বাসের দোতলায় উঠেই যথারীতি একটু হতাশ হল হাসান কারণ একেবারে সামনের সিটটা ফাকা নাই। দোতলা বাসের একেবারে সামনে জানালা খুলে বসার মজাই আলাদা। গরমে অন্তত এইখানে পেটভরে ঢাকার ব্যালান্সডায়েটে ভরপুর হাওয়া খাওয়া যায়। যাই হোক দোতলায় একেবারে পিছনে সিঁড়ির পাশে এক সিটে বসে পড়লো সে।তার ডানে বসা এক পোলা তার দিকে কেমন যেন কৌতুহল নিয়ে দেখতে লাগলো বসার পরে।হাসান ঠিক বুঝতে পারছিলো না কি এই কৌতুহলের কারণ।সহসা তার গলায় লটকানো অফিসের দেয়া আইডি কার্ডের ফিতার দিকে খেয়াল করলো।অনেকটা খোঁয়াড়ে গলায় দড়ি বাঁধা ছাগলের মত লাগছে নাকি তাকে? তার নিজেরও হাসি পেলো হঠাৎ এটা ভেবে। বাস ততক্ষণে চেয়ারম্যানবাড়ি ছাড়িয়ে কাকলি বাসস্ট্যান্ডে এসে দাড়িয়েছে।
একের পর এক অপরিচিত কিন্তু পুরাতন মানুষ উঠতে লাগলো দোতলায়।যে কয়টি সিট শান্তিতে ছিল তারা অতিসত্তর নবউত্থিত মাংসল চাপে ও গরমে হাঁসফাঁস করতে লাগলো। না চাইলেও হাসানকে সবাইকে উঠতে দেখতে হল কারণ সে একেবারে সিঁড়ির পাশেই।তবে তার বামের সিটে বসা ছেলেটার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই এদিকে। আপনমনে FM রেডিও শুনছে। হয়ত কর্ণপাত সুরগুলোর ভাষা তার কাছে এই অচেনা মানুষগুলোর উপস্থিতি বা তাদের গল্পের চাইতে বেশি আপন। বাস ছাড়ার একটু পরে সে খেয়াল করলো যে একটি পিচ্চি (আনুমানিক ৪/৫ বছর বয়স) বিপুল উদ্যমে প্রাণপণ চেষ্টায় সিঁড়িবেয়ে দোতলায় উঠার চেষ্টা করছে। এক হাতে একটি পলিথিনের পুঁটলি থাকায় বেশি সুবিধা করতে পারছে না। হাসান উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো পিচ্চির সাথে বড় কেও আছে কিনা কিন্তু ঠিক কাউকে নজরে এল না। তাকে উঠে সাহায্য করবে কিনা এই দোটানায় যখন বিবেক দোদুল্যমান ততক্ষণে পালোয়ান দোতলায় বিজয়ের হাসি ঠোঁটে নিয়ে উঠে পড়েছে। এবং তার পরপরই হাসান খেয়াল করলো জীর্ণ পোষাকে জীবনের ভারে ন্যূজ এক অন্ধ মধ্যবয়স্ক উঠে আসছে উপরে দেয়ালের হাতল ধরে আস্তে আস্তে। পিচ্চিটা তখন বীরবিক্রমে বিশাল ভাব নিয়ে তার খালি হাতটা এগিয়ে দিয়েছে লোকটার দিকে, যদিও বাসের দুলুনিতে ঠিকমত দাঁড়িয়ে থাকতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। পিচ্চির কান্ড দেখে একটু মজা লাগলো হাসানের এবং তার মত আরও অনেকের। ততক্ষণে হাসান বুঝে গেছে পিচ্চি আর তার সাথে আসা (সহজেই অনুমেয় যে তার বাবা) মানুষটার গল্প কারণ এরকম মানুষের জন্যে তার দৈনিক বাকবিতন্ডা হয় বিবেকের সাথে অফিস যাওয়ার পথে প্রতিনিয়ত এবং প্রতিবারই সে জয়ী। আজও তাই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উপেক্ষার প্রয়াসে সে মুখ জানালার দিকে ঘুরিয়ে কাচের ফাঁক দিয়ে গোধূলি লগ্নটাকে দেখতে লাগলো পাশের বাস্তবতার নগ্ন চেহারা থেকে গা বাঁচিয়ে। কেননা তার “আমিত্ব” আর সময় তাকে জ্ঞান দিয়েছে এরকম মানুষের কাহিনী নিয়েঃ-
• মানুষটি কোনো গ্রুপের এবং পিচ্চিটা ভাড়া করা অথবা
• মানুষটি আসলে অন্ধ নয় কিন্তু এরকম ভান করছে অথবা
• আমি তো দানের ভান্ডার খুলে বসি নাই অথবা
• তুমি যতই দাও সে সব জায়গায় সবসময় একইভাবে ভিক্ষা করবে
আর তাই হাসান নিয়মের গন্ডিতে ফেলে দিল একইভাবে তাদের দুজনকে। যথারীতি মানুষটা সাহায্য চাইতে চাইতে সামনে এগুতে লাগলো। কিন্তু পিচ্চিটা সিঁড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে রইল। সবই ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু মাঝখানে আবার সেই ডানে বসা পোলাটা বাগড়া দিল। আর তাতে হাসানের এই ছিমছাম অতিসাধারণ একটা সময় কেমন যেন পরাবাস্তবতায় গুলিয়ে উঠল। পোলাটা পিচ্চিকে কাছে ডেকে বললো-
- স্কুলে যাস?
