না, ভালবাসা মানে কী, সেই বিষয়ে আমার খুব একটা ধারণা নেই। বিশুদ্ধ অ্যাকাডেমিক আগ্রহ থেকেই এর মানে জানতে চাওয়া। আর ছোটবেলা থেকেই জ্ঞান পিয়াসু হিসেবে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সবকিছু শেখার চেষ্টা করে গিয়েছি, এই লেখা তারই খতিয়ান।
শুরুটা অনেক আগে থেকে। ক্লাস টু’তে স্কুলে ভর্তি হলাম। প্রথমদিন বাবার হাত ধরে হাফ-প্যান্ট পড়ে ক্লাসে গিয়ে দেখি বামপাশের কলামে মেয়েরা বসে, আর ডানপাশে ছেলেরা। আমার ক্লাস ভালো লেগে গেল। শুধু পরের দিনই বায়না ধরলাম, আমি হাফ-প্যান্ট পড়ে স্কুলে যাবনা, এতগুলা মেয়ের সামনে ফুল-প্যান্ট পড়ে না গেলে মান-সম্মান থাকে নাকি! সবই ভালো লাগে, শুধু ছেলে-মেয়েদের আলাদা বসাটা ভালো লাগেনা। তবে যারা ক্লাস ওয়ান থেকে এই স্কুলে পড়ে তাদের কাছ থেকে জানা গেল, পরীক্ষার সময় নাকি পাশাপাশি বসার একটা ব্যবস্থা আছে। সেই থেকে আমি অধীর আগ্রহে পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করি, ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগে আমার আর পরীক্ষাভীতি জাগেনি।
ক্লাস টু আর ক্লাস থ্রি এর মাঝে একটা পার্টিকেল বোর্ডের পার্টিশন ছিল, যার ফাক দিয়ে চাইলে এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসে যাওয়া যেত। ক্লাস শুরুর কিছুদিন পর থেকে দেখা যেত মিঠুন নামে আমাদের এক ক্লাসমেট ওই ফাক দিয়ে ক্লাস থ্রিতে গিয়ে প্রায়ই বসে থাকে। আমাদের কারো মনে হয়ত প্রশ্ন জাগত না, কিন্তু কেউ কেউ অন্যদের চেয়ে একটু এগিয়ে থাকে বলেই না মানবসভ্যতা এক ধাক্কায় অনেকটা এগিয়ে যায়। আমাদের মাঝে এই অগ্রদূত হল বাট্টু, আমাদের সবার মতই সেও লক্ষ্য করেছে মিঠুনের এই উচ্চশিক্ষার প্রতি অকালপক্ব আগ্রহ। কিন্তু আমাদের চেয়ে একটু আলাদা বলেই, মিঠুন যে ক্লাস থ্রিতে পড়া এক মেয়ের সাথে রোজ স্কুলে আসে এই ব্যাপারটা তার চোখে এড়িয়ে যায়না আর এই দুই ঘটনার মাঝে একটা যোগসূত্র সে সহজেই আবিস্কার করে ফেলে। তারপর একদিন আমাদের সবার জটলায় সে ঘোষণা করে, মিঠুন মিতার সাথে লাভ করে। আমাদের মাঝে কেউ কেউ লাভ জিনিসটা কী সে সম্পর্কে ভাসাভাসা ধারণা রাখত, আর যারা রাখত না, তাদের জ্ঞানচক্ষু খোলার কাজটা করে যথারীতি বাট্টূ। সবাই যখন মোটামুটি বুঝতে পারে লাভ মানে কী, তখন সংখ্যাগুরু খুদে বিশারদেরা একমত হয় যে লাভ করা জিনিসটা খুবই খারাপ একটা কাজ। যারা এর সাথে একমত হয়না, পিয়ার-প্রেসারে তারাও খুব দ্রুত লাইনে চলে আসে। তখন আমাদের মন ছিল সবুজ, কোন অন্যায় দেখে চুপচাপ বসে থাকব ততটা কলুষিত হয়ে যাইনি। তাই বাট্টুর নেতৃত্বে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, মিঠুনের নামে আমাদের ক্লাস টিচার বরূণা ম্যাডামের কাছে বিচার দিতে হবে। এবার আসে বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার পালা। আমাদের সম্মিলিত কাপুরুষতার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি দিতে দিতে বাট্টূই এই দ্বায়িত্ব তুলে নেয় কাঁধে , সেদিন থেকে আমি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার মানে ঠিকঠাক জানি।
