প্রমোশন
-সাদ মাহবুব
।।১।।
বাংলাদেশের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট একটি ব্যাংক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব লেনদেন এই ব্যাংকের মাধ্যমেই হয়। এই ব্যাংকেই কাজ করে অসিত।
ব্যাংক ছোট হতে পারে, কিন্তু বিরাম নেই তার একটুও। সবসময়-ই ব্যাস্ত। ছাত্র/ছাত্রীদের অল্প টাকা পয়সার লেনদেন হয় এখানে। তবুও সামান্যটুকুই যে খুব প্রয়োজন সাধারণ ছাত্র/ছাত্রীগুলোর। অন্যরা ব্যাপারটা বুঝুক আর না বুঝুক অসিত খুব ভালোভাবেই বোঝে।
লেভেল-১, টার্ম-২ এর কোর্স রেজিস্ট্রেশনের শেষ তারিখ আজ। লেভেল-১ এর ছাত্র/ছাত্রীদের বরাবর-ই ছেড়ে আসা বাসার প্রতি দূর্বলতা থাকে। সেজন্য সবাই এসে ভিড় করেছে আজ এই শেষদিনে। ব্যাংকের কারো দম ফেলার সময় নেই। লাইন ব্যাংক থেকে বের হয়ে বহুদূর পর্যন্ত চলে গিয়েছে। বুড়ো ক্যাশিয়ার প্রচন্ড বিরক্ত। টাকা ভাংতি নেই অনেক ছেলেমেয়ের। কাজ করছেন তিনি আর রাগে গজ গজ করতে করতে বলছেন, ছাত্র মানুষ! পড়াশুনার মধ্যে থাকতে হবে সবসময়। পুরো সপ্তাহ বাড়িতে কাটিয়ে আজ শেষদিনে এসে ভিড় করেছে ব্যাংকে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের যে কি হয়েছে!
অসিত দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। বুড়ো ক্যাশিয়ার হাবীব সাহেবের ছোট মেয়েটাও বাড়ির বাইরে হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে। ছুটিতে আসলে মেয়েটাকে যেতেই দেন না তিনি। মাঝে মাঝে মেয়েকে সাথে করে ব্যাংকে নিয়ে এসে বলেন, “তুই বস মা, আমি কাজ করি, সিংগারা খা, খুব মজার। দাঁড়া, অসিতকে নিয়ে আসতে বলি।” যুবতী মেয়ে, কতক্ষণ তার এই ব্যাস্ত অফিসে বসে সিংগারা খেতে ভাল লাগে? অসিত তখন হাসে, সিংগারা এনে দিয়ে বলে, আপা খান, তারপর স্যারকে বলে ঘুরতে চলে যান।
-দেখেন না অসিতদা! ছুটিতে এসছি, বন্ধুবান্ধবদের সাথে একটু ঘুরতে যাব আর বাবা এখানে নিয়ে এল।
অসিত হেসে বলে, স্যার আসলে আপনাকে অনেক আদর করে আপা……যাহোক, সমস্যা নেই, খাওয়া হলে আপনি স্যারকে বলেন, আমি আপনার সাথে তাল মিলাবনি।
অসিতের কথার দাম আছে হাবীব সাহেবের কাছে। কথায় কাজ হয়। হাবীব সাহেবের মেয়ে মুক্তি পায়।
অথচ হাবীব সাহেব এখন এই ছেলেমেয়েগুলোর বাসা থেকে দেরি করে আসা নিয়ে বিরক্ত। অসিত হাবীব সাহেবের পাশের কাউন্টারে বসে পড়ল। সে বেশ চটপটে। লাইনের পেছনের সবাইকে বলল, “আরেকটা লাইন করেন ভাইয়ারা।” খুব দ্রত নির্ভুল ভাবে কাজ করতে পারে সে।
ক্যাশিয়ার টাকা নেওয়ার পর রশিদটা দেয়া হয় পাশের দুইজন অফিসারকে। তারা সাইন করলে টাকাটা জমা হয়ে যায় এবং রশিদের ছাত্র/ছাত্রীর অংশটুকু ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়। ব্যাংক থেকে কেউ টাকা তুলতে চাইলে তাদের এই অফিসার দুইজনের-ই সাইন দরকার হয়। একই ব্যাচের এক ছেলে এসেছে টাকা তুলতে। টাকা তোলার পর সে লাইনে দাঁড়াবে রেজিস্ট্রেশনের টাকা জমা দেওয়ার জন্য। কিন্তু ব্যাস্ততার কারণে তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে অনেকক্ষণ। বেশ কিছুক্ষণ পর ছেলেটির ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। আজ টাকা জমা দিতে না পারলে কাল জরিমানাসহ টাকা জমা দিতে হবে। বিরক্ত হয়ে সে অফিসারের টেবিলে থাপ্পর মেরে বলল, কি! আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব? টাকা তুলতেই তো সারাদিন চলে যাবে। টাকা জমা দিব কখন!
অফিসারটি বিরক্ত হল। শান্তস্বরে বলল, আমরা কি কেউ বসে আছি নাকি? দেখছনা কাজে ব্যাস্ত।
-আপনারা তো এখানে কাজ করার জন্যই আছেন, নাকি?
-শোন ছেলে, তোমাদের জন্য এই ব্যাংক বলে তোমরা ভাব আমরা তোমাদের চাকর। …ভদ্রভাবে কথা বল। কিসের এত কাজ তোমাদের? আগে আসতে পারনা?
-আপনার সুবিধা মত সময়-এ আমার আসতে হবে নাকি? আর আমি কি লেনদেন শেষ হয়ে যাওয়ার পর আসছি?
পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। কাজ থেমে গেছে। অসিত দৌড়ে এসে বলল, “ভাইয়া দেন, চেকটা দেন।” চেকটা নিয়ে রশিদ বই খুলে ওই ছেলের অ্যাকাউন্ট চেক করে টাকাটা ডেবিট করে অফিসারের হাতে দিল সাইন করার জন্য। অফিসারের রাগ তখনও যায়নি। বলল, “এরা নতুন, এদের সাইন তো আর আমার মুখস্ত নেই, সাইন চেক করতে হবে।” অসিতের মাথা ভাল, সে এই ছেলেকে আগে দেখেছে এবং সাইনটাও মনে আছে। সে অফিসারটিকে বলল, “স্যার, আমার এই ভাইয়ার সাইনটা মনে আছে, আপনি চাইলে সাইন করে দিতে পারেন।” অসিত যখন বলছে তখন বিশ্বাস করাই যায়।
অফিসার সাইন করে দিল।
চেকটি ছেলেটির কাছে ফিরিয়ে দিয়ে অসিত বলল, “এবার ওই স্যারের কাছে গিয়ে চেকটি দিয়ে দিলেই টাকা দিয়ে দেবেন। … ভাইয়া দেখতেছেন-ই তো কি রকম ব্যাস্ত সবাই আজকে। আর এরা আপনার মুরব্বি মানুষ।” ছাত্রটি লজ্জা পেয়ে বলল, “আরে অসিতদা, বোঝেননা, আধা ঘণ্টা ধরে বসে আছি, কত কাজ বাকি এখনও! মাথাটা একটু গরম হয়ে গিয়েছিল।” মৃদু হেসে অসিত বলল, “বুচ্ছি ভাই, ছাত্র মানুষের মাথা একটু গরম-ই থাকে, পারলে যাওয়ার সময় স্যারকে sorry বইল্যা দিয়েন।” ছেলেটি অসিতের কথায় সায় দিল এবং sorry বলল অফিসারটিকে।
একটু পর একটি মেয়েকে নার্ভাস হয়ে ছোটাছুটি করতে দেখা গেল। একটা লিস্ট চেক করে সে অস্থির হয়ে এক অফিসারের কাছে এসে বলল, “আংকেল, আমার আব্বা সকালে TT করেছে, এখনো টাকাটা আসেনি।” ব্যাস্ত অফিসার কাজ করতে করতেই বলল, “খাতাটা চেক কর, TT/MT যাদের আসছে ওখানে তাদের অ্যাকাউন্ট নাম্বার আর টাকার পরিমাণ তোলা আছে।” মেয়েটি তাড়াতাড়ি বলল, “আমি চেক করেছি, আমার অ্যাকাউন্টে তো এখনও কিছু আসেনি।”
-তাহলে আসেনি মা, কাল খোঁজ নিও।
-কিন্তু আমার রেজিস্ট্রেশন করতে হবে তো!
-তোমার টাকা না আসলে আমি কি করতে পারি বল!
অসিতের মায়া লাগল। এগিয়ে এসে বলল, আপা আপনার অ্যাকাউন্ট নাম্বারটা বলেন তো, আমি ম্যানেজার স্যারকে জিজ্ঞাসা করে আসি।
কিছুক্ষণ পরে হাসি মুখে বেরিয়ে এল অসিত। বলল, “আপনার নামে ২০০০ টাকা আসছে তো আপা। সবাই ব্যাস্ত বলে খাতায় তোলার সময় পায়নি।” হাপ ছেড়ে বাঁচল মেয়েটি। বলল, এখন তোলা যাবে অসিতদা?
-আবার যাবেনা! দেন আপনার চেকটা দেন।
-Thanks অসিতদা।
এই সামান্য একটা শব্দের প্রশংসায় কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল অসিতের মন। লজ্জা পেয়ে আনন্দের সাথে কাজে ফিরে গেল সে।
এই ব্যাস্ততম দিনেই ডীন স্যার এলেন টাকা তুলতে। তিনি আসলে ম্যানেজারের রুমেই বসেন। ম্যানেজার একটু বিরক্ত হলেন। মনে মনে বললেন, তুই ডীন মানুষ! তোর আজকেই আসা লাগবে কেন? একটা দিন পরে আসলে তোর কি এমন ক্ষতি হত! ম্যানেজারের মনের কথা যেন বুঝতে পারলেন ডীন। বললেন, “ম্যানেজার সাহেব হঠাৎ টাকার দরকার পড়ে গেল। আপনারা ব্যাস্ত হবেননা, সবাই সবার কাজ করুক, আপনি অসিত কে একটু ডেকে দিন শুধু।” হাসলেন ম্যানেজার, বললেন, “ব্যাপারনা স্যার, আর জানেন-ই তো অসিত-ই সবসময় সবচাইতে ব্যাস্ত থাকে।” দুজন-ই হাসলেন।
অসিত এসে আদাব জানাল ডীন স্যারকে। ডীন বললেন, কেমন আছ অসিত? তোমার বাবার শরীর ভাল?
-জ্বী স্যার, তবে বয়স হচ্ছে তো! মাঝে মাঝেই শরীর খারাপ করে। সারাদিন খালি এখানকার চাকরিজীবনের গল্প করেন।
হাসলেন ডীন, বললেন, হুমম, বড় ভাল মানুষ তোমার বাবা, খুব sincere ছিল…যাহোক অসিত, কিছু টাকা তোলা লাগত যে বাবা, তোমারা আজ ব্যাস্ত আর আমারও টাকার দরকার পড়ল।
-কোনো সমস্যা নেই স্যার, আপনার অ্যাকাউন্ট নাম্বার ৮৭০৯ না স্যার?
হেসে সায় দিয়ে চেকটি দিয়ে দিলেন ডীন।
র্যাগ কমিটির অর্থ সম্পাদক সাকিব এলো একটু পর। ঠান্ডা মাথার হাসিখুশি ছেলে সে। কর্মরত এক অফিসারকে জিজ্ঞাসা করল, আংকেল একটু দেখবেন প্লীজ, আমাদের র্যাগ অ্যাকাউন্টে নতুন কোন টাকা জমা হয়েছে কিনা। কত টাকা আছে বললেই হবে।
এই অফিসারটি দ্রত কাজ করা মোটেই পছন্দ করেননা। দ্রত কাজ করলেই তার ভুল হয়। চশমা পড়ার পরেও চোখ-নাক-ভুরু-মুখ কুচকে একেবারে রশিদ বইয়ের সামনে ঝুকে পড়ে কি যেন তুলছেন খাতায়। তার উপর কিছুক্ষণ আগের আসা ছেলেটির তাদের এক অফিসারের সাথে বেয়াদবির কারণে রাগ চেপে আছে মনে। সাকিবের আবদারের বিপরীতে মুখ না তুলেই বললেন, দেরি হবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে…আমাদের একটা ক্রস চেক আসছে আংকেল, কিভাবে ভাঙ্গাতে হবে একটু বলবেন?
আরেক অফিসারকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, উনার কাছে যাও।
এই অফিসারটির জীবনের উপর ক্ষোভ আরও বেশি। তার টেবিলের সামনে কখনই খুব বেশি ভিড় দেখেনি সাকিব, তাও যেন অভিযোগের শেষ নেই তার। কোন এক অজ্ঞাত কারণে সব কিছুর উপর প্রচন্ড বীতশ্রদ্ধ তিনি। সাকিবের জিজ্ঞাসার বিপরীতে একটি ফর্ম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ফিল আপ কর।
এক লাখ টাকার ক্রস চেক, উলটাপালটা ফিল আপ করতে চায়না সাকিব। আর যে গম্ভীর মানুষ লোকটা, কোন ভুল করে আরেকটা ফর্ম চাইলে ওকে ধরে পিটাতেও পারে! তাই মৃদু স্বরে সে আবার বলল, কিভাবে ফিল আপ করব একটু বুঝিয়ে বলবেন আংকেল?
