একটা সাইকেল আমার শৈশবের অনেক বড় আনন্দের উপাদান হয়ে ছিলো। সাইকেলে চড়তে শেখা, প্রথমে সাইকেল হাতে নিয়ে ছোটা, তারপর বাঁকা হয়ে মাঝখানের ফাঁকা দিয়ে পা ঢুকিয়ে অনেক কসরত করে চালানো কারন সিটে বসে প্যাডালের নাগাল পেতামনা! তারপর এক দিন রডের উপর বসে “ব্যথা” উপেক্ষা করে তুফান বেগে সাইকেল চালানো। ঝুঁকিপূর্ণ, জান হাতে নিয়ে চালানো যাকে বলে!
তারপর কোন একদিন আবিষ্কার করলাম সাইকেল চালানো আসলে হচ্ছে ব্যালেন্স নিয়ন্ত্রণের ব্যাপার। তারপর সহজ হয়ে গেলো বিষয়টা। কোন আত্মীয়স্বজন বাড়ীতে আসলেই তাদের সাইকেল নিয়ে আমার হাওয়া হয়ে যাওয়া। বেড়াতে আসা আত্মীয়ের হয়তো ফেরার সময় হয়ে যেতো আমার ফেরার নাম নেই। পথে ঘাটে আছাড় খেয়ে পড়া, অন্যদিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে রাস্তা ফেলে ধান ক্ষেতে নেমে যাওয়া, রাস্তায় ছুটে বেড়ানো দুইএক্টা পিচ্চির সাথে সঙ্ঘর্ষ এসব ছিলো নিয়মিত।
আব্বার সাইকেলটা ছিলো এক পরম রহস্যের মতো! জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছিলাম অতি পুরনো সেই দ্বিচক্রযানটা। অনেক রহস্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় রহস্য ছিলো ওই সাইকেল্টার কোন ব্রেক ছিলোনা। স্রেফ উইদাউট এনি ব্রেক-আব্বা সাইকেল্টা চালাতেন। কোন একদিন হয়তো নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো, আব্বা টান মেরে খুলে ফেলে দিয়েছেন, আর লাগানোর দরকার বোধ করেন নি। এলাকায় সাইকেল ছিলো হাতে গোনা, তারমধ্যে পরিষ্কার ব্যবধান নিয়ে সেই সাইকেল যত্রতত্র পড়ে থাকতো। সবাই চিনতো কার সাইকেল এটা। এমন ও হতো আব্বা সাইকেল রেখে কোথাও গেছেন ফিরে দেখেন সাইকেল নেই, আব্বা হেঁটে বাড়ী চলে আসতেন, কিছুক্ষন পর কেউ একজন সাইকেল ফেরত দিয়ে যেতো সাথে কাঁচুমাঁচু জবাব “একটু দরকার আছিল, বাজারে গেছিলাম”। কেউই কিছু মনে রাখতোনা। বাজার থেকে ফিরে অনেক রাতে আব্বা সাইকেল্টা ঘরের বাইরে রেখে দিতেন নিশ্চিন্তে!