তারপর আসে সেই জাজমেন্ট ডে। স্নায়ু ছেঁড়া উত্তেজনার মাঝে বাট্টু দাঁড়িয়ে অভিযোগ করে, “ম্যাডাম, মিঠুন মিতার সাথে লাভ করে”। সময় হঠাৎ মন্থর হয়ে আসে, আমরা ম্যাডামের কুচকে যাওয়া কপালের প্রতিটি রেখা গুণতে পারি, ম্যাডামের চোখ বিস্ফোরিত হয়ে আসে, আর উত্তেজনায় আমাদের শিরায় রক্ত দ্রত ছুটতে থাকে। তারপর জমে যাওয়া সময়কে টুকরো টুকরো করে ম্যাডাম গর্জে উঠেন, “চুপ বেয়াদব ছেলে”। আমরা এ হেন অবিচার দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই। আজ বুঝি ওই অল্প বয়সেই লাভ বুঝে যাওয়াতেই হয়ত বাট্টুর পড়াশোনা আর এগোয়নি। আমাদের সেই ক্লাসটিচার তার বছর খানেক পরেই সন্ন্যাসিনী হয়ে একটা মঠে চলে যান, মানুষের সেবা করার জন্য।
পিটিআই স্কুলের পাট চুকে আমার একবছর পরেই, ভর্তি হই জেলার সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস বয়েজ স্কুলে। তার পরবর্তী আটটা বছরকে বলা যায় আমার জীবনের অন্ধকার যুগ। জানালা দিয়ে এক চিলতে আলো আসে ক্লাস এইটে উঠার পরে। ব্যাচে পড়তে গিয়ে, যখন গার্লস স্কুলের মেয়েরা ও একই ব্যাচে পড়তে আসে। অল্প অল্প গোঁফ উঠা শুরু হয়েছে, কোন মেয়ে নাম ধরে ডেকে ঝাড়ি দিলেও কেমন জানি সুখ লাগে। কিন্তু পোশাক-আশাকের দিক দিয়ে সেই কৈশোরে ও এখনকার মতই নান্দনিকতা বোধ শুন্য ছিলাম বলেই কিনা জানিনা, মেয়েরা আমাকে মোটেই পাত্তা দিত না। তাদের যত আগ্রহ প্যানপ্যানানি রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া শাওন, মেয়েদের মত সুন্দর চেহারার মৃদুল, ছোট ভাইসুলভ অনুজ আর পরিপাটি পোশাক আর অপ্রয়োজনীয় সুঠাম স্বাস্থ্যের নয়নের দিকে। মনের দুঃখ মনে চেপে আমার দিন যায়, বাড়তি উৎপাত হিসেবে জুটে আমার নাম বিকৃত করে অ্যাডাম টিজিং। তারপর একদিন মেয়েদের মাঝে কারো একদিন কাব্যপ্রতিভা ভয়ানক উৎপাত শুরু করে, উঠতি বয়সের মানানসই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ ও তাতে কিছুটা ভূমিকা রাখে। আর একদিন তাই অনুজের হাত ধরে আমাদের হাতে পৌঁছায় আমাদের সবার নাম দিয়ে সুন্দর সুন্দর কথায় ভরা ফুলস্কেপ কাগজ ভর্তি কবিতা। আমি নিজের নাম লেখা লাইনটা বারবার পড়ি আর ভালোলাগায় বারবার ভিজে যাই। কিন্তু আমাদের মাঝে সবকিছুই বেশি বোঝা নয়নের মনে হয় এই কবিতার উত্তরে একটা কিছু সাহিত্য সৃষ্টি না করলে আমাদের মুখ দেখানোর আর উপায় নেই। সবাই ভীষণ চিন্তায় পড়ি।
