(১)
Battersea,South London.
গোধূলির রেশটা তখনো যায়নি পুরোপুরি। সন্ধ্যার আকাশে নানান রঙের খেলা। এলোমেলো একটা নীলচে ভাব পুরো শহরটা জুড়ে। ঘোলাটে চোখ মেলে তাকায় সৃজন। দৃষ্টি ঝাপসা করে দেয় জানুয়ারীর কুয়াশা। কেমন যেন ভূতুড়ে একটা ভাব আছে England এর শীতের। হয়তো এখনই দূরের Albert Bridge,এমনকি বিগবেন টাও স্পষ্ট দেখা যাবে,পর মুহূর্তেই একটু দূরের টেমস এর ঢেউ গুলোর তীরে আছড়ে পড়াটাও ঝাপসা লাগবে চোখে।
কনকনে শীত বলতে যা বোঝায় অনেকটা তাই লাগছে সৃজনের। জ্যাকেটের কলারটা কান পর্যন্ত তুলে দেয় সে। শীতের এই আমেজটা টেমসের ধারের এই জায়গায় বসে সব সমসময়ই উপভোগ করে। বাইশটা শীত পার করেছে তো সে এখানেই। অনেক ভালো লাগে তার এই জায়গাটা। কিন্তু আজ সবকিছুই যেন ধূসর হয়ে গেছে। পুরো পৃথিবীটা যেন ওলোটপালোট হয়ে গেছে তার। দূরের আকাশটার দিকে মুখ তুলে তাকায় সে। অনেকগুলো তারা যেন মিটমিট করে হাসছে। মুখ নামিয়ে নেয় সে। চোখ জলে ভরে আসে। হাতদুটো ভাজ করে রাখে হাঁটুর উপর। তাতে মাথা গুঁজে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। অনুভূতিগুলো আজ ভোঁতা হয়ে গেছে,চোখের জলগুলো গেছে শুকিয়ে। জীবনের কাছ থেকে আর কোন চাওয়া নেই সৃজনের। জীবনটা যে আজ তার সবগুলো দরজা বন্ধ করে দিয়েছে তার জন্য।
টিউমারটার নাম অলিগোডেনড্রোগ্লিয়মা। সহজ ভাষায় বলতে গেলে খুব কমপ্লিকেটেড একটা ব্রেইন টিউমার। এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ ভীষন মাথা ব্যথা করে উঠলো। প্রায়ই এমন হয়,কিন্তু সেদিন যেন সবকিছু ছাড়িয়ে গেলো ব্যথাটা। ডক্টর-হসপিটাল বরাবরই আদিখ্যেতা লাগে তার কাছে। কিন্তু সেদিন অ্যাভয়েড করতে পারেনি। সেইন্ট বারথোলোমিউস হসপিটাল,কাছেই। এক ফ্রেন্ড ইন্টারনি করছে ওখানে,তাই যাওয়া। কিছু টেস্ট,ডায়াগনোসিস। গতকালই রিপোর্ট হাতে পেয়েছিলো। আজ অ্যাপয়েনমেন্ট ছিলো ডক্টরের কাছে। কঠিন সত্যটা জানাতে বেশি দেরি করেননি ডক্টর। একেবারে ম্যালিগন্যান্ট স্টেইজে ধরা পড়েছে। কোন ট্রীটমেন্টেই আর কাজ হবার নয়। শুধু বসে বসে দিন গোনা,মৃত্যুর প্রহর গোনা।
বসে বসে এইসবই ভাবতে থাকে সৃজন। আর সময় বেশি বাকি নেই তার। চুপচাপ বসে থাকে। ডুকরে কেঁদে ওঠে হঠাৎ।
Battersea-র পাড়ে আছড়ে পড়া টেমসের সশব্দ ঢেউয়ে ঢাকা পড়ে যায় তার কান্না।
(২)
প্রায় মাঝরাত। ব্যাটারসী পার্ক অ্যাভিনিউ ধরে হাটতে থাকে সৃজন। রাস্তার ধারের এ বিশাল পার্কটা তে ছোটবেলার অসম্ভব সুন্দর কিছুর স্মৃতি আছে তার। মায়ের সাথে ফেসটিভাল গারডেনগুলোতে ছবি তোলা কিংবা ইয়ারলি কারনিভাল গুলোতে ঘুরে বেড়ানো।