- হুম
- কোন স্কুলে?
- একটু হাসে সে
- নাম জানিসনা ?
- আবার হাসে
- স্কুলে কি পড়ায়? কবিতা পারস?
- পারি
- ক দেহি?
- কোনডা?
- তোর স্কুলে কোনডা পড়ায় তার আমি কি জানি? ক একডা
তারপর হাসান অবাক হয়ে দেখল যে পিচ্চিটা বলা শুরু করেছে-
“আমপাতা জোড়া জোড়া
মারব চাবুক চড়ব ঘোড়া
…………………………….
চাবুক ছুঁড়ে মেরেছে”
সে গড়গড় করে বলে ফেললো পুরোটা। সহসা হাসানের কেমন যেন লাগতে শুরু করে। এবং তার অনুভূতিকে আরও তীব্র করে পিচ্চিটা আবার বলতে থাকে-
“হাট্টিমাটিম টিম
তারা মাঠে পাড়ে ডিম
……………………..
তারা হাট্টিমাটিম টিম”
সময়টাকে হাসানের কাছে আরও অচেনা করে দিয়ে পিচ্চিটা আরো জবাব দিয়ে যায় ৫+৬= কত হয়, ঐ দেখা যায় তালগাছ… এবং আরও অনেক কিছু, তার মাথার ভেতরে কেমন যেন গুমগুম করতে থাকে তাই ধরতে পারেনা পিচ্চির সব স্বতস্ফূর্ত আলাপ। সহসা হাসানের আরও মনে হয় লোকটা যখন উপরে উঠছিল তখন একমাত্র পিচ্চিটাই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তার বাবা হাতটা দেখতে পাচ্ছে কিনা সেটা তোয়াক্কা না করে (কিংবা হাসানের “আমিত্ব” অনুযায়ী তার বাবা বলেই হাত বাড়িয়েছে, অন্য কেউ হলে এটা করত না)। অথচ হাসানের কিংবা বাসের কারও একবারের জন্যেও মনে হয়নাই যে লোকটি সত্যি অন্ধ এবং তা্র জন্যে হাত বাড়িয়ে দেয়া যায়। তবু কিছুটা হলেও পিচ্চির এই স্বতস্ফূর্ত সারল্য সবার পকেটকে কিঞ্চিৎ নাড়া দেয় কারণ অনেকেই এবার ছেড়া ২টাকার জায়গায় ৫টাকা বের করে। তারপর দুজনে আবার নেমে যায় আস্তে আস্তে যদিও মহাকর্ষীয় নিয়মে এবার কষ্ট হয় কম। অনেকে আবার নামার সময় ফ্রি উপদেশ দিয়ে দেয় যেন লোকটা পিচ্চিটাকে স্কুল থেকে না ছাড়ায়। লোকটা শুধু বিড়বিড় করতে থাকে-“না ছাড়ামু না, তয় কেমনে যে ওরে মানুষ করুম এই শরীল নিয়া….সংসার চালাইতে অনেক কষ্ট হয়”। কথাগুলো বাসের জানালার ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে যায় বাতাসের তোড়ে। হাসানের হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে আসে। আগে সে মুখ অন্যদিকে নিয়ে বসে ছিল, লোকলজ্জার ভয়ে তাই তখন পিচ্চিটাকে কিছু দিতে পারে নাই যদি লোকে ভাবে দ্যাখ এতক্ষণ তাকায়াও দেখে নাই আর কবিতা শুইনা দরদ উথলাইয়া উঠছে। সে শুনতে পায় নিচে লোকটা কন্ডাক্টরের সাথে কথা বলছে “আমরার খিলখেত নামায় দিয়েন”। হাসান তড়িঘড়ি উঠে পড়ে, কারণ সেও খিলখেত নামবে।
খিলখেত ওভারব্রিজের পরে বাস এসে দাঁড়ায়। অনেকেই নেমে যায় ধীরে ধীরে; লোকটা, পিচ্চিটা, হাসান এবং আরও অনেকে।হাসান ওদের পিছু নিতে থাকে।
