প্রজেক্ট প্যালিন্ড্রম

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৩/১২/২০১০ - ৯:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিজ্ঞাপনে লেখাই ছিল যে শুধু নির্বাচিত কিছু প্রার্থীকেই মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হবে। তবে এতটা নির্বাচিত হবে ব্যাপারটা আন্দাজ করে উঠতে পারেনি সাইদুল। পেপারে অ্যাডটা দেখেই একটু অন্যরকম লেগেছিল। আর দশটা অ্যাডের মতো জমকালো নয়। স্রেফ শাদার মাঝে কালো দিয়ে ছাপা। একজন প্রোগামার চাওয়া হয়েছিল। যোগ্যতা হিসেবে বলা ছিল গণিতের প্রতি তীব্র মমত্ববোধ থাকতে হবে। এ ধরণের নরম বিশেষণ আজকাল চোখেই পড়ে না। সবাই ভীষণ তেতে থাকে। গ্যারান্টি, ওয়ারেন্টি, ধরিয়ে দিন, সুবর্ণ সুযোগ, আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা, এগুলোই এখন পেপার-পত্রিকার ভাষ্য। সেখানে গণিতের প্রতি তীব্র মমত্ববোধ! ইন্টারেস্টিং লাগাতেই একটা অ্যাপ্লিকেশন ড্রপ করা ওর। তা গণিতের প্রতি মমত্ববোধ সাইদুলের আছে বৈ কি। একদম ছোটবেলা থেকেই সংখ্যা ভীষণ টানত ওকে। বাবা ছোট বেলায় ওকে সংখ্যার জাদু বইটা গিফ্ট করেছিলেন। সেই থেকেই শুরু। গণিত অলিম্পিয়াডে ওর যে সাফল্য তাও সে কারণেই। যত দিন গেছে তত অবাক হয়ে সাইদুল সংখ্যার শক্তি আবিষ্কার করেছে। পুরো বিশ্ব চরাচর বাঁধা পড়ে আছে সংখ্যাতেই। সব কিছুকেই সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যায়। গ্রহ নক্ষত্রের পরিমাণ থেকে শুরু করে পরমাণুতে ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রন-প্রোটন সবই সংখ্যার শক্তিতে চলছে। একটি অরবিটালে কয়টা ইলেকট্রন থাকতে পারে তাও নির্ধারিত আছে সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতেই। সংখ্যার ভিতরও কত মজা। মৌলিক সংখ্যা, যৌগিক সংখ্যা কত কী। সংখ্যাই যে সব কিছুর মূলে তা কম্পিউটারের দিকে তাকালেই পরিষ্কার বোঝা যায়। শুধু ‘শুণ্য’ আর ‘এক’ এর কী দারুণ খেলা!