মা,হাহ. . . .একটা দীর্ঘশ্বাস চলে আসে সৃজনের বুকটা বেয়ে। পৃথিবীতে এই মা word টা কে মনে হয় সব থেকে বেশি ঘৃণা করে সে। তার দুই মাস বয়সে তার মা নিজের সংসার ছেড়ে আরেক লোকের হাত ধরে বাংলাদেশ থেকে UK চলে আসে। শৈশব বলতে এক অসহনীয় সময়ের কথা মনে পড়ে যায় সৃজনের। ঘৃণা করে সে তার শৈশব কে। পাষন্ড এক লোককে কখনো বাবা বলে ডাকতে পারেনি সে কোনদিন।যখন বুঝতে পারে এদের সাথে থাকা মানে নিজের জীবনটা কে শেষ করে দেওয়া,তখনই তাদের ছেড়ে চলে আসে। নিজের একটা জগত বানিয়ে নেয় সৃজন। পার্ট-টাইম জব করে নিজের জন্য একটা অ্যাপারটমেন্ট জুটিয়ে নেয় সে। ব্যাটারসী পারক অ্যাভিনিউ এর পরের ব্লকেই, Silverthorne Road-এ রোডে ছোট্ট ছিমছাম একটা স্টুডিও অ্যাপারটমেন্ট। পেশায় একজন আর্টিস্ট সে। ছবি এঁকে,পার্ট-টাইম জব করে নিজের জীবনটা কে চালিয়ে নিচ্ছিলো। বেশ ভালোই তো চালিয়ে নিচ্ছিলো। কিন্তু আজ তো তার পৃথিবীটাই এলোমেলো হয়ে গেলো। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো. . . . স-অ-ব-কি-ছু . . . . কেন???????? আকাশটার দিকে তাকিয়ে অনেক জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে সৃজন।
ভাবতে ভাবতে এসে গেল নিজের অ্যাপারটমেন্টের সামনে। দরজা খুলে জ্যাকেটটা তুলে রাখলো হ্যাঙারে। ঘুরে তাকিয়ে দেখলো নিজের ঘরটা।
ছোট্ট লিভিং রুমটায় ঢোকার মুখে অনেকগুলো windchimes। গত সামারে একটা পেইন্টিঙ বেচে কেনা। খু-উ-ব ভাল্লাগে তার। বাতাস এসে যখন নাড়া দিয়ে যায়,টুঙটাঙ শব্দে ভরে হায় ছোট্ট ঘরটা। ইনটেরিয়রটা হালকা কফি কালারের। একদিকের দেয়ালে গ্রীক লাভ গডেস আফ্রোদিতি-র একটা পেইন্টিং। একটা পাথুরে গুহায় জলের স্রোতে পা ডুবিয়ে চুলগুলো সামনে এলো করে দাড়িয়ে আফ্রোদিতি। কী দ্যুতি তার চারপাশে। কলেজের final term-এ তার এক ফ্রেন্ড প্রেজেন্ট করেছিলো তাকে।
পাশেই একটা ছোট্ট ওয়ারড্রোব। কাছেই একটা টেবিল। অনেকগুলো ক্যান্ডলস্ট্যান্ড ওখানে। অনেক রাতেই সব বাতি নিভিয়ে ক্যান্ডলগুলো জ্বালিয়ে তার মৃদু আলোয় চলতো পেইন্টিঙ।
মস্তবড় French window টা ঘরের একটা দিক পুরোটাই দখল করে রেখেছে। এক কাপ কফি হাতে নিয়ে প্রায়ই এখানে দাঁড়াতো সৃজন। দূরের টেমসটাকে অনেক সুন্দর লাগতো,রাতে চাদের আলোয়। জানালার ঠিক পাশেই তার ক্যানভাসগুলো। স্ট্যান্ড-এ দাঁড় করানো ৩-৪ টা ছোট-বড় ক্যানভাস। যখন মন চাইতো সাদা ক্যানভাসটার বুকে রঙ ছুঁড়ে তুলির আঁচড়ে একের পর এক ছবি একে যেত সে। এক নাম না জানা উন্মাদনায় পেয়ে বসতো তাকে। আর্ট যে শুধু তার পেশা তা নয়,পেশার থেকে বড়ো এক নেশা।