লোকটা রিগেন্সির পাশে এক ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ায় আর পিচ্চিকে বলে হাতে সব ঠিক আছে কিনা টাকা যা উঠছে। হাসান ঠিক তখন পিছনে। মানিব্যাগ থেকে একটি ১০০ টাকার নোট বের করে লোকটাকে অতিদ্রুত হাতে দিয়ে বলে “চাচা, এইটা রাখেন, আপনার পিচ্চি অনেক সুন্দর কবিতা পড়ে”। আর কিছু বলতে পারে না সে, গলা ধরে আসে, হয়ত তার মনুষ্যত্ব নামক জিনিসটাকে মাত্র ১০০ টাকায় শো করানোর অপরাধে, যা এখনও কিছুটা অবশিষ্ট থাকলেও থাকতে পারে। বলেই সে সামনে হাটা ধরে তার বাসার দিকে ১২ নং রোডের পানে, লোকটাকে কিছু বলার সুযোগ দেয় না সে, পিচ্চিটার দিকেও আর তাকায় না।
হাটার পথে সে আজ দ্বিতীয়বারের মত রাস্তা দিয়ে যাওয়া তার বাসটির নাম দেখে-“সূচনা পরিবহণ-আজিমপুর টু উত্তরা”, প্রথমবার দেখেছিল টিকিট কেটে উঠার সময় চেয়ারম্যানবাড়ি কাউন্টারে।
(অতীত)
মন্তব্য
কঠিন বাস্তবতা এবং ভ্রান্ত আবেগ ... ...
ভালো লাগলো।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
গল্পের টিজারটি মোক্ষম, দৃশ্যপটটিও শুধুমাত্র একটি ডাবল ডেকারের উপরের তলায় সীমাবদ্ধ থাকায় ছোটগল্পের জন্য যথার্থ হয়েছে। আরো ভালো লেখা পড়তে চাই।
-----------------------------------
যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ — কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
(সচলায়তনে আমার কিছু জান্তব ও দুর্ধর্ষ লেখক বন্ধু আছে যাদের মাধ্যমে আমার এর সাথে পড়ি-চয়। তখন থেকেই এর অধিকাংশ লেখককে ভয়াবহ ভয় পাই। এসব ক্যাম্নে লেখে মানুষ!!! তাদের কে দেখে আমার অন্য গ্রহের কিন্তু আমাদের অনুভূতিগুলোর স্রস্টা মনে হয়, আর তাই জীবনের অন্যতম চরম দুঃসাহস নিয়ে কাল নিবন্ধন করে আমার দ্বিতীয় লেখা নিয়ে সচলে ঢুকলাম অতিথি লেখক হিসেবে, কতদিন টিকতে পারি দেখার বিষয়, অবশ্য আমার সেই বন্ধুদের কেউ কেউ এ লেখা দেখেছে আমার নোট হিসেবে, আর তাই আশা করি অন্তত নবজাতক হিসেবে আমার সব উৎকট উৎপাত উৎরায় দিবেন এখানকার বিজ্ঞজনেরা)
আর শামীম ভাই এবং রোমেল ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্যে; এখন একটু ভরসা পাচ্ছি।
পুনশ্চঃ রোমেল ভাই>>গল্পটা পুরোটা জীবন থেকে নেওয়া
ভয়াবহ সত্যকথা ! আমি একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি, বাসের প্রথম দিকের কেউ দিয়ে দিলে মানুষ তার দেখা-দেখি দেয়, না-হলে পুরো বাসেই বেচারাদের পাওয়া হয় না আরকিছু। স্ট্যাটাস মেইন-টেইনের চিন্তা থেকে হতে পারে এমনটা।
মানবিক লেখা উত্তম হয়েছে। হাসানের চিন্তাধারা আর-একটু বিশদ হলেও হত পারতো। তবে ভালো লেগেছে।
(সচলদের ব্যাপারে আপনার মতো অচল আমিও অণুরূপ মুগ্ধ এবং ভীত, 'এসব ক্যাম্নে লেখে মানুষ!!!' নিজের লেখায় কেউ মন্তব্য করলে সেটা পড়ার আগেই বুক ধরফর করে) চালিয়ে যান নিজের মতো।
দারুণ!
বেঁচে থাকুক মনুষ্যত্ব। নইলে একদম অর্থহীন মনে হতো জীবনকে।
লেখা ভাল লাগল।
নতুন মন্তব্য করুন