রাজধানীর অভিজাত পাড়ার একটি ফ্ল্যাটে বসে সংখ্যা নিয়ে সাত পাঁচ ভাবছে সাইদুল। দেখছে আজকে ভাইভা দিতে কেবল ওই এসেছে। তবে যে ঘরে সে বসে আছে সেটা কিছুতেই কোন অফিসের অভ্যর্থণা কক্ষের মত নয়। ওকে প্রথমেই বাইরে জুতো খুলে আসতে হয়েছে। ঘরে সোফা- টোফাও নেই। সারা ঘরে আলো-আঁধারির খেলা। রিসিপশনে কম্পিউটার আর কয়েকটা ছোট ছোট চেয়ার। কেমন যেন একটা পবিত্র ভাব খেলে গেল সাইদুলের মনে। দেয়ালে কিছু বিমূর্ত ছবি ঝোলানো। এছাড়া কোথাও কিছু নেই। কিছুক্ষণ পর বেয়ারার এসে ওকে ভিতরে নিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকে হতাশই হতে হলো ওকে। অফিসের বস এ রকম! একটা শতরঞ্চিতে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছেন একজন এক সৌম্যদর্শন লোক। মাথার চুল কামানো। পরনে গেরুয়া রংয়ের সেলাইবিহীন দুই প্রস্থ কাপড়। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। এ তো দেখি ধর্মশালার ভিক্ষু!
হ্যাঁ আপনি ঠিকই ধরেছেন!
গমগমে একটা কন্ঠ সাইদুলের চিন্তাসূত্র ছিন্ন করে দিল। চমকে গেল ও। বাববাহ! থট রীডার নাকি? ভদ্রলোক ‘বসুন’ বলাতে সাইদুল তাকিয়ে দেখল যে ওই ঘরে বসার জন্য চেয়ার-টেয়ার কিছু নেই। অগত্যা ভদ্রলোকের স্টাইলে মাটিতেই বসতে হলো তাকে। তবে মেঝেতে কোনো ধুলো-বালি নেই।
দেখুন মিস্টার সাইদুল আপনার সিভি দেখে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে আপনিই আমাদের কাজের জন্য সেরা লোক।
কিন্তু কাজটা কী?
আপনার প্রিয় বিষয় মানে সংখ্যা নিয়ে কাজ করা আর কি..। আপনাকে একটি বিশেষ সংখ্যা খুঁজে পেতে হবে যা সামনে থেকে আর পিছন থেকে একই রিডিং দেয়....
ভিক্ষুর মতো হলেও ভদ্রলোকের শব্দ চয়ন আর উচ্চারণের পরিশীলতা নজার এড়চ্ছিল না সাইদুলের।
....ওহো! সরি! আমার পরিচয়টা আসলে আগেই দেয়া বিধেয় ছিল- আমি ধর্মাত্মা ত্রয়োদশ। পড়াশোনা চিটাগাং আর ক্যামব্রিজে। তুলনামূলক ধর্মশাস্ত্রে ডক্টরেট করেছিলাম একসময়।
একটু ধাক্কাই খেল যেন সাইদুল। হাইলি কোয়ালিফায়েড ভিক্ষু দেখা যাচ্ছে! আবার বাস্তবে ফিরল সাইদুল। ভদ্রলোক প্যালিন্ড্রমের কথা বলছিলেন। এটা একটা মজার বিষয় ওর কাছে। কিছু সংখ্যা আছে যা সামনে আর পেছন থেকে পড়লে একই পাঠ দেয়। যেমন ১২১। সাধারণত কোনো সংখ্যার সাথে তার বিপররীত সংখ্যা যোগ করলে প্যালিন্ড্রম পাওয়া যায়। ওই ১২১ যেমন এসেছে ৮৩ আর ৩৮ এর যোগফল থেকে। এই যোগ করার কাজটি একটি ধাপেই সম্পন্ন হতে পারে বা লাগতে কয়েকটি থেকে শত শত হাজার হাজার ধাপ!
প্যালিন্ড্রম বের করার চাকরি!
চাকরি মনে করলে চাকরি ফান ভাবলে ফান। তবে এজন্য আপনাকে কম্পিটিটিভ স্যালারি অফার করছি আমরা। এরপর ভদ্রলোক একটা সংখ্যা বললেন। আবার বিষম খেল সাইদুল। স্বীকার করতে ওর দ্বিধা হওয়ার কথা নয় যে এত স্যালারি নিজের জন্য ও কখোনোই ভাবেনি।