ছন্নছাড়া ভাবনাগুলো তো ছুটি দেয় না। জীবনটাকে না বলা কি খুব কঠিন??? খুব তো বাঁচতে ইচ্ছা করছে আজ। আগে তো কখনো জীবনটাকে এতো ভালোবাসতে ইচ্ছা করেনি??? সে তো বাঁচতেই চেয়েছিলো এই সুন্দর পৃথিবীটাতে, আর তো বেশি কিছু নয়,খুব কি বেশি ছিলো এটা??? খুব কি বড়ো চাওয়া ছিলো?? চোখের নোনতা জল শুকিয়ে যায়।
হঠাৎ মনটাকে শক্ত করে সৃজন। চোখের জল মুছে নেয়। একটা কাজ বাকি আছে এখনো। পৃথিবীতে আপনজন বলতে একজনকেই মানে সে,যাকে আজ পর্যন্ত কোনদিন দেখেনি সে। তার বাবা! ছোটবেলায় দেশে ফেলে আসা বাবা!বাবার কাছেই যাবে সে। মৃত্যুর আগে নিজের দেশটাকেও যে একবার দেখতে হবে তার।
(৩)
হিথ্রো থেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ঢাকাগামী ফ্লাইটে উঠলো সৃজন। জার্নির লম্বা সময়টা একটা ব্যপার নিয়ে ভেবেই কাটিয়ে দিলো। কেমন হবেন তিনি??? কী বলবেন যখন এত বছর পর দেখবেন নিজের ছেলেকে??? বাবার কনট্যাক্ট নাম্বার ছিলো তার কাছে। কদিন আগে তার সাথে কথা হয়েছে ফোনে। শান্ত সুস্থির একতা কন্ঠ। মনে অনেক সাহস এনে দেয়। সৃজন লুকায়নি কিছু তার কাছে। জানিয়েছে মৃত্যুর আগে কিছুদিন কাটাতে চায় তার সাথে। বাবা বলেছেন,ঢাকা চলে আসতে। বেশি কথা হয়নি আর।
একটা ম্যাগাজিনে নাক ডুবিয়ে রাখলো সৃজন। ঢাকায় ল্যান্ড করলো ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেনটা। এয়ারপোরটের চেকিং শেষ করে বের হয়ে আসলো। অনেক মানুষ সেখানে। এর মধ্যে থেকে বাবাকে কীভাবে খুজে পাবে ভাবতে লাগলো সৃজন। তার খুঁজতে হলো না। মাহমুদ সাহেব নিজেই ছেলেকে খুজে বের করলেন। কোন কথা হলো না। শুধু একবার ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন বুকের সাথে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে একটা ক্যাব ডাকলেন। ছেলেকে নিয়ে সরাসরি নিজের বাসায় উঠলেন।
সৃজনরা UK চলে যাবার পর একলাই থেকেছেন মাহমুদ সাহেব। আর বিয়ে করেননি। একটা স্কুলে পড়ান। মাইনে যা পান তাতে কোনমতে নিজের খরচটা চালিয়ে নেন। পল্টনের ছোট একটা ফ্ল্যাটবাড়ি।
ঢাকায় এসে প্রথম কয়েকদিন একটু জিরিয়ে নিল সৃজন। বাবার সাথেও খুব বেশি একটা কথা হয়নি তার। অসুস্থতা দিন দিন বেড়েই চলেছে তার। শরীরটাও দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে।
ঢাকায় আসার তৃতীয় দিন। সন্ধ্যাবেলা। বারান্দায় বসে আছে বাবা-ছেলে।
মাহমুদ সাহেব বললেন,
-“শরীরটা এখন কেমন সৃজন????“
-“ভালো,বেশ ভালো, বাবা তুমি চিন্তা করো না। কোন লাভ তো নেই চিন্তা করে।“
কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকার পর সৃজন বলে উঠলো,
-“বাবা, আর বেশিদিন নেই, আমি বুঝতে পারছি . . . . . “
-“এভাবে বলো না বাবা,তুমি জানো না ব্যপারটা আমার জন্য কতোটা পেইনফুল??্রর? এতোদিন পর ছেলেকে পেলাম অথচ তাকে পেয়েই আবার হারিয়ে ফেলবো??? জীবনটাতে আমি এতো বেশি ভুল ই কি করেছি যে আমাকে এমন সময়ও দেখতে হলো???নাকি আমার ভুলগুলোর শাস্তি সৃষ্টিকর্তা তোমাকে দিচ্ছেন??? মনটা তো একেবারে ভেঙে গেছে আমার. . . . “, বলতে গিয়ে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো মাহমুদ সাহেবের।
বাবার দিকে মুখ তুলে তাকালো সৃজন। তার হাতটা ধরে বললো,
-“বাবা তুমি মন খারাপ করো না, কিছু করার তো নেই, সৃষ্টিকর্তা আমার জন্য যে নিয়তি নির্ধারন করে দিয়েছেন তা তো আমি তুমি চাইলেও খন্ডাতে পারবো না। এর থেকে কি ভালো হয়না, বাকি যে সময়টা আছে দু‘জন মিলে একসাথে কাটিয়ে দেইদ???“
হাসি ফুটলো তার বাবার মুখে। চা করে নিয়ে আসতে গেলেন তিনি।
বাবার জন্য নিজের করা একটা পেইন্টিঙ নিয়ে এসেছে সৃজন। গত কয়েকদিন মনেই পড়েনি। আসলে এতোদিন পড়ে বাবার সাথে দেখা, ক্লান্তি সব মিলিয়ে ভুলেই গিয়েছিলো এটার কথা। স্যুটকেসটা খুললো সে। ভেতর থেকে পেইন্টিঙটা বের করে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাড় করিয়ে রাখলো।
কিছুকখন পর মাহমুদ সাহেব চা নিয়ে আসলেন। ট্রে-টা সাইড টেবিলের উপর রেখে চেয়ারে বসতে নিয়েই তার চোখ পড়লো পেইন্টিঙ-টার ওপরে। কিছুকখন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলেন ওটার দিকে। চোখ ফিরিয়ে আবার তাকালেন স্রিজনের দিকে।
-“সৃজন এটা কি তোমার আঁকা????“
-“হ্যাঁ বাবা, কেমন হয়েছে????“
-“খুব ভালো হয়েছে,অনেক সুন্দর হয়েছে বাবা।“ একটু হাসলেন মাহমুদ সাহেব।
সৃজন ও হাসলো। খুব সুন্দর তার হাসিটা। নির্মল সে হাসিটার দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা ডুকরে কেঁদে উঠলো তার। তার নিষ্পাপ ছেলেটার কি দোষ ছিলো??? সবই কি ভাগ্যের পরিহাস??? চোখের পানি অনেক কষ্টে রাখলেন। মুখে জোর করে হাসিটা ধরে রাখলেন। ঠোটগুলো কিছুটা যেন কেঁপে উঠলো তার।
-“এটা তোমার জন্য নিয়ে এলাম বাবা, তোমার ভালো লেগেছে শুনে অনেক ভাল্লাগলো। লাস্ট মানথে কলেজের এক্সিবিশনে আমার একটা পেইন্টিঙ অনেক পাউন্ড দিয়ে কিনে নিলেন এক ভদ্রলোক। যদিও টাকার কোন ভ্যালু নাই আমার কাছে। বেঁচে আছি তো শুধু এই আর্টের উপরেই। বলতে পারো এটা আমার নেশা। হাহাহাহা . . . . . “ , বড়োসড়ো একটা হাই তুললো সৃজন, “ঘুম পেয়েছে বাবা,আমি শুতে গেলাম। “
