হাইফেনেটেড প্রজন্ম

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৪/১২/২০১০ - ১১:৫৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার একটা পোষা ভোঁদড় ছানা আছে। তিন বছর আগে আমার বড় বোনের সুবাদে প্রাপ্ত। বাসার বাইরে সে নিতান্তই ভাল মানুষ, কিন্তু ঘরের ভিতরে তাকে এক জায়গায় এক মুহূর্তের বেশি থাকতে দেখা যায় না। তার উপর যত্রতত্র জিনিষ ফেলা আর অনর্গল কথা তো আছেই। তার কথা বলার মাধ্যম আবার একটা দুইটা নয়, পাঁচ পাঁচটা ভাষা। প্রথম ভাষাটা তার নিজেরই উদ্ভাবিত, দ্বিতীয়টি অবশ্যই পারিবারিক সূত্রে শেখা বাংলা, শেষ তিনটি ভাষার তালিম সে পেয়েছে ডে কেয়ার থেকে। এই তিন ভাষার মধ্যে ইংলিশ টা বুঝতে পারি, ফ্রেঞ্চ-এ 'bonjour' ছাড়া আর কিছু বুঝি না, স্প্যানিশ-এ একেবারেই লবডঙ্কা। দিনের ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা বাইরে কাটানোর ফলে বাচ্চাটা ইংলিশ-এ কথা বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বুঝতে পারি। যদিও বাসার নিয়ম অনুযায়ী ঘরে ঢোকার পর শুধু বাংলা বলতে হয়। বাংলা শব্দ বললে কি হবে, উচ্চারণ ভঙ্গি যে একেবারেই আমেরিকান। তারপরেও কচি মুখের কথায় মন ভরে যায়, একইসাথে আবার প্রচণ্ড ভাবে ভাবায়, ও কি কখনো শখ করে পাগলা দাশু পড়বে? ফেলুদা, তিন গোয়েন্দা, কিংবা ননটে-ফন্টে? আমার ছোট্ট ভোঁদড় ছানাটা কি কখনও বাংলাদেশকে ভালবাসবে? সম্ভবত না।

একটা পরিবারের সব চিন্তা ভাবনা মনে হয় নতুন প্রজন্মকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। সেই চিন্তায় প্রাধান্য পায় খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার মত মৌলিক চাহিদাগুলো। এই যুগে সামাজিক নিরাপত্তাকেও এর আওতায় আনা যেতে পারে। একটা উন্নত দেশে বাবা মায়ের মোটামুটি ভাল আয় থাকলে এই চাহিদাগুলো খুব সহজেই পূরণ করা সম্ভব হয়। যেমন আমেরিকায় ভেজাল বেছে খেতে হয়না। এখানে তেল, লবণ, চিনি, মশলাতে কখন ভেজাল পাওয়া গেছে বলে শুনিনি। ম্যাড কাউ বা আন্থ্রাক্স আক্রান্ত মাংস কিংবা ফর্মালিন দেওয়া মাছ দোকানে পাওয়া যাবে না। আর শিশুদের খাবারের ব্যাপারে তো অতিরিক্ত আয়োজন। একটা ন্যাদান্যাদা বাচ্চার (infant) জন্য যেই খাবার, চার পাঁচ মাস গড়ালেই (supported sitter) তাকে অন্য জাতের খাবার দেয়া হবে। দেড় বছরের মধ্যে খাবারের আরও দুই তিন ধাপ পার করা যায়। এতো গেলো খাবারের কথা, মানে সিরিয়াল আর বিভিন্ন সব্জি/ফলের খাবার, এর পাশাপাশি দুধ আর বিভিন্ন স্ন্যাক্স তো আছেই। এক দুধেরই যে কত বাহার থাকতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। যাই হোক, এইসব ভিটামিন যুক্ত এবং ভেজালমুক্ত খাবার খেয়ে আমাদের বাছারা বেড়ে উঠুক, সেটা সবারই কাম্য। ওদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে চার কি ছয় মাস পরপর ডাক্তারের কাছে নিয়মিত নিতে হয়। ডাক্তার লম্বা মাপে, ওজন মাপে, মাথার পরিধির মাপে, চোখ, কান, নাক, গলা সব দেখে। বাচ্চা কয় ধরণের শব্দ করে, লাফ দেয় না ঝাপ দেয় এইসব হিসাব নেয়। এই সব ভিজিট অবশ্য প্রথম দুই বছরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