ব্রেকবিহীন সাইকেল চালানো আমাদের কাছে এক বীরোচিত কাজ মনে হলেও আব্বার কাছে ব্যাপার টা ছিলো ডালভাতের মতো। সেই সাইকেল দিয়ে “আস্তে সাইকেল চালানো” প্রতিযোগীতায় আব্বা জয়ী হতেন! ব্যপারটা কিভাবে সম্ভব ছিলো জানিনা। শুধু দেখতাম আব্বার পুরনো সাইকেল শামুকের গতিতে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে একেবারে থেমে যাচ্ছে, আব্বা শুধু ব্যলেন্স ঠিক করে দাঁড়িয়ে আছেন। অন্যদিকে ব্রেকওয়ালা সাইকেল গুলো যাচ্ছে, চালক ব্রেক চাপছেন আর ধপাস করে পড়ে যাচ্ছেন। “আস্তে সাইকেল চালানো” প্রতিযোগীতার নিয়ম হচ্ছে কে কতো বেশী সময় নিয়ে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পার হতে পারেন। মাটিতে পা পড়লেই ডিস্কোয়ালিফাইড।
সেই সাইকেল নিয়ে কতো বার রাস্তা পার হয়ে জঙ্গলে ঢুকেছি তার কোন সংখ্যা নেই, গাছের সাথে বাড়ি খেয়ে থেমেছি, রিকশার পেছনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে “গতি নিয়ন্ত্রণ” করেছি। সেই সাইকেল নিয়ে একটা দৃশ্য পুরোপুরি মনে আছে এখনো। একদিন বাড়ী ফেরার সময় দেখলাম ব্রেকবিহীন সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে বসে আছে একটি টিয়া পাখি। সেই টিয়া পাখি নিয়ে আমাদের সেকি উত্তেজনাময় দিন যাপন! মানুষজন মাঝে মাঝে বলতো “ডাক্তার সাব, সাইকেল্টা পাল্টান এইবার”।
মানুষের কথায় নাকি আমার “নিরাপত্তা”র কথা চিন্তা করেই কিনা আব্বা নতুন একটা সাইকেল কিনে ফেললেন। ফনিক্স। কড়া ব্রেক, কঠিন স্পীড! ব্রেকবিহিন সাইকেল এর ও ক্রেতা খুঁজে পাওয়া গেলো। এক সাইকেল মেকানিক ওই জিনিস কিনে নিলো ২০০টাকায়। তারপর সেই সাইকেলের মাথা, অন্য সাইকেলের চাকা এভাবে জোড়াতালি দিয়ে ছোটদের সাইকেল বানিয়ে মেকানিক ভাড়া দেয়া শুরু করল। আমার দেখা সেটাই ছিলো পৃথিবীর প্রথম ম্যানুফেকচারিং অথবা রিসাইক্লিং প্রসেস!!
নতুন সাইকেল নিয়ে এর পর শুরু হলো টেনশন। তালা ঠিক মতো কাজ করে কিনা, কোথাও গেলে সাবধানে রাখা, ঠিকভাবে তালা মারা। সাইকেলে তেল দেয়া, পরিষ্কার করা আরো কত কি! এর পর আমাকে দাদা সাইকেল কিনে দিলেন ক্লাস সেভেন এ উঠার পর। হিরো সাইকেল। কি গতি! আমি হাওয়ায় উড়ে বেড়ালাম!
ইউনিতে উঠেও সাইকেল কিনেছিলাম। ঢাকার অলিগলি ঘুরেছি। মোটর সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে নারিকেল গাছের অর্ধেক্টা উঠে গিয়েছিলাম বাইকসুদ্ধ। ব্রেকবিহীন সাইকেলের চাইতে বেশী চালিয়েছি “ব্রেক সহ” সাইকেল। অথচ কি অদ্ভূত, সাইকেলের কথা মনে উঠলেই প্রথমে মনে পড়ে সেই ব্রেকবিহীন , রঙ ওঠা, জরাজীর্ণ দুইচাকার যান টার কথা!
কত দিন গেলো! সেই ব্রেকবিহীন সাইকেল নেই, আব্বা নেই। সাইকেলের সামনে চড়ে কতো সবুজ পার হয়েছি, ডুবে গিয়েছিলাম গভীর নীলে! ধুলো মাখা পথ, দূরদুরান্ত পাড়ি দিয়েছি। সাইকেলের সামনে বসে আব্বার গায়ের গন্ধ পেতাম, ঘামের গন্ধ পেতাম! এটা কি ওটা কি বলে ব্যস্ত করে রাখতাম।
শুধু মাঝে মাঝে মনে হয় ব্রেক বিহীন সেই দুই চাকার বাহন টা পেলে চলার পথটা হয়তো আরো একটু মসৃন হতো, সাথে সেই চিরকালের মতো হারিয়ে যাওয়া গায়ের গন্ধটা!
মন্তব্য
আপনার সেই সাইকেলের মতোই ভীষণ মসৃন আপনার লেখার গতিও। কিন্তু আপনি আপনার নাম দিতে ভুলে গেছেন।
খুব ভালো লাগলো স্মৃতিচারণ। আমার টুকটুকে লাল সাইকেলটার কথা মনে করিয়ে দিলেন।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আমি শামীম। করপোরেট কামলা!