-“হ্যা বাবা,যাও ঘুমিয়ে পড়,রাত হয়েছে ভালই,আমার তো খেয়ালই ছিলো না,বুড়ো হয়েছি কিনা,সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়, “জলদি করে বললেন মাহমুদ সাহেব।
ছোট করে হেসে চলে গেল সৃজন।
কয়েকদিন পর। ঢাকা। নিজের রুমে বসে বাবার একটা পোরট্রেইট আকছিলো সৃজন। অলমোস্ট হয়ে এসেছে। শেষ কিছু আচড় দেয়া বাকি তুলির, ব্যস হয়ে যাবে তারপর।
বাবার খুকখুক কাশির শব্দে পিছু ফিরে চাইলো সৃজন।
-“ভেতরে এসো বাবা, তোমার ছবিটা তো হয়ে এলো প্রায়,“ মুখ তুলে বাবার দিকে তাকালো।
-“হ্যা,বেশ ভলো হয়েছে। সৃজন,কিছু কথা বলার ছিলো বাবা,একটু শুনবে???“
-“বলো বাবা,“ রঙ-তুলি একদিকে সরিয়ে চেয়ারটা পেতে দেয় সে বাবাকে বসার জন্য। নিজে খাটের উপর উঠে গিয়ে বসে।
বসেন মাহমুদ সাহেব। কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে শেষে বলে ওঠেন, “কীভাবে কথাটা বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না বাবা। আসলে সেদিন তোমার ছবিটা দেখেই মনে হলো কথাটা। তোমার প্রতিভাটা যদি কাজে লাগানো যেত তাহলে কেমন হত?? ধরো তোমার পেইন্টিঙস দিয়ে লন্ডনে একটা এক্সিবিশন??? যা আয় হবে তা দিয়ে একটা ফান্ড করা যেত তাহলে। আমার স্কুলটা তো handicapped শিশুদের জন্য। নিজের চোখেই তো দেখি,খুব ভালো কিছু জোটে না ওদের কপালে। ওদের জন্য ভালো একটা স্কুল??? এতোগুলো নিষ্পাপ শিশু, ওদের জীবনটা তো সহজ না। সেই কঠিন জীবনটাকে কিছুটা সহজ করতে পারলে, কিছুটা আনন্দে ভরিয়ে দিতে পারলে,ভালো হত না??? আমার অনেকদিনের স্বপ্ন. . . . এই শিশুগুলোর জন্য কিছু করবো, কিন্তু নিজের অতো টাকা যে ছিলো না কখনোই, কিন্তু তুমি তো চাইলে পারো বাবা, এতোগুলো শিশু পড়বে আমার ছেলের টাকায় বানানো স্কুলে, নিষ্পাপ প্রানগুলো থেকে প্রার্থনা করবে তোমার জন্য . . . . “, অঝোর ধারায় কঁদতে শুরু করলেন মাহমুদ সাহেব। অনেক্ষন ধরে মাথা নিচু করে কাঁদলেন। কিছু বলতে পারলেন না আর।
উঠে দাড়িয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালো সৃজন। অনেক্ষন চুপ করে থাকলো। হঠাৎ করেই যেন বেঁচে থাকার একটা তাগিদ অনুভব করলো,বেচে থাকার একটা মানে খুজে পেল। একটা স্বপ্ন খেলা করতে থাকলো তার দুচোখে। ঘুরে বাবাকে প্রশ্ন করলো,” handicapped Children of Dhaka” subject টা কেমন হয় বলতো বাবা?????”
অশ্রুভরা চোখে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলেন মাহমুদ সাহেব।
(৪)
Ferguson Art Gallery,Northcote Road,Clapham,London.