এখন আপনি বলুন আপনি আমাদের সাথে কাজ করতে আগ্রহী কি না..
আপনারা ঠিক কী করছেন তা না জেনে তো কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারিনা। এমনওতো হতে পারে আপনার বেআইনী কোনো কাজ করছেন বা উগ্রবাদী কোনো সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্টতা আছে আপনাদের.....
রাইট! কোনো দায়িত্বের নেয়ার আগে অবশ্যই সবকিছু ভেবে নেয়া দরকার। তবে এটুকু বলতে পারি আমরা কোনো উগ্রবাদী সংগঠন নই। ধর্মীয় সংগঠন তা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। আর প্রকৃত ধর্মের ভেতর উগ্রপন্থার আসলে কোনো স্থান নেই। আমাদের এই সার্কেল অব ব্রাদারহুড এর নাম আপনি হয়তো শোনেননি। আসলে গৌতম বুদ্ধের সময় কাল থেকেই আমাদের এই এই সার্কেল টিকে আছে। যদিও খুবই সীমিত আকারে। পৃথিবীর প্রায় স্থানে আমাদের মতাদর্শী কিছু লোক জন আছেন। তাদের অনেকে আবার বেশ অর্থ বিত্তশালী। তো তাদের আর্থিক সহায়তাই কাজ চলে যায় এর। ভগবান বুদ্ধের সমসাময়িক আরেক মনীষি ধর্মাত্মা প্রথম এর প্রবর্তক। আমরা তাঁকে বলি প্রভু ধর্মাত্মা। তো তিনি অনেক ধ্যান করে বের করলেন যে মহাপ্রভু বা পরমাত্মা এই বিশ্ব ভ্রহ্মান্ড তৈরী করেছেন সংখ্যার ইট দিয়ে। অর্থাৎ সংখ্যার পর সংখ্যা বসিয়ে তৈরী করা হয়েছে জীব-জড়ের সমস্ত কিছু। গ্যালক্সির বিন্যাস থেকে শুরু করে ক্রোমোজেমের ডিএনএর সিকুয়েন্স সবই সংখ্যার সাম্যে তৈরী। তাই প্রভু ধর্মাত্মা বললেন তোমরা সংখ্যার ভেতরেই পরমপ্রভুকে খুঁজবে। সেই থেকেই একটা দল অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেই সংখ্যা নিয়ে কাজে নেমে পড়ল। সংখ্যার হরেক রকম বিন্যাস আছে। সবই আমরা বিন্যাস করছি গত তিন হাজার বছর ধরে। শেষে এসে আটকালাম ওই প্যালিন্ড্রমের মধ্যে। আমাদের বিভিন্ন দল বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করছে। তো আমার ওপর দায়িত্ব বর্তেছে প্যালিন্ড্রমের সমাধান করা। আমি তো আর প্রোগামার বা সংখ্যা বিশেষজ্ঞ নই। আপনার সিভি দেখে আমার ধারণা জন্মেছে যে আপনিই আমার সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।
এটা তো খেলা--খেলার জন্য গাঁটের পয়সা খরচ করছেন?
দেখুন সাইদুল এটা আমাদের একান্ত ধর্মীয় বিশ্বাস। সবাই কিন্তু বিশ্বাসকেই পুঁজি করেই জীবনপাত করছে। আমরাও তাই। তবে ধর্মের বিশ্বাসের কারণে হিংসা হানাহানি একদম পছন্দ করি না আমরা। যা হোক আপনার সাথে কথা বলে ভাল লাগলো। রিসিপশনে আপনার জন্য একটা অ্যাপয়নমেন্ট লেটার রেখেছি। যাবার সময় নিয়ে যাবেন। টার্ম এন্ড কন্ডিশনস সব লেখা আছে। আমরা একটু কনজারভেটিভ বলে কিছু বিধি নিষেধ ধাকবে। আপনি রাজি হলে আমাদের সাথে যোগ দিতে পারেন। তবে সিদ্ধান্ত দ্রুত জানাবেন আশা করি। কারণ আপনাকে না পেলে আমরা দ্বিতীয় আরেকজনকে নেব। ওকে?

