মক্কা নোটসঃ দি ব্লাইন্ডিং পিলারস

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২৯/১০/২০১০ - ৮:৩৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto

মক্কার হারাম শরীফের আয়তন বিশাল শুধু বড় না, বিরাআআআট। কয়েক হালি বায়তুল মোকাররম এর ভেতরে আরামসে চালান করে দেয়া যাবে মনে হয়। এর নির্মাণও একদিনে হয়নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অংশ তৈরি হয়েছে। কাবা ও তার চত্বরের বয়স মনে হয় অনেক, তার পরের একতলা অংশের বয়সও মনে হয় বেশ। তারপরের বাইরের দুই-আড়াই তলা অংশের নির্মাণ মনে হয় খুব বেশীদিন আগের না।

সৌদ বংশ সিংহাসন নেবার আগে পর্যন্ত আরব মোটামুটি তুর্কী সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবেই ছিল, তাই আগের নির্মাণে তুর্কী ছাপ যথেষ্ট দেখা যায়। তবে বেশ বড় অংশই সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি। autoআগের তুর্কী ছাপ দেখলাম আবু জেহেলের বাড়িতে যে টয়লেট করা হয়েছে তাতে নির্দেশনা আরবী ইংরেজী ছাড়া তুর্কীতে দেয়া আছে। এছাড়া সম্পুর্ণ হেরেমের মোটামুটি সব সাইনবোর্ড, নোটিস, নির্দেশনা আরবী/ইংরেজী/উর্দু এই তিন ভাষায় দেয়া আছে। autoআমার হিসেবে ভাষা হিসেবে তুর্কী আর মালে অন্ততঃ এই দুটো যোগ করা দরকার ছিল।

auto
আমি মূল মসজিদের নির্মানপদ্ধতি নিয়ে একটু আপত্তিতে আছি। এইটা সত্য যে, সম্পুর্ণ দালানের কারুকাজ খুবই অসাধারণ, নিতান্তই হালকা রঙ ব্যাবহার করে কম্পলেক্স কম্পোজিশন না করে এতো সুন্দর কারুকাজ যে করা যায় জানাই ছিলো না। কিন্তু আমার হিসেবে মসজিদ নির্মাণে অতিরিক্ত পরিমাণে পিলারের ব্যাবহার করা হয়েছে। মানুষজন মক্কায় আসে কাবাগৃহ দর্শনের জন্য। কিন্তু মসজিদের মাঝে এতো বেশী পিলার ব্যাবহার করা হয়েছে যে, মোটামুটি পঞ্চাশ থেকে ষাট ভাগ যায়গাতেই বসলে সামনে খালি পিলার ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। আমার হিসেবে আধুনিক আর্কিটেকচারাল পদ্ধতি ব্যাবহার করে পিলারের সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব এই মসজিদ পুনঃনির্মাণ করলে। ওপরের ছবি থেকে ২০ গজ গেলেই কাবার চত্বর কিন্তু দেখা উপায় নাই।

এখানে আসলে দুটো জিনিষ সবারই একটু সময় লাগে অভ্যস্ত হতে। প্রথমত নামাজরত মুসল্লীর সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি। যেটা সাধারণ অবস্থায় নিতান্ত মন্দ অভ্যাস হলেও এখানে নির্বিকার ভাবে করা লাগে। দ্বিতীয় হল নারী পুরুষের একই সাথে নামাজ। তবে পুরুষ-মহিলা যায়গা ভাগ করে, আলাদা কাতারে বা সামনে পিছনে এভাবে নামাজে দাঁড়ায়। এইটাও এইভাবে শুধু পৃথিবীর একমাত্র এক যায়গাতেই সম্ভব। কারণ বাস্তবিক পক্ষেই এইখানে আগমনকারীরা ছোটবড় নির্বিশেষে সবাই এই কৃষ্ণগৃহের সম্মোহনের জালে এমনভাবে আবদ্ধ থাকে যে অন্য দিকে তাকানোর কথা মাথায় আসেও না।

auto
একটা ইন্টারেস্টিং জিনিষ দেখলাম যে, মার্বেল পাথরের যে প্রাঙ্গন আর ফ্লোর, সেখানে দুই পাথরের মাঝখানে সিমেন্ট বা সেই ধরণের কিছু ব্যাবহার না করে রাবারের সলুশন ব্যাবহার করা হয়েছে। আমি নিশ্চিত না, তবে মনে হল, তাপে সম্প্রসারণ আর ঠান্ডায় সঙ্কোচনের সাথে মানিয়ে নেবার জন্য এই ব্যাবস্থা। নাহলে পাথর ফাটিয়ে ফেলত একটা আরেকটাকে।

হারাম শরীফের উত্তর পশ্চিম দিকে বিশালায়তন নির্মাণ কাজ চলছে। কাজ করছেন এনারা। ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেখানে কাজ হচ্ছে সেখানে আগে বড়সড় পাহাড় ছিল। এখন পাহাড় ফ্ল্যাট করে সেখানে খোদাই করে মহা কর্মযজ্ঞ চলছে। এক যুগ পরে এলে হয়তো চিনতেই পারবো না। কয়েকটা ছবি দিলাম এখানে। অনলাইনের গুজব যে শেষ পর্যন্ত এই প্রজেক্টের চেহারা এইরম হতে পারে। এইখানে পেলাম একখান জিনিষ। এইটারে ঠিকমতন ভাইরাল করা গেলে অন্তত পশ্চিমা বিশ্বে একখান খাসা অনলাইন মিমিতে পরিণত হতে পারত। autoআমি অনেক চেষ্টা করেও হাসি চাপতে পারছিলাম না, কে কয় সেফটি ফার্স্ট!