সচল হওয়ার আগে সচলায়তন নাম দেখায়না, আমিও কম পরিশ্রম করে অভ্যস্ত। ঠিক আছে এর পর থেকে নাম দিয়ে দিবো। ভালো থাকুন।
একটু বেশি বয়সেই সাইকেল চালানা শিখেছিলাম। ক্লাস সেভেনে হবে সম্ভবতঃ। সাইকেল ভালোভাবে রপ্ত হওয়ার আগেই মোটস সাইকেল ধরলাম। এরপর অনেক দিন গেছে। হারলে ডেভিডসন পর্যন্ত চালিয়েছি। কিন্ত সেই প্রথম দিনের হাফ প্যাডেলের স্মৃতি আজও ভূলতে পারিনি।
চমৎকার লেখা। পুরোনো দিনের কথা মনে পড়িয়ে দিলো। আপনাকে ধন্যবাদ।
======================================
অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত আলো, সেইতো তোমার আলো।
সকল দ্বন্ধ বিভেদ মাঝে জাগ্রত যে ভালো, সেইতো তোমার ভালো।।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
স্মৃতিচারণ দারুণ হয়েছে।
ভালু পাইলাম
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
সবাইকে ধন্যবাদ!
হয়েছে কি আজাকাল জানিনা, শুধু মাথার ভেতর পুরনো দিনের কথা গিজগিজ করে! ২৯বছর বয়সে কি মানুষ বুড়ো হয়ে যায়!!
ঃ(
আমি ছোটবেলাতেই জানতাম আমারে দিয়া কোনো যানবাহন চালানো হইবো না, এই ব্যাপারে আমার কোনো উৎসাহ নাই।
তবু সাইকেল একটু একটু শিখছিলাম, কিন্তু পারি না আসলে। গাড়ি চালানোও শিখছিলাম, কিন্তু রাস্তায় বাইর হওনের সাহস হয় নাই...
লেখা ভালো লাগছে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ভাই রে সাইকেল ও চালাইতে পারেন না!
আপনার নাম ঠিকানা বলেন, নিজের হাতে আপনারে সাইকেল চালানো শিখামু। তবে হাড় দুই একটা ভাংলেও ভাংতে পারে সেটা আগেই বলে রাখি। এই বুড়া হাড্ডিতে (আশা করি আপনার বয়স ২৫ বা তদুর্ধ) সাইকেল শেখার ধকল সইবে কিনা আমার সন্দেহ!!
নজরুল ভাইয়ের বয়স ২৫
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
আমাদের বাসায় সাইকেল ছিল না, দুর্ঘটনার ভয়ে বাবা কখনই দেননি, আরবী পড়াতে আসা হুজুরের সাইকেল নিয়ে আমিও উধাও হয়ে যেতাম, দিন পার করে তার বাসায় গিয়ে দিয়ে আসতাম পরে...থাকার পরিসরের বাইরে কতো সবুজের সন্ধান যে পেয়েছি সাইকেলে করে, বলে শেষ করা যাবে না!
ভালো লেগেছে লেখাটা...চালিয়ে যান।
(Phoenix এর উচ্চারনটা 'ফনিক্স' না, হবে ফিনিক্স)
দুই দুই বার ম্যারাথন ড্রাইভ করছি। একবার প্রায় ১০০০ কিলো আরেকবার ৭২০ কিলো। মাঝখানে খুচরা-খাচরির অভাব নাই। তারপরেও আমার কপালে সাইকেল সয় না। যতবার কিনি ততবার চুরি যায়। শেষ সাইকেলটায় দুই দুইটা তালা মাইরা রাখছিলাম। রাখতে পারি নাই। গত বছর দিনে দুপুরে লইয়া গ্যাছে গা...... আবার কিনুম..........
ও হ্যাঁ সাইকেল চুরির কথা বলতে ভুলে গেছি। ইউনিতে উঠে কেনা edward সাইকেল্টা চুরি হয়ে গিয়েছিলো। জাস্ট তালা মেরে তিন তলায় উঠলাম। খেয়ে নাম্লাম, ব্যবধান ৩০মিনিট, সাইকেল হাওয়া!!...দুস্ক রে ভাই দুস্ক!!
কর্পোরেট কামলা হিসেবে নাম লেখানোর পর আর সাইকেল কেনার প্ল্যান করা হয়ে ওঠেনি।
খুব ভালো লাগলো শামীম
অট: কামলা সাহেবের লেখায় কামলার ছাপ পাইলামনা, আরো ভালো লাগলো
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
নতুন মন্তব্য করুন