---নিশা---
বেশিদিন আগের কথা নয় । হয়তো পাঁচ ছয় মাস, বা তারও কম সময়ের কথা বলছি ।
ফেইসবুকে তখন আমার "ফ্রেন্ড" সংখ্যা মাত্র উনপঞ্চাশ যাঁদের মাঝে পঁয়ত্রিশ জনই সামনাসামনি বেশ পরিচিত আর আট জন কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-তারকা। এর বাইরে ছয়জন যাঁদেরকে সামনাসামনি দেখি নি। তাদেরকে কিভাবে ফ্রেন্ড লিস্টে এড করেছি জানেন? প্রথমে ছবি দেখেছি, ছবিতে যদি "লাফাংগা পোলা" মনে না হয় তবে ইনফো চেক করেছি, ইনফোতে যদি রুচিশীল শিক্ষিত সংস্কৃতমনা এবং ভালো মন মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে তবে মিউচুয়াল ফ্রেন্ডদের মেইল দিয়ে জিজ্ঞেস করেছি যে "ক/খ/গ কে চিনেন কিনা? কীরকম?" ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসবে যদি নিশ্চিত হই যে আসলেই মানুষটা "আওলফাওল" না, ভালোও না, বেশ ভালো, তবে তাকে কনফার্ম করেছি। সাবধানের মার নেই বাবা!
একদিন সাইবার ক্যাফেতে গেলাম ব্লগ থেকে একটা লেখা প্রিন্ট করতে। কাজ শেষে ফেইসবুকে ঢুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট কারা পাঠিয়েছি দেখছি।
ওরে বাপস, একশ নয়টা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট জমা!
প্রথমে ভাবলাম, "খুলে দেখার কী দরকার! যার মনে চাইছে পাঠাইছে, সো হোয়াট?" পরে ভাবলাম, "না। দেখি। সময় তো আছে।"
সেইমতে মাউসে ক্লিক করা মাত্র মনিটরভর্তি ছবি আসলো। আমি মাউসের তির নামাচ্ছি নিচে আর ছবি দেখে দেখে নিজের মনেই কথা বলছি, "একশ নয়, সাইফুল আলম, বাবা, ছাগলা দাড়ি কেন তোমার ? একশ আট, উদাসী মাহমুদ, ভাই আঁতলা, কী দুঃখে উদাস হইছো?" ইত্যাদি ইত্যাদি। আস্তে আস্তে তীর নামছে নামছে আর আমি বকবক করছি, "সবগুলান তো লাফাংগা পোলা রে!"
এরপর দেখি ছিয়ানব্বই নং। না, ছেলেটা বেশ ভদ্র। পরনে হলদে রঙের ফতুয়া। জানলা দিয়ে আসা কমলা আলো চোখে মুখে।
ইনফো চেক করলাম। বেসিক ইনফো, ইন্টারেস্ট, ফেবারিট বুকস, মিউজিক পড়ে মনে হলো বেশ জ্ঞানী, ভালো, বিবেকবান, উন্নত মানসিকতার।
টাশকি খেলাম ফেবারিট টিভি প্রোগাম পড়ে, "এক দুই তিন সিসিমপুর!" বলে কি! কলেজপড়ুয়া এই আমার প্রিয় টিভি প্রোগাম সিসিমপুর শুনে সবাই হাসে আর বাচ্চা ডাকে। কিন্তু এই ছেলেটা দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও বাচ্চা!