আরো কয়েকটা ছবি দিলাম
auto

auto

auto

কাবার দর্শনার্থীদের সামলানোর জন্য বিভিন্ন যায়গায় বেশকিছু কর্মী নিয়োজিত থাকেন। রাস্তার মাঝে কেউ বসে পড়লে তাকে সরিয়ে দেয়া, কেউ হারিয়ে গেলে বা সাহায্যের প্রয়োজন হলে তার ব্যাবস্থা করা, তাওয়াফকারীদের সংখ্যা বেড়ে গেলে প্রয়োজনমত প্রাঙ্গনের মানুষজনকে সরানো ইত্যাদি ইত্যাদি। সমস্যা হল, এই বেচারাদের পৃথিবীর সবচেয়ে ভাষাগতভাবে বৈচিত্রময় মিছিল সামলানো লাগে। তার ওপরে আগতদের বেশীরভাগই বয়স্ক, এবং শিক্ষাদীক্ষায় খুব কেউকেটা না। তাই খুব সহজ জিনিষও বোঝানো মুশকিল হয়ে যায়। তাই সবচেয়ে কমন ডায়লগ হল “ইয়াল্লা হাজী!!” তার সাথে হাত দিয়ে ইশারা। আগে এরা শুধুই আরবী বলত, এখন ভারতীয়দের সাথে মিশে দুচার শব্দ হিন্দী/উর্দুও বলে। যেমনঃ “চলো, রাস্তা!, মহিলা পিছে! ”

কাবার যে বিশাল প্রাঙ্গন, মসজিদ, আঙ্গিনা সম্পুর্ণ যায়গা সবসময় নয়া পয়সার মত ঝকঝক করে। দেখে মনে হয় এই ঘন্টাখানেক আগেই বানানো শেষ হয়েছে। অথচ মহা ধুলোবালির যায়গায় কোন জিনিষ এক দিন ফেলে রাখলেই দিব্যি ধুলোর আস্তর পড়ে যায়। এর কারণ হল হারাম শরীফের পরিচ্ছন্নতাবাহিনী। এই বিশাল কম্পলেক্সের এই মাথা থেকে ঐমাথা সকাল থেকে সন্ধ্যা নিরবিচ্ছিন্নভাবে ধোয়ামোছা চলে। এই হয়তো বসে আছেন এক কোণায়, হটাৎ করে দশ পনেরজনের এক দঙ্গল এসে চারপাশ দড়ি দিয়ে ঘিরে আপনাকে সহ সবাইকে উঠিয়ে দিল। যান্ত্রিক দ্রুততায়, একজন পানি ঢালছে, আরেকজন মুছছে তারপরে গাড়ির মত একটা যন্ত্রে বাকি আদ্রতাটুকু শুষে নিচ্ছে, দুমিনিট পরে এসে বোঝারও উপায় নাই একটু আগে কি হচ্ছিল। ফলে উন্নত বিশ্বের গড়পড়তা এয়ারপোর্ট বা হাসপাতালের চেয়ে ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন থাকে পুরো এলাকা। পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মোটামুটি নব্বই ভাগই ইন্দোনেশিয়া আর পাকিস্তানের। দুবছর আগেও এই কর্মীবাহিনীর অর্ধেকের বেশী ছিল বাংলাদেশী। আমি জানিনা কোন রহস্যময় কারণে পুরো বাহিনী এভাবে বদলে গেলো। হাজীদের জমজমের পানি খাওয়ানো আর কাবার পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে ছিল বনু হাশিম সেই থেকে বনু বাঙ্গালের হাতে এসে হাতছাড়া হয়ে যাবার মত দুঃখজনক আর কিছু আমার কাছে নাই।

শইলস্বাস্থ্য এখন পর্যন্ত ভালই আছে। খাবারের জন্য যে পাঁচমিশালী ঘ্যাঁট দেয় তাতে বাগুন ছিল। দু-তিন দিন খাবার পরেই কিঞ্চিত এলার্জী। এলাট্রল খাবার পরে এখন মোটামুটী স্বস্তি।

ফরিদ
বইমেলা


মন্তব্য

তানভীর এর ছবি

ফলে উন্নত বিশ্বের গড়পড়তা এয়ারপোর্ট বা হাসপাতালের চেয়ে ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন থাকে পুরো এলাকা।