সব ক্লাসেই নাকি একজন ক্লাসকবি থাকে, আমাদের সেরকম কেউ ছিলনা। দুই তিনটা রচনার বেশি আলসেমি করে মুখস্ত করা হয়নি বলে, প্রায়ই আমাকে রচনা বানিয়ে লিখতে হত। তাই খ্যাতির বিড়ম্বনায় এই গুরু দ্বায়িত্ব পড়ে আমার কাধে। আমার আবার কবিতা আসেনা, তাই দুই-তিনটা কাগজ নষ্ট করার পরে আমি স্থির করি গদ্যই লিখতে হবে, আর সেটা হতে হবে জীবন থেকে নেয়া। বিপুল উদ্যমে বেশ বড়সড় একটা সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করে বন্ধুদের মতামত নেয়ার জন্য সবাইকে দেখাই। পুরোটা পড়ে সবাই বেশ আনন্দিত হয়, একই সাথে আমার নিরাপত্তা নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। কারণ কিছুইনা, আমি মানুষের মাঝে নানা বৈচিত্র্য দেখাতে গিয়ে উদাহরণ হিসেবে আমাদের সহপাঠিনী মেয়েদের কে উদাহরণ হিসেবে টেনেছি। আর যেহেতু পরীক্ষার খাতায় লিখছিনা, লেখায় একটু রম্য ঢুকে গিয়ে লম্বা-খাটো, চিকন-মোটা, সুঁচালো-গোলাকার মুখ, চিকন-মোটা গলার স্বর সবকিছু নিয়ে হালকা রসিকতা চলে এসেছে। হাতের লেখায় এটা দেয়া যেহেতু বিপদজনক নয়ন তার কম্পিউটারে পুরোটা কম্পোজ করে তারপর প্রিন্ট আউট নিয়ে আমাদের বার্তাবাহক অনুজের হাত দিয়ে পাঠাই কাঙ্খিত জনদের হাতে। কিভাবে জানি সবাই বুঝে ও যায় এটা আমার কীর্তি। লেখাটা পড়ে সবাই প্রাথমিক ভাবে রেগে যায়, আর আমার তলানির দিকে থাকা জনপ্রিয়তা শূন্যের নিচে নেমে যায়। আমার খুব অভিমান হয়, প্রতিভার এই অবমূল্যায়ন দেখে। আর এভাবেই কিশোরীদের অবহেলায় শেষ হয় আমার স্কুল জীবন।
নটর ডেম কলেজে পড়তে আসি, সে এক বন্ধ্যা সময়। একেতো বয়েজ কলেজ, তার উপর সুন্দরী ম্যাডামদের কেউ আমাদের গ্রুপে ক্লাস নেন না। তাই ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে চলে আসি কোচিং এর সময়ে। আমার গ্রুপে দুই তিনজন চোখ ঝলসানো বালিকা। আমি তাদের মন জয় করার জন্য ক্লাসের সব প্রশ্নের উত্তর সবার আগে আগে দিয়ে দেই, সবকটা হোমওয়ার্ক নিয়মিত করে আনি, আর ক্লাসের পরীক্ষা গুলোতে ও প্রায়ই ভালো মার্কস পেয়ে যাই। এত পরিশ্রম বিফলে যায়না, দুই বালিকার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ স্থাপন হয়। তাদেরকে মাঝে মাঝে অংক বুঝিয়ে দেই, আমার হোমওয়ার্ক কপি করতে দেই। আমি তখন দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ। তারপর ভর্তি পরীক্ষা হয়, আমি চান্স পেয়ে গেলেও বালিকারা অন্য কোথাও হারিয়ে যায়। পিছন ফিরে তাকালে কোচিং এর সময়টাকেই আমার সবচেয়ে সুফলা সময় মনে হয়।
তারপর ভার্সিটি লাইফের শুরু হয়। ক্যাম্পাসে জোড়ায় জোড়ায় ঘুরতে দেখে জীবনে প্রথমবারের মত পড়াশোনার অসারতার দিকে আমার চোখ পড়ে। চেনা জানা সবাইকেই দেখি কিছু দিন পরপর প্রেমে পড়ে যেতে, শুধু আমারই কিছু হয়না। মন খারাপ করে রুমে ফিরে “সুইটহার্ট, আই অ্যাম সিটিং অ্যালোন”