পথে বেরিয়ে সাইদুল কিছুটা বিভ্রান্ত। আসলে ও কী করবে? যোগ দেবে এই পাগলামির সাথে নাকি না করে দেবে? আবার টাকার অংকটাও অবজ্ঞা করার মতো নয়। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেখেই মুগ্ধ হলো ও। পেশাদারিত্বের ছাপ সর্বত্র। টাকার অংকটা ফাঁকা। সাইদুলকে যেকোনো সংখ্যা লিখে দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। তিন মাসের অগ্রীম ওরা ওর অ্যাকাউন্টে আগেই নাকি পাঠিয়ে দেবে! মজা করতেই যেন শূণ্য ঘরে ২০০০০০ অংকটা লিখে ও অ্যাকসেপটেন্স লেটার পাঠিয়ে দিল। চার দিনের মাথায় নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিশাল অংকের অর্থ জমা হবার খবর জেনে বেশ দমেই গেল সাইদুল। লোকটা পাগলামি করছে না তাহলে? পুরো সিরিয়াস? কিন্তু ছোট্ট একটা কাজের জন্য এত টাকা? নাকি কাজটা মোটেই ছোট্ট কাজ নয়! একটা বড় প্রজেক্ট-প্রজেক্ট প্যালিন্ড্রম। শেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সাইদুল -- কাজটা নেবে। আর কিছু না হোক অ্যাডভেঞ্চার তো হবে। এরপর একটা সপ্তাহ যেন কালবোশেখীর ঝড়ে উড়ে গেল। মেস ছেড়ে দিয়ে কদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি গেল। ব্যক্তিগত কিছু কাজ সারল। কিছু ধার দেনা ছিল তাও মেটালো। কারণ চুক্তির শর্তানুসারে ও আগামী দুবছর চাইলেই ছুটি পাচ্ছে না। দুবছর পর কন্ট্রাক্ট বাড়তেও পারে নাও পারে। একদিন ব্রাদারহুড অফিস থেকে জানানো হলো তিন দিনের বেসিক ফাউন্ডেশন ট্রেনিং নিতে ওকে টাঙ্গাইলের মধুপুরে যেতে হবে। ওখানে একটি টট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের। সেখানেই ট্রেনিং নিতে হবে। অন্যান্য নতুন কলিগদের সাথেও পরিচয় হবে সেদিন। রেস্ট হাউজে পৌঁছে সাইদুল দেখল অন্যরা কেউ তখনো আসেনি। ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করতে দুপুরের খাবার খেয়েই শুয়ে পড়ল ও। একটু জিরিয়ে নেবে। কিন্তু এরপর আর কিছু মনে নেই ওর।