বাচ্চা-বাচ্চা মিলে গেলো। তাই ওকে ফ্রেন্ড হিসেবে নিয়ে নিলাম মিউচুয়াল ফ্রেন্ডদের জিজ্ঞেস না করেই।
প্রথম দশ-বারো দিন কোন আমার স্ট্যাটাসে ওর কমেন্টের জবাবে ভদ্রতা করে উত্তর দিয়েছি। নিজ থেকে কিছু লিখি নি ওকে। যাক না আরও কিছু দিন! দেখি, কেমন। এদেশে মেয়ে হয়েই তো জন্মেছি।
এরই মাঝে ফেইসবুকের এক দাদাকে নিয়মিত লিখতাম স্ট্যাটাস আর মেইলে। দাদাই একদিন মেইলে লিখলো, "ওই দাদাটাকে লিখো মাঝে মাঝে (মানে সেই আটানব্বই নাম্বার, হলদে ফতুয়া পড়া সিসিমপুরপ্রেমী ছেলেটা)। দাদা অসুস্থ তো, তুমি লিখলে ওর ভালো লাগবে।" আমি জবাব দিলাম, "ওনার কী হয়েছে দাদা ?" দাদা জবাব দিলো, "অ্যানকোলাইজিং স্পন্ডিলাইটিস।" দাদা মানে পুতুদা, প্রীতম বিশ্বাস।
আমি সেদিনই জানলাম, হলদে ফতুয়া পড়া সিসিমপুরপ্রেমী সেই ছেলেটার অ্যানকোলাইজিং স্পন্ডিলাইটিস, তাই সেই ছেলেটা গত তিন বছর ধরে হাঁটতে পারে না, প্রচণ্ড ব্যথা তাঁর গোটা শরীরে।
ছেলেটার নাম শাশ্বত সত্য। আমার খুব খুব খুব প্রিয় দাদাভাই।
আমি কখনো চিন্তাও করিনি, যাকে কখনো একটিবারও চোখে দেখিনি, কেবল ফেইসবুক আর মুঠোফোনই যার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম, কয়েকশত মাইল দূরে থেকেও তাঁর প্রতি এতো বেশি বেশি ভালোবাসা জন্মাতে পারে, এতো আপন লাগতে পারে তাকে... কখনো ভাবি নি।
তা-ই হয়ে গেলো।
আমি আমার একটামাত্র বড়ভাইকে পেলাম।
আমার সত্যিকারের দাদাভাই।
আমার বড় ভালোবাসার দাদাভাই।
যে দাদাভাইয়ের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক না, আছে আত্মার বাঁধন।
আমার দাদাভাই এখন ভারতের হাসপাতালে একা একা শুয়ে আছে। পাহাড় দেখছে। বৃষ্টি দেখছে। সবুজ দেখছে। কিন্তু সেসব ছুঁতে পারছে না। দাদাভাইয়ের খুব ইচ্ছে করে, নরম ঘাসের স্পর্শ পায়ে মাখতে, তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে গান গাইতে, নীলজল দিগন্ত ছুঁয়ে দিতে...। আমার দাদাভাই আর কদিন পরেই তাঁর ইচ্ছে পূরণ করতে পারবে। দাদাভাইকে পারতেই হবে।
আর তো কদিন, দাদাভাই চট্টগ্রামে আসবে। আমি, সামিন আর আমার সত্যদাদাভাই...রাস্তায় হাঁটবো হাত ধরাধরি করে। আমাদের শহরটা দেখাবো দাদাভাইকে। দাদাভাইকে গান শোনাবো। দাদাভাইকে নিয়ে সাগর দেখতে যাবো। দাদাভাইকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো...আর বলবো না। আমি আর সামিন মিলে দাদাভাইকে চমকে দেয়ার জন্য কত পরিকল্পনা করে রেখেছি-সব বলে দিলে কি হয়!
দাদাভাই, চোখটা বন্ধ করো তো। কোথায় তুমি একা হাসপাতালে শুয়ে আছো?
এই যে আমি, তোমার দিদিভাই, তোমার হাতটা ধরে আছি।
তোমার চুলে হাত বুলিয়ে বলছি, "দাদাভাই, ভয় পেয়ো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।"
তুমি হেসে বলছো, "ধুর পাগলী, ভয় পাবো কেন! আমি তো জানিই সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই-ই তো ভয় পাচ্ছিস।"
আমি বলছি, "আমি যে খুব ভীতু দাদাভাই।"
দাদাভাই, তোমার ভীতু দিদিভাইটা কিন্তু তোমাকে অনেক ভালোবাসে।
[আগামীকাল আমার দাদাভাইয়ের শরীরে অস্ত্রোপচার, এরপরও আরো থাকবে তেরোটা বাকি! সবাই একটু শুভকামনা করবেন না আমার দাদাভাইয়ের জন্যে?]
দাদাভাইয়ের জন্যে আমি ছাড়াও অন্যদের ভালোবাসার চিহ্ন:
২) সামহোয়্যার-এ
৫) সচলায়তনে।
মন্তব্য
অজস্র শুভেচ্ছা আর শুভকামনা রইলো!
নিশ্চয়ই আপনার দাদাভাই আমাদের এ শহরের পথ ছুঁয়ে হেঁটে বেড়াবেন...
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
অনেক ধন্যবাদ তিথিপু । আমার দাদাভাইকে যে পারতেই হবে !
সুন্দর লেখা গুলো কেন যে সবসময় এমন মন খারাপ করা হয়...
অনেক দোয়া রইল সত্যদার জন্য।
ভাল লিখেছেন।
লিখতে থাকুন, ভাল থাকুন।
অবশ্যই আর কদিন পর আমি মন ভালো করা একটা লেখা দিবো আমার দাদাভাইকে নিয়ে । অবশ্যই ।
প্রার্থনা করবেন ।
শুভকামনা রইল। কোথাকার হাসপাতালে আছেন? কলকাতা না ভেলোর না অন্য কোথাও?