|
গান শুনতে থাকি, কিন্তু পটেনশিয়াল সুইটহার্টরা পাষাণ হৃদয় নিয়ে আমার কাতর দৃষ্টি উপেক্ষা করে অন্য কারো হাত ধরে হাটতেই থাকে। তারপর সিএসই ডে তে এক ধবধবে ফর্সা আপুকে আগুনে লাল শাড়ি পড়ে “...যখন সোনালী রূপোলি আলো নদীর বুকে বাসা খুজে রে” গাইতে শুনে একেবারে পাগল হয়ে যাই। ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। অবশ্য এই ভূত মাথা থেকে খুব তাড়াতাড়িই সরে যায়, ওই আপুর ফিয়ন্সে ভাইয়াটাকে দেখে আর বেশি সাহস ধরে রাখতে পারিনি।
সবচেয়ে বাজে কাটতো সরস্বতী পূজার দিনগুলি। ওইদিন আমাদের হলে মেয়েরা ঢুকতে পারতো। ভাগ্যবানেরা তাদের প্রেমিকা না হয় বান্ধবী নিদেন পক্ষে আত্মীয়া দের কে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসত। আর হতভাগাদের কেউ কেউ দলবেঁধে একটা রুমে ঢুকে ঘর অন্ধকার করে সিগারেটের ধোয়ায় নিজেদের হতাশাকে উড়িয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করত। আমার আবার বিড়ি সিগারেট এইসব চলতনা, ধোয়া ও সহ্য হতনা। তাই একা একা হিংসা, দুঃখ, ক্ষোভ ইত্যাদির যুগপৎ আগুনে নিজেই জ্বলতে থাকতাম। একবার সহ্য করতে না পেরে দুপুরের দিকে বাড়ির দিকেই রওয়ানা দিয়ে দিলাম, আর হল থেকে বের হওয়ার সময় কুক্ষণে পড়ে গেলাম হলের সবচেয়ে ফাজিল বড়ভাই আর ব্যাচমেটদের সামনে। এই নিয়ে এত র্যাগ খেয়েছি যে, এই লেখাটা লিখার সময় ও দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো।
তারপর জীবন একটু সিরিয়াস দিকে মোড় নেয়। ভালবাসার মানে আমার আর কখনোই ভালো করে জানা হয়ে ওঠেনা।
সজল
২৭/১১/২০১০
মন্তব্য
আহা, সমবেদনা লন।
বালিকাদের পড়া বুঝিয়ে দেবার কোনোই সাইড এফেক্ট হয় না ভাই, দেশে বিদেশে এত বছর পড়া বুঝিয়ে এসেও তো... অবশ্য আমার পক্ষে ভালই, কখনই 'লাভ'-ক্ষতির লোভাতুর ছিলাম না।
এটা একে রম্য, তারপর আবার আপনার ব্যক্তিগত আখ্যান, তাই অভিযোগের কিছুই নেই, তবুও আড়ালে বলি, বাঙালির ছেলেদের এই ফর্সা-ফেটিশ দেখতে দেখতে বিরক্ত লাগে। বলুন তো, আপনার ইস্কুলের ওই রম্যে কি লম্বা-বেঁটে ইত্যাদির পাশাপাশি ফর্সা-কালো নিয়েও কিছু রসিকতা ছিল না?
কৌস্তুভ, যার মনে যারে চায়। চট্টগ্রামের মানুষ পারলে তিনবেলায় শুঁটকি খায়, আবার অনেক জেলার মানুষ শুঁটকির গন্ধই সহ্য করতে পারেনা। কাজেই লেখকের ফর্সা প্রীতিকে ফর্সা ফেটিশ বলাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছেনা। বিশেষ করে দেশের হলুদাভ ফর্সা বালিকাদের প্রতি আমার নিজের ও কিছুটা অবসেশন আছে কিনা।
ভাই আশরাফ, যার মনে যা চায়-টাই সবসময় মেনে নেওয়া যায় কি? শুঁটকি একটা নির্দোষ উদাহরণ, তা বলে তো আর আর সব কিছু নির্দোষ না। ভালো বাসা আমরা সকলেই চাই, তাই বলে খালেদার বাংলো ভালোবাসাকে...?