কত ঘন্টা ঘুমিয়েছে বলতে পারবে না। যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন মধুপুরের লাল রুক্ষ্ণ পরিবেশের বদলে সবুজ শান্ত একটা পরিবেশে নিজেকে আবিষ্কার করল সাইদুল। ও শুয়ে আছে ধবধবে শাদা একটি বিছানায়। ছিমছাম পরিপাটি ভাবে সাজানো একটি ঘর। লাগোয়া বাথরুমও আছে একটা। জানালার গ্রিল দিয়ে সামান্য দূরে বিশাল এক প্যাগোডার মতো স্থাপনা চোখে পড়ল ওর। তাহলে রেস্ট হাউজে খাবারের সাথে ঘুমের বড়ি মেশানো ছিল। তারপর ঘুমন্ত সাইদুলকে কোনো গাড়িতে চাপিয়ে এখানে এনে রাখা হয়েছে। জায়গাটা পাহাড়ের মধ্যে। পার্বত্য অঞ্চলের কোথাও সন্দেহ নেই। তবুও বেশ ভয়ই পেয়ে গেল সাইদুল। আদম পাচারকারীদের হাতে পড়েনিতো ও? উঠে ফ্রেশ হতেই প্যাগোডার মতো স্থাপনায় নিয়ে যাওযা হলো ওকে। কয়েকজন আদিবাসি তাকে এসকর্ট করে নিয়ে গেল। তারা দুর্বোধ্য কোনো ভাষায় নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিল। সেখানে গিয়ে ধর্মাত্মা ত্রয়োদশকে দেখে প্রাণে একটু পানি পেলো সাইদুল। একমাত্র পরিচিত জন!
দুঃখিত সাইদুল, হাস্যেজ্জ্বল মুখে শুরু করলেন তিনি, নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতেই আপনার ওপর একটু জুলুম করে ফেলেছি আমরা। আমাদের প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ও ভাব গাম্ভীর্য বজায় রাখার স্বার্থে ব্যাপারটা জরুরী। আপনার ফ্যামিলির আপডেট নিয়মিতই আপনি পাবেন। প্রয়োজনে আমার স্যাটেলাইট ফোন দিয়ে তাদের সাথে কথা বলতেও পারবেন। তবে এখানকার ঠিকানা আপনাকে বলা হবে না। তারাও জানবেন না। যদি একান্তই কেউ চিঠিপত্র পাঠাতে চায় সেটি লন্ডন অফিস থেকে রিডিরেক্ট হয়ে এখানে আসবে। যাবেও লন্ডন ঘুরে। আপনার লেখা চিঠি অবশ্যই এডিট করব আমরা। একটু পরেই আপনাকে বিজ্ঞানালয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আপনার কর্মস্থল হবে ওটাই। ওখানে একটা মোটামুটি শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার সিস্টেম গড়ে তুলেছি আমরা। ক্রে জাগুয়ারের মতো দানবীয় শক্তি না থাকলেও আমাদের পেটাফ্লপস মেশিনটি একদম কমও নয়। সেকেন্ডে এক কোয়াড্রিলিয়ন হিসেব করতে পারে এইচ পির এই মেশিনটি। বলা যায় দুলক্ষ উচ্চ গতির ল্যাপটপের সমতূল্য এই মেশিন। যেটায় কাজ করার পর গর্ব বোধ করবেন আশা করি। এই অঞ্চলে এতো শক্তিশালী সিস্টেম আর একটিও নেই। সত্যি সত্যি মেশিনের সামনে এসে বিষ্ময়ে প্রায় বোবা হয়ে গেল সাইদুল। যেন পুরো একটি টি অ্যান্ড টি এক্সচেঞ্জ। শত শত কেবিনেট, ওয়্যার, মনিটর এলাহী কান্ড। তবে ইনপুট দেবার সনাতন কী বোর্ড পদ্ধতি দেখে মনে সামান্য বল পেল সাইদুল। ওর প্রজেক্টের নাম প্রজেক্ট প্যলিন্ড্রম। সব অনাবিষ্কৃত প্যালিন্ড্রম বের করতে হবে। কাজটি খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়। মেশিনকে কয়েকটা লজিক দিতে হবে যেন প্রতি সংখ্যার সাথে তার বিপরীত সংখ্যা সে অটোমেটিক যোগ করে যায় যতক্ষণ না প্যালিন্ড্রম পাওয়া যায়। তার পর বসে বসে অপেক্ষা কখন সেকরম একটা সংখ্যা বের করা যায়! সাইদুল জানে যে এখন পর্যন্ত ১৯৬ সংখ্যাটিকে তার বিপরীত সংখ্যার সাথে হাজার বার যোগ করার পরও কোনো প্যালিন্ড্রম সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তাই প্রথমে ১৯৬ নিয়েই পড়ল সে। প্রথম দুমাস দিন রাত খেটে সিস্টেমের জন্য প্রয়োজনীয় লজিক লিখল ও। তারপর মেশিনে ফিট করে কাজ শুরু করে দিল। অনেক শক্তিশালী মেশিন-সেকেন্ডে এক হাজার ট্রিলিয়ন অংক কষতে পারে। মেশিন স্টার্ট করার সাথে সাথেই পুরো ঘর জুড়ে সেঁটে থাকা শত শত মনিটরে সংখ্যা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। একঘেঁয়ে ভাবে মনিটরের পর্দার ওপর থেকে নিচে নামছে সংখ্যাগুলো। কদিনের মধ্যেই একটা রুটিনের মধ্যে বাঁধা পড়ে গেল জীবন। মেশিন মোট ষোল ঘন্টা চালু থাকে প্রতিদিন। সাইদুলকে সারাক্ষণ বসে থাকতে হয় না। ও মাঝে মাঝে এসে সামারি রিপোর্ট পর্যালোচনা করে। কোনো সম্ভাবণা আছে কিনা তা বের করে। অনেকের সাথেই পরিচয় হলো এর ফাঁকে। বোঝা গেল তারা সবাই এই সংখ্যার কাজে খুবই আগ্রহী। মাঝে মাঝে ধর্মাত্মাও দর্শন দেন। একসময় কাজের ওপর বিরক্ত ধরে গেল সাইদুলের। একদিন ধর্মাত্মাকে কাছে পেয়ে ও প্রশ্ন করল
আচছা এই সবচেয়ে বড় প্যালিন্ড্রম বের করার চেষ্টা করছেন সেটা কেন করছেন? বের করতে পারলে কী লাভ হবে?
ব্যাপারটা আপনার কানে কেমন শোনাবে জানিনা। তবে আমাদের বিশ্বাস হচেছ যে পরমপ্রভু একটি মিশন দিয়ে মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। তা হলো তাঁর প্রকৃত পরিচয় খুঁজে বের করা। তবে তা লুকোনো আছে কোনো সংখ্যার মারপ্যাঁচে। আমাদের নানান দল নানান বিষয় নিয়ে কাজ করছে। যেমন আমরা আপাতত প্যালিন্ড্রম নিয়ে কাজ করছি। আমাদের ধর্মগুরুরা হাজার বছর আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন যে হাজার বছর পরে হয়তো তার উত্তর পাওয়া যাবে।
উত্তর পেলে তারপর কী হবে? আপনাদের মিশন তো তখন শেষ হয়ে যাবে--তখন?
তখন নিশ্চয়ই আমাদের আর কিছু করতে হবে না। যা করার পরমপ্রভুই করবেন। শাস্ত্রমতে যে মুহূর্তে তার নামের কোড ব্রেক করতে পারব আমরা ঠিক সেই মুহূর্তেই চিরকাঙ্খিত মাহেন্দ্রক্ষণটি এসে হাজির হবে..।
কী সেই মাহেন্দ্রক্ষণ?
মহাপ্রলয়।
বেশ কৌতুক অনুভব করল সাইদুল। দুনিয়ায় কত কিসিমের পাগল যে থাকে! নামের কোড বের করতে পারলেই পৃথিবীর সমাপ্তি? একদম দ্য এন্ড! ধর্মাত্মা যে থট রীডার তা আগেই দেখেছিল সাইদুল। এবারও তার অবিশ্বাস দেখে একটা সূক্ষ্ণ হাসির রেখা ভিক্ষুর ঠোঁটে দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।

