে বিশে নিয়ে আসতে চাই – বাইশে নিয়ে যেতে চাই; অন্ততঃ চেষ্টা করি। আমার চেষ্টার শেষ আমি জানি না। কিন্তু তবু চেষ্টা করি। করে চলি। বাবার স্বপ্নকে বাস্তবের অবয়বে দেখতে আমার বড্ড ইচ্ছে করে।।
মন্তব্য
আইডিয়াটা ভাল্লাগলো
শুধু আইডিয়াটা!
শহীদ মিনার নিয়ে আপনার বাবা এবং আপনার ভাবনাকে শ্রদ্ধা।
সজল
সজল
ঠিক আমার বাবা নয় আসলে কাহিনীটা গল্পের মূল চরিত্র শহীদ ও তার বাবাকে নিয়ে লেখা। প্রতিটি গল্পের নায়ক তার লেখকই কেন হবেন? লেখকের কাজ সমাজের প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখা। উল্লেখযোগ্য চরিত্রকে কলমের টানে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা। আমি তাই করার চেষ্টা করেছি। পড়ার জন্য ধন্যবাদ। মন্তব্য করার জন্য আরেকবার।
জহিরুল ইসলাম নাদিম
আপনার বাবার জন্য অনেক শ্রদ্ধা রইল। আপনার আর বাবার মধ্যে এমন মধুর সম্পর্ক যে, আপনাকে ঈর্ষা করতে ইচ্ছা হয়।
ঘরে ঘরে এমন বাবা ও সন্তান আসুক তাই আমরা চাই।
ধন্যবাদ আপনাকে গল্প পড়া ও মন্তব্য করার জন্য।
জহিরুল ইসলাম নাদিম
অনেক সুন্দর গল্প
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
ধন্যবাদ আপনাকে!
জহিরুল ইসলাম নাদিম
গল্পটা আগে চোখ এড়িয়ে গেছিল। ভাল লাগল।
ধন্যবাদ কৌস্তুভ!
জহিরুল ইসলাম নাদিম
গল্পটা ভালো লেগেছে পড়তে, আগে বলা হয়নি, আজ জানিয়ে গেলাম।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
মর্ম! আরো কিছু পরে হলে আর চোখেই পড়ত না আপনার মন্তব্য....
নতুন মন্তব্য করুন