-শিক্ষিত ছেলে তোমরা, লেখাপড়া জান আর এসব বোঝনা?
আর কথা বলে লাভ নেই, ঝামেলা ভাল লাগেনা সাকিবের। আস্তে করে অসিতের কাছে গিয়ে বলল, ও অসিতদা!
খাতা থেকে মুখ তুলে সাকিবকে দেখে হাসি ফুটল অসিতের মুখে, বলল, আরে সাকিব ভাই! কেমন আছেন?
-আছি রে ভাই ভাল-ই, দৌড়ের উপর আছি……ব্যাস্ত নাকি?
একটু গর্বের সাথে জবাব দিল অসিত, হ রে ভাই, দেখেননা কত পোলাপাইন, রেজিস্ট্রেশনের টাকা নিতেছি……র্যাগের টাকা পয়সা কেমন উঠতেছে সাকিব ভাই?
-উঠতেছে কোনরকম, দেখি কি হয়! এখনও অবশ্য ৩/৪ মাস সময় তো আছেই…বিপদে পড়ছি ভাই।
-আরে কন কন, কি হইছে?
সাকিব ঘটনা জানাল, অসিত হেসে বলল, আরে এটা কোন ব্যাপার নাকি? আসেন এদিকে।
ফর্মটি বুঝিয়ে দিয়ে অসিত নিজে থেকেই বলল, র্যাগ অ্যাকাউন্ট ৯৩৮৯ না সাকিব ভাই? দাঁড়ান, দেখে বলে দিচ্ছি নতুন কোন টাকা জমা হয়েছি কিনা।
বিগত অভিজ্ঞতা থেকে অসিত জানেই যে র্যাগের সময় ছেলেমেয়েরা কয়েকদিন পর পর-ই টাকার খোঁজ নিতে আসে।
লাঞ্চ টাইম হয়ে এল। এখনও অনেক ছাত্র/ছাত্রী লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। কাউন্টারের সামনে একটি খাতা দিয়ে বন্ধ করে বিরতির ঘোষনা দিতেই হতাশার ধ্বণি শোনা গেল ছেলেমেয়েদের কণ্ঠে। অসিত হাবীব সাহেবকে বলল, স্যার, আপনি খেয়ে আসেন আস্তে ধীরে, আমি ততক্ষণ টাকা নিচ্ছি, আপনি আসলে আমি যাব।
অসিত ছাড়া ব্যাংকের কাজ বড়ই স্থবির। বিশেষ করে ব্যাস্ত দিনগুলোতে অসিতকে খুবই দরকার।
।।২।।
অসিত দুইবার এইচ, এস, সি পরীক্ষায় বসেছিল। পাশ করতে পারেনি। শেষে পড়াশুনার পাট চুকিয়ে এই ব্যাংকে ফাই-ফরমাশ খাটার চাকরি নেয়। এই খাবার এনে দেবে, ছোট-খাট কাজ করবে, কখনও পিয়ন, কখনও বা দারোয়ান হিসেবে কাজ করানোর জন্যই তাকে নেওয়া। কিন্তু তার কাজ শেখার ইচ্ছা, যেকোন কাজ দ্রুত বুঝে যাওয়া এবং নির্ভুলভাবে তাড়াতাড়ি কাজ করার যোগ্যতার কারণে সব অফিসার-ই তাদের কাজের কিছু অংশ অসিতের নামে বরাদ্দ রেখে একটু আরাম করে। আর যতই দিন যাচ্ছে এই বরাদ্দকৃত কাজের পরিমাণ বাড়ছে।
অসিতের কিন্তু খারাপ লাগেনা। সদা হাস্যজ্জ্বল সাদা-মাটা চেহারারর যুবকটি সব কাজ কোনোরকম বিরক্তি ছাড়াই করতে থাকে। এত শিক্ষিত ব্যাংকাররা তাকে বড় বড় কাজ করতে বলছে, তার কাজের প্রশংসা করছে এটা ভাবতেই তার ভাল লাগে। সে জানে, তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে মাঝে মাঝে অন্যরা প্রায় একরকম বসেই থাকে বলা যায়, তবে সে এও জানে যে, তার কাজ শেষে অন্যরা যে প্রশংসাটুকু করে তা অভিনয় নয়, এবং যে স্নেহ তারা করে সেটাও নিখাঁদ।
আর যে ব্যাপারটা অসিতের ভাল লাগে তা হল এই ব্যাংকের পরিবেশটা। সবসময় এখানে জ্ঞানীগুনি লোকদের আগমন। কত বড় বড় পি, এইচ, ডি ডিগ্রীধারী স্যাররা আসেন এখানে। সবাইকে বাদ দিয়ে তাকে খোঁজ করেন তাঁরা। কারণ, তাকে বললে কাজ তাড়াতাড়ি হবে। তার কুশল জিজ্ঞাসা করেন, তার বাসার খোঁজ-খবর নেন এত বড় বড় মানুষ। ভাবতেই গর্ব হয় তার। আর ভাল লাগে এখানকার ছাত্রদের আন্তরিকতা। কোনো সমস্যা হলেই “অসিতদা” বলে যখন আপা/ভাইয়ারা তার কাছে ছুটে আসে তখনা তার মনে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চাকরিটাই সে করে। ছাত্র/ছাত্রীদের সব ভাল লাগে তার। তারা রাগলেও ভাল লাগে, আন্দোলন করলে সবসময় সেটা তার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়, এমনকি তারা গালাগালি করলেও সেটা তার ভাল লাগে। এখানে প্রায় ছয় বছর ধরে কাজ করছে সে এবং যতই দিন যাচ্ছে তার ভাল লাগার পরিমাণ বাড়ছে।
আজকে অসিতকে বড়ই আনন্দিত দেখাচ্ছে। অন্যকাজে ব্যাবহৃত পুরাতন একটা টেবিল দেয়া হয়েছে তাকে। টেবিলটা ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করেছে সে। কাপড় ছেড়া ফোম দেখা যাওয়া একটি চেয়ার বসিয়ে সে সুন্দর নিজের অফিস পাতিয়েছে। তার মানে-এখন থেকে আর কোনো স্যারের টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে মাজা হেলিয়ে কাজ করতে হবেনা তাকে। ব্যাংকের অফিসাররা স্নেহের সুরে অসিতকে বলছেন, আরেব্বাবা, আমাদের অসিতের প্রমোশন হয়েছে দেখছি…কি অসিত! অফিস পছন্দ হয়েছে?