এরপর আরো ক মাস কেটে গেছে। সেই একই বোরিং জীবন। আর ভাল্লাগছেনা সাইদুলের। ভাবছে রিজাইন দেয়া যায় কিনা। টাকা কিছু কম পেলেও এখানে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। আজই ধর্মাত্মাকে ব্যাপারটা বলতে হবে। কন্ট্রোল রুমের চেয়ারে বসে তন্দ্রা মতো এসে গিয়েছিল। হঠাৎ তির তির একটা শব্দে ঘোর কাটল সাইদুলের। অবাক হয়ে দেখল মনিটর স্থির হয়ে গেছে। লাল ডিজিট গুলো সবুজ আলো হয়ে জ্বলছে। এমনই প্রোগাম করেছিল ও। সংখ্যা খুঁজে পেলে লাল ডিজিট সবুজ হয়ে যাবে। তার মানে ওই বিশেষ প্যালিন্ড্রম সংখ্যাটি পাওয়া গেছে! সামারি শিট বলছে ১৯৬ কে মোট তের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মিলিলিয়ন বার যোগ পাল্টা যোগ করার পরই মিলেছে এই বিশেষ সংখ্যা। সংখ্যাটি বেশ বড়। ঠিক কত বড় তা ভেবে বের করতে পারল না সাইদুল। তবে কেউ যদি সংখ্যাটি পড়তে শুরু করে তাহলে হয়তো কয়েক কোটি বছর লেগে যাবে! সে যাই হোক প্রজেক্ট প্যালিন্ড্রম সফল সমাপ্তির মুখ দেখেছে এটাই বড় কথা। এবার এমনিতেই এখানকার পাট চুকানো যাবে। ভাবতেই একটা ভাল লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল সাইদুল। তখনই খেয়াল হলো তির তির শব্দটা যেন আরো বেড়েছে। সুপার কম্পিউটার যখন চলত তখনো তো এরকম শব্দ হতো না! ভাল ভাবেই তাকাতেই ব্যাপারটা খেয়ালে এলো ওর। প্রায় প্রতিটি প্রসেসর কেবিনেটই একটু একটু কাঁপছে। যাচাই করতে কাছে গিয়ে একটাতে হাত ছোঁয়াতেই কাঁপনটা স্পষ্ট টের পেল। ভূমিকম্প হলে যেমন কাঁপে প্রায় সেরকম। একবার ভাবল ইন্টারকমে ধর্মাত্মাকে জানাবে। পরক্ষণেই কী হচ্ছে জানতে নিজেই বিজ্ঞানালয়ের বাইরে বেরিয়ে এলো। তখনই বুঝল কারণটা। সামনের বিশাল পাহাড়টা আড়াআড়ি দুভাগ হয়ে যাচ্ছে! সাইদুল ভয়ে-বিস্ময়ে নড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলল। ওর বিস্ফারিত চোখের সামনে দিয়ে আজদাহা সাপের মতো ফাটলটা এগিয়ে আসছে ওরই দিকে। মহাপ্রলয়?!