জানলাম। তবে মক্কার টয়লেটের কথা কইলেন না? হজ্জ করে আসছেন এমন একজনের কাছে শুনসি এগুলোর পরিচ্ছন্নতা নাকি ঢাকার গণশৌচাগারগুলোর চেয়েও খারাপ।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

গুরু, ঐগুলান এখন পাকিরা সাফ করে কিনা? তাই পাকি ছাগুদের মত পবিত্র চোখ টিপি

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

ফরিদ এর ছবি

আমার অভিজ্ঞতা প্রায় বিপরীত। অন্ততঃ এখন পর্যন্ত যথেষ্টর চেয়ে বেশী পরিচ্ছন্ন। শেষ এক সপ্তাহ যখন মারদাঙ্গা ভীড় হয় তখন কি অবস্থা হবে জানিনা।

তানভীর এর ছবি

এই ব্লগটা পড়ে দেখতে পারেন। আপনার অভিজ্ঞতা বিপরীত জেনে আচ্চাইয্য হলাম হাসি

আপনার ভ্রমণ আনন্দময় হোক। আরো লিখুন।

ফরিদ এর ছবি

হতেও পারে।
১, ঘটনা ২০০০ সালের এখন ২০১০

২, উনার অভিযোগ পাবলিক টয়লেট নিয়ে, আমি হারাম শরীফের টয়লেটের বিষয়ে লিখেছি। মাঝরাস্তার টয়লেটের খুব সুহাল না বলে আমিও শুনেছি।

৩, আরেক পর্ব দিলে এখানকার কিছু ছবি দিতে পারি।

আরিফ.হাসান এর ছবি

ফরিদ সাহেব,
সালাম। লেখার জন্য ধন্যবাদ। আপনার এই নোটগুলোকে একটা ছোটখাটো সিরিজ বানিয়ে ফেলতে পারেন। অনেকটা লাইভ ব্লগিংয়ের মতো হলেও মন্দ হতো না। ফলে যারা এখন পর্যন্ত হজ্বে যাননি কিন্তু ভবিষ্যতে যাবার ইচ্ছা রাখেন, ওনাদের জন্য একটি "ড্রেস রিহার্সেল" হয়ে যেতো আর কি!

যাইহোক ভালো থাকুন আর আল্লাহ্‌ আপনাকে সুস্হভাবে হজ্বের সবগুলো রিচুয়্যাল পালন করার জন্য সাহায্য করুন!

পুনশ্চঃ বনু বাঙ্গাল পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে না থাকায় আমি এক অর্থে খুশিই হয়েছি। কারণ এই পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের যতগুলো দেশে আমার আমার কানেক্টিং ফ্লাইট ছিলো তার মোটামুটি সবখানেই ক্লিনার ছিলো বাংলাদেশীরা। না আমি এ নিয়ে মোটেই লজ্জিত নই, বলতে পারেন কিছুটা বিব্রত। কারণ, এমন কিছু ফোরাম দেখেছি, যেখানে পাকুরা বাংলাদেশীদের সাথে ঝগড়া করছে আর বলছে "you guys are cleaning the toilets of the world".মন্তব্যটা দেখে আর বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে একটু খারাপই লেগেছিলো। আশা করা যায়, শেষ পর্যন্ত এই অপবাদ ঘুচার সময় আসছে!

অঃটঃ আমার আব্বু-আম্মুও এইবার হজ্ব গিয়েছেন,ওনাদের জন্য দোয়া করবেন।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

ঠিক বুঝলাম না, সারা দুনিয়ার টয়লেট সাফ করার মাঝে আপত্তির কি দেখলেন, সে কাজের বিনিময়ে যদি দেশে বসে পুরা একটা সংসার চলে যায় তাতে অসুবিধা বা আপত্তি থাকার কথা না। এরা তো কষ্ট করে কাজ করে খাচ্ছে, পাকিদের মত টাউট বাটপারি করছে না। ভালু পাইলাম না আপনার কমেন্ট।

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

অতিথি লেখক এর ছবি

কোনো কাজই হেলা ফেলা করার মত না। সব পেশাকেই শ্রদ্ধার সাথে দেখা উচিত। ইসলাম ধর্মেও তাই বলা আছে। পাকি মাদা...... রা বললেই কোনো কাজ হারাম হয়ে যায় না। আশা করি পাকিদের মত করে ভাববেননা।

অনন্ত

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সাইফ তাহসিন এর ছবি

ছবিগুলান ফ্লিকার দিয়া পুস্টাইলে ভালো হইত, পাতার ডাইন পাশ দিয়া দেখি বাইর হইয়া গেছে। চলুক আপনার হজ্জ্ব / ভ্রমন ব্লগ

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

মাহবুব রানা এর ছবি

পড়ছি, চলুক।

সত্তুক এর ছবি

ভাল লাগল,চালাই যান।

কৌস্তুভ এর ছবি

এসব বিষয়ে কিছুই জানিনা। লেখাটা ইন্টারেস্টিং লাগল।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।