আজ তেমন একটা কাজ নেই ব্যাংকে। সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে একে অপরের সাথে হাস্যরসিকতায় মেতেছে। একে অপরের পরিবারের খোঁজ খবর নিচ্ছে, বড় ছেলের দুরন্তপনার কথা বলছে, বড় মেয়ের চঞ্চলতায় কপট দুশ্চিন্তা দেখাচ্ছে, স্ত্রীর রান্নাবান্নার বৈচিত্রতার গল্প করছে, ছোট ছেলের তীব্র মেধার প্রশংসা এবং ছোট মেয়েটিকে ঘরের লক্ষী বানিয়ে গর্ব করছে। আর চুপ করে শুনছে অসিত। সেও স্বপ্নের জাল বুনছে।
ইদানিং খুব বিয়ে করতে ইচ্ছা জাগে তার। বয়স অবশ্য বেশিনা। মাত্র ছাব্বিশ। যে বেতন পায় তাতে বউকে কি খাওয়াবে সে জানেন। তবুও মাকে লাজুক স্বরে মনের কথা জানিয়েছে সে। তার কোনো নির্দিষ্ট পছন্দ নেই। মেয়েটির চেহারা, গায়ের রঙ, স্বাস্থ্য শরীর যেরকম-ই হোকনা কেন কিছুতেই তার আপত্তি নেই। সে বসায় গেলে হাসিমুখে মেয়েটি দরজা খুলে দেবে, তারা একসাথে খেতে বসবে, সে এখানকার স্যারদের, ভার্সিটির ছাত্র-শিক্ষকদের ঘটনা বলে গর্ব করবে-এতটুকুই তার স্বপ্ন।
তার স্বপ্নে বাঁধা পড়ল। সাকিবের আনন্দ বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন এল, আরিব্বাস অসিতদা!! টেবিল পেয়েছ দেখছি! তোমার প্রমোশন হয়েছি নাকি?
লাজুক স্বরে অসিত জবাব দিল, কি যে বলেন সাকিব ভাই! আমার আবার প্রমোশন কি?
-যখনই আসি তোমাকে ব্যাস্ত দেখি, তোমার কিন্তু আসলেও প্রমোশন দরকার।
লজ্জা আর বিনয়ে বিগলিত হয়ে সে প্রসংগ পরিবর্তন করে বলল, কি যে বলেন ভাই?......সাকিব ভাই, র্যাগ ডে’র দিন কি ফিক্সড হইছে?
-হুমম, সেপ্টেম্বারের ২ তারিখ।
হিসেব করে অসিত বলল, মমমম, ও! আর ২মাস, ২১ দিন বাকি তাইলে।
-আরে ভাই আবার মনে করায় দিলা, ব্যান্ড পাচ্ছিনা।
আগ্রহ নিয়ে অসিত জিজ্ঞাসা করল, কোন ব্যান্ড আসবে ভাই? বাচ্চু নাকি জেমস?
হাসল সাকিব, বলল, আরে ওত দামী ব্যান্ড আনতে পারুমনারে ভাই। শিরোনামহীন আর আর্টসেলকে আনতেই হবে। পোলাপাইন খুব চাইতাছে। আর সাথে আরেকটু বড় আরেকটা ব্যান্ড আনব। দেখি কি হয়!
-এরা ভাল ভাই? শুনিনি আগে।
-বলো কি! এখন তো এরাই কোপাচ্ছে…যাহোক, শোন, আমি মানুষকে তেল মারিনা। র্যাগ হবে ২ দিন। প্রথমদিন রঙ মারামারি, আনন্দ র্যালি, ঘুড়ি উৎসব আর র্যাগ ডিনার। আর পরের দিন আমাদের cultural program আর ব্যান্ড নাইট। দুইদিন-ই তোমার উপস্থিতি চাই। প্রথম সারিতে বসায় দিব তোমারে। শিরোনামহীন, আর্টসেলের গান শুনবা, বুঝবা কি বস জিনিস এরা।
কথাটা সাকিব আন্তরিকভাবে বলেছে। অসিত আবেগী মানুষ। এই সামান্য কথাতেই তার চোখে পানি চলে আসতে চাচ্ছে। বলে কি! সে বসবে প্রথম সারিতে! অনেক কষ্টে আবেগ দমন করে সে বলল, অবশ্যই আসব ভাই, অবশ্যই……আপনারা যখন বলছেন অবশ্যই ওরা ভাল ব্যান্ড হবে…অবশ্যই আসব সাকিব ভাই।
।।৩।।
দিবানিদ্রায় নিমগ্ন ছিল সাকিব। র্যাগের কনভেনার রাজনের ফোনে ঘুম ভাঙল তার। উত্তেজিত স্বরে রাজন বলল, ওই শালা, ঘুম থেকে উঠ। তাড়াতাড়ি ব্যাংকে যা।
আরামের ঘুম ভাঙ্গিয়ে কেউ তাড়াহুড়া করতে বললে কারওই ভাল লাগেনা। সাকিব বলল, কি হইছে আগে ক, তারপর ভাইবা দেখুম যামু কিনা।
-ভাব লইসনা সাকিব…শোন দোস্ত, বড় একটা ব্যান্ড পাইছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগ বইল্যা ৮০,০০০ এ করতে রাজি হইছে, কিন্তু পুরা টাকা এ্যাডভান্স চাইছে।
-বুঝলাম, কিন্তু এখন সাড়ে চারটা বাজে, ব্যাংকের লেনদেন তো শেষ।
-আমি ওসব জানিনা, তুই টাকা তুইল্যা আন। আজকে বৃহষ্পতিবার। রবিবার টাকা দিতে বলছে, পরশুরাতে আমি আর তুই ঢাকা রওনা দিব।
-কি মুশকিল! ব্যাংক প্রায় বন্ধ, এখন আমারে ক্যান টাকা দিব?