জহিরুল ইসলাম নাদিম


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ অতিথি মন্তব্যকারীকে!

অতিথি লেখক এর ছবি

আগ্রহ নিয়ে পড়ছিলাম। শেষটা জমল না।

অমিত্রাক্ষর
অমিত্রাক্ষর@জিমেইল ডট কম

অতিথি লেখক এর ছবি

দুঃখিত, জমাতে না পারার জন্য।

ওডিন এর ছবি

ভালো লাগলো। হাসি

আর্থার সি ক্লার্কের 'নাইন বিলিয়ন নেমস অফ গড' এর সাথে প্লটের বেশ অনেকখানি মিল আছে অবশ্য। এইটা কি ইচ্ছাকৃত?

______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না

শামীম এর ছবি

ধপাস করে পড়ে যাওয়ার মত খুব অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি!
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

সজল এর ছবি

প্যালিনড্রোম বানানোর সোজা বুদ্ধি দেই চোখ টিপি । ইচ্ছা মত একটা বড়সংখ্যা লিখুন, তারপর তার শেষ থেকে সংখ্যাটাকে উলটো করে লিখুন। কথা হচ্ছে, সবচেয়ে বড় প্যালিনড্রোম সংখ্যা বলে কি কিছু আছে? প্রাইম নাম্বারের ক্ষেত্রে যেমন যতবড়ো প্রাইমই পাওয়া যাকনা কেন, তারচেয়ে বড় একটা প্রাইম পাওয়া সম্ভব, তেমনি ভাবে প্যালিনড্রোমের ক্ষেত্রে ও সম্ভব। [আমার উপরে বলা বুদ্ধি মত বানিয়ে দেখুন খাইছে ]

নাম্বার নিয়ে গল্প ভালো লাগলো, তবে নাম্বারের প্রব্লেম টা আরেকটু স্পেসিফাইড হলে, বা আরো মজার হলে ভালো লাগত।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই শামীম
আপনি যদি এই গল্প পড়ে ধপাস করে পড়ে যান, তাহলে দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, আর্থার সি ক্লার্কের "ঈশ্বরের ন' লক্ষ কোটি নাম" গল্প পড়ে আপনি চোখ উলটে মূর্ছা যাবেন।
এইখানে পুরো গল্পটি পাবেন।
http://livearchive.org/2010/pdf/arthur-c-clarke-the-nine-billion-names-of-god/

গল্পটার বিষয়বস্তু যে শুধু নকল তাই নয়, ফরমেটিংও এক।
ক্লার্ক এমনিতেই জনপ্রিয়, তার উপর সত্যজিৎ রায়ের অনুবাদের কল্যাণে এই গল্প সব বাঙালি পাঠকের কাছে পরিচিত, এই তথ্য জেনেও নাদিম সাহেব এমন কাঁচা একটা কাজ কেন করতে গেলেন?