জমজমাট একটা আর্ট গ্যালারি শিল্পবোদ্ধা জনতার মহানগরী লন্ডনের বুকে। এ মুহূ্র্তে সেন্ট্রাল এট্রিয়ামটা লোকে লোকারণ্য। শ‘খানেক মানুষ ঘুরে ঘুরে দেখছেন দেয়ালে সাজানো কতগুলো পেইন্টিঙ। অদ্ভুত এক মায়াময় জাদু যেন শিল্পীর হাতে। প্রতিবন্ধী কিছু শিশুর ছবি এমনভাবে মানুষকে বোধহয় আগে কখনো নাড়া দিয়ে যায়নি। সেই সুদূর বাংলাদেশের বুকে ঢাকার রাজপথের সেই শিশুগুলোর হাহাকারে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে ছবিগুলো,তাদের কান্নাগুলো যেন শতগুণে প্রতিধ্বনিত হয়ে ভারী করে দিচ্ছে এট্রিয়ামের পরিবেশটাকে।
বিশাল গ্যালারির এক পাশে দাড়িয়ে গল্প করছিলেন মি. পিটার ফারগুসন। তার আশেপাশে কয়েকজন ফেমাস আরটিস্ট-গ্যালারি অউনার। আর সবার মধ্যমণি হয়ে আছে সৃজন, এই অসম্ভব সুন্দর ছবিগুলোর স্রষ্টা।
একটু সরে গিয়ে মাইক্রোফোনটা হাতে তুলে নিলেন মি. ফারগুসন, “Ladies and gentlemen,may I have your attention please?????”
ভিজিটরদের সবাই নড়েচড়ে উঠলো তার কথায়। সবাই তাকালো তার দিকে।
“ . . . . আজকে আমরা সবাই এখানে একসাথে হয়েছি,অনেকগুলো কষ্ট আর অনেকগুলো কান্না আছে এর পেছনে। দুখী মানুষ,বঞ্চিত মানুষের কষ্টগুলো আমরা খুব বেশি দেখি না,কিন্তু Third world country গুলোর কথা এ কবারও আসে আমাদের মনে????একবারও কি আমাদের নাড়া দিয়ে যায় তাদের কষ্টগুলো?????আমরা যদি আমাদের কাজগুলো,আমাদের দায়িত্বগুলো ঠিকমতন পালন করতে পারতাম,আজ কি এই ছবিগুলো আমাদের দেখতে হত???? নিজের অজান্তেই শিউরে উঠতে হত মানবতাকে এভাবে পঙ্গু হয়ে যেতে দেখে???? দোষগুলো কারো একার নয়,আমাদের সবারই। আজ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো এক তরুন,কীভাবে সত্যকে সবার সামনে নিয়ে আসতে হয়। তার কাজ তো সে করেছে। এখন বাকি কাজ কিন্তু আমাদের। . . . Please give a big round of applause for Mr. Iftekhar Mahmud Srijon. . . .”
ঝলমলে সে সন্ধ্যায় শত করতালির মধ্যে যেন হাঁটু ভেঙে আসতে চাইছিলো সৃজনের, মাথার ভেতর এক হিংস্র দানব যেন সবকিছু শেষ করে দিতে চাইছিলো, অনন্ত এক ঘুম নেমে আসতে চাইছিলো তার দু‘চোখে। কিন্তু তার সিক্ত চোখগুলোয় যেন ঠিকরে পরছিলো তারার ঔজ্জ্বল্য। সে পেরেছে, হ্যাঁ,সে পেরেছে তার কাজটুকু করে যেতে, তার স্বপ্নগুলো পূরণের আর খুব বেশি মনে হয় দেরি নেই। স্বপ্নগুলো যে সত্যি হবার অপেক্ষায় . . . .