ফর্সা ফেটিশটা লেখকের সম্বন্ধে বলা নয়, সাধারণ ছেলেদের মানসিকতা সম্বন্ধে বলা। আর শুধু বাঙালির ছেলেই কেন, সারা ভারতের ছেলেদেরও একই হাল। আর এই ফেটিশটা আদৌ নির্দোষ নয়। এটাকে উশকে যাচ্ছে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির মত পণ্যবিক্রেতারা, আর কালো মেয়েদের আর তাদের পরিবারের উপর এই নিয়ে সমাজ এবং মিডিয়ার চাপ যে কেমন ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেটা জানেন আশা করি।
এটা একটা সমষ্টিগত লক্ষণ না হয়ে শুধু আপনার বা লেখকের ব্যক্তিগত রুচির মধ্যেই থাকলে তো কিছু বলারই ছিল না। আর শুধু লক্ষণেই সীমাবদ্ধ নেই, এই সমষ্টিগত ব্যবহার কুপ্রভাব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই বলা। ব্যক্তিগত ভাবে নিয়েন না।
এর শুরু মনে হয় আরো আগে। হাজার হাজার বছর আগে যখন আর্যরা এসেছিল তখন থেকে। তাই এখন আমাদের আচরনে আমরা এটা দেখতে পাই। তাই আমরা যে কিছুটা বর্ণবাদী এটা অস্বিকার করার আর উপায় নেই। রবি বাবু তার এক গল্পেই বলেছেন বাংগালি পাত্রের গায়ের রং যাই হোক না কেন পাত্রিকে ফর্সা হতে হবে।
সেই। আর কতদিন চেতনে বা অবচেতনে সিদ্দিকী সাহেবের মত 'খাঁটি' অভিবাসনকারী বংশধারার ভজনা করে যাব আমরা?
কৌস্তুভ, বাহ্যিক স্টিমুলেশন (যেমন, টিভি বিজ্ঞাপন) এর কারনে যে প্রেফারেন্স সৃষ্টি হয় সে ব্যাপারে অবশ্যই সচেতন থাকা উচিত। কিন্তু পছন্দ অপছন্দের বেলায় যে সহজাত ঝোঁক, তা নিশ্চয়ই নিন্দনীয় নয়। তাই সঙ্গী বা সঙ্গীনি নির্বাচনের সময় কাল-ফর্সা, মোটা-চিকন, লম্বা-বেঁটে এসব ব্যাপারে চুজি হওয়াটাকে আমি স্বাভাবিক বলে মনে করি। তবে হ্যাঁ, ইন্টারভিউ বোর্ডে চেয়ারের ওপাশে বসা ব্যক্তিটিকে হতে হবে লুক-নিরপেক্ষ, যেহেতু সেক্ষেত্রে পরিমাপের মাপকাঠি মেধা, রূপ বা যৌবন নয়। সমষ্টিগত কুপ্রভাব মোটে ও কাম্য নয়, তবে বুকে হাত দিয়ে কোন মানুষ বলতে পারবেনা যে সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে উপরে বলা ফ্যাক্টর গুলো সে মাথায় রাখেনা। লেখকের যদি ফর্সা গায়িকাকে দেখে প্রেমভাব জেগে উঠে তাহলে সেই সত্যভাষণে আমি কোন দোষ দেখিনা।
আশরাফ ভাই, আমি তো প্রথমেই লিখেছি, লেখকের এই ব্যক্তিগত আখ্যানে আমি অভিযোগের কিছুই দেখি না। তাই যদিও আপনিও দোষ না দেখেন, তাহলে তো কোনো বিরোধ নেই।
আমার বক্তব্য ছিল সমাজে ওই ট্রেন্ডটির ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে। সেই নিয়ে সাধারণ পরিপ্রেক্ষিতেই আরেকটু বক্তব্য রাখি। সমাজে থাকতে থাকতে কখনওই সম্পূর্ণভাবে স্বেচ্ছানুসারী হওয়া যায় না। কেউ চুজি হতেই পারে, ইচ্ছামতন নির্বাচন করার তার যথেষ্ট অধিকার আছে, কিন্তু এই নির্বাচন-মানসিকতার যে ফলাফল সমাজে পড়বে এবং তার যে প্রতিক্রিয়া হবে, তার কথাও মনে রাখতে হবে বই কি। পশ্চিমবাংলার কথাই ধরি যদি, কেউ মার্ক্সবাদ পছন্দ করতেই পারে, কিন্তু এর ফলে তার এবং সমমনস্কদের ভোটে তিরিশ বছর ধরে সিপিএম যে স্বেচ্ছাচার চালিয়ে আসছে তার দায় কি তাদেরও পড়ে না?