আমার ভাগ্নির মত এখানকার বেশির ভাগ বাচ্চার শিক্ষার হাতেখড়ি হয় ডে কেয়ারে। এত টুকটুক বাচ্চাদের জন্য তায়ে-কোয়ানডো, কম্পিউটার, ব্যালে, গানের ক্লাস। বিভিন্ন ভাষা শেখার কথা তো আগেই বলেছি। এত আনন্দের ভিতর দিয়ে প্রথম কয়েক বছর যাবে, পাঁচ পেরুলেই বাসার সবচেয়ে কাছের স্কুলে ভর্তি হতে হবে, কোন পরীক্ষা বা ডোনেশানের প্রয়োজন নেই। এদের রংচঙে বই আর ক্লাসে পড়ানোর স্টাইল দেখলে রবি ঠাকুরও তাঁর মত পালটাতেন। বাচ্চারা একটু একটু করে বড় হয়, তাদের শিক্ষার প্রাঙ্গণ ঘর, স্কুল পেরিয়ে বন্ধু মহল আর টিভি শোতে যেয়ে পৌছায়। ঠিক সেই সময় থেকেই হয়ত বাংলাদেশী কালচারটাকে একটু একটু করে পানসে লাগা শুরু করে, আমেরিকান ঝলমলে রঙ্গিন জীবন ব্যবস্থাটা টানে বেশি (এটা অবশ্য একেবারেই আমার নিজস্ব মত আশেপাশের কিছু বাঙালি ছেলেমেয়েদের দেখে। অনেকে বিরূপ মত পোষণ করতেই পারেন)। এটা হওয়াটাই মনে হয় স্বাভাবিক। হ্যানা মনট্যানা আর iCarly-র মাঝেই তো ওরা নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে চাইবে। কিন্তু আমার ইচ্ছা করে আমার সোনামণিটা একসময় আবোল তাবোলের ছড়া কাটবে, দাশুর ক্ষ্যাপামি বা নতুন ছেলে নটবরের কীর্তি দেখে হাসতে হাসতে সোফা থেকে পড়ে যাবে। আমি মেনে নিতে পারি না যে আমার পরের প্রজন্ম নিজেকে বাংলাদেশি মনে করবে না, লীগ আর দলের মারামারি দেখে বিরক্ত হবে না, রাজাকার আর অন্য সব দেশের ওয়ার ক্রিমিনালদের একি কাতারে দাঁড় করাবে। এই কষ্টটা আমি এখনো পুরোপুরি পাইনি, কিন্তু যারা পেয়ে গেছেন তারা কি একটু জানাবেন এটা কত বড় বা কতটুকু কষ্ট।

-রু


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার মতো যারা পশ্চিমে পাড়ি জমান বিভিন্ন কারনে, তাদের অনেকেই এই দুশ্চিন্তায় ভোগেন!

বেটার লিভিং ও বেটার ফিউচারের কথাটা সবাই বলেন, আর একই সাথে ভবিষ্যত প্রজন্মের বাঙ্গালিত্ব হারানোও সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু এটা যে অবস্যম্ভাবী, সেটা আবার অনেকেই বুঝতে চান না।

ভেজাল মুক্ত খাবার আর নিরাপদ ভবিষ্যত নিশ্চিত করার সাথে সাথে বাঙ্গালিত্ব বিসর্জনও নিশ্চিত। ওটা মেনে নিতে না পরলে ভবিষ্যত প্রজন্মকে আবার বাংলায় ফিরিয়ে আনাই ভাল।

সে হয়তো নন্টে ফন্টে পড়বেনা, ফেলুদা পড়বে না, কিন্তু সে তার স্থানীয় নন্টে ফন্টের ইকুইভ্যালেন্ট শৈশব উপভোগ করবে, যেটা আবার আমাদের বোধগম্য নাও হতে পারে।

সবচেয়ে ভাল হয় সব দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে তার শৈশবটা আপনিও উপভোগ করুন... !

--- থাবা বাবা!

নাশতারান এর ছবি

এই টানাপোড়েন প্রথম প্রজন্মের থাকবেই। দ্বিতীয় প্রজন্ম বড় হবে এক ধরনের দোটানার মধ্যে। তৃতীয় প্রজন্মে গিয়ে সেটুকুও আর থাকবে না। সেটাই স্বাভাবিক। সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে উঠতে হয়, এ চাপিয়ে দেওয়ার জিনিস নয়।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

কিছু পেতে হলে কিছুতো ছাড়তেই হয়, এটাই জীবনের ট্রেডঅফ।
এটাকে মেনে নেওয়াটা আসলেই খুব কঠিন। আমার যদিও এখনো অনেক পথ বাকি কিন্তু এখনই ভাবতে ভয় লাগে।

পাগল মন

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য এবং সুন্দর মন্তব্য রাখার জন্য। একজন পার্সোনালি নিচের মন্তব্যটি জানিয়েছেন।

"... নতুন প্রজন্ম নিয়ে মন খারাপের ব্যপারটা পশ্চিমে পাড়ি জমানো প্রায় সব পরিবারেরই সমস্যা। তবে সমস্যাটা যতটা না বাড়ির বড়দের তারচেয়েও বেশি নতুন প্রজন্মের। একটু একটু করে তারা যখন বড় হতে থাকে অন্দর-বাইরের সাংস্কৃতিক দূরত্বটা তাদেরকে একটা দোটানার মধ্যে ফেলে। আত্মপরিচয় নিয়ে একটা সংকটে পড়তে হয় ওদের। এটা হয়ত আগের প্রজন্মের মানুষদের সংকটের চেয়ে অনেক গভীর। ..."

প্রতিটি বক্তব্যের সাথেই একমত, দ্বিমত পোষন করতে পারছি না। আমার ভাগ্না-ভাগ্নির ভবিষ্যত আমি নির্ধারণ করতে পারি না। তবে এটা বুঝতে পারছি যে নিজের বাচ্চা হলে আমি এটা মানতে পারতাম না। সবাইকে আবারো ধন্যবাদ জানাই।

-রু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।