(৫)
আশুলিয়া,ঢাকা।
হঠাৎ বাচ্চাদের হাসির শব্দ কানে এলো মাহমুদ সাহেবের। লম্বা করিডরটার শেষ মাথায় ছিলেন তিনি। ধীরপায়ে হেঁটে আসলেন। ছোট একটা রুম। জানালার পাশে দাড়িয়ে চুপচাপ দেখতে লাগলেন।
ছোট ছোট কতগুলো দেবশিশু খেলা করছে যেন। নিরমল হাসিতে ভরে উঠেছে তাদের পবিত্র মুখগুলো। কী এক অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য তাদের চোখেমুখে। হাসির মধুর শব্দগুলো খুব আপন লাগে। অনেকদিন আগের কোন সুখস্মৃতির কথা বুঝি মনে পড়ে যায় তার।
জানালার পাশে কিছুক্ষন চুপটি করে দাড়িয়ে থেকে সরে আসেন তিনি। আবার হাঁটতে শুরু করেন ধীরপায়ে।
আজ পাঁচ বছর হতে চললো সৃজন নেই। তার এক্সিবিশনের ছবিগুলো অনেক টাকায় সেল হয়। মানবতার এ ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেননি লন্ডনের ধনকুবেররা। এর কিছুদিন পরই মারা যায় সে।
স্কুলটা দেখে যেতে পারেনি সৃজন। জায়গার অনুমোদন পাওয়ার জন্য,নির্মাণ কাজ শেষ হতে হতে প্রায় তিন বছর লেগে গেছে। Handicapped শিশুদের দেশসে রা একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে বেশিদিন সময় লাগেনি।
হাঁটতে হাঁটতে ছোট মাঠটার কাছে এসে পড়লেন মাহমুদ সাহেব। আকাশটার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। বড় থালার মতো বিশাল বড়ো একটা রূপালী চাদ উঠেছে আকাশটা জুড়ে। দিনের আলোর মতো আলোকিত হয়ে উঠেছে যেন চারপাশ। সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠটা যেন রুপালী আলোর ছটায় প্লাবিত হতে চললো। অনেক দূরে ঝি-ঝি পোকাগুলো যেন জম্পেশ আড্ডা বসিয়েছে। ছুরির মতো শীতল উত্তরের বাতাস বয়ে গেল হঠাৎ করে,একেবারে হাড় পরযন্ত কাঁপিয়ে দেয় এতোটাই শীত। সবকিছু মিলিয়ে অদ্ভুত সুন্দর একটা পরিবেশ।
কিন্তু এসব কিছু নাড়া দিয়ে যায়না মাঠের ধারে বসে থাকা অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষটাকে। তার ভেতরের সবটা জুড়েই যেন কি এক হাহাকার। অনুভূতিগুলো সব যেন শুণ্য হয়ে আছে। নিজেকে অনেক বেশি,অনেক বেশি নিঃসঙ্গ মনে হয় তার। চোখ বেয়ে নিঃশব্দে শুধু জল নেমে আসে। মুখটা তুলে সিক্ত চোখে আরেকবার দেখেন আকাশটাকে। অনেকগুলো তারার মধ্যে একটা তারা হঠাৎ চোখে পড়লো তার। তার মনে হতে লাগলো তার হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট ছেলেটা তো খুব বেশি দূরে নেই তার। ওইতো আকাশের ঐ তারা,ঐ তো তার ছেলেটা। হঠাৎ ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। জড়ানো গলায় আপনমনে বৃদ্ধ বলতে থাকেন, “তুমি বেঁচে আছো বাবা, এখনো বেঁচে আছো এ বুকের মধ্যে। তোমার স্বপ্নগুলো সত্যি হয়েছে সৃজন,সত্যি হয়েছে। তোমার স্বপ্নগুলোর মধ্যে তুমি অনেকদিন বেঁচে থাকবে। অনেকদিন. . . . . “
মন্তব্য
লেখক নিজের নাম দিলেন না তো?
আসলে সচলায়তন এ নতুন আমি। প্রক্রিয়াটা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি এখনো। আর তাছাড়া খুব একটা বসা হয়নি নেট এ,বিশেষ করে গত কয়েকদিন। কাইন্ডলি বলতে পারবেন কিভাবে আমার নাম শো করবে????নাকি যতদিন অতিথি লেখক হিসেবে লিখছি,লেখার শেষে নাম জুড়ে দেবো????
সচলায়তন এ নতুন আমি। প্রক্রিয়াটা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি এখনো। গল্পটা লেখার পর অনেকদিন নেট এ বসা হয়নি,তাই চেক ও করতে পারিনি। অতিথি লেখক নামেই গল্পটা প্রকাশিত হয়েছে। নামের ব্যপারটা ঠিক বুঝতে পারিনি,কাইন্ডলি বুঝিয়ে বলবেন একটু???নাম কি লেখার শেষে ইনক্লুড করে দেবো????জানাবেন একটু।
আমার নাম ইশতিয়াক।
অসম্ভব ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হলাম! অনেক আবেগ দিয়ে লেখা হয়েছে বোঝা গেল। পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে নিঃসন্দেহে!