আরেক দিক থেকে ব্যাপারটা দেখি। মেটিং-এর সময় সাথী নির্বাচনের প্রক্রিয়া বিবর্তনের গতিপথের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। যখন এই নির্বাচনের ভঙ্গীগুলো সারভাইভাল-এর সহায়ক, তখন সব চেয়ে ভাল। যেমন, লম্বা বা স্বাস্থ্যবান হলে জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার সুবিধা, এবং এই ধরনের পছন্দরীতিই সচরাচর দেখা যায়। আবার অন্যদিকে, রঙচঙে সাজ হলে পার্টনারের পছন্দ হয়, কিন্তু সেটা আপনাকে শত্রুর নজরে এনে দিতে পারে সহজে। যেমন দেখা গেছে, গাপ্পি মাছের বৌদের অভ্যাস হচ্ছে রঙিন, বড় ছিটওয়ালা পুরুষদের পছন্দ করা। আবার জলে গাপ্পি-খেকো বড় মাছ থাকলে বিবর্ণ, ছোট দাগের মাছরা বাঁচে সহজে। এই দুইয়ের টানাপোড়েন খুব আকর্ষক। তো আমাদের দেশে রোদের আধিক্যের কারণে কালো চামড়ার সুবিধা বেশি, তাই সেটারই বাড়বাড়ন্ত হয়ে এসেছে। এইবার এই ফর্সা পছন্দের অভ্যাসটার কথা, আর্যদের সময় থেকেই ধরুন, বা বাদশাদের থেকে, বা সায়েবদের থেকে, এটা বিবর্তনের সময়ের সাপেক্ষে খুবই নগণ্য, তাই হঠাৎ করেই তো আর ফর্সা মেয়ের অনুপাত বেড়ে যাবে না। অতএব স্বাভাবিক নিয়মের বিপক্ষে গিয়ে এই অভ্যাসটি সমস্যা ঘটাচ্ছে।
আমার বক্তব্য পৌঁছতে পারলাম কি?
কৌস্তুভ, আপনি নিঃসন্দেহে জ্ঞানী, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেক কথার ফাঁকে সেই কথাটা না আবার হারিয়ে যায়, সেটাই ভাবছি। আমার আপত্তি ছিল ফর্সা-প্রীতিকে ফর্সা-ফেটিশ বলায়। আমি জানিনা নন্দনতত্ব এ ব্যাপারে কি বলে, কিন্তু সৌন্দর্য বিচারে সাবজেকটিভ স্যাটিসফেকশান আমার কাছে সব সময় স্বাভাবিক মনে হয়। হয়ত আপনি বিষয়টাকে সমাজবিজ্ঞান বা নৃতত্ববিদ্যার সদ্য পড়া কোন থিওরীর আলোকে দেখছেন, আমি কিন্তু ভাবছি খুব সহজভাবে। সোজাসাপ্টাভাবে বলতে গেলে শারীরিক কিছু ফিচার্স বিপরীত লিঙ্গকে বেশী আকৃষ্ট করবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। এই ফিচার্স এর তালিকা নিত্যপরিবর্তনীয়, আর এই পরিবর্তন এর অনুঘটক হতে পারে মিডিয়ার মত বাহ্যিক স্টিমুলিগুলো। যে প্রীতি জিনতার দুধসাদা ত্বকের ভক্ত তাকে আমার সালাম, আবার যে বিপাশা বসু'র তামাটে ত্বক এ টার্ন্ড অন হয় তাকে ও হাজার সালাম।
(পুনশ্চঃ এই বিষয়ে আলাপ চালিয়ে যাওয়াটা হয়ত সম্ভব হবেনা। একে সামনে পরীক্ষা, তার উপর আছে ক্লিক করে করে বাংলা টাইপিং এর ঝামেলা ! ভালো থাকুন)
হুম। একটু ব্যঙ্গ করলেন বলে মনে হল। কি আর করা।
নারে ভাই, আসলেই আপনাদের পড়াশোনা আমাকে মুগ্ধ করে। আপনার লেখার স্টাইলটা ও আমার খুব পছন্দ। চালিয়ে যান। শুভকামনা রইল।
১। সমবেদনার জন্য ধন্যবাদ
২। "ধবধবে ফর্সা" কেই কি কিন্তু আমার বন্ধুরা ফ্যাকাসে, মড়ার মত বলছিল। একটা ইনস্ট্যান্স থেকে হয়ত আমার সম্পর্কে ভুল ধারণা হতে পারে। তাও কিছুটা ভাবলাম। বন্ধু-বান্ধব নির্বাচন, মানুষের প্রতি ব্যবহার ইত্যাদিতে আমার ক্ষেত্রে গায়ের রঙ কোন ভূমিকা রাখেনি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি। এখন আসা যাক কাউকে ভালো লাগার ক্ষেত্রে, সত্যি হচ্ছে সামাজিক উত্তরাধিকার আমার মাঝে কিছুটা বায়াস তৈরি করেছ উজ্জ্বল রঙের প্রতি, কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ ভাবে না। ফর্সা নয় এমন কাউকে কখনো ভাল লাগেনি তা কিন্তু নয়, যদিও এই লেখায় আসেনি। তবে এই বায়াসের জন্য আমি গর্বিত না।
৩। না ওই রম্যে গায়ের রঙ নিয়ে কোন রসিকতা করা হয়নি, ওইসময়ের বোধ অতটা পরিপক্ষ ছিলনা, তাও চেষ্টা করা হয়েছে কাউকে আঘাত না দেয়ার। যদিও এখন বুঝি পুরো ব্যাপারটা ঠিক মানবিক ছিলনা।
পরিশেষে আমাদের ভেতরে সুপ্ত বর্ণবাদ আসলেই ভয়ানক, এই দিকটা তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ।
সজল
আপনার উত্তর ভাল লাগল। এমনিতেই আপনার লেখা আমার ভাল লাগে। কীবোর্ড চালু থাকুক।
বেশ! চলুক...