সাত্যকি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে আমার এই অনিচ্ছাকৃত ভুলটি ধরিয়ে দেয়ার জন্য। আসলে মূল গল্পটি বা তার অনুবাদ আমি এর আগে দেখিনি তাই পড়ার প্রশ্নই আসে না। অনেক বছর আগে এক আড্ডায় থিমটা শুনেছিলাম কারো কাছে। তারপর ব্যাপারটি আর মনে ছিল না। সম্প্রতি সচলায়তনের জন্য একটা গল্প লিখতে গিয়ে সেটা মনে এলো। প্যালিন্ড্রম নিয়ে আমার লেখা আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। সেটা আনলাম। ধর্মাত্নার চরিত্র সহ সকল চরিত্র ও কাহিনী আমিই লিখলাম। শুধু ধর্মীয় একটা গোষ্ঠীর ঈশ্বরের নাম বের করার চেষ্টা করছে এই আইডিয়াটাই মাথায় ছিল। ব্যাপারটা নকল করছি এমন কোনো চিন্তা বা উদ্দেশ্য ছিল না। সুপার কম্পিউটার সংক্রান্ত তথ্য বের কলাম উইকিপিডিয়া ঘেঁটে। কিন্তু এখন দেখছি প্রায় মিলে যাচ্ছে । আমি নিজেও বিষ্মিত ও লজ্জিত যদিও সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত। আশা করছি এই বিষয় নিয়ে আলোচনা এখানেই শেষ হবে। আমি মডারেটরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি তারা যেন পোষ্টটি সরিয়ে নেন। ধন্যবাদ।

জহিরুল ইসলাম নাদিম

পাগল মন এর ছবি

ভালোই চলছিল, শেষে এসে একটু কেঁচে গেল মনে হয়।
তবে সাত্যকি ভাইয়ের দাবী সত্যি হলে খুব খারাপ ব্যাপার হবে সেটা।
_________________________________________________
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

শান্ত [অতিথি] এর ছবি

প্রথম থেকে ভালোই চলছিল, শেষদিক ঠিক জমলো না।

তারাপ কোয়াস এর ছবি

সাত্যকির দেয়া লিংক থেকে মূল গল্পটা পড়ার পর এই গল্পটা পড়লাম। সাত্যকির বক্তব্য ১১০০১০০ ভাগ সত্য।

ট্যাগে ভাবানুবাদ তথ্যটি দেয়া উচিত ছিলো।


আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা


love the life you live. live the life you love.

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব বেশী প্রশংশা করা গেল না! আর্থার সি ক্লার্কের 'নাইন বিলিয়ন নেমস অফ গড'(সত্যজিৎ রায়ের অনুবাদ "ঈশ্বরের ন' লক্ষ কোটি নাম") এর সাথে মিলটা খুব বেশী! আর শেষটার সাথে ডঃ জাফর ইকবালের "প্রোগ্রামার" গল্পের দূর্বল মিল!

চেষ্টা করলে গল্পটা খুব জমতো, কিন্তু সেটা হলো না!

--- থাবা বাবা!

মূলত পাঠক এর ছবি

এটি যে অনুবাদ সে দু লাইন পড়েই মনে হয়েছিলো। সত্যজিত রায়ের "ব্রেজিলের কালো বাঘ" বইতে আছে, অনুবাদের নাম বোধ হয় "ঈশ্বরের নয় লক্ষ কি তের কোটি (বা ঐ রকম একটা সংখ্যা) নাম"। মন্তব্য পড়তে গিয়ে বুঝলাম লেখায় কোথাও 'অনুবাদ' কথাটা নেই!

অতিথি লেখক এর ছবি

আগ্রহ নিয়ে পড়ছিলাম। শেষটা জমল না।

চীপ ফ্যান্টাসি।

গুরু ভাই

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।