-শালা ঘটনাটা কইলাম না!!!…আচ্ছা এক কাজ কর, নেতারে লইয়া যা। হালারে তো আর এমনি এমনি ভোট দিয়া নেতা বানাইনি। তোর ভাল কথায় কাজ না হইলে ওরে একটু চোটপাট নিতে বলিস।
-আচ্ছা রাখ তুই, দেখি কি করা যায়।
রুমে একটা নীল খাম ছিল-কোনো এক বন্ধুর বোনের বিয়ের দাওয়াতের, উপরে তার নাম লিখা। সেই খামটা তুলে নিয়ে সেন্ট্রাল এর প্রেসিডেন্ট শাহীন কে নিয়ে ব্যাংকে গেল সে। ব্যাংকের কাজ গুছিয়ে সবাই প্রায় চলেই গেছে। শুধু অসিত আর বীতশ্রদ্ধ চেহারার লোকটি বসা। তাদের দাবির কথা শুনতেই যথারীতি চটে গেল সে। শাহীন চোটপাট শুরু করতে যাবে এমন সময় তাকে আটকিয়ে সাকিব বলল, দাঁড়া, অসিতদারে বইল্যা দেখি আগে। ও বুঝবে ব্যাপারটা।
অসিত সব শুনে বলল, সমস্যা বুচ্ছি ভাইয়ারা। যা করা লাগে আমি করব সব, সমস্যা নাই, কিন্তু ভোল্টের চাবি তো স্যারের কাছে, আপনারা খালি অনুমতিটা নিয়ে আসেন।
সাকিব বলল, বাপরে বাপ! আমি নাই, উনি ঝারি ছাড়া কথাই বলতে পারেন না, তুমি একটু জিগায় দেখোনা অসিতদা।
মৃদু হেসে অসিত বলল, আচ্ছা আমি দেখতেছি।
কিছুক্ষণ পরে অসিত অনুমতি সহ ভোল্টের চাবি নিয়ে ফিরে এল। বলল, কত লাগবে ভাই? চেক দেন।
-লাগবো ৮০০০০, কিন্তু ১ লাখ তুলুম। ঢাকা গিয়া যদি দেখি অন্য ব্যান্ডগুলাও রাজি হইছে তাইলে কিছু এ্যাডভান্স দিয়ে আসলাম!
-কোনো সমস্যা নাই।
কাজ করতে করতে অসিত লাজুক স্বরে বলল, সাকিব ভাই, গত সপ্তাহে বিয়ে করছি ভাই……মেয়ে আই, এ পাশ।
প্রকৃতই আনন্দিত দেখাল সাকিবকে, বলল, বল কি অসিতদা!! শাবাশ, ভালো তো, শিক্ষিত মেয়ে।
-হ রে ভাই, খুব ভাল মেয়ে, বেশী মানুষকে জানাইতে পারিনি ভাই, ছোট অনুষ্ঠান করা হইছিল, আপনাকে জানানোর ইচ্ছা ছিল……।
-আরে কোন সমস্যা নাই, তোমরা গুছাইয়া নাও, তারপর যাবনি একদিন।
অস্থির হয়ে অসিত বলল, অবশ্যই ভাই অবশ্যই, সারাদিন আপনাদের গল্প করিতো ওর কাছে, ও-ও বলছে আপনাদেরকে যাইতে, বলছে খালি মোবাইলে জানাইবেন যখন আসতে চান তার আগে, আর বাকিটা ওর ব্যাপার।
কথা বলতে বলতে কাউন্টারের ভিতরে চলে এল সাকিব আর শাহীন। সাকিব নীল খামটা বের করে বলল, এটায় ভইরা দাও টাকাটা…
এমন সময় আবার কল এল রাজনের নাম্বার থেকে। কলটি ধরে বাইরে বেরিয়ে এল সাকিব। রাজন বলল, আমি অনেক কষ্টে ম্যানেজ করছি দোস্ত, বলছে টাকা মঙ্গলবারে দিলেই হবে।
-শালার পো, তুই খালি ভেজাল বাঁধাস, টাকা তো প্রায় তুইল্যা ফেলছি…এখন কি করুম, এত টাকা এই ২ দিনের জন্য আমি রুমে রাখতে চাইতেছিনা, আর জানস ই তো আমার রুমে সবসময় আড্ডা হয়, কখন কি হয় কওয়া তো যায়না, কিছু হইলে ধরাটা তো আমি আর তুই-ই খামু।
-তাইলে এক কাজ কর তুই, টাকাটা ব্যাংকেই রাইখ্যা দে আবার। সোমবারে তুলিস।
-তাই করা লাগব, কিন্তু তুই জানসনা এটাও লজ্জার একটা ব্যাপার হয়ে গেছে এখন, যা হোক, রাখ ফোন…খবরদার ফোন দিবিনা আর আমারে তুই।
অসিতকে এত কষ্ট দেওয়ার পর আবার টাকাটা রেখে দিতে বলতে লজ্জা লাগল সাকিবের। আর অন্য অফিসারটার রাগান্বিত মুখটার কথা মনে পড়তেই সে শাহীনকে ফোন দিয়ে বলল, দোস্ত, তুই অসিতদারে sorry বইল্যা টাকাটা আবার রাইখ্যা দিতে বল।
অসিত বিন্দুমাত্র বিরক্ত হলনা। শাহীনকে বলল, সমস্যা নাই ভাই। আমি এই নীল খাম সহ-ই আলমারিতে রেখে দিচ্ছি। সোমবার এসে তুলে নিয়েন।
আলমারিতে টাকাটা রেখে বন্ধ করার আগে রশিদ বইয়ে পুনরায় টাকাটা লিপিবদ্ধ করে রাখল অসিত।
ক’দিন ধরে অসিতের স্ত্রী অহনা জেদ ধরেছে সে ঘুরতে যাবে। অসিত স্ত্রীর আবদারের উত্তরে বলে, আরে, আমাদের এখানেই তো পাহাড় সাগর সব-ই আছে, আবার কই যাবা ঘুরতে!
অভিমানের সুরে অহনা বলে, দেখ, তুমি এসবের মধ্যে বড় হয়েছ, তাই হয়ত তোমার আলদা কিছু মনে হয়না। কিন্তু আমি উত্তরবঙ্গের মেয়ে। আমার ভাল লাগে। বিয়ের পর তো সবাই একটু আধটু ঘুরেই। চলনা বান্দরবান অথবা কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসি।
-আচ্ছা ঠিক আছে, কাল রওনা দেই তাইলে, কি বল? কাল পরশু তো ছুটিই।
অসিত নিজেও কল্পনা করতে পারেনি যে তারও এত ভাল লাগবে। শনিবার যখন অহনা জেদ ধরল যে, ঐ রাতটাও সে থাকতে চায় তখন খুব একটা আপত্তি করলনা অসিতও। রবিবারে অফিসে একটা ফোন করে বলা উচিৎ ছিল, কিন্তু নব বিবাহিত স্ত্রীর প্রেমে আর ঘোরাঘুরির নেশায় ভুলে গেল সে।
রবিবার রাতে বাসায় ফিরল তারা। ফিরে দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা বসে আছে তার বাসার সামনে। অস্থির হয়ে অসিত বলল, আরে ভায়ারা, একটা ফোন দিয়ে আসবেননা? বাড়িতে তো তেমন কিছুই নাই। এরপর লাজুক স্বরে বলল, বউকে নিয়ে একটু ঘুরতে……
কথা শেষ করতে পারলনা সে। তার আগেই এগিয়ে এসে প্রচন্ড জোরে অসিতের গালে চড় বসিয়ে দিল শাহীন। বলল, খুব পয়সা হইছে তোর, না? পিরীত করিস দূরে গিয়া? শালা চোর!