suরাশু
ধন্যবাদ।
সজল
কি আর করবেন, বাবা মার পছন্দমতো বিয়া করার জন্য দিন গুনেন।
মেঘনাদ কাব্য
হুম, বিয়ের পর বউএর সাথেই প্রেম করতে হবে
সজল
ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ।
সজল
উদ্ধৃতি
"সেই থেকে আমি অধীর আগ্রহে পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করি, ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগে আমার আর পরীক্ষাভীতি জাগেনি।"
মজা পাইছি।
কামরুল হাসান রাঙা
ধন্যবাদ
সজল
আপনার প্রতি রইল সমবেদনা, সাথে আমার প্রতিও...
হুম, আমাদের সকলের জন্য সমবেদনা
সজল
মজা লাগলো পড়ে।
প্রথম গানটা আমারও জাতীয় সঙ্গীত ছিলো। দ্বিতীয়টাও বেশ প্রিয়।
লেখাটা পড়তে গিয়ে স্কুলের আমাকে স্মৃতির ভেতর থেকে টেনে বের করতে গিয়ে দেখলাম, আমার অবস্থা আপনার মতো অতোটা খারাপ ছিলো না বটে! মানে কোনো না কোনো ভাবে বালিকাদের সবাই নামটা অন্তত জানতো। ভাবছেন আমি মহা ভয়ঙ্কর তুখোর ছাত্র ছিলাম? হে হে, জ্বী না জনাব। আমি বরাবরই লাস্ট বেঞ্চি। কিন্তু তারপরেই কেমনে জানতো! উত্তরটা খুবই সোজা। 'নটোরিয়াস' হিসেবে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি- আমার সময়ের, আমার ক্লাসের যেকোনো বালিকার কাছে আমার নাম জিজ্ঞেস করলেই বুঝতে পারবেন, এতোগুলো বছর পরেও তারা আমাকে ভুলে নি।
ভাবছেন বালিকারা সবাই আমাকে আশেকানে ভক্ত হিসেবে মনে রেখেছে? আবারও আপনাকে আশাহত করতে হয় তাহলে। কারণ, আমার নাম বলার পরপর আপনি যে প্রশ্নটা শুনবেন তা হলো, "কই, হালার পুতে আছে কই। খালি ঠিকানাটা কন্। অই শেফালীর বাপ, আমার শলার ঝাড়ুটা লও দেখি...!"
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আমাকে তুখোড় ছাত্র হিসেবেই শুরুতে চিনত সবাই, কিন্তু আমার রেপুটেশন গিয়ে থামত নটোরিয়াস হিসেবেই । আপনি বালিকাদের সাথে একটা গেট-টুগেদার আয়োজন করেন, তারপর অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন
সজল
সমবেদনা রইল।
লেখা সুখপাঠ্য হয়েছে। ভালো লাগল।
-কুটুমবাড়ি
পড়া এবং সমবেদনা জানানোর জন্য ধন্যবাদ
সজল
আহারে!
রম্য রচনা লিখে এত সমবেদনা পাচ্ছি কেন
ধন্যবাদ
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
মজা পাইছি
শাহেদ সেলিম
ধন্যবাদ।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
নতুন মন্তব্য করুন