দাদাভাই ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছেন ।
আজ অর্থাত্ ২৫ তাং বাংলাদেশ সময় সকাল ১১ টায় দাদাভাইয়ের অপারেশন হবে । total hip replacement. বিকেল ৪ টায় শেষ হবে । প্রার্থনা করবেন ।
দাদার প্রতি শুভকামনা রইল। আশা করছি তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।
অনন্ত
দাদাভাইকে পারতেই হবে । প্রার্থনা করবেন । এতো ভালোবাসা কি ব্যর্থ হতে পারে ?
শুভ কামনা সেই দাদাভাইয়ের জন্য
০২
চমৎকার লেখাটার জন্য ধন্যবাদ
অনেক ধন্যবাদ ।
যদি পারতাম, গোটা পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে বলতাম আমার দাদাভাইয়ের জন্য প্রার্থনা করতে ।
দাদাভাই সুস্থ্য হয়ে সবার মাঝে ফিরে আসুন এই কামনা করছি। আপনাকে ধন্যবাদ সুন্দর লেখার জন্যে।
রাতঃস্মরণীয়
অনেক ধন্যবাদ ।
দাদাভাই আসবেই ।
নিশার চমৎকার দাদাভাইটির জন্য অনেক শুভকামনা থাকলো।
ভাইটিকে চমকে দেবার সব আয়োজন পূর্ণতা পাক।
ধন্যবাদ । দাদাভাইয়ের অপারেশন চলছে । প্রার্থনা করবেন ।
খুব চমৎকার লেখার ধরণ। সুন্দর এবং প্রান্জল।
প্রচন্ড ভালবাসা আপনাদের জন্য
- কাঠপেন্সিল
refathIzzlam@gmail.com
-------------------------------------------------------------
কেমন করে বলো ঐখানে যাই....যেখানে তুমি আর তোমরা আছো সবাই।
অসংখ্য ধন্যবাদ । প্রার্থনা করবেন ।
দাদা ভাইয়ের প্রতি শুভকামনা রইল
ধন্যবাদ । প্রার্থনা করবেন ।
হলুদ বসন্তের মতো মন ছুঁয়ে গেল কাম্য বিষন্নতায়! অভিনন্দন!
রোমেল চৌধুরী
ধন্যবাদ । দাদাভাই যেন সুস্থ হয়ে উঠেন প্রার্থনা করবেন ।
দারুণ লেখাটা মন ছুঁয়ে গেলো। শুভকামনা রইলো... আপডেট জানাবেন আশাকরি
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
২৬ তাং সকাল ৯টায় দাদাভাইয়ের মা ইন্ডিয়া থেকে কল করেছিলেন আমাকে । বলেছেন যে পরম করুণাময়ের অসীম দয়ায় দাদাভাইয়ের আর কোন বিপদ নেই । অপারেশন পুরোপুরি সফল । I.C.U. তে দাদাভাই থাকবেন দু দিন । ডাক্তাররা খুব খুশি ।
কিন্তু সেদিন রাত ১০ টায় দাদাভাইয়ের ফোন পেলাম । ফোন করেই বলে উঠলো, "তোর জন্য তো ঘুমুতেও পারলাম না রে ।" এরপর জানলাম, দাদাভাইয়ের পায়ের অবস্থা ভালো । দাদাভাই বললো, "আমার রক্ত লাল রে দাদাভাই । এই লাল রক্তের সাথে মিশে গেছে ভারতের একজন ক্রিশ্চিয়ান যাজকের রক্ত, একজন মুসলিম কাকাবাবু আর একজন হিন্দু কাকাবাবুর রক্ত । আমার রক্তই ঘোষণা দিচ্ছে, আমার পরিচয় আমি মানুষ । ধর্ম আমার পরিচয় নয়...।"
আজ সকালেও দাদাভাইয়ের সাথে কথা হলো । আরও কয়েকমাস পর দাদাভাই বাংলাদেশে আসবেন ।
আপনার দাদাভাইয়ের জন্য অনেক শুভকামনা...সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন উনি।
আপনার লেখাটা অসাধারণ হয়েছে।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
অসংখ্য ধন্যবাদ ।
দাদাভাই বর্তমানে সুস্থ । আরও কিছু অপারেশন বাকি আছে । এসবের পর অবশ্যই দাদাভাই হাঁটতে পারবেন ।
আপডেট কী?
দাদাভাইয়ের জন্য শুভকামনা...
নতুন মন্তব্য করুন