বিস্ময়ের ধাক্কা কাটেনি বলে অপমানবোধ তখনও ছেয়ে ধরেনি অসিতকে। অবাক কণ্ঠে সে বলল, কি করছি ভাই? কোনো বেয়াদবি হইছে?
এগিয়ে এসে রাজন বলল, তোমাকে কত বিশ্বাস করতাম আমরা, আর তুমি এই কাজ করতে পারলা?
-কি করলাম ভাই?
এবার অপর গালে চড় বসিয়ে দিয়ে শাহীন বলল, কিছু বুঝিসনা, না? শালার অভিনয় দেখ। এর সবসময়কার মহাবিনয় দেখে আমার কখনই ওরে ভাল মানুষ মনে হয়নি।
এবার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল অসিতের। ঝাপসা চোখে একবার ছাত্রদের দিকে, আরেকবার নতুন স্ত্রীর দিকে তাকাল সে।
বাসে চড়লেই বমি করার স্বভাব অসিতের, তাও আবার পাহাড়ী পথ। অসুস্থ আর লং জার্নি করা পরিশ্রান্ত স্বামীর উপর এই অত্যাচার আর অপমান সহ্য করতে না পেরে ভেজা চোখে রাজনকে জিজ্ঞাসা করল অহনা, উনাকে আর মারতে নিষেধ করেন দাদা…কি হইছে একটু বলবেন দয়া করে?
-বৌদি, আমাদের র্যাগ এর ১ লাখ টাকা চুরি করেছে অসিতদা।
আবারও বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকাল অসিত। শাহীন আদেশ দিল, শালারে নিয়ে চল ক্যাম্পাসে।
অস্থির হয়ে স্বামীর কাছে দৌড়ে এল অহনা। যে মেয়ে একা ঘরেও অসিতকে জড়িয়ে ধরতে লজ্জা পায় সে জনসম্মুখে অসিতকে শক্ত করে ধরে বলল, আপনাদের কোনো ভুল হয়েছে ভাইয়ারা, বিশ্বাস করেন, ও এই কাজ করতেই পারেনা। ওর মত মানুষ!! সারাদিন যে লোক আপনাদের গল্প করে!
রাজন ধীর স্বরে বলল, বৌদি সরুন তো।
অসিতের দুহাত ধরে রেখেছে ছাত্ররা। ক্ষক্ত-বিক্ষত হৃদয়ে, স্ত্রীর সামনে সকল পৌরষত্ব হারিয়ে থুতনি দিয়ে অহনার মাথা স্পর্শ করল অসিত। ভাঙ্গা কণ্ঠে বলল, কিচ্ছু হবেনা আমার। তুমি ক্লান্ত, ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও-যাও। এরা ছাত্রমানুষ! ছাত্রদের মাথা গরম-ই থাকে। যাও বউ…
এরপর কানে কানে বলল, আরে বাবা, ছাত্রদের রক্ত গরম থাকবেনা তাহলে কাদের থাকবে বল। ভুল ভাংলে আবার দেখবা কত ভাল ব্যাবহার করছে ওরা।
ছোট বিশ্ববিদ্যালয়। সামান্য ঘটনা ঘটলেই সেটা বিশাল ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়, সবার ভিড় জমে যায়। অসিতকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। সেই দুপুরের পর থেকে আর কিছু খায়নি সে। শরীরে ক্লান্তি আর অন্তত একজন মানুষকেও সত্য কথাটা বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যার্থ হওয়ার অবসাদ তার মনে। চারিদিকে নিরুপায় হয়ে তাকাচ্ছে সে। কত ভালবাসত এরা তাকে। TT তুলতে আসা আপাটা ঘৃণার চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আরেকটি ছেলে বলছে, গরীব মানুষ, লোভ সামলাতে পারেনি মনে হয়। অসিতদা বইল্যা দেন কই রাখছেন টাকাটা।
যারা তার পক্ষে তাদের মনে তার প্রতি সহানুভুতি, আর বাকিদের মনে রাগ আর ঘৃণা। কিন্তু কারও মনে তার প্রতি বিশ্বাস নেই। শাহীন আর তার দলের সাঙ্গপাঙ্গরা বেশ মেরেছে তাকে। বলছে, বুচ্ছি তো দূরের কোন ব্যাংকে গিয়ে রাইখ্যা আসছস টাকাটা। সেজন্যই তো রবিবার আসসনি অফিসে।
রাজন বলল, শোন অসিতদা, যে টাকা খরচ করছ-করে ফেলছ, সমস্যা নাই। বাকিটা ভালই ভালই দিয়ে দাও। কাল ঢাকা যেতে হবে আমাদের।
শাহীন বলল, কিসের! পুরো এক লাখ টাকা দিবি তুই হালার পো। কোথা থেকে দিবি, কি করবি আমরা জানিনা। কাল সকাল হলেই এনে দিবি।
রাত বাড়ার সাথে সাথে ভিড় কমতে শুরু করল। অনেকে ঘুমাতে চলে গেল। ক্ষুধা পিপাসায় জর্জরিত অসিত এক গ্লাস পানি চাওয়ারও সাহস পেলনা। পরদিন সকালে ভার্সিটির স্যাররা, ব্যাংকের লোকেরা অসিতকে ঘিরে দাঁড়াল। এত নির্যাতনের পরেও ঘুমিয়ে পড়েছিল অসিত। চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে। শুধু আশপাশের সম্মানিত মানুষ গুলোর চোখের ঘৃণাটুকু দেখে কষ্ট আর নিরব অভিমান নিয়ে একেক জনের চোখের দিকে তাকাচ্ছে সে। শেষে ডীন কে বলল, স্যার ভায়াদের একটু বলেন, আমাকে ছেড়ে দিতে। আমি এনে দেব এক লাখ টাকা।
সবার মধ্যে রোল উঠল, এই এই স্বীকার করেছে চোরটা।
সকাল প্রায় আটটা। সবাই আজ আগেই চলে এসেছে। হঠাৎ সাকিবকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। হাপাতে হাপাতে সবার উদ্বেগকে উপেক্ষা করে অসিতের বাঁধন খুলে দিল সে। সারারাত ঘুমায়নি ও। এরপর সকলের উদ্দেশ্যে বলল, প্রথম কথা অসিতদাকে আমি কখনই আপনাদের মত অবিশ্বাস করতে পারিনি। আমি কাল সারা দিন রাত অনেক খোঁজ খবর নিয়েছি।
এবার শব্দ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল অসিত। বলল, সাকিব ভাই, একটু পানি খাব ভাই।