গল্পের কাহিনী, বুনন, গাঁথুনি ভালো হয়েছে। বিশেষ করে শুরুটা অসম্ভব সুন্দর।
লেখা বেশ ঝরঝরে। তবে কোথাও কোথাও আরেকটু আবেগের বিস্তার থাকলে আমার আরও ভালো লাগতো। যেমনঃ সৃজনের মৃত্যু, ওর নিজের বাবাকে ছেড়ে লন্ডনে চলে আসা ইত্যাদি।
এটা আমার একান্ত নিজস্ব মতামত। এগুলো ছাড়াও অনেকের ভালো লাগবে।
আপনি নিয়মিত লেখুন। পাঠককে বিমোহিত করার ক্ষমতা আছে আপনার!
তবে কিছু ভুল বানান চোখে পড়ল। আশা করি ঠিক করে নেবেন। আর আপনার নাম লিখেননি কেনো? নাহলে আপনাকে অভিবাদন জানাবো কিভাবে?
ভালো থাকবেন। আপনার লেখার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইল।
--শাহেদ সেলিম
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। অনেকদিন ধরে নেট এ বসা হয়নি। তাছাড়া সচলায়তন এর নিয়মকানুন এখনো ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারিনি। আশা করছি এখন থেকে সচল থাকবো।
বানান ভুল এর ব্যপারটা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আর আমার নাম ইশতিয়াক।
আমার লেখা পড়বেন।
আপনাদের অভিমত আমাকে ইমপ্রুভ করতে সাহায্য করবে।
ধন্যবাদ আবারো।
দুই মাস বয়সে যে ছেলের মা চলে যায় সেই ছেলে কিভাবে মায়ের হাত ধরে হাটার স্মৃতি মনে রাখতে পারে ? তাও আবার এই ব্যাটারসি পার্কেই ? বাবা যে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন সেই কথা বলা হয়নি কোথাও ।
আবার যেই বাবাকে পাষন্ড বলা হয় শুরুতে সেই বাবার কাছেই ফিরে যায় মরে যাবার আগে ?
আপনার গল্পের গাথুনি খুব দুর্বল ভাই । তবুও, লেখার চেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই ।
@অতিথি, আপানার এ মন্তব্যের জবাব লেখক হয়তো তাঁর মত করেই দেবেন। কিন্তু একজন পাঠক হিসেবে আমি আপনাকে সবিনয়ে বলতে চাই, আপনি খুব সম্ভবত পুরো গল্পটা মনোযোগ দিয়ে পড়েননি। এখানে বলা হয়েছে, ছেলেটি খুব ছোট বেলায় তার মার সাথেই বিদেশে চলে আসে। তার মা দ্বিতীয় বিয়ে করে। ছেলেটি তার মার কাছেই বড় হয়। পরে যখন সে স্বাবলম্বী হয়, তখন আলাদা হয়ে যায়। এখানে তার দ্বিতীয় বাবাকে পাষন্ড বলা হয়েছে। ছেলেটি খুব ছোটবেলাতেই তার আসল বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে বাধ্য হয়। মৃত্যুর আগে সে তার আপন, ভালো বাবার কাছে নিজ দেশে ফিরে আসে।
এখন বলুন, গল্পের গাঁথুনি দূর্বল না আপনার মনোযোগ?
ভালো থাকবেন।
--শাহেদ সেলিম
ভালো প্রয়াস। শুধু একটা ব্যাপার একটু চোখে লেগেছে। লেখক দেখলাম প্রতিবারই তিনটি করে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ব্যবহার করেছেন। নিজের মত করে একটা মানে করে নিলাম। ??? = কেনু কেনু কেনু।
চমৎকার লেখা, মন ছুঁয়ে গেল।
কামরুল হাসান রাঙা
ভালো লাগেনি। আদিখ্যেতাপূর্ণ মনে হয়েছে।
আমার ধারনা এই লেখক চাইলে আরো ভালো লিখতে পারবেন।
এই যা, লেখকের দেখি পাত্তাই নেই।
বেশ ভাল লাগল, বিশেষ করে শুরুটা।
নতুন মন্তব্য করুন