সাকিব জুনিয়র এক ছেলেকে খাবার আর পানি আনতে বলল। তারপর সবার উদ্দেশ্যে বলল, প্রথম কথা, ব্যাংকে এত টাকার মধ্যে মাত্র ২টা পঞ্চাশ হাজারের বান্ড্ল নেই এটা জানা এত সোজা ব্যাপার নয়। জানা গিয়েছিল কারণ ওই টাকাটা রাখা হয়েছিল নীল রং-য়ের এক খামে ভরে। এ কথাটা জানত শুধু শাহীন আর অসিতদা। রবিবার সকালে আমি যখন টাকা তুলতে যাচ্ছিলাম তখন দৌড়ে এসে আমার সাথে ব্যাংকে যাইতে চাইল শাহীন। নীল খামের কথা উল্লেখ করল সে এবং সেটা না পাওয়ায় সে অসিতদাকে ডাকার কথা বলল, ওইদিন অসিতদা অফিসে যাননি। এরপর আরেক অফিসারকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে উনি বললেন যে, ওই সময় উনি কাজ করছিলেন, অসিত-ই পুরা ব্যাপারটা দেখছিল। যা হোক, সেই আমার নাম লেখা নীল খামটা আমি কাল রাতে শাহিনের তোষকের নীচে পেয়েছি। গতকাল সে শহরে গিয়েছিল ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে। Dutch Bangla Bank এ নতুন অ্যাকাউন্ট খুলেছে সে। টাকার পরিমাণ এক লাখ। একটু আগে চুপ করে ওর রুমে ঢুকে ওর মানিব্যাগে টাকা জমা দেওয়ার রশিদটা পেয়েছি আমি……কাল রাতে কিছু বলতে পারিনি কারণ সেটা ছিল আমার সন্দেহর কথা আর তাতে হয়ত শাহীন সাবধান হয়ে যেত।
ছাত্রদের চোখে মুখে তীব্র লজ্জা ফুটে উঠল। তবে তাদের চাইতেও বেশী লজ্জা পেল অসিত। এ কেমন কথা! একজন ছাত্র, তিনি আবার সব ছাত্রদের নেতা। তিনি কিভাবে এই কাজ করেন!! সে বুঝতে পারল যখন আলমারি বন্ধ না করেই রশিদ বইয়ে লিখছিল সে, তখনই টাকাটা সরিয়ে নিয়েছিল শাহীন। কিন্তু তার মনে ভুলেও সন্দেহ জাগেনি। তার বাবা সবসময় বলেন, বাবা। সবকিছু চেক করা তোর চাকরির দায়িত্ব। যত বিশ্বাসী মানুষই হোকনা কেন তোর দায়িত্ব পালন করা তার প্রতি বিশ্বাসের অবমাননা নয়। ঠিক-ই তো, দোষ তো তারও আছে। আলমারি লাগানোর আগে তার আরেকবার চেক করা উচিৎ ছিল। সকল ছাত্র আর শাহীন ভাই যে লজ্জা পেল এখন, তার চাইতে সে চুরি করলে তো অনেক কম লজ্জার ব্যাপার হত।
অপরাধবোধে জর্জরিত ছাত্ররা জড়িয়ে ধরল অসিতকে। জাপটে ধরে তাকে কাঁধে নিল তারা। বিনীত লজ্জায় গর্ব ভরে সে মনে মনে বলল, ছাত্র মানুষ! রাগ পানি হয়ে গেলে তারা তো এমন-ই। তাকে ঘাড়ে নিয়ে ছাত্ররা মিছিল করতে করতে শাহীনের রুমের দিকে গেল। কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে রড। ঘুম ভেংগে এই রুপ দেখে শাহীন সব বুঝে গেল। ভয়ে আত্না শুকিয়ে এল তার। সবাই সবকটি দরজা দখল করে হলে ঢুকছে। পালানোর কোনও পথ নেই। বারান্দা দিয়ে এদিক ওদিক দৌড়ে শেষে বাথরুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল সে।
একের পর এক লাথিতে স্ট্রেংথ হারাচ্ছে বাথরুমের দরজাটি। ভুলের প্রায়শ্চিত্ত, জনসম্মুখে নিজেদের চারিত্রিক কলংক, শিক্ষক আর ব্যাংকের লোকজনদের সামনে নিজেদের কুশ্রী রুপের নগ্ন প্রকাশ প্রত্যেকটি ছাত্রকে যেন লজ্জায় পাগল করে দিয়েছে। শাহীনের মনের অবস্থা বুঝতে পারল অসিত। ছাত্রদের জড়িয়ে ধরে বলল, মাফ করে দেন ভাই। দু’দিন পর একসাথে পাশ করে বের হয়ে যাবেন। একসাথে চাকরি করবেন। র্যাগে একসাথে আনন্দ, নাচ-গান করবেন। ভুলে যান ভাই সব। ভার্সিটি জীবনের শেষ কয়টা দিন একসাথে গলা ধরাধরি করে কাটাইয়া দেন…দেন তো ভাই, রড-লাঠি আমার হাতে দেন।
প্রত্যেকের হাত থেকে রড-লাঠি নিয়ে নিল অসিত। কেউ বাঁধা দিলনা। সামান্য এই মানুষটার কাছে দ্বিতীয়বারের মত ছোট হল তারা। তাই মনে তীব্র যন্ত্রনা আর অনুশোচনা নিয়ে নিরবে মেনে নিল তার নেতৃত্ব। তার একটু পরেই শাহীন দরজা খুলে বেরিয়ে এল। অসিতকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সে।
গর্বে আর আনন্দে অসিতের চোখে পানি। আহা! অহনা নেই। স্বামীর অপমানটুকুই দেখল সে। তাকে নিয়ে ছাত্রদের আনন্দ মিছিল আর এই ছাত্রনেতার (হোক না সে ভুল করেছে একবার! ছাত্র মানুষ তো!) তাকে জড়িয়ে ধরা দেখতে পেলনা অহনা। দেখলে অনেক গর্ব হত ওর।
সবার পক্ষ থেকে অসিতের কাছে ক্ষমা চেয়ে ডীন বললেন, সাকিব ছাড়া তোমাকে কেউ বিশ্বাস করিনি আমরা। আমার করা উচিৎ ছিল। তোমার বাবার মত সৎ লোকের ছেলে এমন হতেই পারেনা বোঝা উচিৎ ছিল আমার…একটা দুঃখের খবর আছে অসিত। ব্যাংকের হেড অফিসে ব্যাপারটা জেনে গেছে। অযোগ্য-অসাবধান লোককে দিয়ে এত কাজ করানো হত শুনে ম্যানেজারের উপর বেশ এক চোট নিয়েছে তারা। যদিও আমরা জানি, তুমি কতটা যোগ্য লোক ছিলে। যাহোক, আমি VC স্যারকে তোমার কথা বলেছি। হয়ত কোনো চাকরি হয়ে যাবে।
বিন্দুমাত্র কষ্ট দেখা গেলনা অসিতের মুখে। আবেগরূদ্ধ কণ্ঠে সে বলল, আজকে যে ভালবাসা পেলাম স্যার!.........আমার চাকরি নেই, কিন্তু ভাইয়ারা বিশ্বাস করেন, আমার মনে প্রমোশন পাওয়ার আনন্দ।
মন্তব্য
বেশ ভাল লাগলো সাদ। লিখতে থাকুন মন খুলে।
অনন্ত আত্মা
পড়ে একি সাথে মন খারাপ ভালো দুটোই হল। অনেক ভাল লিখেছেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ অনন্ত আত্না এবং আজব পোলা ভাইকে
ভাল্লাগছে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ জামান ভাই.........
খুব ভালো লাগলো। ভার্সিটি লাইফের দিনগুলো আসলেই খুব অস্থির ছিল। আবেগের বশে এরে মাথায় তুলি তো ওরে লাথি মারি।
ধন্যবাদ আশরাফ ভাই, আমারও খুব মনে হয় রে ভাই ভার্সিটি লাইফের কথা, সেজন্য প্রায় সব লেখাতেই থাকে..................
লেখা ভাল্লাগছে, চালিয়ে যান।
কামরুল হাসান রাঙা
ধন্যবাদ রাঙা ভাই, চেষ্টা করব চালিয়ে যাওয়ার জন্য
শাহীনদের অভাব নেই ক্যাম্পাসে-ক্যাম্পাসে, অসিত'দের খোঁজা কষ্টসাধ্য।
এই গল্পটি চমৎকার হয়েছে সাদ, চালিয়ে যাও।
দিগন্ত দোস্ত, অনেক অনেক ধন্যবাদ। এরকম মানুষ আসলেও কম, কিন্তু আমার জীবনে এরকম ৪/৫ জনের দেখা মিলছিল। বলাই বাহুল্য কেউ তারা ধনী না, সবার অবস্থা অসিতের মতই
ভাই, আমিতো পইড়া পুরা টাস্কি খাইয়া গেলাম! জটিল হইছে বস
অনেক অনেক অনেক অনেককক...... ভালো লাগলো!
খুবই সুন্দর হইছে গল্পটা!
অসিতের চরিত্র আপনি যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাতে আমি মুগ্ধ!
এই গল্পটি থেকে একটি চমৎকার নাটক তৈরী করা যেতে পারে।
দারুণ!!!!
--শাহেদ সেলিম
হাহ হা, সেলিম ভাই, অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমার আগের লেখাগুলাতেও মন্তব্য করেছিলেন এবং সবসময় উৎসাহ দিছেন। সেজন্য আবার ধন্যবাদ। আপনার ভাল লাগছে জেনে আসলেও অনেক ভাল লাগল। আপনি নাটকটা পরিচালনা করতে চাইলে করতে পারেন, আমি আনন্দের সাথে দেখব সেটা
অতি উত্তম প্রস্তাব মাহবুব ভাই
এই গল্পের সবচেয়ে ভালো লেগেছে যেটা সেটা হলো দৃশ্যবর্ণনা। আসলেই খুব ভালো লেগেছে। লেখালেখি চালিয়ে যান ভাই। আপনার কাছ থেকে অনেক অনেক ভালো লেখা পাওয়া সম্ভব।
শাহেদ সেলিম
চমৎকার একটা গল্প। কিছুক্ষনের জন্য নিজের ছাত্রজীবনে ফিরে গিয়েছিলাম। আমাদের আশেপাশে এমন অনেক বড়মনের অসিত ছড়িয়ে আছে। আমাদের মনের নীচতা নিয়ে আমরা বার বার অসিতদের সামনে লজ্জিত হই।
এমন চমৎকার গল্পের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ রঙ্গিন ভাই..সবার মধ্যেই ভাল কিছু থাকে সেটাই দেখাতে চেয়েছি......ছাত্রজীবন সময়টা আসলেও বেশী বস ছিলরে ভাই
আপনার গল্পের ভাষা, বর্ণনার গতি এবং ছোট কিছু দৃশ্যকল্প ভালো লেগেছে। উপরে এক অতিথি যা বলেছেন- সে রকম আমারো মনে হচ্ছিলো একটা গতিময় নাটক দেখছি। ড্রামাটিক গল্প যাকে বলে- সে রকম লেগেছে।
যেটা ভালো লাগেনি, সেটি হলো প্লটটা। বহু ব্যবহৃত। র্যাগের একাউন্টের কথা আসতেই আন্দাজ করা গেছে কী হতে চলেছে।
যাকগে, হাতপা খুলে লিখতে থাকুন। আপনার আরো অনেক লেখা পড়বার আশায় রইলাম।
_________________________________________
সেরিওজা
ধন্যবাদ সুহান ভাই। আসলে নিজের বাস্তবের কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখাটা সহজ মনে হয়। পুরো কল্পনা করে লেখা ফুটিয়ে তোমার যোগ্যতা এখনও আসেনি।
আপনার প্রশংসা টা পড়েও অনেক ভাল লাগল...
আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে গল্পটি এবং বলার ভঙ্গিটি।
আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে গল্পটি এবং বলার ভঙ্গিটি।
আর আমার ভাল লেগেছে যে আপনার এটা এত ভাল লেগেছে, অনেক ধন্যবাদ হোসেন ভাই
দুঃখজনক ব্যাপার হলো অসিতদের সাথে প্রায় সবসময় এইরকমই হয়ে আসছে। গল্প চমৎকার লেগেছে। আরো লিখুন।
অনেক ধন্যবাদ বই খাতা ভাই............লিখব আরও ইনশাল্লাহ
অনেক ধন্যবাদ বই খাতা ভাই............লিখব আরও ইনশাল্লাহ
ভালো লাগলো
নতুন মন্তব্য করুন